বছর ঘুরে আবার ফিরে এসেছে পবিত্র ঈদুল আযহা , সেই মহান উৎসব যখন মুসলিম উম্মাহ একযোগে আল্লাহর প্রতি ত্যাগ ও আনুগত্যের অমোঘ বার্তা প্রেরণ করে। এটি শুধু আনন্দ ও উৎসবের পর্ব নয়, বরং মহান নবী ইবরাহিম (আঃ)-এর জীবনের এক অসামান্য ইতিহাসের স্মৃতিচিহ্ন। যিনি তাঁর প্রিয় পুত্রকে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য উৎসর্গ করতে প্রস্তুত ছিলেন, মানবতার প্রতি এক অসাধারণ ত্যাগ ও ভক্তির প্রতীক হিসেবে। ঈদুল আযহার পবিত্রতা আজও মুসলিম সমাজের হৃদয়ে ভ্রাতৃত্ব, সহানুভূতি এবং পরোপকারের মূল্যবোধ জাগ্রত করে।
দেশের নানা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও এই পবিত্র উপলক্ষে শুধু ধর্মীয় দায়িত্ব পালনেই সীমাবদ্ধ থাকেন না, বরং তারা ত্যাগ ও মানবিকতার গভীর তাৎপর্য অনুধাবন করে, যা তাদের ব্যক্তিত্বে ও সামাজিক জীবনে দায়িত্বশীলতার প্রকাশ ঘটায়।বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যস্ত সময়ের মাঝেও ঈদের ছুটি শিক্ষার্থীদের জীবনে এনে দেয় এক অবিচ্ছেদ্য বিশ্রতির সুর। পড়াশোনা, ক্লাসের চাপ আর সময়সীমার টানাপোড়েন থেকে কিছুক্ষণ মুক্ত হয়ে তারা ফিরে যায় নিজেদের পরিবারে। দীর্ঘ যাত্রাপথ পেরিয়ে, নানা কষ্টের পর বাড়ির দোরগোড়ায় পৌঁছানোর সেই অনুভূতি আলাদা এক প্রশান্তি দেয়। পরিবারের সঙ্গে কেমন সময় কাটছে এবং কোরবানির মাহাত্ম্য ও যথার্থতা উপলব্ধি নিয়েই মনের ভাব প্রকাশ করছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যায়নরত শিক্ষার্থীরা।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিএসসি ডিসিপ্লিন এর শিক্ষার্থী,ফাইয়াজ জসিম ফয়সাল জানান-কোরবানি ঈদ আমাদের জীবনে এক বিশেষ উৎসব, যা আল্লাহর প্রতি আমাদের বিশ্বাস ও ত্যাগের শিক্ষা দেয়। এই দিনে আমরা শিখি কীভাবে অন্যদের সাহায্য করতে হয়, বিশেষ করে দরিদ্র ও অসহায়দের। কোরবানির মাধ্যমে আমরা আমাদের সম্পদ ভাগ করে সমাজে ভালোবাসা ও সহযোগিতা ছড়িয়ে দিতে পারি। এটি শুধু ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, বরং আমাদের মনের অহংকার কমিয়ে মানুষের মাঝে একতা গড়ে তোলার একটি মাধ্যম। আমি বিশ্বাস করি, আমাদের সকলের উচিত এই মহৎ শিক্ষা থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে সদয় ও দায়িত্বশীল হওয়া। খুবির শিক্ষার্থী হিসেবে আমি গর্বিত যে আমরা এমন একটি ঐতিহ্যের অংশ।
হাবিপ্রবি শিক্ষার্থী( ফুড এন্ড প্রসেসিং ইঞ্জিনিয়ারিং) আসাদুজ্জামান সাগর মনে করেন- ঈদুল আযহা হলো ত্যাগের উৎসব, যা মুসলমানদের অন্যতম বড় ধর্মীয় পর্ব। এই দিনে ফজরের নামাজের পর ঈদগাহে গিয়ে ঈদুল আযহার নামাজ আদায় করা হয় এবং সামর্থ্য অনুযায়ী গরু, ছাগল, ভেড়া ইত্যাদি পশু কোরবানি করা হয় আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। ঈদুল আযহার মূল শিক্ষা হলো আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠ আনুগত্য ও নিজের অহংকার ত্যাগ করা, যেমন ইবরাহীম (আঃ) তাঁর প্রিয় পুত্রকে আল্লাহর আদেশে কুরবানী করেছিলেন। এটি শুধু পশু কোরবানি নয়, বরং মানুষের অন্তরের কুপ্রবৃত্তিরও ত্যাগের প্রতীক। ঈদুল আযহার আনন্দে পরিবার-পরিজন একত্রিত হয়ে উৎসব পালন করে, নতুন পোশাক পরিধান ও বিশেষ খাদ্য পরিবেশন করে। এই উৎসব মুসলমানদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব ও সহমর্মিতার বার্তা বহন করে।
ঈদুল আযহা মূলত ত্যাগ ও কুরবানীর প্রতীক। এর পিছনে রয়েছে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর কাহিনী – যিনি আল্লাহর আদেশ পালনের জন্য প্রাণপ্রিয় পূত্র ইসমাইল (আঃ) কে কুরবানী দিতে রাজী হয়ে গিয়েছিলেন আল্লাহ তাঁর এই আনুগত্য দেখে ইসমাইল (আঃ) এর পরিবর্তে একটি পশু কোরবানি দেয়ার আদেশ দেন। ঈদুল আযহা মুসলমানদের আত্মত্যাগ, আল্লাহর প্রতি সম্পূর্ণ আনুগত্য এবং মানবিক মূল্যবোধের প্রতীক। এটি সমাজে সহানুভূতি, সহানুজ্ঞান ও ঐক্যের বার্তা দেয়। এমন ধারণা পোষণ করেন -মালিহা ফাহমিদা, ফাইন্যান্স এন্ড ব্যাংকিং, বেরোবির একজন শিক্ষার্থী।
অপরদিকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল এর সিভিল ইঞ্জিনিয়ার ডিপার্টমেন্টের শিক্ষার্থী সাব্বির রহমানের মতে,বাংলাদেশের যেমন অনেক ধর্মের মানুষ রয়েছে, তেমনি রয়েছে অনেক উৎসব। তবে মুসলমানদের জন্যও রয়েছে বছরে ২টি উৎসব। এর মধ্যে ঈদুল আজহা হল মুসলমানদের জন্য একটি অন্যতম প্রধান উৎসব। এটি জিলহজ্জ মাসের ১০ তারিখে পালন করা হয়। ঐতিহাসিকভাবে দেখতে গেলে, এই উৎসবের পেছনে রয়েছে হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর আত্মত্যাগের ঘটনা। আর তাই এই ঈদটি হযরত ইব্রাহিম (আ.) আল্লাহর আদেশে তাঁর পুত্র ইসমাইল (আ.)কে কোরবানির করার প্রস্তুতির স্মরণে পালন করা হয়।কোরবানি হলো আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা, আনুগত্য ও ত্যাগের প্রতীক। আর এই ত্যাগ অর্থাৎ ঈদুল আজহার মাধ্যমে যা শিখি তা হলো যে প্রকৃত মুসলিম হতে হলে নিজেই প্রিয় জিনিসও আল্লাহর রাস্তায় ত্যাগ করতে হবে। কারণ এর মাধ্যমে আমরা আত্মত্যাগ ও পরোপকারিতার ধারণা পেতে পারি। কোরবানির পশুর গোশত গরীবদের মাঝে ভাগ করে দেওয়া হয়। এতে সমাজের সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব বৃদ্ধি পায়।
ঈদুল আযহা সম্পর্কে বুয়েট সিএসসি ডিপার্টমেন্টে অধ্যায়নরত শিক্ষার্থী রায়হানুল কবীর জানান, একজন ছাত্র হিসেবে ঈদুল আজহা আমার কাছে শুধু একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, বরং ত্যাগ, আত্মসমর্পণ এবং মানবতার শিক্ষা দেয় এমন একটি বিশেষ দিন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে পড়াশোনার চাপ অনেক বেশি, কিন্তু ঈদের এই দিনে আমি শিখি যে কিভাবে কঠিন সময়েও ধৈর্য ধরে ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। ঈদুল আজহার কোরবানি ও ভ্রাতৃত্বের বার্তা আমাকে অনুপ্রেরণা দেয় যেন আমি আমার পড়াশোনায় আরও মনোযোগী ও সহানুভূতিশীল হতে পারি। গরিব ও দুর্বলদের পাশে দাঁড়ানোর শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার মধ্যেও প্রতিফলিত হয়। তাই ঈদুল আজহার মূল্যবোধ আমার ব্যক্তিগত ও শিক্ষাজীবনে শক্তিশালী গাইড হিসেবে কাজ করে।
ঈদুল আজহা মুসলিম উম্মাহর অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব। এই দিনটি কোরবানি ও ত্যাগের প্রতীক হিসেবে পালিত হয়। হযরত ইব্রাহিম (আ.) আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তার প্রিয় সন্তান কোরবানি দিতে চেয়েছিলেন — সেই স্মৃতিকে কেন্দ্র করেই ঈদুল আজহা উদযাপিত হয়। এদিন মুসলমানরা আল্লাহর রাহে পশু কোরবানি করে এবং গরিব-দুঃখীর মাঝে তা বণ্টন করেন। ঈদের এই আনন্দ সবার মাঝে ভ্রাতৃত্ব ও সহানুভূতির বার্তা ছড়িয়ে দেয়- এমনটাই মনে করেন রুয়েটে আইপিই ডিপার্টমেন্টে অধ্যায়নরত মাকরুহা তাসনিম তরী।
সবশেষে বলা যায়, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ঈদুল আযহার অর্থ ও তাৎপর্যকে শুধু ঐতিহ্যের ছাপ হিসেবে নয়, বরং একটি জীবনদর্শনের সূচনা হিসেবে দেখছেন। তারা মনে করেন, এই উৎসবের মাধ্যমে যে আত্মত্যাগের শিক্ষা পাওয়া যায় তা তাদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় শক্তি যোগায়। ঈদের দিন তারা কেবল কোরবানির পশু জবাই করে না, বরং মানবিকতার মূল্যবোধ ও ভ্রাতৃত্ববোধের বার্তাও জীবনে বাস্তবায়নের সংকল্প গ্রহণ করে। তাদের মতে, ঈদুল আযহা হলো সেই বিশেষ সময় যখন আমরা নিজেকে নতুনভাবে সজীব এবং সমাজের প্রতি দায়িত্বশীল হিসেবে অনুভব করি। এই দৃষ্টিভঙ্গি ঈদের উৎসবকে শিক্ষার্থীদের জন্য কেবল ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, বরং ব্যক্তিত্ব গঠনের এক অনন্য মঞ্চে পরিণত করেছে।