ঢাকা ০৭:৩৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৭ জানুয়ারী ২০২৫, ১৪ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::
পাঁচবিবিতে শীতবস্ত্র বিতরণ লালমনিরহাটের কৃষকেরা তামাক চাষে ঝুঁকছেন বগুড়ায় ধর্ষন মামলার যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ড ও অর্থদন্ড প্রাপ্ত ওয়ারেন্টভুক্ত আসামী দীর্ঘ ২০ বছর পর গ্রেফতার বকশীগঞ্জে আইনশৃঙ্খলা ও চোরাচালান প্রতিরোধ কমিটির মাসিক সভা অনুষ্ঠিত কমলনগরে হাজিরহাট হামিদিয়া কামিল মাদ্রাসার বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণ শায়েস্তাগঞ্জ ইউ এন ও অফিসিয়াল নম্বর হ্যাক করে টাকা চাইলো প্রতারক চক্র অনুষ্ঠিত হলো  উত্তর তারাবুনিয়া মহিসুন্নাহ ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসা পিঠা উৎসব ২০২৫ সুবিধাবঞ্চিত শিশু ও এতিমদের নিয়ে কক্সবাজার ভ্রমন করল দূর্বার তারুণ্য ফাউন্ডেশন আজ পবিত্র শবে মেরাজ মরহুম আব্দুল লতিফ তালুকদার মেমোরিয়াল টি-১৬ ক্রিকেট টুর্নামেন্টের শুভ উদ্বোধন

সাংবিধানিক মতে ইউনূস সরকার কি বৈধ?

বহু আগেই ৯০ দিন শেষ। সংবিধান অনুযায়ী সংসদ ভেঙে দেওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন হতেই হবে। সেই হিসাবে গত ৫ নভেম্বরের মধ্যে নির্বাচন দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের সরে দাঁড়ানোর কথা। দৈব দুর্বিপাকে আরও ৯০ দিন সময় নেওয়া যায়। কিন্তু এমন কিছু ঘটেনি আর সরকার কোনো ব্যাখ্যাও দেয়নি, সুপ্রিম কোর্টের রেফারেন্সও নেয়নি। মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকার শুরু থেকেই সাংবিধানিক বৈধতার প্রশ্নে ঝুঁকির মুখে রয়েছে। সংবিধানে অন্তর্বর্তী সরকার বলতে কিছু উল্লেখ না থাকলেও আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধান শেখ হাসিনা ভারতে চলে যাওয়ার পর শূন্যতার মধ্যে ৮ আগস্ট ইউনূসের নেতৃত্বে সরকার শপথ গ্রহণ করে। তার আগে সুপ্রিম কোর্টের রেফারেন্স নেওয়ার কথা বলা হয়। সে সময় প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনার পদত্যাগের কথাও বলা হয়, যার সত্যতা পরে পাওয়া যায়নি। আর সুপ্রিম কোর্টের রেফারেন্স বলে একটি নথি সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশ করা হলেও তাতে সে সময়ের প্রধান বিচারপতি বা আপিল বিভাগের বিচারপতিদের কোনো সই ছিল না। ডকট্রিন অব নেসেসিটির বিষয়টি ধরে নিয়ে যদি সেই রেফারেন্সকে সত্য বলেও মেনে নেওয়া হয়, তার পরেও ইউনূস সরকার সংবিধান অনুযায়ী এখন বৈধ কি না, সেই প্রশ্ন রয়েই যায়। এর কারণ হল, যেভাবেই হোক রাষ্ট্রপতি সংসদ ভেঙে দিয়েছেন ৬ আগস্ট। সেই সংবিধান এখনও বহাল আছে। আর সংবিধানে সংসদ ভেঙে দেওয়ার পর সরকার কত দিন দায়িত্ব পালন করবে, তার মেয়াদ সুনির্দিষ্ট। সংবিধানের ১২৩ এর ৩ এর সুস্পষ্ট করেই সংসদ ভেঙে দেওয়ার পর যে সরকার আসবে, তার মেয়াদের বিষয়ে ইঙ্গিত রয়েছে। এতে বলা আছে, ‘মেয়াদ-অবসানের কারণে সংসদ ভাংগিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাংগিয়া যাইবার পূর্ববর্তী নব্বই দিনের মধ্যে; এবং ‘মেয়াদ-অবসান ব্যতীত অন্য কোনো কারণে সংসদ ভাংগিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাংগিয়া যাইবার পরবর্তী নব্বই দিনের মধ্যে’ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে। এই হিসাবে ৬ নভেম্বরের মধ্যে নির্বাচন দিয়ে ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারকে কেটে পড়ার কথা ছিল। কিন্তু উপদেষ্টারা শপথ গ্রহণের দিন থেকে সরকারের মেয়াদ আর নির্বাচন প্রশ্নে কোনো কথার জবাবই দেননি। অবশ্য সংবিধানের একই অনুচ্ছেদে এও বলা আছে যে, ‘তবে শর্ত থাকে যে, যদি প্রধান নির্বাচন কমিশনারের মতে, কোন দৈব-দূর্বিপাকের কারণে এই দফার নির্ধারিত মেয়াদের মধ্যে উক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব না হয়, তাহা হইলে উক্ত মেয়াদের শেষ দিনের পরবর্তী নব্বই দিনের মধ্যে উক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে।’ দৈব দূর্বিপাকের কারণে নির্বাচন করা যায়নি, এমন কোনো কথাও বলা হয়নি। আর সেই ব্যাখ্যাও সরকারের তরফে আসেনি। তার পরেও যদি বিষয়টি মেনে নেওয়া হয়, তাহলে সংবিধান অনুযায়ী ৪ ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতেই হবে। কিন্তু সরকারের পঞ্চম মাসে এসে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস একটি বিদেশি সংবাদ মাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে চলতি বছরের ডিসেম্বর বা ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে নির্বাচনের পরিকল্পনার কথা বলেছেন। কিন্তু কোন আইনি ক্ষমতাবলে এতদিন তিনি সরকারে থাকবেন, সেই ব্যাখ্যা দেননি। আগের অন্তর্বতী সরকারগুলোর কথা গণ আন্দোলনের মুখে এর আগে নির্বাচিত সরকারের পতন হয়েছে দুটি। এর মধ্যে জাতীয় পার্টির হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ছিলেন রাষ্ট্রপতি। তিনি পদত্যাগ করার পর রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতৈক্যের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি হন সে সময়ের প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদ। তিনি রাজি হয়েছিলেন এই শর্তে যে, নির্বাচন করে দিয়ে তিনি আবার পদে ফিরে যাবেন। ১৯৯১ সালের পঞ্চম সংসদ নির্বাচনের পর সাহাবুদ্দিনের এই রাষ্ট্রপতি হওয়া এবং আবার প্রধান বিচারপতির পদে ফিরে যাওয়ার বৈধতা দিতে সংবিধান সংশোধন করতে হয়েছিল। অন্তর্বর্তী সেই সরকারের আইনি বৈধতাও দিতে হয়েছিল। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আন্দোলনের মুখে বিএনপি সরকারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া সংসদ ভেঙে দিয়ে পদত্যাগ করেন। আগে সে সময়ের বিরোধী দলের দাবি মেনে নিয়ে তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে প্রবর্তন করেন, ক্ষমতা সেই সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হাবিবুর রহমানের হাতেই দেন। সেই সরকার নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্বাচন করে এবং নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে শেখ হাসিনার হাতে ক্ষমতা অর্পণ করা হয়। ২০০৬ সালে আওয়ামী লীগের আন্দোলনের মুখে খালেদা জিয়া মেয়াদ শেষ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদের হাতে দেন। ইয়াজউদ্দিন আহমেদ একই সময়ে রাষ্ট্রপতি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে নির্বাচন আয়োজনের চেষ্টা করেন। ভোটের তারিখ ঘোষিত হয় ২২ জানুয়ারি। ১১ জানুয়ারি হস্তক্ষেপ করে সেনাবাহিনী। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার পদ ছেড়ে দিয়ে রাষ্ট্রপতি হিসেবে জরুরি অবস্থা জারি করেন তিনি। সেই জরুরি অবস্থা থাকার কারণেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সর্বোচ্চ ৯০ দিনের মেয়াদ প্রায় দুই বছর টেনে নেওয়া গেছে। কিন্তু এবার সংবিধান স্থগিত করা হয়নি। সংবিধান বহাল থাকা অবস্থায় ইউনূস সরকারের নির্বাচন প্রশ্নে সংবিধানের বিধানের বাইরে যাওয়ার বিষয়ে সংবাদ মাধ্যমের তরফেও কোনো প্রশ্ন তোলা হচ্ছে না বা যাচ্ছে না। সংসদ ভেঙে দেওয়ার আদেশ কি বৈধ? এটিও একটি গুরুতর সাংবিধানিক প্রশ্ন। সংবিধানের ৪৮ (৩) অনুচ্ছেদ অনুসারে কেবল প্রধানমন্ত্রী ও ৯৫ অনুচ্ছেদের (১) দফা অনুসারে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত রাষ্টপতি তাঁহার অন্য সকল দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করবেন। আবার ৫৭ (২) অনুচ্ছেদে বলা আছে, সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থন হারালে প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করবেন বা সংসদ ভেঙে দিতে লিখিতভাবে রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ দেবেন। এই অনুচ্ছেদের নির্যাস অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি তখনই সংসদ ভেঙে দেবেন, যখন তিনি নিশ্চিত হবেন যে প্রধানমন্ত্রীর উত্তরসূরি এই সংসদ নির্বাচন করতে পারবে না। অর্থাৎ রাষ্ট্রপতি নিজ ইচ্ছায় সংসদ ভেঙে দেওয়ার ক্ষমতাপ্রাপ্ত নন। কিন্তু গত ৫ আগস্ট প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানই সংবাদ মাধ্যমের সামনে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনার পদত্যাগের কথা বলেন। তার দাবি, ভারতে যাওয়ার আগে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন। সেই রাতেই তিন বাহিনীর প্রধান পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন জাতির উদ্দেশে যে ভাষণ দেন, সেখানেও তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের বিষয়টি নিশ্চিত করেন। কিন্তু পরে রাষ্ট্রপতিই একটি সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, তিনি পদত্যাগপত্র পাননি। আর শেখ হাসিনার যেসব টেলিফোনালাপ ফাঁস হয়েছে, তাতেও তিনি পদত্যাগ না করার কথাই বলেছেন। তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ও একই কথা বলেছেন। শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেননি মানে হলো তিনি সংসদ ভেঙে দেওয়ার পরামর্শও দেননি। সংবিধান অনুযায়ী এই পরামর্শ হতে হবে লিখিত। রাষ্ট্রপতিকে চাপ দিয়ে সেই কাজ করিয়ে নেওয়া হলেও ভবিষ্যতে এই সাংবিধানিক প্রশ্নে জবাবদিহি করতেই হবে। মৃত্যুদণ্ডের ঝুঁকি? আন্দোলনের মুখে যদি সরকার ব্যবস্থা একেবারেই অচল হয়ে যায় তাহলে অসাংবিধানিক কোনো শাসন চেপে বসতে পারেই। কিন্তু সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী অনুযায়ী সেটি যারা এই পথে আগাবে, তাদেরকে মৃত্যুদণ্ডের ঝুঁকি নিয়েই আগাতে হবে। এমন কোনো সরকার আসতে হলে সংবিধান স্থগিত বা রদ করতে হবে। তবে পরের কোনো সরকার যখন ক্ষমতায় আসবে, তখন তারা সংবিধানের বিধান বলে ব্যবস্থা নিতে পারবে। অনুচ্ছেদ ৭ এর ক। (১) তে বলা আছে, কোনো ব্যক্তি শক্তি প্রদর্শন বা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বা অন্য কোন অসাংবিধানিক পন্থায় – (ক) এই সংবিধান বা ইহার কোনো অনুচ্ছেদ রদ, রহিত বা বাতিল বা স্থগিত করলে বা করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করলে বা (খ) এই সংবিধান বা তার কোনো বিধানের প্রতি নাগরিকের আস্থা, বিশ্বাস বা প্রত্যয় পরাহত করলে বা তা করাবার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করলে- তার এই কার্য রাষ্ট্রদ্রোহিতা হইবে এবং ওই ব্যক্তি রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে দোষী হবে। উপ-অনুচ্ছেদ ২ অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি (১) দফায় বর্ণিত- কোনো কাজ করতে সহযোগিতা বা উসকানি দিলে বা কাজ অনুমোদন, মার্জনা, সমর্থন বা অনুসমর্থন করলেও তা একই অপরাধ হইবে। এই অনুচ্ছেদে বর্ণিত অপরাধে দোষী ব্যক্তি প্রচলিত আইনে অন্যান্য অপরাধের জন্য নির্ধারিত দণ্ডের মধ্যে সর্বোচ্চ দণ্ডে দণ্ডিত হইবে। বাংলাদেশে সর্বোচ্চ দণ্ড মৃত্যুদণ্ড। অবশ্য ইউনূস সরকার সংবিধান সংশোধন বিষয়ক যে কমিশন গঠন করেছে তার প্রধান বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ জনের একটি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সংবিধানের এই বিধানটি অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে বলে সরকারের পক্ষের আইনজীবীরা দাবি করেছেন। তবে পূর্ণাঙ্গ রায় এখনও প্রকাশ হয়নি। ফলে এই বিষয়ে এখনও পরিষ্কার ধারণা করা সম্ভব নয়।

Tag :

আপনার মতামত লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল ও অন্যান্য তথ্য সঞ্চয় করে রাখুন

জনপ্রিয় সংবাদ

পাঁচবিবিতে শীতবস্ত্র বিতরণ

সাংবিধানিক মতে ইউনূস সরকার কি বৈধ?

আপডেট সময় ০৪:৫৫:৩০ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৬ জানুয়ারী ২০২৫

বহু আগেই ৯০ দিন শেষ। সংবিধান অনুযায়ী সংসদ ভেঙে দেওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন হতেই হবে। সেই হিসাবে গত ৫ নভেম্বরের মধ্যে নির্বাচন দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের সরে দাঁড়ানোর কথা। দৈব দুর্বিপাকে আরও ৯০ দিন সময় নেওয়া যায়। কিন্তু এমন কিছু ঘটেনি আর সরকার কোনো ব্যাখ্যাও দেয়নি, সুপ্রিম কোর্টের রেফারেন্সও নেয়নি। মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকার শুরু থেকেই সাংবিধানিক বৈধতার প্রশ্নে ঝুঁকির মুখে রয়েছে। সংবিধানে অন্তর্বর্তী সরকার বলতে কিছু উল্লেখ না থাকলেও আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধান শেখ হাসিনা ভারতে চলে যাওয়ার পর শূন্যতার মধ্যে ৮ আগস্ট ইউনূসের নেতৃত্বে সরকার শপথ গ্রহণ করে। তার আগে সুপ্রিম কোর্টের রেফারেন্স নেওয়ার কথা বলা হয়। সে সময় প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনার পদত্যাগের কথাও বলা হয়, যার সত্যতা পরে পাওয়া যায়নি। আর সুপ্রিম কোর্টের রেফারেন্স বলে একটি নথি সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশ করা হলেও তাতে সে সময়ের প্রধান বিচারপতি বা আপিল বিভাগের বিচারপতিদের কোনো সই ছিল না। ডকট্রিন অব নেসেসিটির বিষয়টি ধরে নিয়ে যদি সেই রেফারেন্সকে সত্য বলেও মেনে নেওয়া হয়, তার পরেও ইউনূস সরকার সংবিধান অনুযায়ী এখন বৈধ কি না, সেই প্রশ্ন রয়েই যায়। এর কারণ হল, যেভাবেই হোক রাষ্ট্রপতি সংসদ ভেঙে দিয়েছেন ৬ আগস্ট। সেই সংবিধান এখনও বহাল আছে। আর সংবিধানে সংসদ ভেঙে দেওয়ার পর সরকার কত দিন দায়িত্ব পালন করবে, তার মেয়াদ সুনির্দিষ্ট। সংবিধানের ১২৩ এর ৩ এর সুস্পষ্ট করেই সংসদ ভেঙে দেওয়ার পর যে সরকার আসবে, তার মেয়াদের বিষয়ে ইঙ্গিত রয়েছে। এতে বলা আছে, ‘মেয়াদ-অবসানের কারণে সংসদ ভাংগিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাংগিয়া যাইবার পূর্ববর্তী নব্বই দিনের মধ্যে; এবং ‘মেয়াদ-অবসান ব্যতীত অন্য কোনো কারণে সংসদ ভাংগিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাংগিয়া যাইবার পরবর্তী নব্বই দিনের মধ্যে’ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে। এই হিসাবে ৬ নভেম্বরের মধ্যে নির্বাচন দিয়ে ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারকে কেটে পড়ার কথা ছিল। কিন্তু উপদেষ্টারা শপথ গ্রহণের দিন থেকে সরকারের মেয়াদ আর নির্বাচন প্রশ্নে কোনো কথার জবাবই দেননি। অবশ্য সংবিধানের একই অনুচ্ছেদে এও বলা আছে যে, ‘তবে শর্ত থাকে যে, যদি প্রধান নির্বাচন কমিশনারের মতে, কোন দৈব-দূর্বিপাকের কারণে এই দফার নির্ধারিত মেয়াদের মধ্যে উক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব না হয়, তাহা হইলে উক্ত মেয়াদের শেষ দিনের পরবর্তী নব্বই দিনের মধ্যে উক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে।’ দৈব দূর্বিপাকের কারণে নির্বাচন করা যায়নি, এমন কোনো কথাও বলা হয়নি। আর সেই ব্যাখ্যাও সরকারের তরফে আসেনি। তার পরেও যদি বিষয়টি মেনে নেওয়া হয়, তাহলে সংবিধান অনুযায়ী ৪ ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতেই হবে। কিন্তু সরকারের পঞ্চম মাসে এসে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস একটি বিদেশি সংবাদ মাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে চলতি বছরের ডিসেম্বর বা ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে নির্বাচনের পরিকল্পনার কথা বলেছেন। কিন্তু কোন আইনি ক্ষমতাবলে এতদিন তিনি সরকারে থাকবেন, সেই ব্যাখ্যা দেননি। আগের অন্তর্বতী সরকারগুলোর কথা গণ আন্দোলনের মুখে এর আগে নির্বাচিত সরকারের পতন হয়েছে দুটি। এর মধ্যে জাতীয় পার্টির হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ছিলেন রাষ্ট্রপতি। তিনি পদত্যাগ করার পর রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতৈক্যের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি হন সে সময়ের প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদ। তিনি রাজি হয়েছিলেন এই শর্তে যে, নির্বাচন করে দিয়ে তিনি আবার পদে ফিরে যাবেন। ১৯৯১ সালের পঞ্চম সংসদ নির্বাচনের পর সাহাবুদ্দিনের এই রাষ্ট্রপতি হওয়া এবং আবার প্রধান বিচারপতির পদে ফিরে যাওয়ার বৈধতা দিতে সংবিধান সংশোধন করতে হয়েছিল। অন্তর্বর্তী সেই সরকারের আইনি বৈধতাও দিতে হয়েছিল। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আন্দোলনের মুখে বিএনপি সরকারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া সংসদ ভেঙে দিয়ে পদত্যাগ করেন। আগে সে সময়ের বিরোধী দলের দাবি মেনে নিয়ে তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে প্রবর্তন করেন, ক্ষমতা সেই সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হাবিবুর রহমানের হাতেই দেন। সেই সরকার নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্বাচন করে এবং নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে শেখ হাসিনার হাতে ক্ষমতা অর্পণ করা হয়। ২০০৬ সালে আওয়ামী লীগের আন্দোলনের মুখে খালেদা জিয়া মেয়াদ শেষ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদের হাতে দেন। ইয়াজউদ্দিন আহমেদ একই সময়ে রাষ্ট্রপতি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে নির্বাচন আয়োজনের চেষ্টা করেন। ভোটের তারিখ ঘোষিত হয় ২২ জানুয়ারি। ১১ জানুয়ারি হস্তক্ষেপ করে সেনাবাহিনী। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার পদ ছেড়ে দিয়ে রাষ্ট্রপতি হিসেবে জরুরি অবস্থা জারি করেন তিনি। সেই জরুরি অবস্থা থাকার কারণেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সর্বোচ্চ ৯০ দিনের মেয়াদ প্রায় দুই বছর টেনে নেওয়া গেছে। কিন্তু এবার সংবিধান স্থগিত করা হয়নি। সংবিধান বহাল থাকা অবস্থায় ইউনূস সরকারের নির্বাচন প্রশ্নে সংবিধানের বিধানের বাইরে যাওয়ার বিষয়ে সংবাদ মাধ্যমের তরফেও কোনো প্রশ্ন তোলা হচ্ছে না বা যাচ্ছে না। সংসদ ভেঙে দেওয়ার আদেশ কি বৈধ? এটিও একটি গুরুতর সাংবিধানিক প্রশ্ন। সংবিধানের ৪৮ (৩) অনুচ্ছেদ অনুসারে কেবল প্রধানমন্ত্রী ও ৯৫ অনুচ্ছেদের (১) দফা অনুসারে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত রাষ্টপতি তাঁহার অন্য সকল দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করবেন। আবার ৫৭ (২) অনুচ্ছেদে বলা আছে, সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থন হারালে প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করবেন বা সংসদ ভেঙে দিতে লিখিতভাবে রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ দেবেন। এই অনুচ্ছেদের নির্যাস অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি তখনই সংসদ ভেঙে দেবেন, যখন তিনি নিশ্চিত হবেন যে প্রধানমন্ত্রীর উত্তরসূরি এই সংসদ নির্বাচন করতে পারবে না। অর্থাৎ রাষ্ট্রপতি নিজ ইচ্ছায় সংসদ ভেঙে দেওয়ার ক্ষমতাপ্রাপ্ত নন। কিন্তু গত ৫ আগস্ট প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানই সংবাদ মাধ্যমের সামনে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনার পদত্যাগের কথা বলেন। তার দাবি, ভারতে যাওয়ার আগে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন। সেই রাতেই তিন বাহিনীর প্রধান পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন জাতির উদ্দেশে যে ভাষণ দেন, সেখানেও তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের বিষয়টি নিশ্চিত করেন। কিন্তু পরে রাষ্ট্রপতিই একটি সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, তিনি পদত্যাগপত্র পাননি। আর শেখ হাসিনার যেসব টেলিফোনালাপ ফাঁস হয়েছে, তাতেও তিনি পদত্যাগ না করার কথাই বলেছেন। তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ও একই কথা বলেছেন। শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেননি মানে হলো তিনি সংসদ ভেঙে দেওয়ার পরামর্শও দেননি। সংবিধান অনুযায়ী এই পরামর্শ হতে হবে লিখিত। রাষ্ট্রপতিকে চাপ দিয়ে সেই কাজ করিয়ে নেওয়া হলেও ভবিষ্যতে এই সাংবিধানিক প্রশ্নে জবাবদিহি করতেই হবে। মৃত্যুদণ্ডের ঝুঁকি? আন্দোলনের মুখে যদি সরকার ব্যবস্থা একেবারেই অচল হয়ে যায় তাহলে অসাংবিধানিক কোনো শাসন চেপে বসতে পারেই। কিন্তু সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী অনুযায়ী সেটি যারা এই পথে আগাবে, তাদেরকে মৃত্যুদণ্ডের ঝুঁকি নিয়েই আগাতে হবে। এমন কোনো সরকার আসতে হলে সংবিধান স্থগিত বা রদ করতে হবে। তবে পরের কোনো সরকার যখন ক্ষমতায় আসবে, তখন তারা সংবিধানের বিধান বলে ব্যবস্থা নিতে পারবে। অনুচ্ছেদ ৭ এর ক। (১) তে বলা আছে, কোনো ব্যক্তি শক্তি প্রদর্শন বা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বা অন্য কোন অসাংবিধানিক পন্থায় – (ক) এই সংবিধান বা ইহার কোনো অনুচ্ছেদ রদ, রহিত বা বাতিল বা স্থগিত করলে বা করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করলে বা (খ) এই সংবিধান বা তার কোনো বিধানের প্রতি নাগরিকের আস্থা, বিশ্বাস বা প্রত্যয় পরাহত করলে বা তা করাবার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করলে- তার এই কার্য রাষ্ট্রদ্রোহিতা হইবে এবং ওই ব্যক্তি রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে দোষী হবে। উপ-অনুচ্ছেদ ২ অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি (১) দফায় বর্ণিত- কোনো কাজ করতে সহযোগিতা বা উসকানি দিলে বা কাজ অনুমোদন, মার্জনা, সমর্থন বা অনুসমর্থন করলেও তা একই অপরাধ হইবে। এই অনুচ্ছেদে বর্ণিত অপরাধে দোষী ব্যক্তি প্রচলিত আইনে অন্যান্য অপরাধের জন্য নির্ধারিত দণ্ডের মধ্যে সর্বোচ্চ দণ্ডে দণ্ডিত হইবে। বাংলাদেশে সর্বোচ্চ দণ্ড মৃত্যুদণ্ড। অবশ্য ইউনূস সরকার সংবিধান সংশোধন বিষয়ক যে কমিশন গঠন করেছে তার প্রধান বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ জনের একটি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সংবিধানের এই বিধানটি অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে বলে সরকারের পক্ষের আইনজীবীরা দাবি করেছেন। তবে পূর্ণাঙ্গ রায় এখনও প্রকাশ হয়নি। ফলে এই বিষয়ে এখনও পরিষ্কার ধারণা করা সম্ভব নয়।