ঢাকা ০২:০৪ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ০৭ জানুয়ারী ২০২৫, ২৩ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::
ওমর আলীর জায়গায় ইউনাইটেডর ময়লা পানি, চলার রাস্তায় দীর্ঘ সাঁকো (প্রথম পর্ব) আগামী মাসে প্রতিষ্ঠিত হবে জুলাই গণঅভ্যুত্থান অধিদপ্তর: উপদেষ্টা নাহিদ ঐতিহাসিক সিরিজের দল ঘোষণা করেছে বিসিবি ফারুক হাসানের ওপর হামলাকারীদের জামিনের নিন্দা গণঅধিকার পরিষদের রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্য হবে অংশীদারিত্বের গণতন্ত্র: আ স ম রব খালেদা জিয়াকে বহনকারী কাতারের এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে যা আছে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় উপ-পরিচালক মারা গেছেন কলমাকান্দায় আরাফাত রহমান কোকো স্মৃতি মিনি নাইট ফুটবল টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত জেনে নিন ধনেপাতা মেশানো জলের যত গুণাগুণ ১৫ পুলিশ হত্যার পর লতিফ বিশ্বাসের বিরুদ্ধে ১১ বছর আগের ঘটনায় আরেক মামলা

প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম’র ব্যাংকে কালো টাকার পাহাড়

সিলেটে মো. রফিকুল ইসলাম নামে এলজিইডির এক উপজেলা প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়ম, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং মানহানির অভিযোগ এনে ১০ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা করেছেন একজন ঠিকাদার।
গত বুধবার সিলেট যুগ্ম জেলা জজ ১ম আদালতে এই মামলাটি করেন জৈন্তাপুরের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স শাহান এন্টারপ্রাইজের মালিক আলহাজ্ব মো. ইসমাইল আলী আশিক।
অভিযুক্ত রফিকুল ইসলাম বর্তমানে হবিগঞ্জের আজমিরিগঞ্জ উপজেলায় এলজিইডির প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত আছেন। বিগত সময়ে সিলেটের গোয়াইনঘাটে কর্মরত থাকাকালে সিটিংবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নির্মাণকাজ প্রকল্পের বিল আটকে রাখা, ঘুষ দাবি ও গহণ এবং কাজ শেষ হওয়ার পরও প্রকল্পের বিল পরিশোধ না করে ব্যাংক গ্যারান্টি নগদায়নের অপচেষ্টাসহ নানা অভিযোগে মামলাটি করা হয়েছে। মামলায় ঘুষের ৬ লক্ষ টাকা গ্রহনের অভিযোগ আনা হয় এলজিইডির প্রকৌশলী রফিকুলের বিরুদ্ধে। কাজ শেষ হওয়ার পর প্রকল্পের বিল পরিশোধ না করে ব্যাংক গ্যারান্টি নগদায়নের অপচেষ্টাও চালান তিনি। এছাড়া বিগত আওয়ামী আমলে মন্ত্রী ইমরানের ছত্রছায়ায় থেকে গোয়াইনঘাট উপজেলার তৎকালীন এই এলজিইডির প্রকৌশলীর নানা অপকর্ম ও দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরা হয় মামলায়।
মামলার অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলা এলজিইডির আওতায় উপজেলার সিটিংবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নির্মান কাজের টেন্ডার পায় মেসার্স শাহান এন্টার প্রাইজ। এক কোটি তেতাল্লিশ লক্ষ একান্ন হাজার তিনশত চুয়াত্তর টাকার এ কাজ নিয়ে উপজেলা প্রকৌশলীর সঙ্গে গত ২০২২ সালের ১৭ জানুয়ারি চুক্তি সম্পাদন হয়। বাদী প্রতিষ্ঠান পারফরম্যান্স সিকিউরিটি হিসেবে এনআরবিসি ব্যাংক বটেশ্বর শাখা কর্তৃক সাত লক্ষ আঠার হাজার টাকার ব্যাংক গ্যারান্টি প্রদান করেন।
অভিযোগে ঠিকাদার ইসমাইল আলী আশিক জানান, কাজ হাতে পেয়ে মেসার্স শাহান এন্টার প্রাইজ প্রাথমিকভাবে প্রায় ত্রিশ লক্ষ টাকার মালামাল ক্রয় করে পাইলিং ও বেইসের মাটি কাটার কাজ সম্পাদন করে। বেইজ ঢালাই কাজের প্রস্তুতি গ্রহণকালে ইতোপূর্বে সম্পাদিত কাজের বিল পরিশোধ করতে বলায় এলজিইডি প্রকৌশলী রফিকুল দশ লক্ষ টাকার ঘুষ তাবি করেন। বিভিন্ন ব্যক্তিদের মধ্যস্থতায় দুর্নীতিবাজ রফিকুল ঘুষের পরিমাণ ৬ লক্ষ টাকা ধার্য করেন। বিল না পেয়ে শ্রমিক-কর্মচারীদের পাওয়া পরিশোধ ও ক্রয়কৃত নির্মাণ সামগ্রীর মূল্য পরিশোধে বাধ্য হয়ে ব্যবসায়ী ইসমাঈল আলী আশিক ঘুষের এক লক্ষ তের হাজার টাকা নগদে পরিশোধ করেন। পরবর্তীতে দুটি চেকের মাধ্যমে আরো চার লক্ষ সাতাশি হাজার টাকা প্রকৌশলী রফিকুলের কথামতো তার হিসাব রক্ষক নাসিম শিকদারকে প্রদান করেন।
একপর্যায়ে চেকের মাধ্যমে টাকা নগদায়ন করতে না পেরে ঘুষের টাকা আদায়ে নানা অপকৌশলের আশ্রয় নেন রফিকুল। তিনি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে চাপ সৃষ্টির জন্য বারবার নোটিশ প্রদান ও ব্যাংকে গচ্ছিত গ্যারান্টির টাকা আত্মসাতের অপচেষ্ঠা করেন। নোটিশের জবারে ২০২২ ও ২০২৩ সালের বন্যায় ভারতীয় সীমান্তবর্তী গোয়াইনঘাট এলাকা প্লাবিত থাকার বিষয়টি অবহিত করেন। বিষয়টি বিবেচনা করে এলজিইডির অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (মনিটরিং) নির্মাণ কাজের মেয়াদ বৃদ্ধি করেন। উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা দ্বারা প্রকল্প কাজের মেয়াদ বৃদ্ধি হলেও মেসার্স শাহান এন্টার প্রাইজের প্রতি আক্রোশের বহিঃপ্রকাশ ঘটান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম। তিনি মেসার্স শাহান এন্টার প্রাইজের লাইসেন্স ২ বছরের জন্য স্হগিত করে দেন। ধূর্ত রফিকুল ব্যাক গ্যারান্টির ৭ লক্ষ ১৮ হাজার চাকাও ব্যাক থেকে উঠিয়ে নেন। ঘুষখোর ও দুর্নীতিবাজ এলজিইডি কর্মকর্তা কর্তৃক লাইসেন্স স্হগিত হলে নানামুখী জটিলতার মুখেমুখি হতে হয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে।
আদালতে দায়েরকৃত মামলায় এলজিইডি কনট্রাক্টার ওয়েল ফেয়ার এসোসিয়েশনের সাবেক সহ-সভাপতি ইসমাঈল আলী আশিক উপজেলার এই ঘুষখোর প্রকৌশলীর এমন অন্যায় ও অপকর্মের দ্বারা আর্থিকভাবে ও সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার বিষয় তুলে ধরেন। মামলায় অভিযোগ করে তিনি বলেন, গোয়াইনঘাটে কর্মরত থাকাকালে ঘুষখোর ও দুর্নীতিবাজ রফিকুল সিলেটের মন্ত্রী ইমরানের আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন। মন্ত্রী ইমরানের মদদপুষ্ঠ হওয়ার ফলে গোয়াইনঘাটে এলজিইডির সকল ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে জিম্মি করে ঘুষ বানিজ্যে মেতে ওঠেন প্রকৌশলী রফিকুল। ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে অবৈধভাবে অর্জিত টাকায় রাতারাতি অঢেল সম্পদের মালিক বনে গেছেন তিনি। অবৈধ টাকায় শিবগঞ্জে ফ্লাট, গ্রামের বাড়ীতে নিজ ও স্ত্রীর নামে বিপুল পরিমাণ জমি কিনেছেন ঘুষখোর রফিকুল। অসৎ এই প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্ত চলমান রয়েছে।
বাদীপক্ষ এ মামলায় তাদের প্রতিষ্ঠানের ক্ষতির জন্য ১০ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ দাবি করেছেন। এ ঘটনায় বাদীপক্ষ আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি ব্যবসায়িক সুনামহানি এবং টেন্ডারে অংশ নেয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।
এদিকে, এ মামলার পরিপ্রেক্ষিতে সিলেটের ব্যবসায়ী মহলে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। অনেকে এ ঘটনাকে প্রশাসনিক দুর্নীতি ও অপব্যবহারের বিরুদ্ধে একটি নজিরবিহীন পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন। সচেতন মহল মনে করছেন মামলাটি শুধু আর্থিক ক্ষতিপূরণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না বরং এটি প্রশাসনিক স্বচ্ছতা এবং দুর্নীতি রোধে একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে। এ ঘটনাটি প্রশাসনিক দুর্বলতা এবং প্রকল্প বাস্তবায়নে স্বচ্ছতার অভাবের বিষয়টি নতুন করে সামনে এনেছে, যা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সতর্কবার্তা হতে পারে।এদিকে গোয়াইনঘাট উপজেলা প্রকৌশলী রফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে অনিয়ম দুর্নীতি স্বেচ্ছাচারিতার অন্ত নেই। কাজ শেষ হলেও ঠিকাদারদের বিল পরিশোধে টালবাহানা, ঘুষ না দিলে বিল চেকে সাইন করেন না উপজেলা প্রকৌশলী। আবার তাকে তার চাহিদার ঘুষ দিলে অথবা তার সাথে কমিশন চুক্তি ঠিক রাখলে যেনতেনভাবে প্রকল্পের কাজ করলেও বিলের টাকাও তুলে নিতে পারেন ঠিকাদাররা। ঘুষের চুক্তি থাকলে কোন কোন প্রকল্পে নিয়ম মাফিক কাজ না করলেও তিনি কোন ব্যবস্থা নেন না। নানা অজুহাতে ঠিকাদারদের হয়রানি, ভোগান্তিতে রাখার কারণে উপজেলার প্রায় সকল ঠিকাদার তার অনিয়ম দুর্নীতির বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০২১ সালের ৭ই মার্চ গোয়াইনঘাট উপজেলা প্রকৌশলী হিসেবে যোগ দিয়েই তিনি শুরু করেন স্বেচ্ছাচারী আচরণ। বিএনপি-জামায়াতের সমর্থনকারী ঠিকাদারদের পাশাপাশি তিনি আওয়ামীপন্থি ঠিকাদারদেরও তিনি হয়রানি করতেন। নিজেকে এমপি ইমরান আহমদের কাছের লোক এমন পরিচয় দিয়ে তিনি করে আসছেন অনিয়ম, দুর্নীতি। গোয়াইনঘাট এলজিইডি অফিস সূত্রে জানা যায়, তিনি প্রতিদিন সিলেট শহরে থেকে সিএনজি ভাড়া করে উপজেলার বিভিন্ন প্রকল্প ঘুরে দেখেন। সিলেট থেকে উপজেলায় এলেও তিনি অনিয়মিত অফিস করেন। বিক্ষুব্ধ ঠিকাদারদের অনেকেই অভিযোগ করেন, প্রতিদিন ভাড়ায় চালিত একটি সিএনজি নিয়ে বিভিন্ন ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে চলমান প্রকল্প পরিদর্শনে যান প্রকৌশলী রফিকুল।
বিভিন্ন সাইটের কাজ পরিদর্শন শেষে ঠিকাদারদের কাছে সিএনজি ভাড়া বাবত ১ হাজার টাকা দাবি করেন তিনি। গোয়াইনঘাট উপজেলা প্রকৌশল কার্যালয়ের আওতাধীন সকল বাস্তবায়নের জন্য নির্মাণকাজ চলমান প্রকল্পে তিনি নিজেই ঘুরে দেখেন, জুনিয়র সহকারী প্রকৌশলীদের বিভিন্ন প্রকল্প ঘুরে দেখা ও তদারকির নিয়ম থাকলেও তিনি তা নিজের হাতে নিয়ে তার ভাগ্নে পরিচয়ে রাব্বি নামের বহিরাগত একজনকে সুপারভাইজার নিয়োগ দিয়েছেন। মাঠ ও অফিসে দুর্নীতি ও লুটপাটে তিনি রাব্বিকে দায়িত্ব দিয়েছেন বলে জানা যায়। জানা যায়, ঘুষ দুর্নীতি আর প্রকল্পের লুটপাট চালাতে তিনি বর্তমানে নির্মাণ চলমান সালুটিকর গোয়াইনঘাট সড়কের মিক্সিং প্লান্টে নিযুক্ত রেখেছেন। প্রকৌশল সংশ্লিষ্ট নয় এবং সম্পূর্ণ নন টেকনিক্যাল পার্সন রাব্বিকে দিয়ে তিনি জনগুরুত্বপূর্ণ এ সড়কের মিক্সিং প্লান্ট নিযুক্ত রেখে ওই প্রকল্পের ঠিকাদারকে অনিয়ম দুর্নীতির সুযোগ দিয়ে ঘুষ বাণিজ্য অব্যাহত রেখেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। নানা অনিয়মের কারণে ইতিপূর্বে একাধিকবার বদলির আদেশ হলেও উপর মহলের কর্তাব্যক্তিদের খুশি করে বহাল তবিয়তেই থাকছেন বিতর্কিত এই প্রকৌশলী। গোয়াইনঘাটের প্রধান সড়ক সালুটিকর গোয়াইনঘাট সড়কের নির্মাণকাজ চলমান। তোয়াকুল থেকে সালুটিকর পর্যন্ত ১০ কিলোমিটার ২৭ কোটি টাকা ব্যয়ে আরসিসি ঢালাইয়ের কাজ চলছে। উক্ত প্রকল্পের কাজে প্রকৌশলী রফিকুলের নিযুক্ত ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের সাথে আঁতাত থাকায় অত্যন্ত নিম্নমানের পাথর, বালুর ব্যবহারে তৈরি হচ্ছে সালুটিকর-গোয়াইনঘাট সড়কের নির্মাণ কাজ। সমপ্রতি সরজমিন পরিদর্শনকালে ওই সড়কের বিভিন্ন অংশে ফাটলসহ নিম্নমানের কাজের চিত্র চোখে পড়ে। গত ৬ই নভেম্বর ঢাকা থেকে প্রকল্পের পিডির নির্দেশে সরজমিন সালুটিকর গোয়াইনঘাট সড়ক নির্মাণকাজ পরিদর্শনে সিলেটের এলজিইডির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ একটি টিম আসে। তদন্তে তারা বিভিন্ন অনিয়মের পাশাপাশি দেখতে পান ডুয়েলবার রড ছাড়াই ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান নির্মাণকাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এসময় পরিদর্শনে আসা টিম উপজেলা প্রকৌশলীর দায়িত্বে অবহেলাসহ প্রকল্পের কাজে অসন্তুষ্ট হন। নিজেকে বাঁচাতে চতুর প্রকৌশলী রফিকুল ওই প্রকল্পের ঢাকার ঠিকানা বরাবরে একটি চিঠি পাঠিয়ে প্রকল্পের নির্মাণকাজের ধরা পড়া অনিয়মের ব্যাখ্যা চান।
১০ই নভেম্বর গোয়াইনঘাট উপজেলার ঠিকাদার লোকমান উদ্দিন, জিয়াউর রহমান সুজন, মো. শাহজাহানসহ বেশকজন তাদের কাজ শেষ হওয়া প্রকল্পের বিলের চেক না পেয়ে ও বিল প্রদানে উপজেলা প্রকৌশলী রফিকুল ইসলামের টালবাহানা বন্ধ ও দ্রুত তাকে গোয়াইনঘাট থেকে প্রত্যাহারে হট্টগোল শুরু করেন।

Tag :

আপনার মতামত লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল ও অন্যান্য তথ্য সঞ্চয় করে রাখুন

জনপ্রিয় সংবাদ

ওমর আলীর জায়গায় ইউনাইটেডর ময়লা পানি, চলার রাস্তায় দীর্ঘ সাঁকো (প্রথম পর্ব)

প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম’র ব্যাংকে কালো টাকার পাহাড়

আপডেট সময় ০৭:৫৭:৩৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ৪ জানুয়ারী ২০২৫

সিলেটে মো. রফিকুল ইসলাম নামে এলজিইডির এক উপজেলা প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়ম, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং মানহানির অভিযোগ এনে ১০ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা করেছেন একজন ঠিকাদার।
গত বুধবার সিলেট যুগ্ম জেলা জজ ১ম আদালতে এই মামলাটি করেন জৈন্তাপুরের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স শাহান এন্টারপ্রাইজের মালিক আলহাজ্ব মো. ইসমাইল আলী আশিক।
অভিযুক্ত রফিকুল ইসলাম বর্তমানে হবিগঞ্জের আজমিরিগঞ্জ উপজেলায় এলজিইডির প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত আছেন। বিগত সময়ে সিলেটের গোয়াইনঘাটে কর্মরত থাকাকালে সিটিংবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নির্মাণকাজ প্রকল্পের বিল আটকে রাখা, ঘুষ দাবি ও গহণ এবং কাজ শেষ হওয়ার পরও প্রকল্পের বিল পরিশোধ না করে ব্যাংক গ্যারান্টি নগদায়নের অপচেষ্টাসহ নানা অভিযোগে মামলাটি করা হয়েছে। মামলায় ঘুষের ৬ লক্ষ টাকা গ্রহনের অভিযোগ আনা হয় এলজিইডির প্রকৌশলী রফিকুলের বিরুদ্ধে। কাজ শেষ হওয়ার পর প্রকল্পের বিল পরিশোধ না করে ব্যাংক গ্যারান্টি নগদায়নের অপচেষ্টাও চালান তিনি। এছাড়া বিগত আওয়ামী আমলে মন্ত্রী ইমরানের ছত্রছায়ায় থেকে গোয়াইনঘাট উপজেলার তৎকালীন এই এলজিইডির প্রকৌশলীর নানা অপকর্ম ও দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরা হয় মামলায়।
মামলার অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলা এলজিইডির আওতায় উপজেলার সিটিংবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নির্মান কাজের টেন্ডার পায় মেসার্স শাহান এন্টার প্রাইজ। এক কোটি তেতাল্লিশ লক্ষ একান্ন হাজার তিনশত চুয়াত্তর টাকার এ কাজ নিয়ে উপজেলা প্রকৌশলীর সঙ্গে গত ২০২২ সালের ১৭ জানুয়ারি চুক্তি সম্পাদন হয়। বাদী প্রতিষ্ঠান পারফরম্যান্স সিকিউরিটি হিসেবে এনআরবিসি ব্যাংক বটেশ্বর শাখা কর্তৃক সাত লক্ষ আঠার হাজার টাকার ব্যাংক গ্যারান্টি প্রদান করেন।
অভিযোগে ঠিকাদার ইসমাইল আলী আশিক জানান, কাজ হাতে পেয়ে মেসার্স শাহান এন্টার প্রাইজ প্রাথমিকভাবে প্রায় ত্রিশ লক্ষ টাকার মালামাল ক্রয় করে পাইলিং ও বেইসের মাটি কাটার কাজ সম্পাদন করে। বেইজ ঢালাই কাজের প্রস্তুতি গ্রহণকালে ইতোপূর্বে সম্পাদিত কাজের বিল পরিশোধ করতে বলায় এলজিইডি প্রকৌশলী রফিকুল দশ লক্ষ টাকার ঘুষ তাবি করেন। বিভিন্ন ব্যক্তিদের মধ্যস্থতায় দুর্নীতিবাজ রফিকুল ঘুষের পরিমাণ ৬ লক্ষ টাকা ধার্য করেন। বিল না পেয়ে শ্রমিক-কর্মচারীদের পাওয়া পরিশোধ ও ক্রয়কৃত নির্মাণ সামগ্রীর মূল্য পরিশোধে বাধ্য হয়ে ব্যবসায়ী ইসমাঈল আলী আশিক ঘুষের এক লক্ষ তের হাজার টাকা নগদে পরিশোধ করেন। পরবর্তীতে দুটি চেকের মাধ্যমে আরো চার লক্ষ সাতাশি হাজার টাকা প্রকৌশলী রফিকুলের কথামতো তার হিসাব রক্ষক নাসিম শিকদারকে প্রদান করেন।
একপর্যায়ে চেকের মাধ্যমে টাকা নগদায়ন করতে না পেরে ঘুষের টাকা আদায়ে নানা অপকৌশলের আশ্রয় নেন রফিকুল। তিনি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে চাপ সৃষ্টির জন্য বারবার নোটিশ প্রদান ও ব্যাংকে গচ্ছিত গ্যারান্টির টাকা আত্মসাতের অপচেষ্ঠা করেন। নোটিশের জবারে ২০২২ ও ২০২৩ সালের বন্যায় ভারতীয় সীমান্তবর্তী গোয়াইনঘাট এলাকা প্লাবিত থাকার বিষয়টি অবহিত করেন। বিষয়টি বিবেচনা করে এলজিইডির অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (মনিটরিং) নির্মাণ কাজের মেয়াদ বৃদ্ধি করেন। উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা দ্বারা প্রকল্প কাজের মেয়াদ বৃদ্ধি হলেও মেসার্স শাহান এন্টার প্রাইজের প্রতি আক্রোশের বহিঃপ্রকাশ ঘটান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম। তিনি মেসার্স শাহান এন্টার প্রাইজের লাইসেন্স ২ বছরের জন্য স্হগিত করে দেন। ধূর্ত রফিকুল ব্যাক গ্যারান্টির ৭ লক্ষ ১৮ হাজার চাকাও ব্যাক থেকে উঠিয়ে নেন। ঘুষখোর ও দুর্নীতিবাজ এলজিইডি কর্মকর্তা কর্তৃক লাইসেন্স স্হগিত হলে নানামুখী জটিলতার মুখেমুখি হতে হয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে।
আদালতে দায়েরকৃত মামলায় এলজিইডি কনট্রাক্টার ওয়েল ফেয়ার এসোসিয়েশনের সাবেক সহ-সভাপতি ইসমাঈল আলী আশিক উপজেলার এই ঘুষখোর প্রকৌশলীর এমন অন্যায় ও অপকর্মের দ্বারা আর্থিকভাবে ও সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার বিষয় তুলে ধরেন। মামলায় অভিযোগ করে তিনি বলেন, গোয়াইনঘাটে কর্মরত থাকাকালে ঘুষখোর ও দুর্নীতিবাজ রফিকুল সিলেটের মন্ত্রী ইমরানের আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন। মন্ত্রী ইমরানের মদদপুষ্ঠ হওয়ার ফলে গোয়াইনঘাটে এলজিইডির সকল ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে জিম্মি করে ঘুষ বানিজ্যে মেতে ওঠেন প্রকৌশলী রফিকুল। ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে অবৈধভাবে অর্জিত টাকায় রাতারাতি অঢেল সম্পদের মালিক বনে গেছেন তিনি। অবৈধ টাকায় শিবগঞ্জে ফ্লাট, গ্রামের বাড়ীতে নিজ ও স্ত্রীর নামে বিপুল পরিমাণ জমি কিনেছেন ঘুষখোর রফিকুল। অসৎ এই প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্ত চলমান রয়েছে।
বাদীপক্ষ এ মামলায় তাদের প্রতিষ্ঠানের ক্ষতির জন্য ১০ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ দাবি করেছেন। এ ঘটনায় বাদীপক্ষ আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি ব্যবসায়িক সুনামহানি এবং টেন্ডারে অংশ নেয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।
এদিকে, এ মামলার পরিপ্রেক্ষিতে সিলেটের ব্যবসায়ী মহলে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। অনেকে এ ঘটনাকে প্রশাসনিক দুর্নীতি ও অপব্যবহারের বিরুদ্ধে একটি নজিরবিহীন পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন। সচেতন মহল মনে করছেন মামলাটি শুধু আর্থিক ক্ষতিপূরণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না বরং এটি প্রশাসনিক স্বচ্ছতা এবং দুর্নীতি রোধে একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে। এ ঘটনাটি প্রশাসনিক দুর্বলতা এবং প্রকল্প বাস্তবায়নে স্বচ্ছতার অভাবের বিষয়টি নতুন করে সামনে এনেছে, যা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সতর্কবার্তা হতে পারে।এদিকে গোয়াইনঘাট উপজেলা প্রকৌশলী রফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে অনিয়ম দুর্নীতি স্বেচ্ছাচারিতার অন্ত নেই। কাজ শেষ হলেও ঠিকাদারদের বিল পরিশোধে টালবাহানা, ঘুষ না দিলে বিল চেকে সাইন করেন না উপজেলা প্রকৌশলী। আবার তাকে তার চাহিদার ঘুষ দিলে অথবা তার সাথে কমিশন চুক্তি ঠিক রাখলে যেনতেনভাবে প্রকল্পের কাজ করলেও বিলের টাকাও তুলে নিতে পারেন ঠিকাদাররা। ঘুষের চুক্তি থাকলে কোন কোন প্রকল্পে নিয়ম মাফিক কাজ না করলেও তিনি কোন ব্যবস্থা নেন না। নানা অজুহাতে ঠিকাদারদের হয়রানি, ভোগান্তিতে রাখার কারণে উপজেলার প্রায় সকল ঠিকাদার তার অনিয়ম দুর্নীতির বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০২১ সালের ৭ই মার্চ গোয়াইনঘাট উপজেলা প্রকৌশলী হিসেবে যোগ দিয়েই তিনি শুরু করেন স্বেচ্ছাচারী আচরণ। বিএনপি-জামায়াতের সমর্থনকারী ঠিকাদারদের পাশাপাশি তিনি আওয়ামীপন্থি ঠিকাদারদেরও তিনি হয়রানি করতেন। নিজেকে এমপি ইমরান আহমদের কাছের লোক এমন পরিচয় দিয়ে তিনি করে আসছেন অনিয়ম, দুর্নীতি। গোয়াইনঘাট এলজিইডি অফিস সূত্রে জানা যায়, তিনি প্রতিদিন সিলেট শহরে থেকে সিএনজি ভাড়া করে উপজেলার বিভিন্ন প্রকল্প ঘুরে দেখেন। সিলেট থেকে উপজেলায় এলেও তিনি অনিয়মিত অফিস করেন। বিক্ষুব্ধ ঠিকাদারদের অনেকেই অভিযোগ করেন, প্রতিদিন ভাড়ায় চালিত একটি সিএনজি নিয়ে বিভিন্ন ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে চলমান প্রকল্প পরিদর্শনে যান প্রকৌশলী রফিকুল।
বিভিন্ন সাইটের কাজ পরিদর্শন শেষে ঠিকাদারদের কাছে সিএনজি ভাড়া বাবত ১ হাজার টাকা দাবি করেন তিনি। গোয়াইনঘাট উপজেলা প্রকৌশল কার্যালয়ের আওতাধীন সকল বাস্তবায়নের জন্য নির্মাণকাজ চলমান প্রকল্পে তিনি নিজেই ঘুরে দেখেন, জুনিয়র সহকারী প্রকৌশলীদের বিভিন্ন প্রকল্প ঘুরে দেখা ও তদারকির নিয়ম থাকলেও তিনি তা নিজের হাতে নিয়ে তার ভাগ্নে পরিচয়ে রাব্বি নামের বহিরাগত একজনকে সুপারভাইজার নিয়োগ দিয়েছেন। মাঠ ও অফিসে দুর্নীতি ও লুটপাটে তিনি রাব্বিকে দায়িত্ব দিয়েছেন বলে জানা যায়। জানা যায়, ঘুষ দুর্নীতি আর প্রকল্পের লুটপাট চালাতে তিনি বর্তমানে নির্মাণ চলমান সালুটিকর গোয়াইনঘাট সড়কের মিক্সিং প্লান্টে নিযুক্ত রেখেছেন। প্রকৌশল সংশ্লিষ্ট নয় এবং সম্পূর্ণ নন টেকনিক্যাল পার্সন রাব্বিকে দিয়ে তিনি জনগুরুত্বপূর্ণ এ সড়কের মিক্সিং প্লান্ট নিযুক্ত রেখে ওই প্রকল্পের ঠিকাদারকে অনিয়ম দুর্নীতির সুযোগ দিয়ে ঘুষ বাণিজ্য অব্যাহত রেখেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। নানা অনিয়মের কারণে ইতিপূর্বে একাধিকবার বদলির আদেশ হলেও উপর মহলের কর্তাব্যক্তিদের খুশি করে বহাল তবিয়তেই থাকছেন বিতর্কিত এই প্রকৌশলী। গোয়াইনঘাটের প্রধান সড়ক সালুটিকর গোয়াইনঘাট সড়কের নির্মাণকাজ চলমান। তোয়াকুল থেকে সালুটিকর পর্যন্ত ১০ কিলোমিটার ২৭ কোটি টাকা ব্যয়ে আরসিসি ঢালাইয়ের কাজ চলছে। উক্ত প্রকল্পের কাজে প্রকৌশলী রফিকুলের নিযুক্ত ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের সাথে আঁতাত থাকায় অত্যন্ত নিম্নমানের পাথর, বালুর ব্যবহারে তৈরি হচ্ছে সালুটিকর-গোয়াইনঘাট সড়কের নির্মাণ কাজ। সমপ্রতি সরজমিন পরিদর্শনকালে ওই সড়কের বিভিন্ন অংশে ফাটলসহ নিম্নমানের কাজের চিত্র চোখে পড়ে। গত ৬ই নভেম্বর ঢাকা থেকে প্রকল্পের পিডির নির্দেশে সরজমিন সালুটিকর গোয়াইনঘাট সড়ক নির্মাণকাজ পরিদর্শনে সিলেটের এলজিইডির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ একটি টিম আসে। তদন্তে তারা বিভিন্ন অনিয়মের পাশাপাশি দেখতে পান ডুয়েলবার রড ছাড়াই ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান নির্মাণকাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এসময় পরিদর্শনে আসা টিম উপজেলা প্রকৌশলীর দায়িত্বে অবহেলাসহ প্রকল্পের কাজে অসন্তুষ্ট হন। নিজেকে বাঁচাতে চতুর প্রকৌশলী রফিকুল ওই প্রকল্পের ঢাকার ঠিকানা বরাবরে একটি চিঠি পাঠিয়ে প্রকল্পের নির্মাণকাজের ধরা পড়া অনিয়মের ব্যাখ্যা চান।
১০ই নভেম্বর গোয়াইনঘাট উপজেলার ঠিকাদার লোকমান উদ্দিন, জিয়াউর রহমান সুজন, মো. শাহজাহানসহ বেশকজন তাদের কাজ শেষ হওয়া প্রকল্পের বিলের চেক না পেয়ে ও বিল প্রদানে উপজেলা প্রকৌশলী রফিকুল ইসলামের টালবাহানা বন্ধ ও দ্রুত তাকে গোয়াইনঘাট থেকে প্রত্যাহারে হট্টগোল শুরু করেন।