দেশের সাবরেজিস্টারদের বিরুদ্ধে ঘুস নেওয়ার অভিযোগ অনেক পুরনো। যারা সাবরেজিস্টারদের অফিসে যাওয়া-আসা করেন, তারা এই বিষয়ে ভালোভাবে ওয়াকিবহাল। স্থান ও জায়গা ভেদে সাবরেজিস্টারদের ঘুস কমবেশি নির্ভর করে।
কুমিল্লা জেলার তেমনি গুরুত্বপূর্ণ কর্মএলাকা হলো আদর্শ সদর সাবরেজিস্ট্রি অফিস। এটি ‘ভিআইপি সাবরেজিস্ট্রি অফিস’ হিসাবেই পরিচিত। শহরের ফৌজদারি এলাকায় অবস্থিত এর কর্ম এলাকা গোটা শহরতলিজুড়ে। এখানে প্রতিদিন কোটি টাকা থেকে শুরু করে শতকোটি টাকার দলিল সম্পাদন হয়।
এই অফিসে দলিল সম্পাদন, নকল (সার্টিফায়েড) কপি, টিপসইসহ নানা খাতে প্রতি মাসে সাবরেজিস্ট্রারকে কমপক্ষে এক কোটি টাকা ঘুস দিতে হয়। এরপরও পদে পদে হয়রানির শিকার হতে হয় বলে অভিযোগ সেবাপ্রত্যাশীদের।
এই ভিআইপি সাবরেজিস্ট্রি অফিসে যিনি কর্মরত, তার হাঁকডাকও আলাদা। সাধারণ সাবরেজিস্ট্রাররা এখানে পোস্টিং পান না। এখানে পোস্টিং পেতে হলে ‘হেডম’ লাগে। সাথে লাগে বাড়তি অঢেল টাকা-পয়সা। আর যারা এই যোগ্যতা দেখাতে পারবেন, তারাই এখানে পোস্টিং পাওয়ার সুযোগ পাবেন।
ভিআইপি সাবরেজিস্ট্রি অফিসে গত ২ বছরের বেশি সময় ধরে দায়িত্ব পালন করে আসছেন তেমনই একজন যার নাম মো. হানিফ। তিনি এই সময়ে হাতিয়ে নিয়েছেন প্রায় ২৫ কোটি টাকা। নিজস্ব অনুসন্ধান, সেবাগ্রহীতা, অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারী, দলিল লেখক, দালাল সবার সঙ্গে কথা বলে এই চিত্র পাওয়া গেছে।
সম্প্রতি চারদিকে দুর্নীতিবিরোধী খবর চাউর হচ্ছে। উত্তপ্ত হচ্ছে পরিস্থিতি। যা দেখে অনেক সরকারি কর্মকর্তা নড়েচড়ে বসছেন। সাবধানি ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছেন। এরই ধারাবাহিকতায় এই সাবরেজিস্ট্রার এখান থেকে দ্রুত বদলি হওয়ার দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন।
কুমিল্লার আদর্শ সদর সাবরেজিস্ট্রি অফিসে প্রতিদিন চলে বিশাল কর্মযজ্ঞ। এখানে ৭০ জন নকলনবিশ কাজ করছেন অবিরাম। অফিস সহকারী, অফিস সহায়ক, টিসি মোহরার ও মোহরারসহ ডজনখানেক কর্মচারী এবং পিয়ন রয়েছেন। দালাল সিন্ডিকেটের সদস্যরাও মহাব্যস্ত।
শতাধিক দলিল লেখক এবং তাদের পাঁচ শতাধিক সহকারী আরও বেশি ব্যস্ত। এই কার্যালয়ে ২০২২ সালের শুরুতে যোগদান করেন সাবরেজিস্ট্রার মো. হানিফ। যোগদানের পরপরই উত্তরসূরির পদাঙ্ক অনুসরণ করে তিনিও ঘুসের পাইপলাইনে যুক্ত হয়ে পড়েন।
অভিযোগ রয়েছে, দলিলের প্রকারভেদ এবং দলিলের মূল্যের ওপর এখানের সাবরেজিস্ট্রারকে দিতে হয় ১০ হাজার থেকে লাখ টাকা পর্যন্ত। এই উপজেলা এবং নগরীর প্রতিটি জায়গা মূল্যবান হওয়ায় পান থেকে চুন খসলেই লাখ টাকা ঘুস দিয়েও সাবরেজিস্ট্রারের মন জয় করতে কষ্ট হয়। অ্যাপার্টমেন্ট কিংবা দলিলের মূল্য কোটি টাকা ছাড়ালেই শুরু হয় ঘুসের দরকষাকষি।
সেবাগ্রহীতারা বলছেন, ছোটখাটো দলিলের সব কাগজপত্র ঠিক থাকলেও সাবরেজিস্ট্রারকে প্রতি দলিলে সেরেস্তার নামে ৩ হাজার টাকা, দলিলের টিপসই বাবদ ৫শ থেকে ১ হাজার টাকা ও প্রতিটি দলিলের নকল কপিতে (সার্টিফায়েড) স্বাক্ষর করতে দিতে হয় অতিরিক্ত এক হাজার টাকা।
সূত্র জানায়, সাবরেজিস্ট্রার এসব ঘুষের টাকা সরাসরি নিজের হাতে নেন না। নকল স্বাক্ষরের টাকা নকলনবিশদের মাধ্যমে আর টিপসইয়ের টাকা নেওয়া হয় পিয়নের মাধ্যমে। উচ্চমূল্যের দলিল এবং ছোটখাটো ত্রুটিযুক্ত দলিলের ক্ষেত্রে কন্ট্রাক্ট করার জন্য রয়েছে দালাল সিন্ডিকেট। অফিস সহকারী এবং পিয়নদের মাধ্যমে কন্ট্রাক্ট হওয়ার সিগন্যাল পেলেই দলিলে স্বাক্ষর করে দেন সাবরেজিস্ট্রার।
হিসাব করে দেখা যায়, এই সাবরেজিস্ট্রি অফিসে প্রতি মাসে গড়ে দলিল রেজিস্ট্রি হয় প্রায় ১ হাজার। দলিলের নকলের চাহিদা বেশি থাকায় স্বাক্ষর হয় প্রায় ১ হাজারের অধিক। এসব রেজিস্ট্রিকৃত দলিল থেকে সেরেস্তা, নকল, টিপসই ও বিভিন্ন অজুহাতে প্রতি মাসে সর্বনিম্ন ১ কোটি টাকা ঘুস নিচ্ছেন সাবরেজিস্ট্রার মো. হানিফ। যার পুরো টাকাটাই আদায় করা হয় সরকার নির্ধারিত দলিল ফির বাইরে।
সেবাপ্রত্যাশীরা অভিযোগ করেন, সব কাগজপত্র ঠিক থাকার পরেও প্রতিটি ফ্ল্যাট দলিল করতে সরকার নির্ধারিত ফির বাইরে নানা অজুহাতে ৫-১০ হাজার টাকা ঘুস দিতে হয়। আর জমি রেজিস্ট্রি হলে কোনো কথাই নেই। অনেক খুঁটিনাটি দেনদরবার করতে হয় রেজিস্ট্রি করতে। কারণ কুমিল্লা শহরের জমি অত্যন্ত মূল্যবান। নগরীতে ১ থেকে ২০ কোটি টাকা শতাংশ পর্যন্ত জমির মূল্য রয়েছে।
এখানে দলিল লেখকরাও সাবরেজিস্ট্রার এবং অফিস খরচের নামে গ্রাহকদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেন। তবে মুখ খুললে মূল্যবান জমি এবং ফ্ল্যাট নিয়ে সমস্যা হতে পারে-এমন আশঙ্কায় কথা বলতে চান না সেবাপ্রত্যাশীরা।