স্মরণ কালের লোমহর্ষক ঘটনা ছিল ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতের উপর ফ্যাসিস্ট হাসিনার হত্যাকাণ্ড। সোমবার বিকেলে হেফাজতের আন্দোলনে হাজার হাজার নেতাকর্মী দাবি আদায়ের লক্ষ্যে শাপলা চত্বরে জড়ো হয়ে নেতাদের জ্বালাময়ী বক্তব্য শ্রোবনে মত্ত ছিল ছাত্র জনতা। ঠিক তখনি ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের নীল নকশা শুরু হয় আন্দোলন কে স্থমিত করতে। তাজা রক্তের গন্ধে বিভোর হয়ে যায় আওয়ামী হায়নারা। মাষ্টার প্লান করে হত্যাযজ্ঞ চালানোর জন্য র্্যাবের তৎকালীন মহাপরিচালক বেনজির আহমেদ। বিকেল বেলা থেকে শুরু হয় সাউন্ড গ্রেনেড ও গুলি। যুবলীগ, ছাত্রলীগ , আওয়ামীলীগসহ তার সকল অঙ্গ সংগঠনের ক্যাডাররা চালায় নির্মম হত্যাযজ্ঞ।
পরের দিন বিভিন্ন পত্রিকা ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় ঢালাওভাবে হেফাজতের বিরুদ্ধে দাঙ্গা হাঙ্গামার ধূয়া তুলে খবর প্রচার করা হয়। কয়েকটি কাল্পনিক ভূয়া মামলা দায়ের করে আসামি করা হয় কয়েক হাজার নেতাকর্মী কে বাদ যায় নি সাত বছরের মাদ্রাসার শিশু। অনেক মাদ্রাসার পক্ষ থেকে আন্দোলনে যোগ দেয়া ছাত্রদের তালিকা প্রকাশ করতে স্পর্দা পায়নি। তাদেরকে প্রশাসনের উচ্চ পর্যায় থেকে ভয় দেখানো হয়েছিল তথ্য ফাস করলে জেল খাটতে হবে। হেফাজতের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হওয়া মামলাগুলোতে হেফাজতে কোর পক্ষেনো আইনজীবী দাঁড়াতে সাহস করেনি। শুধু মাত্র বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের একজন ব্যারিস্টার সাকিলা ফারজানা। ব্যারিস্টার সাকিলা ফারজানা, যাকে হেফাজত নেতাদের জামিন করার কারণে, তাকে জঙ্গি বানিয়ে গ্ৰেপ্তার করে রিমান্ডে নিয়ে ভয়াবহ নির্যাতন করা হয়।
রিমান্ডে মদ্যপ অবস্থায় জিজ্ঞাসাবাদ করেন চরিত্র বিবর্জিত কুলাঙ্গার পুরুষ অফিসার। মদের গন্ধের সঙ্গে তার মুখ দিয়ে বের হয় অশ্লীল ভাষাও। একইসঙ্গে চলে লাথি আর চড়-থাপ্পড়। মদ্যপ অবস্থায় জিজ্ঞাসাবাদকারী ওই অফিসার ছিলেন সাবেক সেনাকর্মকর্তা মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান। কোনো ব্যারিস্টার নন, যেন চলছে ‘জঙ্গি’ শাকিলা ফারজানার রিমান্ড। হেফাজত নেতাদের জামিন করিয়ে দেওয়া আর বিরোধী দলের মামলা পরিচালনা করার কারণেই টার্গেট হন তিনি। তাকে বানানো হয় জঙ্গি।
তথ্য সূত্রে জানা যায়,এ জঙ্গি তকমা লাগিয়েই তাকে বাসা থেকে গভীর রাতে তুলে নিয়ে প্রথম ধাপে গুম, দ্বিতীয় ধাপে গ্রেপ্তার দেখিয়ে দফায় দফায় নির্যাতন করা হয়। কারান্তরীণ অবস্থায় তার পরিবারের সদস্যরা এবং কারাগার থেকে বের হওয়ার পর ঘরে-বাইরে, রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছে এবং পেশাগত জীবনেও তাকে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে। বির্পযস্ত মেয়েকে দেখে তার বাবা চাপ সামলাতে না পেরে মারা যান স্ট্রোকে।
ব্যারিস্টার শাকিলা ফারজানা তার একদীর্ঘ সাক্ষাৎকারে এসব তথ্য তুলে ধরেন। কথা বলার সময় মাঝেমধ্যেই তিনি কাঁদছিলেন। জড়িয়ে যাচ্ছিল কথা। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ আমলে একজন উচ্চশিক্ষিত রক্ষণশীল মুসলিম নারীকে কীভাবে রিমান্ডে নির্যাতন করা হয়েছে, সে নির্মমতার গল্প শোনান উপস্থিত সাংবাদিকদের।
আরো জানা যায়,শাপলা চত্বরের ঘটনাকে কেন্দ্র করে লালখানের ‘কথিত বিস্ফোরণে’ র্যাব হেফাজত নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা করে। এ মামলায় হেফাজত নেতা মুফতি হারুন ইজাহারকে আটক করা হয়। শাকিলা মুফতি হারুন ইজাহারসহ কয়েকজন হেফাজত নেতাকর্মীর জামিন করান। পরবর্তীতে শাপলা চত্বরের ঘটনায় ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের করা বিভিন্ন মামলায় সাড়ে ৩০০ নেতাকর্মীর জামিনের জন্য পিটিশন দেন তিনি। কিন্তু কবছর ধরে বিরোধী দলের মামলা পরিচালনা করায় তার বিরুদ্ধে সরকারের কাছে নেগেটিভ রিপোর্ট যায়।
যেভাবে গ্রেপ্তার হলেন :
অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে ২০১৫ সালের ১৮ আগস্ট গ্রেপ্তার হওয়ার বিষয়ে ব্যারিস্টার শাকিলা বলেন, এদিন আমার ধানমন্ডির বাসায় প্রায় ২০০ র্যাব সদস্য ঢুকে পড়ে। এক র্যাব সদস্য যিনি পরে মামলার তদন্তকারী অফিসার ছিলেন, তিনি আমাকে বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে যেতে হবে। আপনাকে জঙ্গি অর্থায়নের মামলায় গ্রেপ্তার করা হলো।’ গাড়িতে তুলে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বেঁধে ফেলা হয় চোখ। প্রায় ৪০ মিনিট গাড়ি চলার পর থামে এক জায়গায়। একটি ছোট রুমের মধ্যে আমাকে ঢোকানো হয়েছে। মনে হয়েছিল এখানে ইলেকট্রিক শকের শব্দ। আর ওই শব্দটা এত তীব্র যে, মিনিটের মধ্যেই মাথাব্যথা শুরু হয়ে যায়।যা আমাকে অবচেতন করে তোলে।
শাকিলা আরো বলেন,এরপর শুরু হলো মাইর। একজন বলেন, ‘তোর ল্যাপটপের পাসওয়ার্ড দে।’ কিন্তু তখন আমার কিছুই মনে ছিল না। একদিকে জঙ্গি বলে গ্রেপ্তার, অপরদিকে ওদের গালাগালি, অশ্লীল ভাষার সঙ্গে চলছিল মারধর। তখন মনে হচ্ছিল এর চেয়ে মরে গেলেই হয়তো কষ্ট দূর হয়ে যাবে। আমি তখন বললাম, পাসওয়ার্ড মনে নেই। এ কথা বলার পর মারধরের মাত্রা আরও বেড়ে গেল। পরে বললাম, আমার জুনিয়র আইনজীবী লিটনের কাছে থাকতে পারে। সঙ্গে সঙ্গে শুনলাম লিটনের চিৎকার। তাকে লাথি মারা হচ্ছে। আমি চিৎকার করে জানতে চাইলাম, লিটন তুমি এখানে কেন? জবাবে লিটন বলল, আপা আমাকেও ওরা ধরে এনেছে। আপনার সাথে কাজ করি বিদায় আমাকেও ওরা ধরে এনে অমানবিক নির্যাতন চালাচ্ছে।
চোখ বেঁধে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে:
শাকিলা আরো জানান,টানা নির্যাতনের পর আবার গাড়িতে তোলা হয় ব্যারিস্টার শাকিলা ফারজানাকে। তিনি বলেন, ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা অত্যাচারের পর আমাদের তোলা হয় গাড়িতে। প্রায় ৫০ মিনিটের মতো গাড়ি চলে। যখন থামাল, তখন তাদের একজন ওয়্যারলেসে বলছিল, ‘স্যার আমরা মানিক মিয়া অ্যাভিনিউর সামনে। অপারেশনে যাব?’ অপারেশনের কথা শুনে মনে মনে ধরে নিলাম, এখন হয়তো মেরে ফেলবে। গ্রেপ্তার করেছে জঙ্গি মামলায়। এবার শুট করে জঙ্গি বলে চালিয়ে দেবে।
তিনি আরও বলেন, কিছুক্ষণ পর তাদের কথায় বোঝা গেছে তারা অপারেশনে যাবে না। এরপর গাড়ি চলে পুরো রাত। পরে দেখলাম পতেঙ্গা র্যাব-৭-এ নিয়ে আসা হয়েছে। এরপর চোখ খুলে দিল। পরে র্যাব-৭-এর লে. কর্নেল মিফতাউদ্দিন বললেন, ‘চলুন মিডিয়ার সামনে, সাংবাদিকরা অপেক্ষা করছে। আমরা যেভাবে বলতে বলব, সেভাবেই বলবেন।’ এরপর তারা গণমাধ্যমের কাছে ঢালাওভাবে একতরফা বলে দিল।
রিমান্ডে নির্যাতন:
ব্যারিস্টার শাকিলা বলেন, জঙ্গি মামলা সাজিয়ে আদালতে হাজির করে আমাকে ৫ দিনের রিমান্ডে নেয় র্যাব। প্রথম দফায় ৫ দিন; দ্বিতীয় দফায় দুদিন। রিমান্ডের প্রথম দিন চোখ বেঁধে জিজ্ঞাসাবাদ করা শুরু হলো। ওই সময় জিজ্ঞাসাবাদকারী মদপান করে এসেছিলেন। আমি তার মুখ থেকে প্রচণ্ড গন্ধ পাচ্ছিলাম। মুখে মদের গন্ধ; অপরদিকে খারাপ ভাষা আর লাথি চলছিল সমানে। তিনি যে জিয়াউল আহসান ছিলেন, সেটি আমাকে আরেক কর্মকর্তা পরে কনফার্ম করেন।
শাকিলা বলেন, রিমান্ড শেষে চোখ খোলা অবস্থায় নেওয়া হলো জবানবন্দি দেওয়ার জন্য। গান পয়েন্টে রাখা হলো জবানবন্দি নিতে। কর্নেল মিফতা বললেন, ‘যেভাবে বলব, সেভাবেই জবানবন্দি দেবেন।’ না দিলে আপনার বড় ছেলেকে তুলে নিয়ে এসে জঙ্গি মামলায় দিয়ে দেব।’ এ কথা শোনার পর আমি চিৎকার করে কেঁদে উঠি। বললাম, ওর দিকে হাত না বাড়িয়ে প্লিজ শুট মি কর্নেল মিফতা। এরপর আমি জবানবন্দি দিলাম। তা আদালতে পেশ করা হলো। পরে আদালত কারাগারে পাঠিয়ে দেয়।
তিনি বলেন, অতঃপর কারাগার হয়ে ওঠে আমার জন্য মানসিক ও শারীরিক অত্যাচারের আরেকটি সেল। মাঝেমধ্যে ঘুম ভেঙে গেলে দেখতাম আমার মাথার পাশে খুব কাছে এক নারী মুখের মধ্যে ব্লেড নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। যেন এখনই আমাকে ব্লেড দিয়ে আঘাত করবে। আমি ভয়ে চিৎকার করে উঠতাম।
মা দাঁড়িয়ে থাকতেন জেলগেটে:
গ্রেপ্তারের পর থেকেই শাকিলার মা জেলগেটে দাঁড়িয়ে থাকতেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাকে মানসিক নির্যাতনের জন্য গারদের মধ্যে প্রতিদিন তিন ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। গারদের মধ্যে যে লোহার জাল, সেখানে দাঁড়িয়ে বাইরে জেলগেট দেখা যেত। একদিন হঠাৎ দেখলাম জেলগেটে মা দাঁড়িয়ে রয়েছেন। পরে জেনেছি তিনি প্রতিদিন জেলগেটে আসেন।
উল্লেখ্য, ১০ মাসের বেশি সময় কারাগারে থাকার পর ২০১৬ সালের ৫ জুন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ শাকিলার জামিন দেয়। এর মাধ্যমে তিনি মুক্তি পান। তবে নির্যাতনের সেসব স্মৃতি এখনও তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। এভাবেই কেটে গেল সাকিলা ফারজানার দশটি মাস।এখনো সেই দিন গুলো কথা মনে পরলে গা শিউরে ওঠে। ফিরিয়ে দিতে পারবে না তার হারানো অতীতকে। ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকারের লোমহর্ষক নির্যাতনের যারা শিকার হয়েছে তাঁরাই কেবল ভবিষ্যত প্রজন্মকে দূঃশাসনের কথা প্রকাশ করতে পারবেন। হেফাজতের হত্যার বিচার আর কত দূরে? বিভিষিকাময় দিনগুলো আজো সাকিলা ফারজানার চোখের ঘুম কেড়ে নেয়। চোখের পাতা লেগে আসলেই ভয়ংকর দিন গুলোর নির্যাতনের ভিডিও ভাসতে থাকে। সে এখন জীবন্ত লাশ হিসেবে কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছেন। আদৌ কি এজাতি ফারজানার অতীত দিনগুলো?