রাজশাহী থেকে উত্তরে ৪০ কিলোমিটার দূরে নওগাঁর মান্দা উপজেলা। আর মান্দা সদর থেকে ১০ কিলোমিটার দক্ষিণে কালীগ্রাম। সেখানেই রয়েছে দেশের এই অনন্য কৃষি জাদুঘর। এ যেন এক টুকরো ‘বাংলাদেশ’। নিতান্ত শখের বসেই ব্যক্তি উদ্যোগে প্রায় ১৫ বছর ধরে তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন এই কৃষি জাদুঘর। যেখানে আবহমান বাংলার কৃষি ও কৃষকের জীবন-জীবিকার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে এমন প্রায় সব ধরনের পণ্যই রয়েছে।
একেক জনের শখ আর শৌখিনতা একেক রকম। বলা যায় একেবারেই স্বতন্ত্র। কারণ এটি তার ব্যক্তি চিন্তা চেতনার মিশেলেই তৈরি। তেমনই হয়েছে, এই ব্যতিক্রমী কৃষি জাদুঘরের উদ্যোক্তা জাহাঙ্গীর আলম শাহের ক্ষেত্রেও। শৈশব থেকে কৃষিপণ্যের প্রতি অসম্ভব ঝোঁক ছিল তার। এক সময়ের শখ কৈশোর ও যৌবন পেরিয়ে পূর্ণতা পেয়েছে পৌঢ়ে এসে। রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের এই শিক্ষক সদ্যই অবসর নিয়েছেন। এখন তার সব ধ্যানধারণা নিভৃত পল্লীর এই কৃষি জাদুঘরকে ঘিরেই। আর এরই মধ্যে তার নিজ হাতে গড়া শাহ্ কৃষি তথ্য পাঠাগার ও কৃষি জাদুঘর পেয়েছে অন্যরকম এক পরিচিতি। রাজশাহীর এই শিক্ষকের স্থায়ী নিবাস নওগাঁর কালীগ্রামে। সেখানে পৈতৃক সূত্রে পাওয়া তিন একর জায়গার ওপর প্রতিষ্ঠিত করেছেন এই কৃষি জাদুঘর।
স্থানীয় কৃষক-কৃষাণীরা অবসর পেলেই প্রাচীন বাংলার কৃষক ও কৃষি সম্পর্কে পুরো ধারণা লাভ করতে সেখানে ছুটে যান। এখানে রয়েছে দেড় হাজারেরও বেশি কৃষি উপকরণ। বলা চলে, একটি দেশের সর্ববৃহৎ কৃষি সংগ্রহশালা। এটি একজন সাধারণ মানুষের অসাধারণ কীর্তি। যা, চোখে না দেখলে বোঝানো মুশকিল। কৃষক ও কৃষির সঙ্গে জড়িত কি নেই এখানে? প্রবল ইচ্ছাশক্তিই যে অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে তা আবারও প্রমাণ করেছেন এই স্কুল শিক্ষক। কেবল কৃষি পণ্যই নয়, তার পুরো বাড়ি ঘিরে লাগানো রয়েছে ২৬২টি ওষুধি গাছ।
তার কৃষি জাদুঘরের পা রাখলে যে কারোরই চোখ ছানাবড়া হয়ে যাবে! মাথার ঠিক ওপরেই সারি করে টানানো রয়েছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ক্ষেতখামারে কাজের সময় সর্বোচ্চ ব্যবহৃত মাথল (বিশেষ ক্যাপ) আর কৃষিকাজের নানা উপকরণ। রয়েছে গরুর গাড়ির ছই, সেচের জোত, ঘুঘু, টিয়া, বক ধরা ফাঁদ, দড়ি পাকানোর ঢ্যারা, ঢেঁকি, বিশাল ধানের গোলা। এক কথায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন ঢংয়ের কৃষি উপকরণে তার মাটির ঘরগুলো ঠাসা। আর দেয়ালজুড়ে বিশাল কৃষি পঞ্জিকা। তার ভেতরে কৃষকের স্বাস্থ্য শিক্ষা ও চাষবাসের জন্য থরে থরে সাজানো রয়েছে দুর্লভ সব বই। এ এক অবাক করা সংগ্রহশালা।
মান্দা উপজেলার কালীগ্রামের এই কৃষি জাদুঘরের ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়বে চালার সঙ্গে ঝোলানো সেই ঐতিহ্যবাহী গরুর গাড়ির চাকা, গরুর জোয়াল, ছই, জমিতে সেচ দেওয়ার জোত ইত্যাদি। সামনের খোলা বারান্দায় ঝোলানো রয়েছে আম পাড়ার জালি ও ঠুসি, কৃষকের ক্ষেতের ইঁদুর মারার জন্য নানা রকমের ফাঁদ, কাগজের তৈরি জাঁতার মডেল, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মাছ ধরার ছোট-বড় নানা রকমের চাঁই, পলই। রয়েছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের হরেক রকম নিড়ানি। কাস্তে, হাতুড়ি, গাঁইতি, পালকি, বায়স্কোপ, হারিকেন, হ্যাজাক বাতি, রেলওয়ের আগের দিনের সেই সংকেত বাতি, কুপিবাতি, পাটের তৈরি দোলনা,বিভিন্ন ধরনের খেপলা জালসহ শতশত কৃষিপণ্য। আর এগুলো দেখলেই আবহমান বাংলার কৃষি ও কৃষকের কথা মনে পড়ে যাবে সবার।
এছাড়াও দেয়ালের একাংশ জুড়ে জাহাঙ্গীর শাহ উদ্ভাবিত একটি বিশাল কৃষি পঞ্জিকা। যা কৃষকের পুরো বছরের চাষের তথ্য কনিকা হিসেবে কাজ করে। পাশে থাকা শাহ কৃষি পাঠকক্ষে রয়েছে কৃষিবিষয়ক বই-পুস্তক ও ম্যাগাজিন। কৃষকদের প্রয়োজনীয় প্রায় সব বই-ই রয়েছে এখানে। কৃষকদের নিয়মিতভাবে কৃষি তথ্য, চাষবাস এবং বালাইনাশক বিভিন্ন পরামর্শ দেওয়া হয়। আর প্রতিদিন বিকেলে বসে পাঠশালা। যেখানে ওই গ্রামের দরিদ্র শিশুদের পড়ানো হয়। পাঠাভ্যাসের জন্য বইসহ বিভিন্ন উপকরণও বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়ে থাকে।
কথা হয়, শাহ কৃষি জাদুঘরের কেয়ারটেকার প্রয়োজনীয় আলীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ২০০৮ সালে যাত্রা শুরু হয় এই কৃষি জাদুঘরের। এই জাদুঘরের উদ্যোক্তা জাহাঙ্গীর আলম শাহ দেশের আনাচে-কানাচে ঘুরে ঘুরে একেকটি কৃষি পণ্য সংগ্রহ করেছেন। এক, দুই করে আজ এই সংগ্রহশালা বিশালকার ধারণ করেছে। ব্যক্তি উদ্যোগে গড়া এই সংগ্রহশালা দেশের মধ্যে সর্ববৃহৎ। যেখানে আবহমান বাংলার কৃষিজাত পণ্য, কৃষি সংস্কৃতি ও কৃষি জীবনের ইতিহাস এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ করা হয়েছে। জাদুঘরের পাশাপাশি রয়েছে কৃষি তথ্য পাঠাগারও। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সর্বসাধারণের জন্য খোলা থাকে এই জাদুঘর। বিনামূল্যে এগুলো পরিদর্শন ও গবেষণার সুযোগ পান দর্শনার্থী এবং গবেষকরা।
তিনি বলেন, শাহ কৃষি জাদুঘর পরিদর্শনে দেশ-বিদেশ থেকে প্রায় সময়ই দর্শনার্থী, পর্যটক ও গবেষকসহ নামিদামি অনেক মানুষই এসেছেন। এর মধ্যে ২০০৯ সালে আমেরিকার বেক্স স্টার করপোরেশনের পরিচালক ও কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞ স্টিভেন গেস্ট জাদুঘর পরিদর্শন করে গেছেন। ফিরে গিয়ে তিনি জাহাঙ্গীর শাহের কাছে ই-মেইল পাঠিয়ে এর পাঠাগারের জন্য বই নিয়ে আসার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন। ওই বছরই জাদুঘরে গিয়েছিলেন জাপানি চিকিৎসক কাতাসু হিরো ইয়ামসিতা ও তার স্ত্রী সেইকো ইয়ামসিতা। তাদের সঙ্গে এসেছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান ড. মল্লিকা ব্যানার্জিও।
জাহাঙ্গীর আলম শাহ জানান, কৃষি ও কৃষকের পরিবারেই তার জন্ম। সেই ছোট থেকেই কৃষির প্রতি তার প্রচণ্ড আগ্রহ ছিল। ২০০৮ সালে তিনি প্রথম অনুভব করেন কৃষি লাইব্রেরি দরকার। এরপর লাইব্রেরির জন্য বিভিন্ন বই সংগ্রহ করতে করতে একপর্যায়ে তা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। এরপর তিনি অনুভব করেন তার বাড়িতেই অনেক কৃষিপণ্য পড়ে আছে, যেগুলো প্রদর্শন করলে অনেকেই দেশজ কৃষির সঙ্গে পরিচিত হতে পারবেন। যেই ভাবনা থেকে সেই কাজ। এরপর শুরু হলো কৃষি জাদুঘর প্রতিষ্ঠার নতুন উদ্যোগ। তারপর এক এক করে কৃষিপণ্য সংগ্রহ করে গড় তুলেছেন কৃষি জাদুঘর। এরই মধ্যে দেশের অনেক কৃষক, কৃষি বিজ্ঞানী ও গবেষক তার জাদুঘর এবং কৃষি পাঠাগার পরিদর্শন করেছেন। এ সময় তারা কৃষি উপযোগী এই লাইব্রেরির ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। কারণ এমন পাঠাগার পুরো দেশের মধ্যে একটিই রয়েছে। আর এত সব কৃষিপণ্য এক সঙ্গে আর কোনো জাদুঘরে নেই। এটি একদিকে যেমন কৃষি ও কৃষকের জীবন জীবিকা সম্পর্কে নতুন প্রজন্মকে ধারণা দেবে। তেমনিভাবে কৃষি উপযোগী পাঠাগারের থেকে কৃষি বিষয়ে সব ধরনের তথ্য ও পরামর্শ পাবেন শিক্ষার্থী, গবেষক এবং কৃষকরা। তিনি এই জাদুঘর আরও সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করছেন বলেও জানান।