রংপুর নগরীর ফুসফুস বলে খ্যাত শ্যামাসুন্দরী খাল। এর গভীরতা ছিল ৪০ ফুটের বেশি। দীর্ঘদিন ধরে দখল-দূষণ, গৃহস্থালির বর্জ্য ফেলা ও যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এই খাল ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। যে খালটি পরিবেশ রক্ষার জন্য খনন করা হয়েছিল, তা এখন পরিবেশ দূষণের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কয়েক বছর আগেও নগরীর সব পানি এই খালের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে খোকসা ঘাঘট নদীতে গিয়ে পড়তো। এখন মৃতপ্রায় এই খাল। পানিপ্রবাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় একটু বৃষ্টিতেই নগরীতে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। এই পানি নামতে সময় লাগে দুই-তিন দিন। ফলে ২০ লাখ নগরবাসী দুর্ভোগের শিকার হন। খালটি মরে গেলে ভবিষ্যতে দীর্ঘস্থায়ী ও মারাত্মক জলাবদ্ধতার কবলে পড়বেন নগরীর বাসিন্দারা।
এ অবস্থায় রংপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা শ্যামাসুন্দরী খাল রক্ষার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সহায়তা চেয়েছেন।
শ্যামাসুন্দরী খাল ও তিস্তা নদী নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক আবু ছালেহ মোহাম্মদ ওয়াদুদুর রহমান (তুহিন ওয়াদুদ)। ভবিষ্যতে দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতার কবলে পড়ার শঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘শ্যামাসুন্দরী খাল হলো রংপুর নগরীর পানি নিষ্কাশনের একমাত্র স্থান। এটি এখন ময়লার ভাগাড়। দিন দিন দখল হচ্ছে খালের জায়গা। বাসাবাড়ির বর্জ্য খালে পড়ছে। পুনরায় খনন করে পানিপ্রবাহ বাড়ানো না গেলে বছরজুড়ে নগরীতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হবে।’
স্থানীয় ইতিহাসবিদদের তথ্যমতে, ১৯ শতকের শেষের দিকে মশাবাহী ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাবের কারণে রংপুরে অনেক লোক মারা যান। এর মধ্যে ছিলেন রংপুরের মহারানি শ্যামাসুন্দরী। মৃত্যুর পর তার ছেলে রাজা জানকী বল্লব মশার প্রজনন মোকাবিলায় রংপুর শহরে একটি খাল খননের উদ্যোগ নেন। খালটি খনন করে তার মায়ের নামে নামকরণ করেন। সেই থেকেই খালটি শ্যামাসুন্দরী নামে পরিচিত।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এই খালটি ১৮৯০ সালে খনন করা হয়। প্রথমে ৬০ থেকে ১০০ ফুট চওড়া হলেও এখন এটি নালায় পরিণত হয়েছে। এর পানি কালো হয়ে গেছে। সঙ্গে তীব্র দুর্গন্ধ। খালের কোথাও কোথাও ময়লা-আবর্জনা স্তূপ হয়ে আছে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, রংপুরের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কেল্লাবন্দ এলাকায় ঘাঘট নদী থেকে উৎপত্তি হয়ে পশারীপাড়া, কেরানীপাড়া, মুন্সিপাড়া, ইঞ্জিনিয়ারপাড়া, পালপাড়া, গোমস্তাপাড়া, সেনপাড়া, তেতুলতলা, মুলাটোল, বৈরাগীপাড়াসহ ৩৩টি ওয়ার্ডের ১৪টির বিভিন্ন স্থানের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে খালটি খোকসা ঘাঘট নদীতে পড়েছে। এটি রংপুর নগরীর মাহিগঞ্জ এলাকায় কেডি খালের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।
সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯-১০ সালে খালটির কিছু অংশ পুনরায় খনন করা হয়। কিন্তু পরবর্তী সমেয় খালের বিভিন্ন জায়গা দখল হয়ে যায়। সেইসঙ্গে বাসাবাড়ির ময়লা-আবর্জনা ও শহরের বর্জ্য খালে ফেলা শুরু হয়। এসব ময়লা-আবর্জনা খালটিকে ভাগাড়ে পরিণত করেছে।
খালের আশপাশের বাসিন্দারা বলছেন, খালের দুই পাশে বেশিরভাগ বাসার ল্যাট্রিনের লাইন দেওয়া। বাসাবাড়ির বর্জ্য গিয়ে খালে পড়ছে। এতে পানি বিষাক্ত হয়ে গেছে। পুরো খাল নালায় পরিণত হয়েছে। বেশিরভাগ স্থান ভরাট হয়ে গেছে। যেসব স্থান ভরাট হয়নি, সেখানের গভীরতা ৫-৭ ফুটে নেমেছে। এখন এটি নগরবাসীর জন্য অভিশাপ। কারণ খাল ভরাট হয়ে যাওয়ায় বৃষ্টিতে নগরীতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। বাড়িঘরে পানি ঢোকে। দুর্ভোগে পড়েন নগরবাসী। খালটি পুনরায় খনন ও দখলমুক্ত করা ছাড়া উপায় নেই।
স্থানীয় প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, ২০০৮ ও ২০১৩ সালে দখল উচ্ছেদের উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা শতভাগ সম্ভব হয়নি। পরবর্তী বছরগুলোতে খাল সংস্কারের কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। খালটি সংস্কারে ২০১১ সালে ২৫ কোটি বরাদ্দ দেওয়া হলেও ওই অর্থ অপব্যবহার করা হয়েছে বলে অভিযোগ আছে।
নগরীর মুন্সিপাড়ার বাসিন্দা সালাউদ্দিন, আক্তার হোসেন, আফরোজা ও মমতাজ বেগম জানান, খাল এখন ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়। এ জন্য সিটি করপোরেশন দায়ী। তাদের কোনও নজরদারি নেই। খালের দুই পাশের বাসিন্দারা অনেক স্থান দখল করেছেন। সব বাসাবাড়ির আবর্জনা খালে ফেলা হচ্ছে। ফলে একটু বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। প্রথমত খালটি রক্ষা করতে হবে। দ্বিতীয়ত ময়লা-আবর্জনা ফেলা বন্ধ করতে হবে। দখল ও দূষণরোধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে সিটি করপোরেশনকে। তাহলেই রক্ষা পাবে খালটি।
নগরীর নিউ ইঞ্জিনিয়ারপাড়া ও গোমস্তপাড়া মহল্লার আলতাফ হোসেন এবং শরীফুল আলম জানান, এর আগে শ্যামাসুন্দরী খাল খনননের নামে ২৫ কোটি বরাদ্দ দিয়ে লুটপাট করা হয়েছে। যেহেতু নগরীর চলাচলের একটি মাত্র সড়ক, সে কারণে এর ওপর দিয়ে স্ল্যাব বসিয়ে বিকল্প রাস্তা তৈরি করতে হবে।
এ বিষয়ে সিটি করপোরেশনের মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা বলেন, ‘খালটির বেহাল দশা। এটি সংস্কারের জন্য পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ দরকার। তাহলে পুনরায় খনন করা যাবে।’
নগরীর সব পানি নিষ্কাশনের জন্য শত কোটি টাকা ব্যয়ে ড্রেনেজ ব্যবস্থা তৈরি করা হয়েছে উল্লেখ করে মেয়র বলেন, ‘কিন্তু খালটির বিভিন্ন অংশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় পানি চলাচল করতে পারছে না। ফলে পুনরায় খনন করতে হবে। এ জন্য প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ কামনা করছি। খালটি খনন করে দুই পাশে রাস্তা নির্মাণসহ অনেক কাজ করতে হবে। ময়লা-আবর্জনা ফেলা রোধ করতে হবে। বরাদ্দ পেলেই এসব কাজ করা যাবে। আর বরাদ্দ না পেলে একসময় এই খাল হারিয়ে যাবে।’