কয়লা, খনিজ তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস হচ্ছে জীবাশ্ম জ্বালানি। আর, এগুলো থেকে আমরা পাই প্রচলিত শক্তি (conventional energy)। তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের মূল উপাদান কয়লা। কয়লা পোড়ালে সরাসরি তাপও পাওয়া যায়। রান্নায় বা বাষ্পীয় ইঞ্জিন চালাতেও কয়লার ব্যবহার আছে।
তবে, প্রাকৃতিক গ্যাসের ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায়, রান্নায় কয়লার ব্যবহার অনেক কমেছে। প্রাকৃতিক গ্যাস সার কারখানায় ও তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রেও ব্যবহৃত হয়। ওদিকে, খনিজ তেলের ব্যবহার মূলত বিদ্যুৎশক্তি ও যান্ত্রিক শক্তি উৎপাদনে।
সমস্যা হচ্ছে, জীবাশ্ম জ্বালানি পরিবেশ দূষণের জন্য দায়ী। বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন ধরনের গাড়ি, বিমান, জাহাজ, ট্রেন, ইত্যাদির সিংহভাগ এখনো চলে জীবাশ্ম জ্বালানিতে। বিভিন্ন কল-কারখানায়ও আছে এমন জ্বালানির ব্যাপক ব্যবহার।
পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর গ্রিনহাউস গ্যাসের (যেমন, কার্বন ডাইঅক্সাইড) নিঃসরণ ঘটে তখন; পরিবেশ হয় দূষিত। এর ফলে জলবায়ু পরিবর্তন ঘটছে, পৃথিবীর তাপমাত্রা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে, জীব বৈচিত্র্যের ওপর পড়ছে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব।
এমনি এক প্রেক্ষাপটে, জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনার চেষ্টা চলছে বিশ্বব্যাপী। এই নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনতে চাই শক্তির বিকল্প উৎস, যা আমাদের প্রয়োজনীয় শক্তি তো দেবে, কিন্তু পরিবেশের ক্ষতি করবে না। এমন শক্তিকেই আমরা বলছি ‘নতুন শক্তি’ (New Energy)। এই নতুন শক্তির একটা রূপ হচ্ছে ‘নবায়নযোগ্য শক্তি’ (renewable energy)।
‘নতুন শক্তি’ ও ‘নবায়নযোগ্য শক্তি’র মধ্যে খানিকটা পার্থক্য আছে। পানিবিদ্যুৎ নবায়নযোগ্য, তবে নতুন শক্তি নয়। কারণ, দীর্ঘকাল ধরে এই শক্তি ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তাছাড়া, পানিবিদ্যুৎ-প্রযুক্তি অনেক পরিণতও বটে।
আবার, বায়ুশক্তি একাধারে নতুন ও নবায়নযোগ্য। এদিকে, পারমাণবিক শক্তির মধ্যে নিউক্লীয় বিদারণ (nuclear fission) হচ্ছে প্রচলিত শক্তি এবং নিউক্লীয় সংযোজন (nuclear fusion) হচ্ছে নতুন শক্তি। আবার, সব ধরনের পারমাণবিক শক্তি-ই অনবায়নযোগ্য।
পৃথিবীতে বর্তমানে মূলত ৫ ধরনের নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে—সৌরশক্তি (Solar energy), বায়ুশক্তি (Wind energy), পানিশক্তি (Hydro energy), স্রোতশক্তি (Tidal energy), ভূ-তাপীয় শক্তি (Geothermal energy), জৈবশক্তি (Biomass energy)।
শহুরে আবর্জনা ও হাইড্রোজেন ফুয়েল সেলও নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস। নবায়নযোগ্য শক্তির ক্রমবর্ধমান ব্যবহারের ফলে, ২০৫০ সাল নাগাদ পৃথিবীর মানুষের বিদ্যুতের চাহিদার ৮৫ শতাংশই নবায়নযোগ্য শক্তি হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
নবায়নযোগ্য শক্তির উৎপাদন বাড়াতে চীনের সরকার নিয়েছে বিভিন্ন উদ্যোগ; দেশে গড়ে উঠেছে নবায়নযোগ্য শক্তির পূর্ণাঙ্গ সরবরাহ শৃঙ্খল (supply chain)। ফলে দিন দিন এই শক্তির ব্যবহার বাড়ছে।
বর্তমানে নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিশ্বে শীর্ষে অবস্থান করছে চীন। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বায়ুশক্তি ও সৌরশক্তি উৎপন্ন হচ্ছে ১৪০ কোটি মানুষের দেশ চীনে। নবায়নযোগ্য শক্তি খাতে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগও করছে চীন। দেশের বাইরে এই খাতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও এগিয়ে আছে চীন।
দশ বছরে চীনের নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদন ক্ষমতা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১০ কোটি কিলোওয়াটে (KW)। এর মধ্যে বায়ুশক্তি ও সৌরশক্তির মিলিত হিস্যা হচ্ছে ৬৭ কোটি কিলোওয়াট, ২০১২ সালের তুলনায় যা ৯০ গুণ বেশি।
২০২৫ সালের মধ্যে চীনের বায়ুশক্তি ও সৌরশক্তি উৎপাদন ক্ষমতা শতভাগ বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। তখন, দেশের মোট চাহিদার ৫০ শতাংশ পূরণ হবে নবায়নযোগ্য শক্তির দ্বারা। দশ বছরে চীন পানিবিদ্যুৎ ও জৈবশক্তি উৎপাদনের ক্ষেত্রেও পেছনে ফেলেছে বিশ্বের অন্য সকল দেশকে।
নবায়নযোগ্য শক্তি খাতের দ্রুত উন্নয়ন বিদেশি কোম্পানিগুলো চীনে বেশি বেশি বিনিয়োগে উত্সাহিত করছে। বহুজাতিক কোম্পানি শেল পিএলসি (Shell plc), এসএবিআইসি (SABIC) ও হানিওয়েল (Honeywell) চীনের এই খাতে বিপুল অর্থ বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে। এসব কোম্পানি চীনের পেট্রোক্যামিকেলস, হাইড্রোজেন, চার্জিং স্টেশন, কার্বন সংরক্ষণ ও ব্যবহার (carbon capture, utilization and storage), ইত্যাদি বিভিন্ন সাব-সেক্টরে বিনিয়োগের পরিকল্পনা করছে।
লন্ডনভিত্তিক শেল বিগত কয়েক বছর ধরেই চীনের নবায়নযোগ্য শক্তি খাতে বিনিয়োগ করে আসছে। শেল, চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানি শেনার্জি গ্রুপের (Shenergy Group Co.) সাথে সহযোগিতার ভিত্তিতে, শাংহাইয়ে একটি হাইড্রোজেন রিফুয়েলিং নেটওয়ার্ক (hydrogen refueling network) গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়ে সামনে এগোচ্ছে। এটি হবে এশিয়ার প্রথম হাইড্রোজেন রিফুয়েলিং নেটওয়ার্ক।
নেটওয়ার্কের আওতায়, আগামী পাঁচ বছরে, ছয় থেকে দশটি হাইড্রোজেন রিফুয়েলিং স্টেশন নির্মিত হবে। আর ২০৩০ সালের মধ্যে এমন ধরনের স্টেশনের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ৩০টিতে।
গবেষক লুও জুওসিয়ান (Luo Zuoxian) বলেন, চীনের নবায়নযোগ্য শক্তির বাজার বিশাল। অন্য কোনো দেশ এর ধারেকাছেও নেই। কারণ, চীন ২০৬০ সালের মধ্যে কার্বন-নিরপেক্ষ হওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে এবং সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। সুতরাং দিন যত গড়াবে, চীনে নবায়নযোগ্য শক্তির চাহিদা তত বাড়বে। বিদেশি কোম্পানিগুলো এই সুযোগ লুফে নেবে।
শুধু বিদেশি কোম্পানি নয়, সংশ্লিষ্ট চীনা কোম্পানিগুলোও নবায়নযোগ্য শক্তি খাতে নিজেদের মেধা ও অর্থ বিনিয়োগ করছে। উদাহরণস্বরূপ চীনা পেট্রোক্যামিকল কর্পোরেশন তথা সিনোপেক-এর কথা ধরা যাক।
সিনোপেক (Sinopec) বিশ্বের বৃহত্তম তেল পরিশোধক কোম্পানি। এটি নিজের সবুজ হাইড্রোজেন উৎপাদন ক্ষমতা ক্রমাগত বাড়িয়েই চলেছে। এই কোম্পানি দেশব্যাপী হাইড্রোজেন রিফুয়েলিং নেটওয়ার্ক গড়ে তুলছে। ২০২৫ সাল নাগাদ সিনোপেক নিজের হাইড্রোজেন রিফুয়েলিং ক্ষমতা বার্ষিক এক লাখ কুড়ি টনে উন্নীত করতে চায়।
বস্তুত, দশ বছরে চীন নবায়নযোগ্য শক্তি প্রযুক্তির জন্য একটি সম্পূর্ণ শিল্পব্যবস্থা গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। দেশেই এখন তৈরি হচ্ছে বিশ্বের বৃহত্তম মেগাওয়াট-স্কেলের হাইড্রোলিক টার্বাইন সেট। সৌরশক্তি খাতেও অর্জিত হয়েছে ব্যাপক অগ্রগতি। সমুদ্রে ১০টি বায়ু ঘূর্ণযন্ত্র বা উইন্ড টার্বাইন থেকে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হচ্ছে।
নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বৃদ্ধির ফলে চীনে পরিবেশ দূষণ উল্লেখযোগ্য হারে কমছে। এক হিসেব অনুসারে, ২০২১ সালে চীনে যেটুকু নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপন্ন হয়েছে, সেটুকু শক্তি উৎপাদন করতে ৭৫ কোটি ৩০ লাখ টন কয়লা পোড়াতে হতো। আর এই পরিমাণ কয়লা পোড়ালে বায়ুমণ্ডলে নিঃসৃত হতো ২০৭ কোটি টন কার্বন ডাই-অক্সাইড, চার লাখ টন সালফার ডাই-অক্সাইড এবং সাড়ে চার লাখ টন নাইট্রোজেন অক্সাইড।
চীনে পরিষ্কার ও সবুজ শক্তির ব্যবহার ক্রমশ বাড়ছে। ২০২১ সালে দেশে যত শক্তি ব্যবহৃত হয়েছে, তার ২৫.৫ শতাংশই ছিল পরিষ্কার ও সবুজ, পরিবেশবান্ধব। ২০১২ সালের তুলনায় যা ১১ শতাংশ পয়েন্ট বেশি।
অন্যদিকে, ২০২১ সালে চীনে শক্তি উৎপাদনে কয়লার ব্যবহার ছিল মোট জ্বালানির ৫৬ শতাংশ, যা ২০১২ সালের চেয়ে ১২.৫ শতাংশ পয়েন্ট কম।
এদিকে, নবায়নযোগ্য শক্তি খাতের দ্রুত উন্নয়ন, চীনের ভেতরে ও বাইরে, বিপুলসংখ্যক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে ও করছে। আন্তর্জাতিক নবায়নযোগ্য শক্তি সংস্থার (IREA) সম্প্রতি প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২১ সালে বিশ্বে এই খাতে কর্মসংস্থান বেড়ে দাঁড়ায় এক কোটি ২৭ লাখে, যার ৪২ শতাংশই চীনে সৃষ্ট। এক্ষেত্রে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও ব্রাজিলের হিস্যা ১০ শতাংশ করে এবং যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের ৭ শতাংশ করে।
২০২১ সালে চীনের নবায়নযোগ্য শক্তি খাতে কর্মসংস্থান বেড়ে দাঁড়ায় ৫৪ লাখে (২০২০ সালে ছিল ৪৭ লাখ)। এর মধ্যে সৌরশক্তি খাতে কর্মসংস্থানের সংখ্যা ছিল সর্বোচ্চ—২৭ লাখ (২০২০ সালে ছিল ২৩ লাখ)।
২০২১ সালে বায়ুশক্তি খাতে বিশ্বব্যাপী কর্মসংস্থানের সংখ্যা ছিল ১৪ লাখ, যার ৪৮ শতাংশই চীনে। একই বছর পানিবিদ্যুৎ খাতে বিশ্বব্যাপী বিদ্যমান কর্মসংস্থানের মধ্যে সর্বোচ্চ ৩৭ শতাংশ ছিল চীনে। মনে রাখতে হবে, মহামারির কারণে বেশকিছু পানিবিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ শেষ হতে দেরি হয়েছিল।
আন্তর্জাতিক নবায়নযোগ্য শক্তি সংস্থার সাবেক মহাসচিব আদনান জেড আমিন একবার বলেছিলেন, বৈশ্বিক শক্তি-ব্যবস্থার রূপান্তরের ক্ষেত্রে চীন একটি অগ্রগামী শক্তি। তিনি এতটুকু বাড়িয়ে বলেননি। শক্তি-ব্যবস্থার রূপান্তর অর্থ প্রচলিত শক্তি-ব্যবস্থা মূলত নবায়নযোগ্য শক্তি-ব্যবস্থায় রূপান্তর করা। নবায়নযোগ্য শক্তি খাতে বিশ্বে চীন এরই মধ্যে নেতৃত্বের আসন নিজের করে নিয়েছে।
চীনের সম্পদ ও পরিবেশ সংরক্ষণ বিভাগের পরিচালক লিউ তেছুন (Liu Dechun) সম্প্রতি বলেছেন, তার দেশ ২০৬০ সালের মধ্যে কার্বন-নিরপেক্ষতা অর্জনের লক্ষ্য পূরণে সক্ষম হবে। কারণ, এক দশকে দেশ নবায়নযোগ্য শক্তি তথা সবুজ ও নিম্নকার্বন শক্তি খাতে ব্যাপক অগ্রগতি অর্জন করেছে।
অগ্রগতির এই ধারা অব্যাহত থাকলে—অব্যাহত না-থাকার কোনো কারণও দেখা যাচ্ছে না—কার্বন-নিরপেক্ষতা অর্জনের গন্তব্যে সময়মতো পৌঁছে যাওয়া চীনের পক্ষে খুবই সম্ভব। তিনিও বাড়িয়ে বলেননি।