২০২৫ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০-এর সংশোধিত ধারা ৯(খ) অনুযায়ী, যদি কোনো পুরুষ বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ১৬ বছরের বেশি বয়সী নারীর সাথে জোর-জবরদস্তি ছাড়া শারীরিক সম্পর্ক করেন, এবং যদি তারা পারস্পরিক আস্থার সম্পর্কের মধ্যে থাকেন, তবে পুরুষ সর্বোচ্চ ৭ বছর কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
এই সংশোধনীর মাধ্যমে নারীর স্বার্থ সংরক্ষিত হয়েছে বলে মনে করা হলেও, আইনের ভারসাম্য রক্ষা হয়েছে কী?
২০০০-এর সংশোধিত ধারা ৯(খ) অনুযায়ী এখানে পুরুষকে শাস্তির আওতায় আনা হলেও নারীকে সম্পূর্ণ দায়মুক্ত রাখা হয়েছে। অথচ যৌনসম্পর্ক উভয়ের সম্মতিতেই হয়েছে। তখন নারী নিপীড়িত হয়নি বরং স্বেচ্ছায় শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়েছে, কিন্তু এই আইনে শুধু পুরুষকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে এবং নারীকে দায়মুক্ত রাখা হচ্ছে।
এখন প্রশ্ন হলো একই ঘটনার জন্য নারী ও পুরুষের জন্য আলাদা বিধান কি ন্যায়বিচারের পরিপন্থী নয়?
আইন বিশেষঙ্গরা বলছেন, বিচারব্যবস্থা সবার জন্য সমান হওয়া উচিত। তাহলে শুধু পুরুষ শাস্তি পাবে, আর নারী দায়মুক্ত থাকবে—এটি ন্যায়সঙ্গত নয়। এই আইনে নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্যই সমান শাস্তির বিধান থাকা উচিত। বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৭ অনুযায়ী, সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং সমান সুরক্ষা পাওয়ার অধিকারী।
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের (আপিল বিভাগ) আইনজীবী ড. কাজী জাহেদ ইকবাল অভিমত প্রদান করেছেন যে, ১৬ নয় বরং ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে কোনো নারীর সঙ্গে জোর-জবরদস্তি ব্যতীত শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের পর যদি বনিবনা না হয় এবং পুরুষের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়, তবে তা ধর্ষণ নয়, বরং প্রতারণা হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত।
তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, প্রতারণা উভয় পক্ষের যেকোনো দিক থেকে আসতে পারে। সুতরাং, একই অপরাধের জন্য উভয় পক্ষের সমান শাস্তি নিশ্চিত করা আবশ্যক, কারণ উক্ত ঘটনা উভয় পক্ষের সম্মতিতেই সংঘটিত হয়েছে।”
নারী প্রলোভনে প্রলুব্ধ হলে সে দায়মুক্ত থাকবে কেন?
আইনটি পুরুষের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের ওপর ভিত্তি করে তাকে শাস্তি দিচ্ছে, কিন্তু নারীর কোনো দায় নির্ধারণ করেনি।
সেখান থেকেই প্রশ্ন – একজন প্রাপ্তবয়স্ক নারী যদি নিজের সম্মতিতে শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হয়, তবে কেন সেই সম্পর্কের দায় কেবল পুরুষের ওপর বর্তাবে?
নারী কি জানে না যে বিয়ে ছাড়া যৌনসম্পর্ক সামাজিকভাবে স্পর্শকাতর বিষয়?
যদি সে নিজের ইচ্ছায় এতে অংশ নেয়, তবে কেন পুরুষকে এককভাবে দোষী সাব্যস্ত করা হবে?
যদি নারী যৌনসম্পর্কে স্বেচ্ছায় সম্মতি দেয়, তবে পুরুষকে একমাত্র অপরাধী বানানো কতটা ন্যায়সংগত?
বিশ্বাসভঙ্গ বা প্রতারণা করলে কি শুধু পুরুষ দোষী হবে? নারী বিশ্বাসভঙ্গের কোনো কেন নেবে না?
বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে যৌনসম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে পুরুষ প্রতারণা করতে পারে, কিন্তু নারীও প্রতারণার মাধ্যমে সুবিধা নিতে পারে এবং পরবর্তীতে প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘন করতে পারে। কিছু নারী ইচ্ছাকৃতভাবে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে পুরুষের সুভিধা আদায় করতে পারে। এত পুরুষও প্রতারিত হতে পারে।
যদি পুরুষের প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘন শাস্তিযোগ্য হয়, তবে নারীর ক্ষেত্রেও যদি সে প্রতারণার সুযোগ নেয়, তাহলে নারী কেন দায়মুক্ত থাকবে?
ধারা ৯(খ) কি পুরুষদের জন্য একপাক্ষিক অন্যায় তৈরি করছে?
আইন অনুযায়ী, যৌনসম্পর্ক যদি উভয়ের সম্মতিতে হয়, তবে বিয়ের প্রতিশ্রুতির ওপর ভিত্তি করেও সেটি অপরাধ হতে পারে। কিন্তু এখানে নারীর সম্মতির কোনো মূল্য দেওয়া হয়নি। এই আইন নারীদের জন্য দায়মুক্তির সুযোগ তৈরি করেছে, যা তাদের যৌনসম্পর্কে লিপ্ত হওয়ার পরও পুরুষদের ব্ল্যাকমেইল করার হাতিয়ার হয়ে দাঁড়াতে পারে। ফলে ন্যায়বিচারের মূলনীতি অনুযায়ী, সমান অপরাধে সমান শাস্তি হওয়া উচিত। ভালো কাজের (বিয়ে) প্রলোভনে যদি খারাপ কাজ (যৌনসম্পর্ক) করা হয়, তবে নারীরও দায় থাকা উচিত।
আইনটিতে প্রাসঙ্গিক ধরে অন্যান্য অপরাধের সঙ্গে তুলনা করলে যা দাড়ায়-
ধরা যাক, কেউ টাকার লোভে খুন করলো। তাহলে কি সে নির্দোষ হয়ে যাবে, কারণ সে টাকা পাওয়ার লোভে ছিল?যদি টাকা বা সম্পদের লোভ দেখিয়ে কেউ অপরাধ করলে শাস্তি পায়, তাহলে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দেখিয়ে যৌনসম্পর্কের ক্ষেত্রেও উভয় পক্ষের শাস্তি পাওয়া উচিত।
এই আইনে পুরুষের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলার ঝুঁকি-
ধারা ৯(খ) শুধুমাত্র পুরুষদের জন্য শাস্তির বিধান রাখায় নারীরা সহজেই এই আইনের অপব্যবহার করতে পারে। যদি আইন নারীকে সম্পূর্ণ দায়মুক্ত করে, তবে এটি পুরুষদের বিরুদ্ধে ব্ল্যাকমেইল করার হাতিয়ার হয়ে দাঁড়াবে।যদি আইনে নারীর জন্যও শাস্তির বিধান থাকতো, তাহলে আইনের অপব্যবহার কম হতো মনে করেন বিশ্লেষকরা। বর্তমানে ধারা ৯(খ) শুধুমাত্র পুরুষদের জন্য শাস্তির বিধান রেখে আইনগত ভারসাম্যহীনতা তৈরি করেছে। এটি পুরুষদের একপাক্ষিকভাবে অপরাধী বানাচ্ছে এবং নারীদের পুরোপুরি দায়মুক্ত করছে। নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্য সমান শাস্তির বিধান রেখে ধারা ৯(খ)-এর সংশোধন করা উচিত বলেও মনে করেন আইন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. রেজাউল করিম রনি উক্ত আইনটিকে একটি ‘কালো আইন’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তাঁর মতে, আইনটি একপাক্ষিক হয়ে পড়েছে, যেখানে একই অপরাধে উভয় পক্ষ দোষী হলেও শুধুমাত্র পুরুষকে শাস্তি ভোগ করতে বাধ্য করা হচ্ছে, অথচ নারীকে সম্পূর্ণভাবে দায়মুক্ত রাখা হয়েছে।
রেজাউল করীম বলেন, সমাজে এমন অনেক নারী রয়েছেন যারা এই আইনটির সুবিধা গ্রহণ করবেন। আইন যেহেতু প্রত্যেক নাগরিকের জন্য সমান, তাই একাধিক পক্ষের মধ্যকার একই অপরাধের ক্ষেত্রে সকলের জন্য সমান শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। আইনটি সমতাভিত্তিকভাবে প্রয়োগ করা হলে বিবাহপূর্ব অপরাধের ব্যাপারে নারী ও পুরুষ উভয়ই সচেতন হবে এবং এর মাধ্যমে সমাজে এই ধরনের অপরাধের হার উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাবে।”