বাংলাদেশ সীমান্তে ভারতীয়দের বেড়া/ফাইল ছবি
৫ আগস্টের পর থেকেই বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে চলছে টানাপোড়েন। ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারতে আশ্রয়, বন্যা, সীমান্ত হত্যা, সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ, ভিসা বন্ধ করে পরে সীমিত করা প্রভৃতি বিষয় নিয়ে দুই দেশের সম্পর্ক খুব স্বস্তির জায়গায় নেই। এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক সীমান্ত আইন লংঘন করে ভারতের কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার চেষ্টা আগুনে যেন ঘি ঢালছে। যাতে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সঙ্গে যোগ হয়েছে দুই দেশের সীমান্তবর্তী জনগণও।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই নজরদারি বাড়িয়েছে দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী। এর মধ্যে সীমান্তে বিভিন্ন ঘটনায় পাল্টাপাল্টি প্রতিক্রিয়াও জানিয়েছে দুই দেশের সরকার। সবমিলিয়ে দুই দেশের সীমান্ত নিয়ে আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় উত্তেজনা বিরাজমান। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে ভারত সীমান্ত ব্যবস্থাপনায় কাঁটাতারের বেড়া স্থাপন করছে। নজরদারির জন্য বৈদ্যুতিক যন্ত্র ও অত্যাধুনিক ক্যামেরা লাগাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। যেখানে নদী বা অন্য কোনো কারণে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার সুযোগ নেই, সেখানে নজরদারির জন্য উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ক্যামেরাসহ বিশেষ যন্ত্র স্থাপন করা হচ্ছে।
উত্তেজনার শুরু
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে আশ্রয় নেওয়ার পর আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের ক্ষমতার অবসান হয়। ক্ষমতাচ্যুত দলের অনেকে ভারতের সীমান্ত অভিমুখী হয় ক্ষোভ থেকে বাঁচতে। ভারতও সীমান্তে কড়াকড়ি করে। টহল বাড়ায়। সার্বিক পরিস্থিতিতে প্রথমে বাংলাদেশিদের ভিসা দেওয়া বন্ধ রাখে নয়াদিল্লি। কিছুদিন পর চিকিৎসা ও জরুরি কিছু ভিসা চালু করে, যা এখনো চলমান। সনাতন ধর্মাবলম্বিদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ, ভারতের গণমাধ্যমে সংঘবদ্ধ প্রোপাগান্ডার জেরে আগরতলায় বাংলাদেশ দূতাবাসে হামলার ঘটনা ঘটে। যদিও দুই দেশের পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠক এবং গত এক মাসের বিভিন্ন আলোচনায় মনে হয়েছে, খানিকটা সহজ হয়ে আসছে সম্পর্ক।
বেড়া দেওয়া নিয়ে নতুন উত্তেজনা
সম্প্রতি বাংলাদেশের কয়েকটি জেলার সীমান্তে বাংলাদেশের বর্ডার গার্ড (বিজিবি) ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর স্থাপনা নির্মাণ নিয়ে আপত্তি তোলার পর সীমান্তে নতুন করে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁ জেলা সংলগ্ন সীমান্তের ভারতের দিকের অংশে বেড়া নির্মাণ নিয়ে বাংলাদেশ অংশ থেকে বাধা দেওয়া হয়। আর লালমনিরহাটের পাটগ্রাম সীমান্তে কয়েক দফায় বেড়া স্থাপনের চেষ্টা চালায় বিএসএফ। তবে বিজিবি সদস্যদের বাধার মুখে তা আর পারেনি।
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বাড়ছে উত্তেজনা
হঠাৎ কেন সীমান্তে বিএসএফ এমন তৎপর হলো, তা নিয়ে চলছে আলোচনা। তাদের এ কার্যকলাপের ইঙ্গিতই বা কী, সেটা বোঝার চেষ্টা করছেন বিশ্লেষকরা।
সীমান্ত ইস্যুতে উত্তেজনার মধ্যেই ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মাকে তলব করে কড়া প্রতিবাদ জানায় ঢাকা। সম্প্রতি পররাষ্ট্রসচিব মো. জসীম উদ্দিনের সঙ্গে আলোচনা করতে আসেন তিনি। পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার ব্যাপারে দুই দেশের মধ্যে বোঝাপড়া রয়েছে। পরে ভারতে নিযুক্ত বাংলাদেশের উপ-হাইকমিশনার নূরুল ইসলামকে তলব করে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। দিল্লি ও ঢাকার মধ্যে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্যই তাকে ডাকা হয়।
শুধু সরকার একা নয়, এক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলো আলোচনার মাধ্যমে ভূমিকা পালন করতে পারে। ভারতকে এটা বোঝাতে হবে শুধু আমাদেরই তাদের দরকার না, তাদেরও আমাদের দরকার।- জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোস্তাকিম বিন মোতাহার
জানা যায়, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বিদ্যমান চার হাজার ১৫৬ কিলোমিটার সীমান্তের মধ্যে ৩ হাজার ২৭১ কিলোমিটার স্থানে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ কাঁটাতারের বেড়া স্থাপন করেছে এবং ৮৮৫ কিলোমিটার স্থানে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করা হয়নি। সেসব স্থানেই ভারতের বিএসএফ কাঁটাতারের বেড়া দিতে চাইছে।
চৌকা সীমান্তে প্রথমে বেড়া দেওয়ার চেষ্টা
গত সপ্তাহে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার চৌকা সীমান্তের ওপারে ভারতের সুখদেবপুর সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ নিয়ে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। ৮ জানুয়ারি চৌকা সীমান্তে বিজিবি ও বিএসএফের মধ্যে ব্যাটালিয়ন কমান্ডার পর্যায়ে পতাকা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, সীমান্ত লাইন থেকে দেড়শ গজের মধ্যে কিছু করা হলে সেটা অপর পাশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে সঠিক নিয়ম মেনে অবহিত করতে হয়। কিন্তু ভারত ১০০ গজের মধ্যে মাটি খুঁড়লেও বিএসএফ বাংলাদেশের বিজিবিকে জানায়নি বলে জানান ৫৯ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল গোলাম কিবরিয়া। পরে বিজিবি থেকে এ নিয়ে বাধা দেওয়া হয় এবং সাময়িকভাবে কাজ থামানো হয়। এদিন দুই দেশের সীমান্তের অধিবাসীদেরও বিজিবি-বিএসএফের সঙ্গে যোগ দিতে দেখা যায়। অতীতে এ ধরনের ঘটনা খুব দেখা যায়নি।
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বাড়ছে উত্তেজনা
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্তে বেড়া দেওয়া স্থগিত করা ইস্যুতে বিএসএফ ১০ জানুয়ারি বলে, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে অরক্ষিত অংশগুলোতে বেড়া দেওয়ার কাজ আপাতত স্থগিত রাখা হচ্ছে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা এড়াতে।
সপ্তাহের ব্যবধানে ফের উত্তেজনা
চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার কালিগঞ্জ সীমান্তে ফের উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। শনিবার (১৮ জানুয়ারি) সকাল থেকে সীমান্তে দুই দেশের নাগরিকরা অবস্থান নেন।
বাংলাদেশ সীমান্তের স্থানীয়রা জানান, বিএসএফ সদস্যরা হঠাৎ করেই কাঁটাতারের বেড়ার পাশে ৫০০-৬০০ ভারতীয়কে জড়ো করেন। এসময় তারা বাংলাদেশের ভেতরেও ঢুকে পড়েন। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে ভারতীয়দের ধাওয়া করেন বাংলাদেশিরা। এতে তাদের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধে। এসময় ভারতীয় নাগরিকরা একাধিক ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটান। এছাড়া বিএসএফ সদস্যরা টিয়ারশেল নিক্ষেপ করেন।
আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করে ভারত সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া তৈরি করতে চেয়েছে। আমরা জোর আপত্তি জানানোর ফলে তারা সেটা বন্ধ করেছে। স্থানীয় জনগণও এতে যোগ দিয়েছেন।- বিজিবির উপ-মহাপরিচালক (যোগাযোগ) কর্নেল মোহাম্মদ শরীফুল ইসলাম
মহানন্দা ৫৯ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল গোলাম কিবরিয়া বলেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। বিস্তারিত পরে জানানো হবে।