কক্সবাজার: কক্সবাজারে টেকনাফের গহীন পাহাড়ে মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) গোপন আস্তানার সন্ধান পেয়েছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
যেখানে ‘টর্চার সেল’ গড়ে অপহরণ, নির্যাতন ও মুক্তিপণ আদায় ছাড়াও হত্যার পর মরদেহ গুম করে আসছিলেন রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা।
আর সেই গহীন পাহাড়ের আস্তানা থেকে আরসার সামরিক কমান্ডারসহ ছয় সদস্যকে আটক করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) সদস্যরা। এ সময় উদ্ধার করা হয়েছে সাতটি দেশি-বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র, গুলি ও নগদ টাকা।
শুক্রবার (২১ জুলাই) রাত সাড়ে ১০টা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত টেকনাফ উপজেলার বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর এলাকার গহীন পাহাড়ে এ অভিযান পরিচালনা করেন র্যাব সদস্যরা।
অভিযানের সার্বিক বিষয়ে শনিবার (২২ জুলাই) সকাল সাড়ে ১০টায় র্যাব-১৫ এর কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন এ তথ্য জানান।
তিনি জানান, টেকনাফের গহীন পাহাড়টিতে আরসার সন্ত্রাসীরা গোপন আস্তানা তৈরি করে ‘টর্চার সেল’ গড়ে ছিলেন। গোপন তথ্যের ভিত্তিতে সেখানে অভিযান চালানো হয়। অভিযানে আটক করা হয় আরসার সামরিক কমান্ডার ও কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের দিল মোহাম্মদের ছেলে হাফেজ নুর মোহাম্মদকে (২৮)। এছাড়া আরসার আটক অন্য সদস্যরা হলেন- ধলা মিয়ার ছেলে মোহাম্মদ হোসেন জোহার (৩০), ওবায়দুর রহমানের ছেলে মো. ফারুক হারেস (২৩), জমলুকের ছেলে মনির আহাম্মদ (৩৬), অলি আহমদের ছেলে নূর ইসলাম (২৯), হোসেনের ছেলে মো. ইয়াছিন (২১)। অভিযানে ঘটনাস্থল থেকে একটি ৭.৬৫ এমএম পিস্তল, একটি বিদেশি রিভলবার, একটি শর্টগান, চারটি দেশীয় তৈরি এলজি, তিনটি দেশীয় রামদা, গুলিসহ নগদ ৭০ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়।
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, আরসার গোপন আস্তানার তথ্য নিশ্চিত হওয়ার পর গহীন পাহাড়ে অভিযান চালিয়ে প্রথমে আরসার শীর্ষ সন্ত্রাসী ও কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্পের অন্যতম সামরিক কমান্ডার হাফেজ নুর মোহাম্মদকে আটক করা হয়। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে আরসার অপর পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। উদ্ধার করা হয় অস্ত্র ও গুলি। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আটক সদস্যরা খুন ও অপহরণসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কার্যক্রমে জড়িত থাকার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন।
তিনি জানান, হাফেজ নুর মোহাম্মদের নেতৃত্বে আরসার ৩০ থেকে ৩৫ জন সদস্য কুতুপালং ক্যাম্প ও তার আশপাশের এলাকায় খুন, অপহরণ, ডাকাতি, মাদক, চাঁদাবাজি, আধিপত্য বিস্তারসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছেন। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য তারা প্রতিবেশী দেশ থেকে দুর্গম সীমান্তবর্তী অঞ্চল দিয়ে অস্ত্র চোরাচালান করতেন বলে জানা যায়। হাফেজ নুর মোহাম্মদ তার দলের সদস্যদের মাধ্যমে রোহিঙ্গা ও স্থানীয়দের খুন, অপহরণ ও গুমের ভয় দেখিয়ে চাঁদা দাবি করতেন। চাঁদার অর্থ না পেলে অপহরণ করে শারীরিক নির্যাতন করে মুক্তিপণ আদায় করা হতো। মুক্তিপণ না পেলে তারা খুন করে গহীন পাহাড়ের জঙ্গলে লাশ গুম করতেন বলে জানা যায়।
সংবাদ সম্মেলনে তিনি আরও জানান, হাফেজ নুর মোহাম্মদ ২০১৬ সালে আরসার সদস্য আরিফ উদ্দিনের মাধ্যমে আরসায় যোগদান করেন। নুর মোহাম্মদ কুংফু ও বিস্ফোরক তৈরিতে পারদর্শী। তার নেতৃত্বেই রোহিঙ্গা ক্যাম্পে হেড মাঝি শফি উল্লাহ হত্যাকাণ্ড, সালাম হত্যাকাণ্ড, সলিম হত্যাকাণ্ড, মালেক হত্যাকাণ্ড, হাবুইয়া হত্যাকাণ্ড, ইমান হত্যাকাণ্ড, আবুল মুনসুর হত্যাকাণ্ড, সালেহ হত্যাকাণ্ড, জোরপূর্বক এক নারীর ঘরে প্রবেশের সময় বাধা দিলে তাকে গুলি করে হত্যা এবং সাম্প্রতিক সময়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আলোচিত ছয়জন হত্যাসহ বিভিন্ন হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত থাকার তথ্য মিলেছে।
এছাড়া মো. হোসেন জোহার হেডমাঝি আবু তালেবকে গুলি করে হত্যা, সাব মাঝি সৈয়দ হোছেনকে গুলি করে চোখ উপড়ে ফেলে হত্যা ও শফিকুর রহমানকে গুলি করে হত্যার প্রধান সহযোগী হিসেবে জড়িত ছিলেন। ফারুক হারেস আরসার প্রহরী দলের প্রধান সমন্বয়কারী এবং টর্চার সেলের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। তার ৭-৮ জনের একটি ‘নেট গ্রুপ’ রয়েছে যারা নিয়মিত ক্যাম্পের প্রহরীর দায়িত্ব পালন করতেন এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অবস্থান পর্যবেক্ষণ করে শীর্ষ স্থানীয় নেতাদের কাছে রিপোর্ট দিতেন। মনির আহাম্মদ, নূর ইসলাম এবং ইয়াছিন পাহাড়ে অবস্থিত গোপন আরসা ঘাঁটির নিরাপত্তা প্রহরীর দায়িত্ব পালন করতেন যেখানে অপহরণ করে নির্যাতন ও মুক্তিপণ আদায় করা হতো।
এ ঘটনায় মামলা দিয়ে আটকদের টেকনাফ থানায় সোপর্দ করা হয়েছে বলেও জানান র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
তিনি জানান, ক্যাম্পে আরসার সাড়ে চারশত সন্ত্রাসী সক্রিয় রয়েছে। এদের আটক করতে র্যাবের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।