ঢাকা ০১:৫৩ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

প্রধানমন্ত্রীর বৈঠক ও প্রত্যাশা শ্রমিকদের সাথে

চা শ্রমিকদের জীবন যাপন সম্পর্কে খুব একটা ধারণা ছিল না। কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরে চা শ্রমিকদের টানা ধর্মঘটের ফলে নানা বিষয় জানতে পারি। দেশ যখন এগিয়ে যাচ্ছে, উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে সব স্থানে। সে সময় চা শ্রমিকরা তাদের দৈনিক ভাতা পায় মাত্র ১২০ টাকা। যা এককথায় অমানবিক। ব্রিটিশ আমল পেরিয়ে পাকিস্তান, তারপর আমাদের প্রিয় এই ভূমির স্বাধীনতার এত বছর পরও চা-বাগানের শ্রমিকদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়নি।

সবচেয়ে করুণ যে বিষয়টি দৃষ্টিগোচর হয়েছে তা হলো শ্রমিকরা যাতে উন্নয়নের ছোঁয়া থেকে বঞ্চিত হয়, নিজের অধিকার থেকে সোচ্চার হতে না পারে, মৌলিক অধিকার সম্পর্কে দাবি তুলতে না পারে, সেজন্য ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে। এভাবেই প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম, টিকে আছে, উৎপাদন ধরে রেখেছেন আর সে চা সারাবিশ্বে বাংলাদেশের সুনাম অক্ষুণ্ন রেখে চলেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই চা শ্রমিকদের উন্নয়নের বিষয়টি গুরুত্বসহ বিবেচনা করবেন। বঙ্গবন্ধু চা শ্রমিকদের শ্রমকল্যাণ যেমন-বিনামূল্যে বাসস্থান, সুপেয় পানি সরবরাহ, বেবি কেয়ার সেন্টার, প্রাথমিক শিক্ষা এবং রেশন প্রাপ্তি নিশ্চিত করেন, সেটি যাতে সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হয়ে সেদিকে নজর দিতে হবে।

দেশের প্রায় ২৪১টি চা বাগানে ধর্মঘট শুরু হয় গত ৯ আগস্ট থেকে। দেড় লাখের বেশি শ্রমিক তাদের কাজ থেকে বিরত থাকেন। বিভিন্ন পত্রিকা কিংবা সোশ্যাল মিডিয়া তাদের বেতন-ভাতা নিয়ে বিস্তর লেখালেখি করছে। দৈনিক মাত্র ১২০ টাকা দিয়ে এই সময়ে জীবনযাত্রা কতটা কঠিন তা শুধু ভুক্তভোগীরাই জানে। পরিবারের সদস্যদের ভরণপোষণ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় কতটা কঠিন, তা কঠিন বাস্তবতায় নিমজ্জিত না হলে হয়তো কারও পক্ষেই অনুধাবন করা কঠিন। জানা যায়, চা বাগানগুলোতে এ, বি এবং সি এই ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়। এ শ্রেণির চা বাগানেই দিনে সর্বোচ্চ মজুরি ১২০ টাকা। অন্যরা পান আরও কম। প্রতি দুই বছর পর পর তাদের মজুরি বাড়ানোর কথা থাকলেও ২০১৮ সালের পর আর মজুরি বৃদ্ধি করা হয়নি। মজুরির বাইরে শ্রমিকরা সপ্তাহে তিন কেজি আটা পান, দুই টাকা কেজি দরে।

এছাড়া তাদের চিকিৎসা ও আবাসন সুবিধা দেওয়ার কথা। একই সঙ্গে সন্তানদের শিক্ষা সুবিধা থাকার কথা। ‘বি’ শ্রেণির বাগানের জন্য মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে ১১৮ টাকা। আর ১১৭ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে ‘সি’ শ্রেণির বাগানের জন্য। একটি বাগানের উৎপাদন ক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে সেগুলোর শ্রেণি নির্ধারণ করা হয়। প্রতিটি বাগানে স্থায়ী শ্রমিকের অর্ধেক অস্থায়ী শ্রমিক থাকেন। তাদের বেতন আরও অনেক কম। তাদের জন্য নেই উৎসব ভাতা ও রেশন। একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন তাদের দাবি আদায়ে যথেষ্ট শক্তিশালী নয়। মালিক ও শ্রমিকের মধ্যকার সম্পর্ক উন্নয়নে এরা বেশ পিছিয়ে। নিজেদের অধিকারের ক্ষেত্রে শক্তিশালী অবস্থা নিতে পারে না। এর কারণ হিসেবে বলা হয় চা-শ্রমিকের বেশিরভাগই অবাঙালি, নিম্নবর্ণের হিন্দু ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর। মূল ধারার জনগোষ্ঠীর থেকে তারা অনেক পিছিয়ে ও বিচ্ছিন্ন।

একথা বলা যায়, চা-শ্রমিকরা অনেকটাই গণ্ডির মধ্যেই থাকে। চা বাগানের বাইরে এরা খুবই বের হয় না, তাই সামগ্রিক বিষয়গুলো থেকে এরা বাইরে থাকে। বলা যায় সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠী। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সাক্ষী আমাদের দেশের চা বাগান। ১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল হবিগঞ্জের তেলিয়াপাড়া চা বাগানের বাংলোটিতে দেশ স্বাধীন করার জন্য ঐতিহাসিক এক শপথ অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ ২৭ জন সেনা কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। এ বৈঠকেই সমগ্র রণাঙ্গনকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করেন মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল আতাউল গণি ওসমানী। তেলিয়াপাড়া চা বাগান ব্যবস্থাপকের বাংলোটিকে ৩ নম্বর সেক্টরের কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বৈঠক শেষে এম.এ.জি ওসমানী নিজের পিস্তলের ফাঁকা গুলি ছুঁড়ে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণের শপথ করেন। বাংলোর সামনে একটি বুলেট স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে।

মহান স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত এই বাগানগুলোকে রক্ষা ও বাগানের শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায় সারাবিশ্বে মানবতা ও মানবিকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চা শ্রমিকদের সাথে আজ বিকালে বৈঠকে বসবেন বলে খবরে প্রকাশ। চা শিল্পকে রক্ষা ও শ্রমিকদের মানবিক দিক বিবেচনা করে নিচের বিষয়গুলো বিবেচনা করা প্রয়োজন। শ্রমিকদের অধিকার, মর্যাদা ও সুবিধা বৃদ্ধি করার বিষয়টি সবার আগে বিবেচনায় নিতে হবে। বাংলাদেশে শ্রম আইন একটি অতি প্রয়োজনীয় হলেও চা শিল্পের শ্রমিকের ক্ষেত্রে শ্রম আইন ব্যবহার হয়না, এই আইনের সকল সুবিধা যাতে শ্রমিকরা পায় তা নিশ্চিত করতে হবে।

চা বাগানের মধ্যে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে প্রয়োজনীয় বিদ্যালয় স্থাপন করতে হবে। যাতে কোনও বাধ্যতামূলক শিক্ষার বিষয়টি বাগানের মধ্যেও প্রযোজ্য হয়। শিশু ও তাদের পরিবকারকে শিক্ষার প্রতি মনোযোগী করার জন্য প্রয়োজনে বিভিন্ন প্রণোদনার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। অন্যদিকে যাতে শিশুর ঝরে না পড়ে সে বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। বাগানের সকল শ্রমিক যাতে সমপরিমাণ বেতন ভাতা ও সুবিধা পায়, সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। নারী ও পুরুষের মধ্যে সুবিধাদি বিষয়ে বৈষম্যের বিষয়টি যাতে না ঘটে, সে বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে। শ্রমিকদের জীবন মান উন্নয়নে বহুমূখী কর্মকান্ড হাতে নিতে হবে। দেশের বিভিন্ন বেসরকারী সংস্থার পাশাপাশি বিদেশি সংস্থাসমূহকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে যাতে তারা এসব সুবিধাবঞ্চিত শ্রমিকদের জন্য নানাবিদ প্রকল্প হাতে নেয়। এক্ষেত্রে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কার্ালয়ের অধীন এনজিও বিষয়ক ব্যুরো পদক্ষেপ নিতে পারে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়সহ অন্যান্য সরকারি বিভাগ কিংবা অধিদপ্তর এসব প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর পাশে দাঁড়াতে পারে।

শ্রমিকদের এই আন্দোলনে যাতে কোনও শ্রমিক ক্ষতিগ্রস্ত না হয় কিংবা চাকরি থেকে বরখাস্ত করা না হয়, সেবিষয়টি মালিকপক্ষের সাথে আলোচনায় নিশ্চিত করতে হবে। শ্রম আইন অনুযায়ী, বাসস্থান ও স্বাস্থ্য সবিধা নিশ্চিতে প্রয়োজন সঠিক ব্যবস্থাপনা, এক্ষেত্রে মালিক পক্ষের সাথে সরকারি সেবা প্রতিষ্ঠানগুলো সমন্বয়ের সাথে কাজ করতে পারে। আইন অনুযায়ী সবেতনে সাপ্তাহিক ছুটি, যথাসময়ে বকেয়া বেতন পরিশোধ ও ওভারটাইমের টাকা প্রদানে মালিকপ্রক্ষের প্রতিশ্রুতি আদায় করতে হবে। যা না মালনে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। শ্রমিকদের সচেতন করার লক্ষে নানাবিধ প্রশিক্ষণ ও সচেতনতার বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে, যাতে তার এই কাজের পাশাপাশি জীবনমুখী বিভিন্ন কাজের সাথে পরিচিতি লাভ করতে পারে এবং সম্পৃক্ত হতে পারে।

চা শিল্পকে বাঁচাতে হবে। চা শিল্পের সাথে সম্পৃক্ত শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে নিতে হবে সঠিক পদক্ষেপ। বর্তমান সরকারের উন্নয়নের ছোঁয়া থেকে যেন একজন চা শ্রমিকও বঞ্চিত না হয়, সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৪ জুন ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দ হতে ২৩ অক্টোবর ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রথম বাঙালি হিসাবে চা বোর্ডের চেয়ারম্যান পদে অধিষ্ঠিত থেকে বাঙালি জাতিকে যেভাবে সম্মানিত করেছিলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই চা শ্রমিকদের উন্নয়নের বিষয়টি গুরুত্বসহ বিবেচনা করবেন। বঙ্গবন্ধু চা শ্রমিকদের শ্রমকল্যাণ যেমন-বিনামূল্যে বাসস্থান, সুপেয় পানি সরবরাহ, বেবি কেয়ার সেন্টার, প্রাথমিক শিক্ষা এবং রেশন প্রাপ্তি নিশ্চিত করেন, সেটি যাতে সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হয়ে সেদিকে নজর দিতে হবে।

Tag :

আপনার মতামত লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল ও অন্যান্য তথ্য সঞ্চয় করে রাখুন

জনপ্রিয় সংবাদ

প্রধানমন্ত্রীর বৈঠক ও প্রত্যাশা শ্রমিকদের সাথে

আপডেট সময় ০৩:১০:৫৯ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৭ অগাস্ট ২০২২

চা শ্রমিকদের জীবন যাপন সম্পর্কে খুব একটা ধারণা ছিল না। কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরে চা শ্রমিকদের টানা ধর্মঘটের ফলে নানা বিষয় জানতে পারি। দেশ যখন এগিয়ে যাচ্ছে, উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে সব স্থানে। সে সময় চা শ্রমিকরা তাদের দৈনিক ভাতা পায় মাত্র ১২০ টাকা। যা এককথায় অমানবিক। ব্রিটিশ আমল পেরিয়ে পাকিস্তান, তারপর আমাদের প্রিয় এই ভূমির স্বাধীনতার এত বছর পরও চা-বাগানের শ্রমিকদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়নি।

সবচেয়ে করুণ যে বিষয়টি দৃষ্টিগোচর হয়েছে তা হলো শ্রমিকরা যাতে উন্নয়নের ছোঁয়া থেকে বঞ্চিত হয়, নিজের অধিকার থেকে সোচ্চার হতে না পারে, মৌলিক অধিকার সম্পর্কে দাবি তুলতে না পারে, সেজন্য ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে। এভাবেই প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম, টিকে আছে, উৎপাদন ধরে রেখেছেন আর সে চা সারাবিশ্বে বাংলাদেশের সুনাম অক্ষুণ্ন রেখে চলেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই চা শ্রমিকদের উন্নয়নের বিষয়টি গুরুত্বসহ বিবেচনা করবেন। বঙ্গবন্ধু চা শ্রমিকদের শ্রমকল্যাণ যেমন-বিনামূল্যে বাসস্থান, সুপেয় পানি সরবরাহ, বেবি কেয়ার সেন্টার, প্রাথমিক শিক্ষা এবং রেশন প্রাপ্তি নিশ্চিত করেন, সেটি যাতে সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হয়ে সেদিকে নজর দিতে হবে।

দেশের প্রায় ২৪১টি চা বাগানে ধর্মঘট শুরু হয় গত ৯ আগস্ট থেকে। দেড় লাখের বেশি শ্রমিক তাদের কাজ থেকে বিরত থাকেন। বিভিন্ন পত্রিকা কিংবা সোশ্যাল মিডিয়া তাদের বেতন-ভাতা নিয়ে বিস্তর লেখালেখি করছে। দৈনিক মাত্র ১২০ টাকা দিয়ে এই সময়ে জীবনযাত্রা কতটা কঠিন তা শুধু ভুক্তভোগীরাই জানে। পরিবারের সদস্যদের ভরণপোষণ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় কতটা কঠিন, তা কঠিন বাস্তবতায় নিমজ্জিত না হলে হয়তো কারও পক্ষেই অনুধাবন করা কঠিন। জানা যায়, চা বাগানগুলোতে এ, বি এবং সি এই ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়। এ শ্রেণির চা বাগানেই দিনে সর্বোচ্চ মজুরি ১২০ টাকা। অন্যরা পান আরও কম। প্রতি দুই বছর পর পর তাদের মজুরি বাড়ানোর কথা থাকলেও ২০১৮ সালের পর আর মজুরি বৃদ্ধি করা হয়নি। মজুরির বাইরে শ্রমিকরা সপ্তাহে তিন কেজি আটা পান, দুই টাকা কেজি দরে।

এছাড়া তাদের চিকিৎসা ও আবাসন সুবিধা দেওয়ার কথা। একই সঙ্গে সন্তানদের শিক্ষা সুবিধা থাকার কথা। ‘বি’ শ্রেণির বাগানের জন্য মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে ১১৮ টাকা। আর ১১৭ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে ‘সি’ শ্রেণির বাগানের জন্য। একটি বাগানের উৎপাদন ক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে সেগুলোর শ্রেণি নির্ধারণ করা হয়। প্রতিটি বাগানে স্থায়ী শ্রমিকের অর্ধেক অস্থায়ী শ্রমিক থাকেন। তাদের বেতন আরও অনেক কম। তাদের জন্য নেই উৎসব ভাতা ও রেশন। একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন তাদের দাবি আদায়ে যথেষ্ট শক্তিশালী নয়। মালিক ও শ্রমিকের মধ্যকার সম্পর্ক উন্নয়নে এরা বেশ পিছিয়ে। নিজেদের অধিকারের ক্ষেত্রে শক্তিশালী অবস্থা নিতে পারে না। এর কারণ হিসেবে বলা হয় চা-শ্রমিকের বেশিরভাগই অবাঙালি, নিম্নবর্ণের হিন্দু ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর। মূল ধারার জনগোষ্ঠীর থেকে তারা অনেক পিছিয়ে ও বিচ্ছিন্ন।

একথা বলা যায়, চা-শ্রমিকরা অনেকটাই গণ্ডির মধ্যেই থাকে। চা বাগানের বাইরে এরা খুবই বের হয় না, তাই সামগ্রিক বিষয়গুলো থেকে এরা বাইরে থাকে। বলা যায় সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠী। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সাক্ষী আমাদের দেশের চা বাগান। ১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল হবিগঞ্জের তেলিয়াপাড়া চা বাগানের বাংলোটিতে দেশ স্বাধীন করার জন্য ঐতিহাসিক এক শপথ অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ ২৭ জন সেনা কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। এ বৈঠকেই সমগ্র রণাঙ্গনকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করেন মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল আতাউল গণি ওসমানী। তেলিয়াপাড়া চা বাগান ব্যবস্থাপকের বাংলোটিকে ৩ নম্বর সেক্টরের কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বৈঠক শেষে এম.এ.জি ওসমানী নিজের পিস্তলের ফাঁকা গুলি ছুঁড়ে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণের শপথ করেন। বাংলোর সামনে একটি বুলেট স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে।

মহান স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত এই বাগানগুলোকে রক্ষা ও বাগানের শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায় সারাবিশ্বে মানবতা ও মানবিকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চা শ্রমিকদের সাথে আজ বিকালে বৈঠকে বসবেন বলে খবরে প্রকাশ। চা শিল্পকে রক্ষা ও শ্রমিকদের মানবিক দিক বিবেচনা করে নিচের বিষয়গুলো বিবেচনা করা প্রয়োজন। শ্রমিকদের অধিকার, মর্যাদা ও সুবিধা বৃদ্ধি করার বিষয়টি সবার আগে বিবেচনায় নিতে হবে। বাংলাদেশে শ্রম আইন একটি অতি প্রয়োজনীয় হলেও চা শিল্পের শ্রমিকের ক্ষেত্রে শ্রম আইন ব্যবহার হয়না, এই আইনের সকল সুবিধা যাতে শ্রমিকরা পায় তা নিশ্চিত করতে হবে।

চা বাগানের মধ্যে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে প্রয়োজনীয় বিদ্যালয় স্থাপন করতে হবে। যাতে কোনও বাধ্যতামূলক শিক্ষার বিষয়টি বাগানের মধ্যেও প্রযোজ্য হয়। শিশু ও তাদের পরিবকারকে শিক্ষার প্রতি মনোযোগী করার জন্য প্রয়োজনে বিভিন্ন প্রণোদনার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। অন্যদিকে যাতে শিশুর ঝরে না পড়ে সে বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। বাগানের সকল শ্রমিক যাতে সমপরিমাণ বেতন ভাতা ও সুবিধা পায়, সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। নারী ও পুরুষের মধ্যে সুবিধাদি বিষয়ে বৈষম্যের বিষয়টি যাতে না ঘটে, সে বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে। শ্রমিকদের জীবন মান উন্নয়নে বহুমূখী কর্মকান্ড হাতে নিতে হবে। দেশের বিভিন্ন বেসরকারী সংস্থার পাশাপাশি বিদেশি সংস্থাসমূহকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে যাতে তারা এসব সুবিধাবঞ্চিত শ্রমিকদের জন্য নানাবিদ প্রকল্প হাতে নেয়। এক্ষেত্রে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কার্ালয়ের অধীন এনজিও বিষয়ক ব্যুরো পদক্ষেপ নিতে পারে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়সহ অন্যান্য সরকারি বিভাগ কিংবা অধিদপ্তর এসব প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর পাশে দাঁড়াতে পারে।

শ্রমিকদের এই আন্দোলনে যাতে কোনও শ্রমিক ক্ষতিগ্রস্ত না হয় কিংবা চাকরি থেকে বরখাস্ত করা না হয়, সেবিষয়টি মালিকপক্ষের সাথে আলোচনায় নিশ্চিত করতে হবে। শ্রম আইন অনুযায়ী, বাসস্থান ও স্বাস্থ্য সবিধা নিশ্চিতে প্রয়োজন সঠিক ব্যবস্থাপনা, এক্ষেত্রে মালিক পক্ষের সাথে সরকারি সেবা প্রতিষ্ঠানগুলো সমন্বয়ের সাথে কাজ করতে পারে। আইন অনুযায়ী সবেতনে সাপ্তাহিক ছুটি, যথাসময়ে বকেয়া বেতন পরিশোধ ও ওভারটাইমের টাকা প্রদানে মালিকপ্রক্ষের প্রতিশ্রুতি আদায় করতে হবে। যা না মালনে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। শ্রমিকদের সচেতন করার লক্ষে নানাবিধ প্রশিক্ষণ ও সচেতনতার বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে, যাতে তার এই কাজের পাশাপাশি জীবনমুখী বিভিন্ন কাজের সাথে পরিচিতি লাভ করতে পারে এবং সম্পৃক্ত হতে পারে।

চা শিল্পকে বাঁচাতে হবে। চা শিল্পের সাথে সম্পৃক্ত শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে নিতে হবে সঠিক পদক্ষেপ। বর্তমান সরকারের উন্নয়নের ছোঁয়া থেকে যেন একজন চা শ্রমিকও বঞ্চিত না হয়, সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৪ জুন ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দ হতে ২৩ অক্টোবর ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রথম বাঙালি হিসাবে চা বোর্ডের চেয়ারম্যান পদে অধিষ্ঠিত থেকে বাঙালি জাতিকে যেভাবে সম্মানিত করেছিলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই চা শ্রমিকদের উন্নয়নের বিষয়টি গুরুত্বসহ বিবেচনা করবেন। বঙ্গবন্ধু চা শ্রমিকদের শ্রমকল্যাণ যেমন-বিনামূল্যে বাসস্থান, সুপেয় পানি সরবরাহ, বেবি কেয়ার সেন্টার, প্রাথমিক শিক্ষা এবং রেশন প্রাপ্তি নিশ্চিত করেন, সেটি যাতে সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হয়ে সেদিকে নজর দিতে হবে।