যান্ত্রিকতা, দূষণ আর কোলাহলময় রাজধানী ঢাকার রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করছে আশপাশের জেলাগুলোর সবুজ প্রকৃতি। এর মধ্যে প্রাকৃতিকভাবে সবচেয়ে বেশি সমৃদ্ধ গাজীপুর। ঢাকাসহ আশপাশের অক্সিজেন আর ভূগর্ভস্থ পানির অন্যতম জোগানদাতা জল-সবুজে ঘেরা ভাওয়াল অঞ্চল হিসেবে পরিচিত প্রাচীন জনপদ গাজীপুর। জল আর বনের আধিক্যেও গাজীপুর ছিল সুস্থ প্রকৃতি ও সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্যের এক দারুণ উদাহরণ। পূর্ণ গাজীপুর থেকে আজ এসব হারিয়ে যাচ্ছে অপরিকল্পিত নগরায়ণ, দখল ও দূষণে।
গাজীপুরে প্রতিনিয়ত নদী তথা পরিবেশ দূষণ করে যাচ্ছে ইটিপিবিহীন কল-কারখানাগুলো। এসব কারখানার বিরুদ্ধে পরিবেশ অধিদপ্তর বারবার অভিযান চালিয়েও তাদেরকে ইটিপি ব্যবহারে বাধ্য করতে পারছে না। ফলে দূষণও রোধ হচ্ছে না। নদী দূষণের কারণে শুষ্ক মৌসুমে গাজীপুরের নদ-নদী ও খাল-বিলের পানি কুচকুচে কালো রঙ ধারণ করে, এমনকি এখন এই বৃষ্টির মৌসুমেও পানির রঙ কালোই থাকছে। এতটাই দূষিত হয়ে গেছে খাল-বিল, নদ-নদীর পানি। গাজীপুর মহানগরীর কোনাবাড়ি, কাশিমপুর, বাসন, ইসলামপুর ভাঙা ব্রিজ সংলগ্ন বিল ও বেলাই বিলসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এমন দৃশ্যই চোখে পড়ে।
গাজীপুর পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, গাজীপুরে বেশ কিছু কারখানা রয়েছে যেগুলোতে ইটিপি থাকার প্রয়োজন সত্ত্বেও তা নেই। এ ধরনের অন্তত ৩০টি কারখানাকে চিহ্নিত করা হয়েছে। ইতোমধ্যেই এসব কারখানাকে এনফোর্সমেন্ট কার্যক্রমের মাধ্যমে একাধিকবার জরিমানা আদায় করা হয়েছে। স্থানীয়রা জানিয়েছে, ইটিপি আছে কিন্তু সঠিকভাবে ইটিপি ব্যবহার করা হচ্ছে না অনেক কারখানায়। আবার ইটিপি থাকলেও খরচ বাঁচানোর জন্য ব্যবহার করছে না অনেকে। কারখানাগুলো তাদের দূষিত পানি ইটিপি ব্যবহার না করে বাইপাসের মাধ্যমে সেই পানি নদী ও জলাশয়ে ফেলছে। এসব কারখানার পানি যে স্থান দিয়ে বের হয়ে খাল বা জলাশয়ে পড়েছে সে স্থানটি দেখলে সহজেই বোঝা যাবে কোন কারখানার দূষিত পানি ইটিপি ছাড়া সরাসরি নদী ও জলাশয়ে পড়েছে।
মহানগরীর কোনাবাড়ি, কাশিমপুর ও টঙ্গী এলাকায় তুরাগ নদীর তীরে গড়ে উঠেছে অসংখ্য কারখানাসহ নানা প্রকার ছোট-বড় শত শত পোশাক শিল্প সংশ্লিষ্ট কারখানা। ইসলামপুর এলাকার কয়েকজন বাসিন্দা জানাব, এসব কারখানার মধ্যে কিছু বড় কারখানায় পানি বিশুদ্ধ করার জন্য ইটিপি থাকলেও বর্ষায় এসব ইটিপি তেমন একটা ব্যবহার করা হয় না। কারখানার দূষিত ও বিষাক্ত পানি সরাসরি ফেলা হচ্ছে তুরাগ নদীতে। এতে নদী দূষণ ছাড়াও নানা প্রজাতির দেশীয় মাছের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। কতৃপক্ষের নজরদারি না থাকায় এমনটা হচ্ছে বলে দাবি তাদের।
একই অবস্থা জেলা শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া চিলাই নদীরও। এটিও প্রতিনিয়ত দখল দূষণে তার অস্তিত্ব হারাতে বসেছে। কারখানার বর্জ্য এবং শহরের ময়লা-আবর্জনা নদীর পানিতে মিশে পানিকে দূষিত করে তুলছে।
স্থানীয় সচেতন নাগরিকরা বলছেন, গত কয়েক বছরে তুরাগ নদীর তীরের বিভিন্ন জায়গা অবৈধ দখলমুক্ত করা হলেও দূষণের মাত্রা কমেনি। একটা সময় শিল্প স্থাপন করাটাই গুরুত্ব পেয়েছিল বেশি, কিন্তু পরিবেশের দিকটি বিবেচনা করা হয়নি। এখন সময় এসেছে নদী খাল-বিল ও জলাশয়ের পরিবেশ রক্ষায় ব্যবস্থা গ্রহণের।
গাজীপুর পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক জানান, ইটিপিবিহীন কারখানাগুলোকে দ্রুত ইটিপি স্থাপনের নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। অন্যথায় তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আর যাদের ইটিপি থাকার পরও তা সঠিকভাবে ব্যবহার করছেন না বলে অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধেও অভিযান অব্যাহত থাকবে এবং আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি জানান, কারখানাগুলো যাতে নিয়মিত বর্জ্য পরিশোধন করে সেটি তারা তদারকি করছেন। বর্তমানে ইটিপি ছাড়া কোনো কারখানাকে অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে না। তবে নদী দূষণের জন্য শুধু কারখানার বর্জ্য দায়ী নয়। এর পাশাপাশি পয়ঃবর্জ্যও এসে নদীতে পড়ছে। পয়ঃবর্জ্য পরিশোধনেরও ব্যবস্থা নিতে হবে।