ঢাকা মহানগরীতে ওএমএস (ওপেন মার্কেট সেল) ডিলার নিয়োগে এক চাঞ্চল্যকর অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। রাজধানীর রেশনিং কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলমের নেতৃত্বে এই নিয়োগ প্রক্রিয়া প্রভাবিত ও অস্বচ্ছভাবে সম্পন্ন হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন বঞ্চিত ডিলাররা। তাঁরা দাবি করছেন, লটারির নামে যা অনুষ্ঠিত হয়েছে, তা আসলে ছিল একটি সাজানো নাটক-যেখানে নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের জন্য আগেই ফল নির্ধারিত ছিল।
খাদ্য অধিদপ্তরের রেশনিং দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরেই অভিযোগ রয়েছে। ডিলারদের অভিযোগ, তিনি ও তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা রাজনৈতিক প্রভাব ও ঘুষের বিনিময়ে ডিলার নিয়োগে মনোনয়ন নিশ্চিত করেন।
বঞ্চিত একাধিক ডিলার জানান, জাহাঙ্গীর আলম নিজেকে “সরকারঘনিষ্ঠ” পরিচয়ে প্রভাব বিস্তার করেন এবং যাদের তিনি পছন্দ করেননি, তাদের তালিকাভুক্তই করা হয়নি।
একজন ডিলার ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “এই কর্মকর্তার অনুমতি ছাড়া ওএমএস-এর কিছুই হয় না। তিনি কাকে ডাকবেন, কাকে বাদ দেবেন-সব ঠিক করেন নিজের মতো করে। নীতিমালা এখানে কেবল কাগজে আছে।”
লটারির নামে প্রহসন : ভুক্তভোগীদের ভাষ্য, গত ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫ সকালে রাজধানীর রমনা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে আয়োজিত ওএমএস ডিলার নিয়োগ লটারি ছিল সম্পূর্ণ অস্বচ্ছ ও বৈষম্যমূলক।
ডিলারদের অভিযোগ লটারির আগে কোনো লিখিত নোটিশ, পত্রিকা বিজ্ঞপ্তি বা নোটিশ বোর্ডে ঘোষণা দেওয়া হয়নি। পরিবর্তে, কেবলমাত্র জাহাঙ্গীর আলমের ঘনিষ্ঠদের এসএমএস পাঠিয়ে আমন্ত্রণ জানানো হয়, যা প্রবেশের গেটপাস হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ফলে, অধিকাংশ আবেদনকারী লটারির দিন উপস্থিত হতে পারেননি। অথচ উপস্থিত ডিলারদের অধিকাংশই ‘নির্বাচিত’ হন। “এসএমএস না পেলে ঢুকতেই দেওয়া হয়নি। অথচ যাদের আগে থেকেই নাম ঠিক করা ছিল, তারাই নির্বাচিত হয়েছেন” বলেন এক বঞ্চিত আবেদনকারী।
ওএমএস নীতিমালা ২০২৪ অনুসারে, পূর্বের ডিলারদের বৈধ কারণ ছাড়া বাদ দেওয়া যায় না। কিন্তু এবার অনেক পুরনো ও সৎ ডিলারকে বাদ দিয়ে নতুন ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। তারা দাবি করেন, “দোষী প্রমাণ ছাড়া বাদ দেওয়ার মাধ্যমে নীতিমালা স্পষ্টভাবে লঙ্ঘন করা হয়েছে।”
খাদ্য অধিদপ্তরের অভ্যন্তরীণ এক সূত্র জানায়, ডিলারশিপ পেতে প্রতি আসনে ২ থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ নেওয়া হয়েছে বলে গোপনে অভিযোগ জমা পড়েছে। অভিযোগে বলা হয়, এই টাকার বড় অংশ গেছে রেশনিং কর্মকর্তার ঘনিষ্ঠ মহলে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মকর্তা বলেন, “আমরা প্রাথমিকভাবে দেখেছি কিছু আবেদনকারীর ফাইল পর্যালোচনার আগেই অনুমোদন হয়ে গেছে। এর পেছনে কারা আছেন, তা তদন্তেই পরিষ্কার হবে।”
ডিলাররা দাবি করছেন ২৯ সেপ্টেম্বরের লটারি বাতিল করে পুনঃনিয়োগ প্রক্রিয়া স্বচ্ছভাবে সম্পন্ন করতে হবে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সম্পদের হিসাব যাচাই ও তদারকি বাড়াতে হবে। ভিডিও নজরদারিতে ওএমএস বিক্রয় কার্যক্রম পরিচালনা বাধ্যতামূলক করতে হবে। কালোবাজারি ও অনিয়মে জড়িতদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
সূত্র জানায়, বঞ্চিত ডিলাররা এখন সংগঠিত হচ্ছেন। তারা জানিয়েছেন, “যদি আমাদের দাবি পূরণ না হয়, তবে আমরা ঢাকায় বৃহত্তর আন্দোলনের কর্মসূচি দেব।” এই অভিযোগ নিয়ে তারা খাদ্য অধিদপ্তর, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এবং প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দপ্তরে অভিযোগপত্র পাঠিয়েছেন। তাঁরা প্রধান উপদেষ্টার সরাসরি হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
সব অভিযোগ সত্ত্বেও এখনো পর্যন্ত খাদ্য অধিদপ্তর বা রেশনিং দপ্তরের পক্ষ থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক তদন্ত ঘোষণা করা হয়নি। এ নিয়ে কর্মকর্তাদের একাংশের মন্তব্য, “বিষয়টি রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর। ঊর্ধ্বতন অনুমতি ছাড়া কেউ মুখ খুলতে পারছেন না।”
ঢাকা মহানগরীর ওএমএস ডিলার নিয়োগে এ ধরনের অনিয়ম শুধু প্রশাসনিক অদক্ষতা নয়, বরং সাধারণ মানুষের জন্য বরাদ্দকৃত খাদ্যপণ্য বিতরণ ব্যবস্থার প্রতি আস্থা নষ্ট করছে। যতক্ষণ পর্যন্ত জাহাঙ্গীর আলমের মতো কর্মকর্তারা “প্রভাবশালী” পরিচয়ে দায়মুক্ত থাকবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত স্বচ্ছ নিয়োগ ও সুষ্ঠু বাজারব্যবস্থা কেবল কাগজে থাকবে-বাস্তবে নয়।
সংবাদ শিরোনাম ::
ঢাকা রেশনিং দপ্তরে ঘুষ-বাণিজ্য, সাজানো লটারি ও বৈষম্যের অভিযোগ
ওএমএস ডিলার নিয়োগে অনিয়মের হোতা জাহাঙ্গীর আলম
-
নিজস্ব প্রতিবেদক - আপডেট সময় ০৪:৪১:০০ অপরাহ্ন, রবিবার, ৫ অক্টোবর ২০২৫
- ৭৪৫ বার পড়া হয়েছে
Tag :
জনপ্রিয় সংবাদ























