সার্বিক পরিস্থিতিতে ২০২৫ সালেই নির্বাচন আদায়ে সরকারের ওপর চাপ অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এক মাস ধরে রোডম্যাপের দাবিতে সোচ্চার থাকা বিএনপি। এ লক্ষ্যে এবার জনসম্পৃক্ত কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামার চিন্তাভাবনা করছে দলটি। এ লক্ষ্যে শরিকদের সঙ্গে বৈঠক শুরু করেছে বিএনপি। তবে দিনক্ষণ এখনো চূড়ান্ত না হলেও আগামী ফেব্রুয়ারি নাগাদ সারা দেশে বড় বড় সভা-সমাবেশ করা হতে পারে। বিএনপির চিন্তা অনুযায়ী, এ কর্মসূচি একদিকে যেমন নির্বাচনের প্রাক-প্রস্তুতি হিসেবে কাজে লাগানো যাবে, অন্যদিকে জনগণ যে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত, সেটিও তুলে ধরা যাবে। গত বুধবার অনুষ্ঠিত দলটির স্থায়ী কমিটির সর্বশেষ বৈঠকে এমন আলোচনা হয়েছে। বিএনপি এখন রাষ্ট্র মেরামতের দলীয় রূপরেখা ৩১ দফাকে নতুন করে ব্র্যান্ডিংয়ে ব্যস্ত। এ নিয়ে বিভাগীয় প্রশিক্ষণ কর্মশালার পর এখন জেলাভিত্তিক কর্মশালা চলছে। এ কর্মসূচি শেষে নির্বাচন ইস্যুতে দলটি ফোকাস করবে বলে জানা গেছে।
বিজয় দিবসে সম্ভাব্য নির্বাচনের একটি ধারণা দিলেও অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর ‘সুনির্দিষ্ট’ নির্বাচনী রোডম্যাপের চাপ অব্যাহত রয়েছে। ২০২৫ সালেই নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব বলে মনে করে বিএনপি। নির্বাচনমুখী প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য এটিই ‘যৌক্তিক সময়’ বলে মনে করে দলটি। তাদের চাওয়া, ’২৫ সাল যেন অতিক্রম না হয়। শরিকদেরও একই অভিমত। বিএনপি ও শরিকরা মনে করে, নির্বাচন ২০২৬ সালে গেলে সেটি হবে ‘অযৌক্তিক’। এর পেছনে যৌক্তিক কোনো কারণ নেই। সেটা হলে এর মধ্য দিয়ে শুধু সময়ক্ষেপণ হবে—যেটি প্রত্যাশিত নয়। কারণ, দীর্ঘদিন ধরে ভোটাধিকার বঞ্চিত মানুষ এখন ভোট দিতে উন্মুখ। সেজন্য দলগুলো কোনো ধারণা নয়, নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ চায়।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সিনিয়র সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন কালবেলাকে বলেন, আমরা মনে করি, ২০২৫ সালের মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব। সেজন্যই বলছি, ’২৫-এর মধ্যেই নির্বাচন হতে হবে। এখনো সরকার সুনির্দিষ্টভাবে রোডম্যাপ দেয়নি। বিজয় দিবসে প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের সম্ভাব্য একটা ধারণা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে কিংবা ২০২৬ সালের প্রথমার্ধে নির্বাচনের সময় নির্ধারণ করা যায়। সবক্ষেত্রেই আমরা বলছি, যদি সরকার আন্তরিক হয় এবং নির্বাচন কমিশন চায়—এর আগেই নির্বাচন সম্ভব।
নির্বাচন ২০২৬-এ হলে বিএনপির কোনো আপত্তি থাকবে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নির্বাচন যত বিলম্ব হবে, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য তত কঠিন হবে। সেজন্য সরকার তাদের দক্ষতা-ক্ষমতা এবং অন্যান্য বিষয় মিলে যত দ্রুত নির্বাচন দিয়ে জনগণের নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে চলে যেতে পারে, ততই এই সরকার ও দেশের জন্য মঙ্গল। সেজন্যই আমরা নির্বাচনটা ২০২৫-এর মধ্যে করতে চাপ দিচ্ছি।
এদিকে দেশের চলমান রাজনৈতিক ও বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা পর্যালোচনা করে পরবর্তী করণীয় ঠিক করতে শরিকদের সঙ্গে ফের ধারাবাহিক বৈঠক শুরু করেছে বিএনপি। এর অংশ হিসেবে গত শনিবার প্রথম দিনে ১২ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট এবং লেবার পার্টির সঙ্গে পৃথকভাবে বৈঠক করেছে দলটি। এতে দেশের বর্তমান পরিস্থিতির পর্যালোচনা করে দ্রুত নির্বাচনের পক্ষে মত দেন মিত্র দলগুলোর শীর্ষ নেতারা। এ জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে সার্বিক সহযোগিতার ভিত্তিতে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য যা যা করা দরকার, তারা তা করবে বলেও মত দেন নেতারা। তবে সরকারের সঙ্গে তারা কোনো দ্বন্দ্বে যেতে চায় না।
সূত্র জানায়, বৈঠকের শুরুতে আগামী জাতীয় নির্বাচনের সময়সীমা প্রসঙ্গে জোট নেতাদের কাছে মতামত জানতে যায় বিএনপি। তারা নির্বাচনমুখী প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে ২০২৫ সালের মধ্যে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব বলে মত দেন। জোট নেতারা বলেন, এ সময়ের মধ্যে নির্বাচন না হলে দেশে অস্থিরতা বাড়বে, পতিত ফ্যাসিবাদের দোসররা আরও শক্তি সঞ্চয় করে গভীর ষড়যন্ত্র করতে পারে। এতে দেশ ও জাতির বড় ক্ষতি হবে।
জানা গেছে, বৈঠকে ১২ দলীয় জোটের পক্ষ থেকে জানানো হয়, নির্বাচনী রোডম্যাপসহ ইস্যুভিত্তিক নানা কর্মসূচি নিয়ে তারা এরই মধ্যে মাঠে নেমেছে। প্রতি সপ্তাহে তারা ইস্যুভিত্তিক কর্মসূচি পালন করবে। এর অংশ হিসেবে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টে ভারত সরকার ও মিডিয়ার অপপ্রচার এবং ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে গত ১৮ ডিসেম্বর জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশ করা হয়েছে। এ ছাড়া আওয়ামীপন্থি সাবেক কাউন্সিলরদের পুনর্বাসনের ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে আগামী ২৬ ডিসেম্বর সমাবেশ করবে। এরপর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে কর্মসূচি হবে। এসব কর্মসূচি থেকে সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ এবং ২০২৫ সালের মধ্যে নির্বাচনের জোরালো দাবি জানানো হবে। এ ছাড়া রাষ্ট্র মেরামতের ৩১ দফাকেও জনগণের কাছে নিয়ে যাবে ১২ দলীয় জোট।
জানতে চাইলে ১২ দলীয় জোটের সমন্বয়ক ও বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদা বলেন, ১২ দলীয় জোট মনে করে, ২০২৫ সালের জুনের মধ্যেই নির্বাচন সম্ভব। এরই মধ্যে নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে। অনেক সংস্কার কমিশন তাদের প্রস্তাবনা পেশ করেছে। তবে কোনো যৌক্তিক কারণে জুনের মধ্যে সম্ভব না হলে অবশ্যই ২০২৫ সালের মধ্যে নির্বাচন হতে হবে। এই সময়টাকে তারা যৌক্তিক বলে মনে করেন। তারা চান, নির্বাচনমুখী যৌক্তিক সংস্কারগুলো এই সরকার করবে। এ জন্য সরকারকে সুনির্দিষ্টভাবে বলতে হবে যে, তারা এসব সংস্কার করতে চায়। তাই অস্পষ্টতা না রেখে সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা করতে হবে।
বিএনপির সঙ্গে বৈঠকে নির্বাচন ইস্যুতে সরকারের ওপর চাপ অব্যাহত রাখতে সভা-সমাবেশ, লিফলেট বিতরণ, প্রধান উপদেষ্টাকে স্মারকলিপি প্রদানের প্রস্তাবনা দিয়েছে জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট। যেখানে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির দাবিও জানানো হবে। এ ছাড়া ৩১ দফাকে ব্যাপকভাবে মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথাও বলেছে তারা।
জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের সমন্বয়ক ও এনপিপির চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফারহাদ বলেন, তারা ২০২৫ সালের অক্টোবরের মধ্যে নির্বাচন চান। তারা মনে করেন, সব সংস্কার এই সরকারের পক্ষে করা সম্ভব নয়। নির্বাচনমুখী প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে ওই সময়ের মধ্যে নির্বাচন হতে হবে এবং এটি যৌক্তিক সময়।