ঢাকা ০৯:০৬ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ০৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ইউক্রেনে যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ‘অকুণ্ঠ সমর্থন’ অব্যাহত রাখবেন কি ট্রাম্প?

মার্কিন নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প আবারও প্রেসিডেন্ট পদে জয়লাভ করায় ইউক্রেন যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করতে পারে। গত আড়াই বছর ধরে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনকে অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়ে আসছেন জো বাইডেনের নেতৃত্বাধীন বর্তমান মার্কিন প্রশাসন।

ট্রাম্পের পররাষ্ট্র নীতির অবস্থান এবং অতীতের কর্মকাণ্ডের কয়েকটি মূল দিক, ইউক্রেন বিষয়ে তার অবস্থান কী হতে পারে তা নিয়ে এখন জোরেশোরে আলোচনা হচ্ছে।

ইউক্রেনের জন্য মার্কিন সমর্থন

প্রথম মেয়াদে ট্রাম্প প্রায়ই অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে জড়িত থাকার বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করতেন। বিশেষ করে যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের সামান্য প্রত্যক্ষ কৌশলগত স্বার্থ রয়েছে। এবার নির্বাচনের আগেও তার দাবি ছিল, হোয়াইট হাউজে ট্রাম্প থাকলে মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউক্রেনে রক্তপাত হতো না।

তিনি ইউরোপীয় নিরাপত্তায় ন্যাটোর ভূমিকাকে কিছুটা ‘সেকেলে’ বলে অতীতে উল্লেখ করেছেন।  অবশ্য শেষ পর্যন্ত ইউক্রেনে মার্কিন সহায়তাকে সমর্থন করেছিলেন।  যেমন ২০১৭ সালে ইউক্রেনের প্রতিরক্ষায় জ্যাভলিন ক্ষেপণাস্ত্রের মতো প্রাণঘাতী অস্ত্র অনুমোদন। তবে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, তিনি সাধারণভাবে অন্য দেশে মার্কিন সহায়তার প্রকাশ্যে সমালোচক।

দ্বিতীয় মেয়াদে এটা সম্ভব যে, ট্রাম্প ইউক্রেনের জন্য মার্কিন আর্থিক ও সামরিক সহায়তা হ্রাস করার পক্ষে যুক্তি দিতে পারেন। ট্রাম্প তার রাজনৈতিক দর্শনে ‘আমেরিকা সবার আগে’ নীতি অনুসরণ করার পক্ষে।  তাই ক্ষমতায় এসে ইউক্রেনের প্রতিরক্ষায় মার্কিন সংশ্লিষ্টতা হ্রাস করার জন্য ইউরোপীয় দেশগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি করবেন, এ নিয়ে জোরালো সংশয় থেকে যাচ্ছে। এতে ইউক্রেনে অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মার্কিন সামরিক সহায়তা বা রাজনৈতিক সমর্থনের মাত্রা পিছিয়ে যেতে পারে।

৭ নভেম্বর প্রকাশিত আল জাজিরার এক প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২২ সালে ইউক্রেনে রাশিয়ার পূর্ণ মাত্রায় আগ্রাসনের পর থেকে, মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যেই ইউক্রেনকে ৬৪.১ বিলিয়ন ডলারের বেশি সামরিক সহায়তা দিয়েছে। যদিও বেসরকারি সূত্র মতে, এই সহায়তা ৭০ বিলিয়নেরও বেশি।

ইউক্রেনে যুদ্ধবিরতি বা নিষ্পত্তির জন্য কূটনৈতিক চাপ

ট্রাম্প তার ‘অপ্রচলিত’ কূটনীতির জন্য পরিচিত।  প্রথম মেয়াদে, তিনি প্রায়ই পরামর্শ দিয়েছিলেন যে তিনি রাশিয়ার সঙ্গে একটি ভালো চুক্তি করতে পারেন, এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার মধ্যে উত্তেজনা কমানোর আগ্রহের ইঙ্গিতও দিয়েছিলেন। তিনি প্রকাশ্য বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, কূটনীতির মাধ্যমে ‘২৪ ঘণ্টার মধ্যে’ ইউক্রেনের যুদ্ধ শেষ করা সম্ভব, যদিও এটি কোন ফর্মুলা হবে তা স্পষ্ট নয়।

মনে করা হচ্ছে, ইউক্রেনকে যুদ্ধবিরতি বা রাশিয়ার সঙ্গে একটি আলোচনার মাধ্যমে নিষ্পত্তির জন্য চাপ দিতে পারেন ট্রাম্প। এরইমধ্যে রাশিয়ার কিছু নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া বা বিনিময়ে রাশিয়াকে আরও অনুকূল নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রস্তাব দেওয়ার মতো ছাড় দেওয়া হতে পারে। তবে এই প্রক্রিয়া অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক উভয় ক্ষেত্রেই বিতর্কিত হতে পারে। বিশেষ করে ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণ আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করেছে।

ন্যাটো ও পশ্চিমা জোটের সঙ্গে উত্তেজনা 

২০১৬ সালে প্রথম মেয়াদে জয়ী হওয়ার আগে থেকে প্রচারের সময় সামরিক জোট ন্যাটোকে ‘অচল সংস্থা’ বলে এসেছেন ট্রাম্প। ন্যাটোর চুক্তিতে বলা হয়েছে, প্রতিটি সদস্য দেশ তাদের জিডিপির দুই শতাংশ প্রতিরক্ষা খাতে খরচ করবে। কিন্তু অধিকাংশ দেশই এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করে না বা করতে পারে না।

ন্যাটো জোটের প্রতিরক্ষা ব্যয়ে যথেষ্ট অবদান না রাখার জন্য এবং ন্যাটো মিত্রদের সমালোচনা করার ইতিহাস রয়েছে ট্রাম্পের। এবার তিনি পুনরায় নির্বাচিত হওয়ায় ন্যাটো সদস্যদের ওপর নতুন করে চাপ তৈরি হতে পারে। বিশেষ করে ইউক্রেনকে সমর্থন, যার মধ্যে আরও সামরিক সহায়তা এবং ব্যয় বহনে অস্বীকৃতি জানাতে পারে রিপাবলিকান প্রশাসন।

ট্রাম্প ন্যাটোর প্রতি মার্কিন প্রতিশ্রুতির পুনর্মূল্যায়নের জন্যও চাপ দিতে পারেন, যা জোটের মধ্যে সুরক্ষা ক্ষুণ্ণ করতে পারে, বিশেষ করে যদি ন্যাটো সদস্যরা ইউক্রেনের পরিস্থিতি মোকাবিলা করার বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করে।

ন্যাটো জোটে ফাটল ধরলে, সেক্ষেত্রে রাশিয়ান আগ্রাসনের বিরুদ্ধে পশ্চিমের সম্মিলিত সংকল্প দুর্বল হয়ে যাবে। আর এটি সম্ভাব্যভাবে রাশিয়াকে আরও কূটনৈতিক সুবিধা দেবে।

মার্কিন-রাশিয়া সম্পর্কের ওপর প্রভাব

ট্রাম্প ঐতিহাসিকভাবে রাশিয়ার প্রতি আরও সমঝোতামূলক অবস্থান নিয়েছেন এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের প্রশংসা করেছেন।  হোয়াইট হাউজে তার প্রত্যাবর্তনে মার্কিন-রাশিয়া সম্পর্কের মধ্যে ‘গলদঘর্ম’ হতে পারে, যা সম্ভাব্যভাবে এক ধরণের কৌশলগত সংলাপ বা মৌন অবস্থানের দিকে নিয়ে যেতে পারে।

এই পরিবর্তন ইউক্রেনের জন্য মার্কিন সমর্থনকে ক্ষুণ্ন করতে পারে, কারণ ট্রাম্প ইউক্রেনের সার্বভৌমত্বকে পুরোপুরি সমর্থন করার জন্য রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিতে পারেন। যাই হোক, এই ধরনের পদ্ধতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মূল মিত্রদেরও বিচ্ছিন্ন করতে পারে এবং রাশিয়ার প্রতি তুষ্টির অভিযোগ আনতে পারে।

২০২০ সালে হোয়াইট হাউস ছাড়ার পরও ট্রাম্প রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞার কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।  তিনি বহুবার বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের পুতিনের সঙ্গে আলোচনায় বসা এবং চুক্তির অংশ হিসাবে সম্ভাব্য নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া উচিত । তার বক্তৃতায়, ট্রাম্প প্রায়শই পুতিনের প্রশংসা করেছেন এবং রাশিয়ার দ্বারা সৃষ্ট হুমকি গুরুত্ব দেননি।  তার ভাষ্য,  ভিন্ন পন্থা ইউক্রেনে যুদ্ধ প্রতিরোধ করতে পারত এবং আলোচনা করে পুতিনের সঙ্গে দ্বন্দ্ব এড়ানো যেত।

অভ্যন্তরণীন মার্কিন রাজনীতি এবং কংগ্রেসের প্রভাব

ট্রাম্পের বৈদেশিক নীতিও কংগ্রেসের রাজনৈতিক আবহাওয়ার ওপর নির্ভর করবে। যদিও বর্তমান বাইডেনের নেতৃত্বে মার্কিন সরকার ইউক্রেনের পক্ষে সমর্থক। তবে মার্কিন সমাজ বিভক্ত। একটি অংশ মনে করে কিয়েভের জন্য অব্যাহত শক্তিশালী সমর্থন প্রয়োজন।

আবার অনেকে যুক্তি দেয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এতটা বেশি জড়িত হওয়া উচিত নয়। কারণ রাশিয়ার সঙ্গে তাদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান বিভাজন ঝুঁকি তৈরি করছে। বিশেষ করে, ট্রাম্পের ঘাঁটিসহ রিপাবলিকান পার্টির কিছু উপদল ইউক্রেনের জন্য চলমান সমর্থনের ব্যয় নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

ট্রাম্প পুনঃনির্বাচিতই হননি শুধু। এবার রিপাবলিকানরা সিনেট নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন। হাউস অফ রিপ্রেজেন্টেটিভস বা প্রতিনিধি পরিষদের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পথেও রিপাবলিকানরা। সেক্ষেত্রে ইউক্রেনে মার্কিন সহায়তা সীমিত করার জন্য উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক চাপ হতে পারে। বিপরীতভাবে, যদি ডেমোক্র্যাটরা কংগ্রেসের নিয়ন্ত্রণ হারায়, ইউক্রেনে সহায়তা কমানোর জন্য ট্রাম্পের প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করার ম্যাণ্ডেট হারাতে পারে।

বৈশ্বিক পরিস্থিতি এবং যুদ্ধের গতিপথের ওপর প্রভাব

যুদ্ধ বিস্তৃতি নিয়ে ট্রাম্পের অধীনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি আরও সংকীর্ণ অবস্থান নেয় বা ইউক্রেনের প্রতি সমর্থন কমায়, তবে এটি বিশ্বব্যাপী মার্কিন জোটের ওপর বিস্তৃত প্রভাব ফেলতে পারে।

বিশেষ করে ইউরোপীয় দেশগুলোকে, যারা রাশিয়ান আগ্রাসনের প্রথম সারিতে রয়েছে, তারা আরও স্বাধীনভাবে কাজ করতে বা নতুন জোট খুঁজতে বাধ্য হতে পারে। কিছু দেশ তাদের নিজস্ব প্রতিরক্ষা উদ্যোগকে ত্বরান্বিত করতে পারে। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব ছাড়া রাশিয়ার মোকাবিলা করা সহজ নয়।

ট্রাম্পের যুক্তি, ইউক্রেনের সমর্থনের পুরো ভার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বহন করা উচিত নয়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, বিশেষত রাশিয়ার কাছাকাছি থাকা রাষ্ট্রগুলোর ইউক্রেনের নিরাপত্তার জন্য আরও দায়িত্ব নেওয়া উচিত।

ইউক্রেন যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাহার বা সম্পৃক্ততা হ্রাস রাশিয়াকে উত্সাহিত করতে পারে এবং ইউরোপে ক্ষমতার ভারসাম্যকে প্রভাবিত করতে পারে। হয় এটি একটি দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের দিকে নিয়ে যাবে। না হয় ইউরোপীয় নিরাপত্তার জন্য দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবসহ প্রতিকূল শর্তে ইউক্রেনকে নমনীয় হতে আলোচনায় বাধ্য করতে পারে।

নিষেধাজ্ঞা এবং অর্থনৈতিক নীতি

ট্রাম্প বারবার নিষেধাজ্ঞার কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন এবং এমনকি রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন, বিশেষ করে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে। পুনঃনির্বাচিত হওয়ায়, তিনি মার্কিন-রাশিয়া সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের বৃহত্তর প্রচেষ্টার অংশ হিসাবে রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা শিথিল করতে যেতে পারেন।

অনেকে যুক্তি দেয়, এই নিষেধাজ্ঞাগুলো পশ্চিমা কৌশলের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ যা রাশিয়ার যুদ্ধ প্রচেষ্টা টিকিয়ে রাখার ক্ষমতাকে দুর্বল করবে।  নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার পদক্ষেপ রাশিয়ার অর্থনীতি এবং তার যুদ্ধ প্রচেষ্টাকে শক্তিশালী করতে পারে। আর এটি সম্ভাব্যভাবে ইউক্রেনের সংঘাত দীর্ঘায়িত করতে পারে।

ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ এরইমধ্যে জানিয়েছেন, ‘শত্রু দেশটির উভয় নেতাই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়িত’। এখন দেখার বিষয় ট্রাম্প-পুতিন শাসনামলের দ্বিতীয় অধ্যায় কীভাবে শুরু হয় এবং কোথায় গিয়ে সমাপ্তি ঘটে।

Tag :

আপনার মতামত লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল ও অন্যান্য তথ্য সঞ্চয় করে রাখুন

জনপ্রিয় সংবাদ

ইউক্রেনে যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ‘অকুণ্ঠ সমর্থন’ অব্যাহত রাখবেন কি ট্রাম্প?

আপডেট সময় ০২:০৮:০৪ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৭ নভেম্বর ২০২৪

মার্কিন নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প আবারও প্রেসিডেন্ট পদে জয়লাভ করায় ইউক্রেন যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করতে পারে। গত আড়াই বছর ধরে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনকে অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়ে আসছেন জো বাইডেনের নেতৃত্বাধীন বর্তমান মার্কিন প্রশাসন।

ট্রাম্পের পররাষ্ট্র নীতির অবস্থান এবং অতীতের কর্মকাণ্ডের কয়েকটি মূল দিক, ইউক্রেন বিষয়ে তার অবস্থান কী হতে পারে তা নিয়ে এখন জোরেশোরে আলোচনা হচ্ছে।

ইউক্রেনের জন্য মার্কিন সমর্থন

প্রথম মেয়াদে ট্রাম্প প্রায়ই অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে জড়িত থাকার বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করতেন। বিশেষ করে যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের সামান্য প্রত্যক্ষ কৌশলগত স্বার্থ রয়েছে। এবার নির্বাচনের আগেও তার দাবি ছিল, হোয়াইট হাউজে ট্রাম্প থাকলে মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউক্রেনে রক্তপাত হতো না।

তিনি ইউরোপীয় নিরাপত্তায় ন্যাটোর ভূমিকাকে কিছুটা ‘সেকেলে’ বলে অতীতে উল্লেখ করেছেন।  অবশ্য শেষ পর্যন্ত ইউক্রেনে মার্কিন সহায়তাকে সমর্থন করেছিলেন।  যেমন ২০১৭ সালে ইউক্রেনের প্রতিরক্ষায় জ্যাভলিন ক্ষেপণাস্ত্রের মতো প্রাণঘাতী অস্ত্র অনুমোদন। তবে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, তিনি সাধারণভাবে অন্য দেশে মার্কিন সহায়তার প্রকাশ্যে সমালোচক।

দ্বিতীয় মেয়াদে এটা সম্ভব যে, ট্রাম্প ইউক্রেনের জন্য মার্কিন আর্থিক ও সামরিক সহায়তা হ্রাস করার পক্ষে যুক্তি দিতে পারেন। ট্রাম্প তার রাজনৈতিক দর্শনে ‘আমেরিকা সবার আগে’ নীতি অনুসরণ করার পক্ষে।  তাই ক্ষমতায় এসে ইউক্রেনের প্রতিরক্ষায় মার্কিন সংশ্লিষ্টতা হ্রাস করার জন্য ইউরোপীয় দেশগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি করবেন, এ নিয়ে জোরালো সংশয় থেকে যাচ্ছে। এতে ইউক্রেনে অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মার্কিন সামরিক সহায়তা বা রাজনৈতিক সমর্থনের মাত্রা পিছিয়ে যেতে পারে।

৭ নভেম্বর প্রকাশিত আল জাজিরার এক প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২২ সালে ইউক্রেনে রাশিয়ার পূর্ণ মাত্রায় আগ্রাসনের পর থেকে, মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যেই ইউক্রেনকে ৬৪.১ বিলিয়ন ডলারের বেশি সামরিক সহায়তা দিয়েছে। যদিও বেসরকারি সূত্র মতে, এই সহায়তা ৭০ বিলিয়নেরও বেশি।

ইউক্রেনে যুদ্ধবিরতি বা নিষ্পত্তির জন্য কূটনৈতিক চাপ

ট্রাম্প তার ‘অপ্রচলিত’ কূটনীতির জন্য পরিচিত।  প্রথম মেয়াদে, তিনি প্রায়ই পরামর্শ দিয়েছিলেন যে তিনি রাশিয়ার সঙ্গে একটি ভালো চুক্তি করতে পারেন, এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার মধ্যে উত্তেজনা কমানোর আগ্রহের ইঙ্গিতও দিয়েছিলেন। তিনি প্রকাশ্য বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, কূটনীতির মাধ্যমে ‘২৪ ঘণ্টার মধ্যে’ ইউক্রেনের যুদ্ধ শেষ করা সম্ভব, যদিও এটি কোন ফর্মুলা হবে তা স্পষ্ট নয়।

মনে করা হচ্ছে, ইউক্রেনকে যুদ্ধবিরতি বা রাশিয়ার সঙ্গে একটি আলোচনার মাধ্যমে নিষ্পত্তির জন্য চাপ দিতে পারেন ট্রাম্প। এরইমধ্যে রাশিয়ার কিছু নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া বা বিনিময়ে রাশিয়াকে আরও অনুকূল নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রস্তাব দেওয়ার মতো ছাড় দেওয়া হতে পারে। তবে এই প্রক্রিয়া অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক উভয় ক্ষেত্রেই বিতর্কিত হতে পারে। বিশেষ করে ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণ আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করেছে।

ন্যাটো ও পশ্চিমা জোটের সঙ্গে উত্তেজনা 

২০১৬ সালে প্রথম মেয়াদে জয়ী হওয়ার আগে থেকে প্রচারের সময় সামরিক জোট ন্যাটোকে ‘অচল সংস্থা’ বলে এসেছেন ট্রাম্প। ন্যাটোর চুক্তিতে বলা হয়েছে, প্রতিটি সদস্য দেশ তাদের জিডিপির দুই শতাংশ প্রতিরক্ষা খাতে খরচ করবে। কিন্তু অধিকাংশ দেশই এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করে না বা করতে পারে না।

ন্যাটো জোটের প্রতিরক্ষা ব্যয়ে যথেষ্ট অবদান না রাখার জন্য এবং ন্যাটো মিত্রদের সমালোচনা করার ইতিহাস রয়েছে ট্রাম্পের। এবার তিনি পুনরায় নির্বাচিত হওয়ায় ন্যাটো সদস্যদের ওপর নতুন করে চাপ তৈরি হতে পারে। বিশেষ করে ইউক্রেনকে সমর্থন, যার মধ্যে আরও সামরিক সহায়তা এবং ব্যয় বহনে অস্বীকৃতি জানাতে পারে রিপাবলিকান প্রশাসন।

ট্রাম্প ন্যাটোর প্রতি মার্কিন প্রতিশ্রুতির পুনর্মূল্যায়নের জন্যও চাপ দিতে পারেন, যা জোটের মধ্যে সুরক্ষা ক্ষুণ্ণ করতে পারে, বিশেষ করে যদি ন্যাটো সদস্যরা ইউক্রেনের পরিস্থিতি মোকাবিলা করার বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করে।

ন্যাটো জোটে ফাটল ধরলে, সেক্ষেত্রে রাশিয়ান আগ্রাসনের বিরুদ্ধে পশ্চিমের সম্মিলিত সংকল্প দুর্বল হয়ে যাবে। আর এটি সম্ভাব্যভাবে রাশিয়াকে আরও কূটনৈতিক সুবিধা দেবে।

মার্কিন-রাশিয়া সম্পর্কের ওপর প্রভাব

ট্রাম্প ঐতিহাসিকভাবে রাশিয়ার প্রতি আরও সমঝোতামূলক অবস্থান নিয়েছেন এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের প্রশংসা করেছেন।  হোয়াইট হাউজে তার প্রত্যাবর্তনে মার্কিন-রাশিয়া সম্পর্কের মধ্যে ‘গলদঘর্ম’ হতে পারে, যা সম্ভাব্যভাবে এক ধরণের কৌশলগত সংলাপ বা মৌন অবস্থানের দিকে নিয়ে যেতে পারে।

এই পরিবর্তন ইউক্রেনের জন্য মার্কিন সমর্থনকে ক্ষুণ্ন করতে পারে, কারণ ট্রাম্প ইউক্রেনের সার্বভৌমত্বকে পুরোপুরি সমর্থন করার জন্য রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিতে পারেন। যাই হোক, এই ধরনের পদ্ধতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মূল মিত্রদেরও বিচ্ছিন্ন করতে পারে এবং রাশিয়ার প্রতি তুষ্টির অভিযোগ আনতে পারে।

২০২০ সালে হোয়াইট হাউস ছাড়ার পরও ট্রাম্প রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞার কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।  তিনি বহুবার বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের পুতিনের সঙ্গে আলোচনায় বসা এবং চুক্তির অংশ হিসাবে সম্ভাব্য নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া উচিত । তার বক্তৃতায়, ট্রাম্প প্রায়শই পুতিনের প্রশংসা করেছেন এবং রাশিয়ার দ্বারা সৃষ্ট হুমকি গুরুত্ব দেননি।  তার ভাষ্য,  ভিন্ন পন্থা ইউক্রেনে যুদ্ধ প্রতিরোধ করতে পারত এবং আলোচনা করে পুতিনের সঙ্গে দ্বন্দ্ব এড়ানো যেত।

অভ্যন্তরণীন মার্কিন রাজনীতি এবং কংগ্রেসের প্রভাব

ট্রাম্পের বৈদেশিক নীতিও কংগ্রেসের রাজনৈতিক আবহাওয়ার ওপর নির্ভর করবে। যদিও বর্তমান বাইডেনের নেতৃত্বে মার্কিন সরকার ইউক্রেনের পক্ষে সমর্থক। তবে মার্কিন সমাজ বিভক্ত। একটি অংশ মনে করে কিয়েভের জন্য অব্যাহত শক্তিশালী সমর্থন প্রয়োজন।

আবার অনেকে যুক্তি দেয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এতটা বেশি জড়িত হওয়া উচিত নয়। কারণ রাশিয়ার সঙ্গে তাদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান বিভাজন ঝুঁকি তৈরি করছে। বিশেষ করে, ট্রাম্পের ঘাঁটিসহ রিপাবলিকান পার্টির কিছু উপদল ইউক্রেনের জন্য চলমান সমর্থনের ব্যয় নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

ট্রাম্প পুনঃনির্বাচিতই হননি শুধু। এবার রিপাবলিকানরা সিনেট নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন। হাউস অফ রিপ্রেজেন্টেটিভস বা প্রতিনিধি পরিষদের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পথেও রিপাবলিকানরা। সেক্ষেত্রে ইউক্রেনে মার্কিন সহায়তা সীমিত করার জন্য উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক চাপ হতে পারে। বিপরীতভাবে, যদি ডেমোক্র্যাটরা কংগ্রেসের নিয়ন্ত্রণ হারায়, ইউক্রেনে সহায়তা কমানোর জন্য ট্রাম্পের প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করার ম্যাণ্ডেট হারাতে পারে।

বৈশ্বিক পরিস্থিতি এবং যুদ্ধের গতিপথের ওপর প্রভাব

যুদ্ধ বিস্তৃতি নিয়ে ট্রাম্পের অধীনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি আরও সংকীর্ণ অবস্থান নেয় বা ইউক্রেনের প্রতি সমর্থন কমায়, তবে এটি বিশ্বব্যাপী মার্কিন জোটের ওপর বিস্তৃত প্রভাব ফেলতে পারে।

বিশেষ করে ইউরোপীয় দেশগুলোকে, যারা রাশিয়ান আগ্রাসনের প্রথম সারিতে রয়েছে, তারা আরও স্বাধীনভাবে কাজ করতে বা নতুন জোট খুঁজতে বাধ্য হতে পারে। কিছু দেশ তাদের নিজস্ব প্রতিরক্ষা উদ্যোগকে ত্বরান্বিত করতে পারে। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব ছাড়া রাশিয়ার মোকাবিলা করা সহজ নয়।

ট্রাম্পের যুক্তি, ইউক্রেনের সমর্থনের পুরো ভার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বহন করা উচিত নয়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, বিশেষত রাশিয়ার কাছাকাছি থাকা রাষ্ট্রগুলোর ইউক্রেনের নিরাপত্তার জন্য আরও দায়িত্ব নেওয়া উচিত।

ইউক্রেন যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাহার বা সম্পৃক্ততা হ্রাস রাশিয়াকে উত্সাহিত করতে পারে এবং ইউরোপে ক্ষমতার ভারসাম্যকে প্রভাবিত করতে পারে। হয় এটি একটি দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের দিকে নিয়ে যাবে। না হয় ইউরোপীয় নিরাপত্তার জন্য দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবসহ প্রতিকূল শর্তে ইউক্রেনকে নমনীয় হতে আলোচনায় বাধ্য করতে পারে।

নিষেধাজ্ঞা এবং অর্থনৈতিক নীতি

ট্রাম্প বারবার নিষেধাজ্ঞার কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন এবং এমনকি রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন, বিশেষ করে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে। পুনঃনির্বাচিত হওয়ায়, তিনি মার্কিন-রাশিয়া সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের বৃহত্তর প্রচেষ্টার অংশ হিসাবে রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা শিথিল করতে যেতে পারেন।

অনেকে যুক্তি দেয়, এই নিষেধাজ্ঞাগুলো পশ্চিমা কৌশলের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ যা রাশিয়ার যুদ্ধ প্রচেষ্টা টিকিয়ে রাখার ক্ষমতাকে দুর্বল করবে।  নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার পদক্ষেপ রাশিয়ার অর্থনীতি এবং তার যুদ্ধ প্রচেষ্টাকে শক্তিশালী করতে পারে। আর এটি সম্ভাব্যভাবে ইউক্রেনের সংঘাত দীর্ঘায়িত করতে পারে।

ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ এরইমধ্যে জানিয়েছেন, ‘শত্রু দেশটির উভয় নেতাই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়িত’। এখন দেখার বিষয় ট্রাম্প-পুতিন শাসনামলের দ্বিতীয় অধ্যায় কীভাবে শুরু হয় এবং কোথায় গিয়ে সমাপ্তি ঘটে।