প্রকল্পের পরিচালক পরিবর্তন হয়েছেন ৬ জন, কাজের মেয়াদ বেড়েছে ৫ বার। এভাবে কেটেছে ৯ বছর। এরপরও আলোর মুখ দেখেনি অগ্রণী ব্যাংকের ভবন-২ (২০ তলা) নির্মাণ প্রকল্প। যা শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৮ সালেই। এখন রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক এলাকা মতিঝিলে ৭০ হাজার স্কয়ার ফুটের ভবনের অবকাঠামো ফাঁকা অবস্থায় পড়ে আছে। কাজ বন্ধ করে দিয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানও।
মূলত বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দায় মার্কিন ডলারের মূল্য বৃদ্ধির পর প্রকল্পে ব্যবহৃত নির্মাণ সামগ্রী (আমদানিকৃত) মূল্য সমন্বয় করা হয়নি। এসব পরিস্থিতি তুলে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে চিঠি দিয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দেশ উন্নয়ন দ্য বিল্ডার্স-জিবিবি (জেভি)। অভিযোগ রয়েছে ব্যাংকের পক্ষে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকল্প পরিচালকদের গাফিলতির কারণে নির্ধারিত সময়ে ভবনে নির্মাণ কাজ শেষ হয়নি। ফলে মতিঝিলসহ আশপাশ এলাকায় ভাড়া ভবনে পরিচালিত হচ্ছে ব্যাংকের বিভিন্ন শাখা। এতে গত ৬ বছরে শুধু ভাড়ার পেছনে ব্যয় গুনতে হয়েছে ২৭ কোটি টাকা। এ ব্যয় আরও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যা সাশ্রয় হিসাবে ব্যাংকের মূলধনে যুক্ত হতো যদি নির্ধারিত সময়ে ভবনের কাজ সমাপ্ত হতো।
জানতে চাইলে বর্তমান ডলারের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি স্বীকার করে প্রকল্প ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুর রহমান মঙ্গলবার যুগান্তরকে জানান, ৮০-৮৫ টাকা প্রতি ডলারের মূল্য ধরে ২০১৫ সালে প্রকল্পের কাজ শুরু হলেও সেটি এখন ১২০ টাকা। ডলারের মূল্য বেড়েছে এটি বাস্তবতায় ঠিক আছে। তবে বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য ব্যাংকের নতুন ব্যবস্থাপনার দৃষ্টি আকষর্ণ করা হয়েছে। ব্যাংকের লোকসানের বিষয়টিতে তিনি একমত হয়ে বলেছেন, ভবনটি নির্মাণ সম্পন্ন হলে বিভিন্ন বিভাগীয় অফিস স্থানান্তরের পরিকল্পনা রয়েছে। এখন সেগুলো ভাড়ায় চলছে।
প্রকল্পটি সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, ৭২ মতিঝিল ঠিকানায় সাড়ে ৭ কাঠার ওপর ২০ তলা অবকাঠামো নির্মাণের পর সেটি পড়ে আছে। ভেতরে প্রবেশ ও অসামাজিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধ লেখা সাইনবোর্ড ভবনের গায়ে সেঁটে দেওয়া আছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে গত ৯ বছর ধরে কয়েকজন নিরাপত্তা কর্মী নিয়োজিত রেখেছে।
যোগাযোগ করা হলে প্রকল্পের ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান দেশ উন্নয়ন দ্য বিল্ডার্স-জিবিবি (জেভি) চেয়ারম্যান জসিম উদ্দিন মন্টু যুগান্তরকে জানান, বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্যেও প্রকল্পের নির্মাণ কাজ শেষ করার চেষ্টা করেছি। প্রায় ৪ বছর আগে কাজের বকেয়া বিল রয়েছে এবং চুক্তিবহির্ভূতভাবে এলডি কেটে নেওয়ার পরও প্রকল্প ছেড়ে চলে আসেনি। তিনি আরও বলেন, চুক্তির বাইরে অনেক আইটেম ব্যাংকের পক্ষ থেকে যুক্ত করা হলেও ডলারের মূল্য বৃদ্ধি সমন্বয় করছে না। টেন্ডার আইটেমগুলোর মূল্য বেড়েছে। একদিকে বকেয়া বিল আটক, ডলারের মূল্য বৃদ্ধি সমন্বয় না করাসহ বিভিন্ন অপ্রতিকূল পরিবেশে কাজ বন্ধ রাখা হয়েছে।
সূত্রমতে, ২০১৫ সালে প্রকল্পটি তিনটি বেজমেন্টসহ ২০ তলা ভবন নির্মাণের জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করে ব্যাংক। তবে বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্যেও ভবনের ২০ তলা পর্যন্ত অবকাঠামো কাজ প্রায় ৪ বছর আগেই শেষ হয়। তবে প্রকল্পের মাঝামাঝি আধুনিকায়নের উদ্দেশ্যে চুক্তিবহির্ভূত বেশকিছু আইটেম যুক্ত করা হয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে। এতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে ২০২১ সালে নতুন করে ওইসব পণ্যের দর দাখিলের অনুরোধ জানায়। কারণ চুক্তির মধ্যে নতুন সংযুক্ত আইটেমগুলো অন্তর্ভুক্ত ছিল না। কিন্তু দর প্রস্তাবের প্রায় ১৮ মাস পর ব্যাংকের পক্ষ থেকে সায় মেলে, তত দিনে ডলারের মূল্য বৃদ্ধির কারণে প্রস্তাবিত দর বেড়ে যায়। অর্থাৎ প্রতি ডলারের মূল্য প্রস্তাবিত দর থেকে ৩৮ টাকা বৃদ্ধি পায়। সেটি ব্যাংককে জানানোর পর কোনো সাড়া মেলেনি। এরই মধ্যে আবার প্রকল্প নির্মাণের নির্ধারিত সময়ও শেষ হয়ে যায়।
জানা গেছে, ডলারের মূল্যস্ফীতির কারণে প্রকল্প ব্যয় আরও ২০ কোটি টাকা বৃদ্ধি পায়। যা এখন পর্যন্ত সমন্বয় করা হয়নি। অপর দিকে ডলারের মূল্য সমন্বয় না হওয়ায় পণ্য আমদানির এলসি খোলা থেকে পিছুটান নেয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানও। উভয় দিকে জটিলতার কারণে প্রকল্পের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।
সূত্র আরও জানায়, বিগত সরকারের আমলে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কমিটি ও সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন এ কর্মকর্তাদের সঙ্গে এ নিয়ে কয়েক দফা বৈঠক হলেও তা অনিষ্পত্তিই থেকে গেছে।
এদিকে অর্থ উপদেষ্টার কাছে লিখিত পত্রে উল্লেখ করা হয়, চুক্তি মোতাবেক প্রকল্পের সময়সীমা শেষে রিমেনিং কাজের ওপর এলডি (লিকিউডিটি ডেমেজ) আরোপের বিধান আছে। কিন্তু প্রকল্পের মাঝ খানে এসে ১০ শতাংশ হারে এলডি কেটে নেওয়া হয়েছে যা সরকারি কেনাকাটা কর্তৃপক্ষের আইন বিরোধী। অপর দিকে ৮ বছর পার হলেও নন টেন্ডারের আইটেম বিল পরিশোধ করা হয়নি। এছাড়া এ পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ ৫ বার বাড়ানো হয়েছে এবং প্রকল্প পরিচালক ৬ জন পরিবর্তন হয়েছে। সঠিক সিদ্ধান্তের অভাবে ব্যাংক এবং ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান উভয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।