ঢাকা ০১:২৮ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৩ অক্টোবর ২০২৪, ৭ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::
কুড়িগ্রাম জেলার নাগেশ্বরী উপজেলায় বিএসটিআই এর অভিযানে ও জরিমানা শুভ উদ্বোধন হলো ন্যাশনাল প্রেস সোসাইটি (এনপিএস) এর রংপুর শাখা রাজবাড়ীতে স্ত্রী হত্যা মামলায় স্বামীর মৃত্যুদণ্ড ২০২৪ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় সাফল্যের শীর্ষে সামসুল হক খান স্কুল অ্যান্ড কলেজ। পুরো ঘটনাটাই ঘটেছিল উদ্দেশ্য প্রনিত ধুম্রজালে দখল-চাঁদাবাজি-ইজারায় হাত বদল: হেমায়েতপুর-আমিনবাজারে ‘নতুন সম্রাট’ মুশা সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের চেয়ারম্যানসহ ৮ জনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা শুভ উদ্বোধন হলো ন্যাশনাল প্রেস সোসাইটি (এনপিএস) এর রংপুর শাখা পানিতে ডুবে প্রতিটি মৃত্যুই প্রতিরোধযোগ্য: পঙ্কজ বড়ুয়া চৌদ্দগ্রামে সড়ক দুর্ঘটনায় কাভার্ডভ্যান চালক নিহত

আতঙ্কের নাম সাবেক চেয়ারম্যান শাহীন

পাবনা জেলার সুজানগর। পদ্মা ও আত্রাই নদীর পলিবিধৌত এ জনপদের রয়েছে সমৃদ্ধ ইতিহাস। দেশের প্রয়োজনীয় সিংহভাগ পেঁয়াজের জোগানদাতা এই উপজেলা। পরিচিতি রয়েছে আশপাশের অঞ্চলের চেয়ে এ অঞ্চলের মানুষ অনেকটাই শান্তশিষ্ট। তবে মোগল সম্রাটদের স্মৃতিবিজড়িত এ উপজেলা গত কয়েক বছরে পরিণত হয়েছে সন্ত্রাসের জনপদ হিসেবে। খুন, ধর্ষণ, দখলবাজি, লুটপাটসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে নাভিশ্বাস উঠেছে বসবাসরত সাধারণ মানুষের। ক্ষেত্রবিশেষ এসব অপরাধ দমনে দুর্বলতা রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীরও। পাবনার বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সুজানগরজুড়ে কয়েক বছর ধরে চলা দখলদারিত্ব এবং সন্ত্রাসের পেছনে গডফাদার হিসেবে কাজ অপেক্ষাকৃত মধ্যবিত্ত পরিবারে বেড়ে ওঠা সুজানগরের শাহীনের। সাত ভাইসহ বিরাট সংসার চালাতে তাদের পিতা আবুল কাশেম ছিলেন হাঁসফাঁস অবস্থায়। তবে ভাগ্য বদলাতে থাকে ২০১৯ সালের পর থেকে। ওই বছর উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন তিনি। এরপর যেন আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। শান্তশিষ্ট উপজেলাকে পরিণত করেন সন্ত্রাসের অভয়ারণ্য হিসেবে। খালবিল, জলাশয় দখল, হাটবাজারের ইজারা, উপজেলার সব নির্মাণকাজে হস্তক্ষেপ, নদী থেকে বালু উত্তোলন, চাঁদাবাজি, গ্রাম্য দলাদলিতে ফায়দা আদায়সহ নানা অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে আয় করেন শত শত কোটি টাকা। কিনেছেন বিপুল পরিমাণ জমি। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে গড়েছেন একাধিক বাড়ি ও ফ্ল্যাট।

শাহীনের এসব দখলদারিত্বে যাদেরই বাধা মনে করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে মামলা-হামলা করেছেন। হত্যার শিকারও হয়েছেন অনেকে। নিজের ভাইদের পাশাপাশি শাহীনের এসব অপরাধ কর্মকাণ্ডে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন শ্যালক রুবেল মিয়াও। সরেজমিন পাবনার সুজানগর উপজেলা ঘুরে সাধারণ জনগণ এবং ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে পাওয়া গেছে এমন তথ্য।

জানা যায়, শাহীনের নিয়ন্ত্রণে অন্তত ৭০টি বালু উত্তোলনের ড্রেজার রয়েছে। এসব ড্রেজার দেখভাল করেন শাহীনের ভাইয়েরা। নদী থেকে অপরিকল্পিত বালু উত্তোলনের কারণে বিভিন্ন স্থানে ভাঙন সৃষ্টি হয়েছে। বিলীন হয়েছে হাজার হাজার একর তিন ফসলি জমি। সরেজমিন চরভবানীপুর, সুজানগর থেকে নাজিরগঞ্জ পর্যন্ত এলাকা ঘুরে পাওয়া গেছে নদীভাঙনে ফসলি জমি বিলীন হওয়ার এমন চিত্র।

স্থানীয় কৃষকরা বলছেন, নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হয়। প্রতিটি সিএফটি বালু বাজারদরের চেয়ে দুই থেকে চার টাকা বেশি দরে বিক্রি করা হয়। এর পরও সাধারণ মানুষকে বেশি দামেই বালু কিনতে বাধ্য করা হয়।

চরভবানীপুর এলাকার আকবর হোসেন কালবেলাকে বলেন, পুরো এলাকায় শাহীন আতঙ্ক। মাইলের পর মাইল নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। কারণ বালু উত্তোলন। এ ছাড়া আগে স্থানীয়ভাবে নদী থেকে বালু উত্তোলন করতেন অনেক ব্যবসায়ী। কম টাকায় সেই বালু কেনা যেত। কিন্তু এখন পুরো সুজানগরে এ বালু ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে শাহীনের লোকজন। নিজেদের ইচ্ছেমতো দাম নেয়।

সুজানগর রেজিস্ট্রি অফিস এবং পাবনা রেজিস্ট্রি অফিস সূত্রে জানা গেছে, গত পাঁচ বছরে এই দুই রেজিস্ট্রি অফিসে প্রায় ৩০ বিঘারও বেশি জমি রেজিস্টি করা হয় শাহীনুজ্জামান এবং তার কাছের স্বজনদের নামে। এ ছাড়া সম্পত্তি গড়ে তুলেছেন শাহীনের শ্যালক রুবেলসহ স্ত্রীর স্বজনরাও। এর মধ্যে জমির পাশাপাশি কিনেছেন প্রাইভেটকার, তৈরি করেছেন মার্কেট। এ ছাড়া শাহীনের নিজ নামে ক্রয় করেছেন পাবনার কাচারী পাড়া এলাকায় একটি তিনতলা এবং একটি একতলা বাড়ি। ঢাকার ইস্কাটনে রয়েছে আলিশান ফ্ল্যাট। রাজধানীর বছিলায়ও জমি কিনে তৈরি করেছেন বাড়ি।

চলতি বছরে অনুষ্ঠিত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে শাহীনুজ্জামান চেয়ারম্যান প্রার্থী ছিলেন। তবে পরাজিত হন। নির্বাচনের সময় বিপুল পরিমাণ টাকাসহ আটকও হন তিনি। এরপর স্থানীয় সংসদ সদস্য এবং প্রভাবশালীদের দৌড়ঝাঁপে ২৪ ঘণ্টা পরে মুচলেকা দিয়ে ছাড়া পান।

২০১৯ এবং ২০২৪ সালের হলফনামা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, মাত্র সাড়ে চার বছরের মধ্যে হলফনামায় বিপুল সম্পদের তথ্য তুলে ধরেছেন শাহীনুজ্জামান। এর মধ্যে ২০১৯ সালে কৃষি জমির পরিমাণ ১০ শতাংশ দেখালেও ২০২৪ সালে সেই জমির পরিমাণ দেখানো হয়েছে প্রায় পাঁচ একর। এ ছাড়াও দেখানো হয়েছে বাড়ি, অ্যাপার্টমেন্ট, ভবনসহ বিপুল সম্পদ, যা ২০১৯ সালের হলফনামায় ছিল না। সঞ্চয়পত্র, ব্যাংকেও রাখা হয়েছে বিপুল পরিমাণ টাকা, যা আগেরবারের হলফনামায় ছিল না।

তথ্য বলছে, শাহীনুজ্জামানের অবৈধ উপায়ে শত শত কোটি টাকা আয়ের প্রাথমিক সত্যতা পায় দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক)। এরপর বিষয়টি বিষদ অনুসন্ধানের জন্য নিয়োগ করা হয় তদন্ত কর্মকর্তা।

জানা যায়, শাহীনুজ্জামানের সঙ্গে দহরম-মহরম সম্পর্ক ছিল পাবনা জেলার তৎকালীন পুলিশ সুপার রফিকুল ইসলামের। সম্প্রতি রফিকুল ইসলামের শত শত কোটি অবৈধ টাকার বিষয়টি সামনে আসে।

সূত্র বলছে, এসব অবৈধ টাকার বেশিরভাগই উপার্জন করেছেন পাবনা থাকাকালীন সময়ে। আর সবকিছু ম্যানেজ করে দিয়েছেন তৎকালীন সুজানগর উপজেলা চেয়ারম্যান শাহীনুজ্জামান।

স্থানীয়রা বলছেন, সাধারণ মানুষকে মামলার ভয় দেখিয়ে অবৈধভাবে টাকা আদায় করতেন শাহীনুজ্জামান। সেই টাকার বড় একটি অংশ দেওয়া হতো রফিকুল ইসলামকে। এমনকি সাধারণ মানুষকে রফিকুল ইসলাম তুচ্ছ কারণে আটক করতেন। এরপর তাদের ছাড়িয়ে আনতেও দেনদরবারের দায়িত্ব পালন করতেন এই সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান। আর এর মাধ্যমে আদায় করতেন অর্থ।

জানা যায়, সম্প্রতি দুদক শাহীনের সম্পত্তির বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া শুরু করলে বিষয়টি সমাধান করে দেওয়ার অনুরোধ করেন একজন দুদক কর্মকর্তাকে। হাফিজুর রহমান নামের দুদকের ওই কর্মকর্তার গ্রামের সুজানগরের রানীনগর ইউনিয়নে। তবে এসব বিষয়ে হস্তক্ষেপে অপরাগতা প্রকাশ করেন হাফিজুর। এতে ক্ষিপ্ত হন শাহীনুজ্জামান। এতেই যেন কালো মেঘ নেমে আসে হাফিজুরের ওপর। স্থানীয়ভাবে একটি মারামারিতে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মামলায় নাম ঢুকিয়ে দেওয়া হয় হাফিজুরের। এরপর সেই হত্যাকাণ্ডের সূত্রধরে পুরো এলাকায় তান্ডব চালান শাহীন। অন্তত শতাধিক বাড়িতে চালানো হয় লুটপাট। অনেকের ঘরবাড়ি ভাঙচুর করা হয়। গবাদি পশু, ঘরের আসবাবপত্রসহ নানা জিনিসপত্র চোখের সামনেই নিয়ে যাওয়া হয়। পুরো এলাকা হয়ে পড়ে পুরুষশূন্য। মহিলার এসব লুটপাটের প্রতিবাদ করলে তাদের ওপরও চালানো হয় নির্যাতন।

থেমে থাকেননি এখানেই। দুদক কর্মকর্তা হাফিজুরের বৃদ্ধ বাবাকে ধরে নিয়ে চালানো হয় নির্মম নির্যাতন। কয়েকদিন হাসপাতালে ভুগে ওই বৃদ্ধ বৃদ্ধ মৃত্যুবরণ করেন। পরে এ ঘটনায় মামলা হয়। সেই মামলায় আসামি করা হয় শাহীনুজ্জামানকে। সূত্র বলছে, শাহীনুজ্জামান স্থানীয় এমপি আহমেদ ফিরোজ কবিরের সুনজরে থাকায় মামলার আসামি করতে বেগ পেতে হয় ভুক্তভোগীদের।

স্থানীয়রা বলছেন, গত পাঁচ বছরে সুজানগরে অন্তত ১০ জন ব্যক্তি খুন হয়েছেন। আর প্রতিটি খুনের পেছনেই রয়েছে শাহীনুজ্জামানের ইশারা। এ ছাড়া গ্রামে গ্রামে দলাদলি তৈরি করে সেখান থেকেও ফায়দা হাসিল করেন এই শাহীন। ব্যবহার করেন পুলিশ প্রশাসনকে। চালানো হয় লুটপাট।

রানীনগরের বাসিন্দা লাইলি বেগম কালবেলাকে বলেন, শাহীন চেয়ারম্যান নেতৃত্ব দিয়ে লুটপাট চালিয়েছে। অনেকের ঘরের টিনের চালাও খুলে নেওয়া হয়েছে। এক বৃদ্ধকে ধরে নিয়ে পিটিয়েছে দীর্ঘসময়। এরপর সেই বৃদ্ধ মারা যান।

এসব বিষয়ে জানতে শাহীনুজ্জামান শাহীনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তবে বাড়িতে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। তার ফোন নম্বরও বন্ধ পাওয়া যায়। সূত্র বলছে, মামলা নথিবদ্ধ হওয়ার সংবাদ পাওয়ার পরে শাহীন গা ঢাকা দিয়েছেন।

জানতে চাইলে পাবনা জেলার পুলিশ সুপার মো. আকবর আলী মুনসী কালবেলাকে বলেন, ‘একটি হত্যা মামলা হয়েছে এটা সঠিক। এখন মামলায় যেভাবে ওনাকে আসামি করা হয়েছে, সেভাবে উনি জড়িত কি না সেটি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

তিনি বলেন, ‘বালুর বিষয়ে অভিযোগ ওঠার সময়েও তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। এ ছাড়া যখন যে অভিযোগই উঠেছে আমরা আইনগত ব্যবস্থা নিয়েছি। এরপরেও সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

 

Tag :

আপনার মতামত লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল ও অন্যান্য তথ্য সঞ্চয় করে রাখুন

আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

কুড়িগ্রাম জেলার নাগেশ্বরী উপজেলায় বিএসটিআই এর অভিযানে ও জরিমানা

আতঙ্কের নাম সাবেক চেয়ারম্যান শাহীন

আপডেট সময় ০৭:৫৫:৩৭ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২ জুলাই ২০২৪

পাবনা জেলার সুজানগর। পদ্মা ও আত্রাই নদীর পলিবিধৌত এ জনপদের রয়েছে সমৃদ্ধ ইতিহাস। দেশের প্রয়োজনীয় সিংহভাগ পেঁয়াজের জোগানদাতা এই উপজেলা। পরিচিতি রয়েছে আশপাশের অঞ্চলের চেয়ে এ অঞ্চলের মানুষ অনেকটাই শান্তশিষ্ট। তবে মোগল সম্রাটদের স্মৃতিবিজড়িত এ উপজেলা গত কয়েক বছরে পরিণত হয়েছে সন্ত্রাসের জনপদ হিসেবে। খুন, ধর্ষণ, দখলবাজি, লুটপাটসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে নাভিশ্বাস উঠেছে বসবাসরত সাধারণ মানুষের। ক্ষেত্রবিশেষ এসব অপরাধ দমনে দুর্বলতা রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীরও। পাবনার বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সুজানগরজুড়ে কয়েক বছর ধরে চলা দখলদারিত্ব এবং সন্ত্রাসের পেছনে গডফাদার হিসেবে কাজ অপেক্ষাকৃত মধ্যবিত্ত পরিবারে বেড়ে ওঠা সুজানগরের শাহীনের। সাত ভাইসহ বিরাট সংসার চালাতে তাদের পিতা আবুল কাশেম ছিলেন হাঁসফাঁস অবস্থায়। তবে ভাগ্য বদলাতে থাকে ২০১৯ সালের পর থেকে। ওই বছর উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন তিনি। এরপর যেন আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। শান্তশিষ্ট উপজেলাকে পরিণত করেন সন্ত্রাসের অভয়ারণ্য হিসেবে। খালবিল, জলাশয় দখল, হাটবাজারের ইজারা, উপজেলার সব নির্মাণকাজে হস্তক্ষেপ, নদী থেকে বালু উত্তোলন, চাঁদাবাজি, গ্রাম্য দলাদলিতে ফায়দা আদায়সহ নানা অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে আয় করেন শত শত কোটি টাকা। কিনেছেন বিপুল পরিমাণ জমি। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে গড়েছেন একাধিক বাড়ি ও ফ্ল্যাট।

শাহীনের এসব দখলদারিত্বে যাদেরই বাধা মনে করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে মামলা-হামলা করেছেন। হত্যার শিকারও হয়েছেন অনেকে। নিজের ভাইদের পাশাপাশি শাহীনের এসব অপরাধ কর্মকাণ্ডে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন শ্যালক রুবেল মিয়াও। সরেজমিন পাবনার সুজানগর উপজেলা ঘুরে সাধারণ জনগণ এবং ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে পাওয়া গেছে এমন তথ্য।

জানা যায়, শাহীনের নিয়ন্ত্রণে অন্তত ৭০টি বালু উত্তোলনের ড্রেজার রয়েছে। এসব ড্রেজার দেখভাল করেন শাহীনের ভাইয়েরা। নদী থেকে অপরিকল্পিত বালু উত্তোলনের কারণে বিভিন্ন স্থানে ভাঙন সৃষ্টি হয়েছে। বিলীন হয়েছে হাজার হাজার একর তিন ফসলি জমি। সরেজমিন চরভবানীপুর, সুজানগর থেকে নাজিরগঞ্জ পর্যন্ত এলাকা ঘুরে পাওয়া গেছে নদীভাঙনে ফসলি জমি বিলীন হওয়ার এমন চিত্র।

স্থানীয় কৃষকরা বলছেন, নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হয়। প্রতিটি সিএফটি বালু বাজারদরের চেয়ে দুই থেকে চার টাকা বেশি দরে বিক্রি করা হয়। এর পরও সাধারণ মানুষকে বেশি দামেই বালু কিনতে বাধ্য করা হয়।

চরভবানীপুর এলাকার আকবর হোসেন কালবেলাকে বলেন, পুরো এলাকায় শাহীন আতঙ্ক। মাইলের পর মাইল নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। কারণ বালু উত্তোলন। এ ছাড়া আগে স্থানীয়ভাবে নদী থেকে বালু উত্তোলন করতেন অনেক ব্যবসায়ী। কম টাকায় সেই বালু কেনা যেত। কিন্তু এখন পুরো সুজানগরে এ বালু ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে শাহীনের লোকজন। নিজেদের ইচ্ছেমতো দাম নেয়।

সুজানগর রেজিস্ট্রি অফিস এবং পাবনা রেজিস্ট্রি অফিস সূত্রে জানা গেছে, গত পাঁচ বছরে এই দুই রেজিস্ট্রি অফিসে প্রায় ৩০ বিঘারও বেশি জমি রেজিস্টি করা হয় শাহীনুজ্জামান এবং তার কাছের স্বজনদের নামে। এ ছাড়া সম্পত্তি গড়ে তুলেছেন শাহীনের শ্যালক রুবেলসহ স্ত্রীর স্বজনরাও। এর মধ্যে জমির পাশাপাশি কিনেছেন প্রাইভেটকার, তৈরি করেছেন মার্কেট। এ ছাড়া শাহীনের নিজ নামে ক্রয় করেছেন পাবনার কাচারী পাড়া এলাকায় একটি তিনতলা এবং একটি একতলা বাড়ি। ঢাকার ইস্কাটনে রয়েছে আলিশান ফ্ল্যাট। রাজধানীর বছিলায়ও জমি কিনে তৈরি করেছেন বাড়ি।

চলতি বছরে অনুষ্ঠিত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে শাহীনুজ্জামান চেয়ারম্যান প্রার্থী ছিলেন। তবে পরাজিত হন। নির্বাচনের সময় বিপুল পরিমাণ টাকাসহ আটকও হন তিনি। এরপর স্থানীয় সংসদ সদস্য এবং প্রভাবশালীদের দৌড়ঝাঁপে ২৪ ঘণ্টা পরে মুচলেকা দিয়ে ছাড়া পান।

২০১৯ এবং ২০২৪ সালের হলফনামা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, মাত্র সাড়ে চার বছরের মধ্যে হলফনামায় বিপুল সম্পদের তথ্য তুলে ধরেছেন শাহীনুজ্জামান। এর মধ্যে ২০১৯ সালে কৃষি জমির পরিমাণ ১০ শতাংশ দেখালেও ২০২৪ সালে সেই জমির পরিমাণ দেখানো হয়েছে প্রায় পাঁচ একর। এ ছাড়াও দেখানো হয়েছে বাড়ি, অ্যাপার্টমেন্ট, ভবনসহ বিপুল সম্পদ, যা ২০১৯ সালের হলফনামায় ছিল না। সঞ্চয়পত্র, ব্যাংকেও রাখা হয়েছে বিপুল পরিমাণ টাকা, যা আগেরবারের হলফনামায় ছিল না।

তথ্য বলছে, শাহীনুজ্জামানের অবৈধ উপায়ে শত শত কোটি টাকা আয়ের প্রাথমিক সত্যতা পায় দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক)। এরপর বিষয়টি বিষদ অনুসন্ধানের জন্য নিয়োগ করা হয় তদন্ত কর্মকর্তা।

জানা যায়, শাহীনুজ্জামানের সঙ্গে দহরম-মহরম সম্পর্ক ছিল পাবনা জেলার তৎকালীন পুলিশ সুপার রফিকুল ইসলামের। সম্প্রতি রফিকুল ইসলামের শত শত কোটি অবৈধ টাকার বিষয়টি সামনে আসে।

সূত্র বলছে, এসব অবৈধ টাকার বেশিরভাগই উপার্জন করেছেন পাবনা থাকাকালীন সময়ে। আর সবকিছু ম্যানেজ করে দিয়েছেন তৎকালীন সুজানগর উপজেলা চেয়ারম্যান শাহীনুজ্জামান।

স্থানীয়রা বলছেন, সাধারণ মানুষকে মামলার ভয় দেখিয়ে অবৈধভাবে টাকা আদায় করতেন শাহীনুজ্জামান। সেই টাকার বড় একটি অংশ দেওয়া হতো রফিকুল ইসলামকে। এমনকি সাধারণ মানুষকে রফিকুল ইসলাম তুচ্ছ কারণে আটক করতেন। এরপর তাদের ছাড়িয়ে আনতেও দেনদরবারের দায়িত্ব পালন করতেন এই সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান। আর এর মাধ্যমে আদায় করতেন অর্থ।

জানা যায়, সম্প্রতি দুদক শাহীনের সম্পত্তির বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া শুরু করলে বিষয়টি সমাধান করে দেওয়ার অনুরোধ করেন একজন দুদক কর্মকর্তাকে। হাফিজুর রহমান নামের দুদকের ওই কর্মকর্তার গ্রামের সুজানগরের রানীনগর ইউনিয়নে। তবে এসব বিষয়ে হস্তক্ষেপে অপরাগতা প্রকাশ করেন হাফিজুর। এতে ক্ষিপ্ত হন শাহীনুজ্জামান। এতেই যেন কালো মেঘ নেমে আসে হাফিজুরের ওপর। স্থানীয়ভাবে একটি মারামারিতে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মামলায় নাম ঢুকিয়ে দেওয়া হয় হাফিজুরের। এরপর সেই হত্যাকাণ্ডের সূত্রধরে পুরো এলাকায় তান্ডব চালান শাহীন। অন্তত শতাধিক বাড়িতে চালানো হয় লুটপাট। অনেকের ঘরবাড়ি ভাঙচুর করা হয়। গবাদি পশু, ঘরের আসবাবপত্রসহ নানা জিনিসপত্র চোখের সামনেই নিয়ে যাওয়া হয়। পুরো এলাকা হয়ে পড়ে পুরুষশূন্য। মহিলার এসব লুটপাটের প্রতিবাদ করলে তাদের ওপরও চালানো হয় নির্যাতন।

থেমে থাকেননি এখানেই। দুদক কর্মকর্তা হাফিজুরের বৃদ্ধ বাবাকে ধরে নিয়ে চালানো হয় নির্মম নির্যাতন। কয়েকদিন হাসপাতালে ভুগে ওই বৃদ্ধ বৃদ্ধ মৃত্যুবরণ করেন। পরে এ ঘটনায় মামলা হয়। সেই মামলায় আসামি করা হয় শাহীনুজ্জামানকে। সূত্র বলছে, শাহীনুজ্জামান স্থানীয় এমপি আহমেদ ফিরোজ কবিরের সুনজরে থাকায় মামলার আসামি করতে বেগ পেতে হয় ভুক্তভোগীদের।

স্থানীয়রা বলছেন, গত পাঁচ বছরে সুজানগরে অন্তত ১০ জন ব্যক্তি খুন হয়েছেন। আর প্রতিটি খুনের পেছনেই রয়েছে শাহীনুজ্জামানের ইশারা। এ ছাড়া গ্রামে গ্রামে দলাদলি তৈরি করে সেখান থেকেও ফায়দা হাসিল করেন এই শাহীন। ব্যবহার করেন পুলিশ প্রশাসনকে। চালানো হয় লুটপাট।

রানীনগরের বাসিন্দা লাইলি বেগম কালবেলাকে বলেন, শাহীন চেয়ারম্যান নেতৃত্ব দিয়ে লুটপাট চালিয়েছে। অনেকের ঘরের টিনের চালাও খুলে নেওয়া হয়েছে। এক বৃদ্ধকে ধরে নিয়ে পিটিয়েছে দীর্ঘসময়। এরপর সেই বৃদ্ধ মারা যান।

এসব বিষয়ে জানতে শাহীনুজ্জামান শাহীনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তবে বাড়িতে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। তার ফোন নম্বরও বন্ধ পাওয়া যায়। সূত্র বলছে, মামলা নথিবদ্ধ হওয়ার সংবাদ পাওয়ার পরে শাহীন গা ঢাকা দিয়েছেন।

জানতে চাইলে পাবনা জেলার পুলিশ সুপার মো. আকবর আলী মুনসী কালবেলাকে বলেন, ‘একটি হত্যা মামলা হয়েছে এটা সঠিক। এখন মামলায় যেভাবে ওনাকে আসামি করা হয়েছে, সেভাবে উনি জড়িত কি না সেটি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

তিনি বলেন, ‘বালুর বিষয়ে অভিযোগ ওঠার সময়েও তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। এ ছাড়া যখন যে অভিযোগই উঠেছে আমরা আইনগত ব্যবস্থা নিয়েছি। এরপরেও সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’