ঢাকা ০৯:২৩ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৮ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::
সকলে একসাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এদেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাব: ৩৩ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি শরীয়তপুরে ছেলের গাছের গোড়ার আঘাতে বাবা নিহত সেই ছেলে গ্রেফতার। ঢাবি ছাত্রশিবিরের সভাপতি কে এই সাদিক শিগগিরই ঢাবি শাখার পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা: শিবির সভাপতি চট্টগ্রাম নগর যুবদলের কমিটি বিলুপ্ত, ২ নেতা বহিষ্কার সরকার পতনের পর এই প্রথম মুখ খুললেন সাদ্দাম-ইনান কিস্তির টাকা দিতে না পারায় গরু ছিনিয়ে নিয়ে গেলেন এনজিও মাঠকর্মীরা রংপুরের মিঠাপুকুরে সড়ক দুর্ঘটনায় দুজন নিহত ভোলায় শহীদ পরিবারদের কোটি টাকার সহায়তা দিল- জামায়াতে ইসলাম জাতিসংঘের ৭৯তম অধিবেশন যোগ দিতে নিউইয়র্কে দৈনিক তরুণ কণ্ঠ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম শান্ত

বিবিসির মোদি তথ্যচিত্র : কেন এত কড়া প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে ভারত?

ঘটনাস্থল মঙ্গলবার রাতে দিল্লির জেএনইউ ক্যাম্পাস। সরকারি নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে একদল ছাত্র-ছাত্রী বড় পর্দায় নরেন্দ্র মোদিকে নিয়ে বিবিসির আলোচিত তথ্যচিত্রটি দেখানোর ব্যবস্থা করেছিল, সেটি দেখার জন্য জমায়েতও হয়েছিল বিশাল।

জেএনইউ কর্তৃপক্ষ এরপরই ছাত্র সংগঠনের অফিসে বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট সংযোগ বিছিন্ন করে দেয়। অন্ধকারের মধ্যেই শত শত ছাত্রী কিউ আর কোড শেয়ার করে নিজেদের মোবাইল বা ল্যাপটপে ডকুমেন্টারিটি দেখতে শুরু করেন – এরই মধ্যে শুরু হয়ে যায় বিরুদ্ধ মতাবলম্বী ছাত্রগোষ্ঠীর পাথরবৃষ্টি। ক্যাম্পাসে ঢোকে দিল্লি পুলিশও, নির্বিচারে লাঠিচার্জ করে তারা। গভীর রাতে জেএনইউ-তে সেই মারপিট ও ধস্তাধস্তির পুনরাবৃত্তি দেখা গেল এদিন রাজধানীর আর একটি নামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়াতেও। আর সেখানেও উপলক্ষ ছিল একই – বিবিসির তথ্যচিত্রটি দেখানো।

জামিয়াতেও কর্তৃপক্ষের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে বামপন্থি ছাত্রদের একটি সংগঠন বড় পর্দায় ডকুমেন্টারিটি দেখানোর ব্যবস্থা করেছিল। কিন্তু দুপুরে দাঙ্গা পুলিশ ক্যাম্পাসে ঢুকে তাদের সেই আয়োজন তছনছ করে দেয়। পূর্ব দিল্লিতে জামিয়ার ক্যাম্পাস রণক্ষেত্র হয়ে ওঠে, ডজনখানেক ছাত্রকে পুলিশ তুলেও নিয়ে যায়। এর আগে গত ৪৮ ঘণ্টা তেলেঙ্গানার হায়দ্রাবাদ ইউনিভার্সিটি, কেরালার কোচি ইউনিভার্সিটিসহ আরও বহু প্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীরা এই ডকুমেন্টারির প্রথম পর্বটি প্রকাশ্যে দেখানোর ব্যবস্থা করেছে।

কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ (বিশ্ববিদ্যালয়) বা যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতেও এই তথ্যচিত্রের স্ক্রিনিং হবে বলে ঘোষণা করা হয়েছে এবং সর্বত্রই আয়োজক ছাত্রগোষ্ঠীগুলো এটা পরিষ্কার করে দিয়েছে সরকারি সেন্সরশিপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতেই তাদের এই পদক্ষেপ। বস্তুত তিন বছর আগে বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন ক্যাম্পাসে যেরকম স্বত:স্ফূর্ত প্রতিবাদ দেখা গিয়েছিল, অনেকটা একই ধরনের দৃশ্য যেন আবার দেখা যাচ্ছে ভারতের নানা প্রান্তে। যদিও প্রতিবাদের বিষয়টা এখানে ভিন্ন।

আর এখানেই এই প্রশ্নটা বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে, কেন বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র বলে যারা নিজেদের দাবি করে থাকে সেই শক্তিশালী ভারত কেন বিবিসির মাত্র ৫৮ মিনিটের (প্রথম পর্ব) একটা তথ্যচিত্রে এত কঠোর প্রতিক্রিয়া জানাল? আর কেনই বা ইউটিউব বা টুইটারকে নির্দেশ দিয়ে তারা এই তথ্যচিত্রের সব লিংকও ব্লক করতে বলল?

‘উপেক্ষা করলেই ভালো হতো’
ভারতের বর্ষীয়ান সম্পাদক ও দ্য হিন্দু পত্রিকাগোষ্ঠীর প্রধান এন রাম মনে করেন, সত্যিকারের পরিণত একটি সরকার হলে তারা এই ধরনের একটি তথ্যচিত্রে ‘নো কমেন্টস’ বলেই জবাব দিত এবং পুরোপুরি উপেক্ষা করত। বাস্তবে কিন্তু দেখা গেছে ভারত সরকার এটিকে ‘প্রোপাগান্ডা পিস’ বলে বর্ণনা করেছে এবং এতে ঔপনিবেশিক মানসিকতার পরিচয় প্রকাশ পাচ্ছে বলেও মন্তব্য করেছে। দেশের আইনমন্ত্রী পর্যন্ত কটাক্ষ করে বলেছেন, ‘বিবিসিকে কেউ কেউ দেশের সুপ্রিম কোর্টেরও ঊর্ধ্বে মনে করেন!’

এন রাম এই জন্যই বলছেন, ‘এই যে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে সরকার যাকে বলে একেবারে ‘গন ব্যালিস্টিক’ (যেন ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে), এটাই একেবারে আত্মঘাতী পদক্ষেপ হয়েছে। সরকার নিজেদের জালে নিজেরাই বল ঢুকিয়েছে।’ বিরোধী তৃণমূল কংগ্রেসের এমপি মহুয়া মৈত্র সোশ্যাল মিডিয়াতে লাগাতার বিবিসির তথ্যচিত্রর লিংক শেয়ার করে চলেছেন। তিনিও মনে করেন ভারতে তথ্যচিত্রটি আটকাতে গিয়েই সরকার এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদকে উসকে দিয়েছে।

মহুয়া মৈত্র বলেন, ‘ডকুমেন্টারিটা ভালো, খারাপ বা কুৎসিত হতে পারে – কিন্তু সেটা আমরা ঠিক করব, যারা দেখছি। সরকার কোন সাহসে বলে কোনটা আমরা দেখব বা কোনটা দেখব না?’ তথ্যচিত্রের কনটেন্টে সরকারের ‘ভয় পাওয়ার মতো বিষয়’ আছে বলেই তারা হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে এটির লিংক ব্লক করতে চাইছে, এ নিয়েও মহুয়া মৈত্রর কোনও সন্দেহ নেই।

ভারতের আর একজন বর্ষীয়ান সাংবাদিক তাভলিন সিং টুইটারে (পরিচালক শেখর কাপুরকে উদ্দেশ্য করে) লিখেছেন, ‘বিবিসির একটা ডকুমেন্টারি যদি ভারতকে ডিস্টেবিলাইজ (অস্থিতিশীল) করতে পারে, তাহলে ভারতের পরাশক্তি হয়ে ওঠার স্বপ্ন না-দেখাই ভালো।’ সেই তাভলিন সিং-ও বিবিসিকে বলছিলেন, ‘পুরো ঘটনাক্রম দেখে আমার মনে হয়েছে এই ডকুমেন্টারিতে যে অস্বস্তিকর প্রশ্নগুলো তোলা হয়েছে সেগুলোর সামনে দাঁড়ানোর মতো সৎ সাহস এদেশে ক্ষমতাসীনদের নেই। আর সে কারণেই তারা মিডিয়ার কণ্ঠরোধ করতে উঠেপড়ে লেগেছেন।’

মোদির ইমেজ রক্ষাই উদ্দেশ্য?
ভারত সরকার কেন এ ধরনের কঠোর প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে, তার আর একটি সম্ভাব্য ব্যাখ্যা দিচ্ছেন আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটির ইতিহাসের অধ্যাপক মোহাম্মদ সাজ্জাদ। তিনি বিবিসিকে বলেন, ‘এদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কিছুদিন আগেই প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছেন, ২০০২ সালে গুজরাটে মুসলিমরা উচিত শিক্ষা পেয়ে গেছে। কাজেই সেই একই বিষয় নিয়ে বিবিসির করা তথ্যচিত্র কেন তারা আটকাতে যাবেন, সেটা একটু অবাক করারই মতো বিষয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘আসলে এর একটাই কারণ হতে পারে, সারা দুনিয়ার সামনে ভারত নরেন্দ্র মোদির একটা অন্য রকমের ইমেজ তুলে ধরতে চায়। সেই ইমেজটা বিশ্বগুরুর, বিশ্বনেতার, সমাজ ও অর্থনীতির কান্ডারীর। কিন্তু বিবিসির তথ্যচিত্র মোদির জন্য বিব্রতকর অন্য একটা ছবি তুলে ধরছে বলেই সরকারের জন্য এটা হজম করা কঠিন।’ বস্তুত গত কয়েকদিনে বিজেপির একাধিক প্রথম সারির নেতাও বলেছেন, বিবিসি কেন এখন এই তথ্যচিত্রটি প্রচার করল, সেই ‘টাইমিং’-টা তাদের কাছে সন্দেহজনক ঠেকছে। নাম প্রকাশ না-করার শর্তে তাদের বক্তব্য ছিল, মাত্র কয়েক মাস আগেই সুপ্রিম কোর্ট নরেন্দ্র মোদিকে গুজরাট দাঙ্গার যাবতীয় দায় থেকে অব্যাহতি দিয়েছে।

পাশাপাশি, বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ২০টি দেশের জোট জি-টোয়েন্টির বর্তমান প্রেসিডেন্ট হিসেবে ভারত এখন সেপ্টেম্বরে শি-বাইডেন-পুতিন-মোদিসহ বিশ্বনেতাদের শীর্ষ সম্মেলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আর ঠিক তখনই নরেন্দ্র মোদির ভাবমূর্তিকে কালিমালিপ্ত করার চেষ্টা হচ্ছে বলে তাদেরও সন্দেহ। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচও মনে করছে, ভারতের সরকারি কর্মকর্তারা ও বিজেপি নেতাকর্মীরা গত কয়েক বছর ধরে বহু পরিশ্রমে ও সযত্নে মোদির একটি বিশেষ ধরনের ইমেজ গড়ে তুলেছেন।

সোমবার দেওয়া এক বিবৃতিতে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, ‘আন্তর্জাতিক স্তরেও গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য যখনই মোদির সামান্যতম সমালোচনা হয়েছে, ভারতের কূটনীতিকরা অত্যন্ত আগ্রাসীভাবে তা প্রতিহত করতে চেয়েছেন।’

স্বপন দাশগুপ্তর যুক্তি
বিবিসির ওই ডকুমেন্টারিতে ক্ষমতাসীন বিজেপির একমাত্র যে নেতা ‘অন রেকর্ড’ ইন্টারভিউ দিয়েছেন, তিনি দলের রাজ্যসভা এমপি স্বপন দাশগুপ্ত। এছাড়া এই তথ্যচিত্রের বিষয়বস্তু নিয়ে ভারত সরকারের বক্তব্য জানতে চেয়ে তাদের প্রতিও বিবিসি অ্যাপ্রোচ করেছিল (‘রাইট টু রেসপন্স’), কিন্তু সরকার তাতে কোনও সাড়া দেয়নি।

তবে ভারতের একটি টিভি চ্যানেলকে স্বপন দাশগুপ্ত মঙ্গলবার বলেছেন, বিবিসি কী উদ্দেশ্য নিয়ে তথ্যচিত্রটি বানাচ্ছে সে সম্পর্কে সাক্ষাৎকার দেওয়ার আগে তার কোনও ধারণাই ছিল না। তবে ‘প্রশ্নের ধরন দেখেই’ বিষয়টি তার কাছে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ভারত সরকার কেন এই তথ্যচিত্রটি উপেক্ষা না-করে এটি বন্ধ করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে, তারও নিজস্ব ব্যাখ্যা দিয়েছেন স্বপন দাশগুপ্ত। ভারতের এনডিটিভিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘সোজা কথা হলো, এই তথ্যচিত্রে ভারতকে এবং ভারতের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে হেয় করা হয়েছে, যার পর সরকারের পক্ষে চুপচাপ বসে থাকা সম্ভব নয়।’

তিনি আরও দাবি করেন, তথ্যচিত্রে এমন একটা ধারণা দেওয়া হয়েছে যে ভারতের বিচারবিভাগ পক্ষপাতপূর্ণ – এ দেশের আদালত শুধু শাসকগোষ্ঠীর পক্ষেই রায় দিয়ে থাকে। অথচ আমরা সবাই জানি এটা কত বড় মিথ্যে। তার দাবি, ‘গুজরাটে ২০০২ সালের দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার একটা অন্তিম ‘ক্লোজার’ কিন্তু আমরা গত বছরেই পেয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু এই ডকুমেন্টারি সেই ঘটনাকে নতুন আকারে প্যাকেজিং করে আবার সেই যন্ত্রণাকে খুঁচিয়ে তুলতে চেয়েছে।’

ব্রিটেনের একটি ‘প্রাইভেট’ প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে এই ধরনের অপচেষ্টার পর ভারত সরকারের পক্ষে চুপচাপ বসে থাকা সম্ভব ছিল না বলেই যুক্তি দিচ্ছেন স্বপন দাশগুপ্ত। তার দলের বহু সতীর্থও এই ব্যাখ্যাতেই সায় দিচ্ছেন।

Tag :

আপনার মতামত লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল ও অন্যান্য তথ্য সঞ্চয় করে রাখুন

আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

সকলে একসাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এদেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাব: ৩৩ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি

বিবিসির মোদি তথ্যচিত্র : কেন এত কড়া প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে ভারত?

আপডেট সময় ১২:৫৫:৪১ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৬ জানুয়ারী ২০২৩

ঘটনাস্থল মঙ্গলবার রাতে দিল্লির জেএনইউ ক্যাম্পাস। সরকারি নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে একদল ছাত্র-ছাত্রী বড় পর্দায় নরেন্দ্র মোদিকে নিয়ে বিবিসির আলোচিত তথ্যচিত্রটি দেখানোর ব্যবস্থা করেছিল, সেটি দেখার জন্য জমায়েতও হয়েছিল বিশাল।

জেএনইউ কর্তৃপক্ষ এরপরই ছাত্র সংগঠনের অফিসে বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট সংযোগ বিছিন্ন করে দেয়। অন্ধকারের মধ্যেই শত শত ছাত্রী কিউ আর কোড শেয়ার করে নিজেদের মোবাইল বা ল্যাপটপে ডকুমেন্টারিটি দেখতে শুরু করেন – এরই মধ্যে শুরু হয়ে যায় বিরুদ্ধ মতাবলম্বী ছাত্রগোষ্ঠীর পাথরবৃষ্টি। ক্যাম্পাসে ঢোকে দিল্লি পুলিশও, নির্বিচারে লাঠিচার্জ করে তারা। গভীর রাতে জেএনইউ-তে সেই মারপিট ও ধস্তাধস্তির পুনরাবৃত্তি দেখা গেল এদিন রাজধানীর আর একটি নামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়াতেও। আর সেখানেও উপলক্ষ ছিল একই – বিবিসির তথ্যচিত্রটি দেখানো।

জামিয়াতেও কর্তৃপক্ষের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে বামপন্থি ছাত্রদের একটি সংগঠন বড় পর্দায় ডকুমেন্টারিটি দেখানোর ব্যবস্থা করেছিল। কিন্তু দুপুরে দাঙ্গা পুলিশ ক্যাম্পাসে ঢুকে তাদের সেই আয়োজন তছনছ করে দেয়। পূর্ব দিল্লিতে জামিয়ার ক্যাম্পাস রণক্ষেত্র হয়ে ওঠে, ডজনখানেক ছাত্রকে পুলিশ তুলেও নিয়ে যায়। এর আগে গত ৪৮ ঘণ্টা তেলেঙ্গানার হায়দ্রাবাদ ইউনিভার্সিটি, কেরালার কোচি ইউনিভার্সিটিসহ আরও বহু প্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীরা এই ডকুমেন্টারির প্রথম পর্বটি প্রকাশ্যে দেখানোর ব্যবস্থা করেছে।

কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ (বিশ্ববিদ্যালয়) বা যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতেও এই তথ্যচিত্রের স্ক্রিনিং হবে বলে ঘোষণা করা হয়েছে এবং সর্বত্রই আয়োজক ছাত্রগোষ্ঠীগুলো এটা পরিষ্কার করে দিয়েছে সরকারি সেন্সরশিপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতেই তাদের এই পদক্ষেপ। বস্তুত তিন বছর আগে বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন ক্যাম্পাসে যেরকম স্বত:স্ফূর্ত প্রতিবাদ দেখা গিয়েছিল, অনেকটা একই ধরনের দৃশ্য যেন আবার দেখা যাচ্ছে ভারতের নানা প্রান্তে। যদিও প্রতিবাদের বিষয়টা এখানে ভিন্ন।

আর এখানেই এই প্রশ্নটা বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে, কেন বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র বলে যারা নিজেদের দাবি করে থাকে সেই শক্তিশালী ভারত কেন বিবিসির মাত্র ৫৮ মিনিটের (প্রথম পর্ব) একটা তথ্যচিত্রে এত কঠোর প্রতিক্রিয়া জানাল? আর কেনই বা ইউটিউব বা টুইটারকে নির্দেশ দিয়ে তারা এই তথ্যচিত্রের সব লিংকও ব্লক করতে বলল?

‘উপেক্ষা করলেই ভালো হতো’
ভারতের বর্ষীয়ান সম্পাদক ও দ্য হিন্দু পত্রিকাগোষ্ঠীর প্রধান এন রাম মনে করেন, সত্যিকারের পরিণত একটি সরকার হলে তারা এই ধরনের একটি তথ্যচিত্রে ‘নো কমেন্টস’ বলেই জবাব দিত এবং পুরোপুরি উপেক্ষা করত। বাস্তবে কিন্তু দেখা গেছে ভারত সরকার এটিকে ‘প্রোপাগান্ডা পিস’ বলে বর্ণনা করেছে এবং এতে ঔপনিবেশিক মানসিকতার পরিচয় প্রকাশ পাচ্ছে বলেও মন্তব্য করেছে। দেশের আইনমন্ত্রী পর্যন্ত কটাক্ষ করে বলেছেন, ‘বিবিসিকে কেউ কেউ দেশের সুপ্রিম কোর্টেরও ঊর্ধ্বে মনে করেন!’

এন রাম এই জন্যই বলছেন, ‘এই যে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে সরকার যাকে বলে একেবারে ‘গন ব্যালিস্টিক’ (যেন ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে), এটাই একেবারে আত্মঘাতী পদক্ষেপ হয়েছে। সরকার নিজেদের জালে নিজেরাই বল ঢুকিয়েছে।’ বিরোধী তৃণমূল কংগ্রেসের এমপি মহুয়া মৈত্র সোশ্যাল মিডিয়াতে লাগাতার বিবিসির তথ্যচিত্রর লিংক শেয়ার করে চলেছেন। তিনিও মনে করেন ভারতে তথ্যচিত্রটি আটকাতে গিয়েই সরকার এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদকে উসকে দিয়েছে।

মহুয়া মৈত্র বলেন, ‘ডকুমেন্টারিটা ভালো, খারাপ বা কুৎসিত হতে পারে – কিন্তু সেটা আমরা ঠিক করব, যারা দেখছি। সরকার কোন সাহসে বলে কোনটা আমরা দেখব বা কোনটা দেখব না?’ তথ্যচিত্রের কনটেন্টে সরকারের ‘ভয় পাওয়ার মতো বিষয়’ আছে বলেই তারা হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে এটির লিংক ব্লক করতে চাইছে, এ নিয়েও মহুয়া মৈত্রর কোনও সন্দেহ নেই।

ভারতের আর একজন বর্ষীয়ান সাংবাদিক তাভলিন সিং টুইটারে (পরিচালক শেখর কাপুরকে উদ্দেশ্য করে) লিখেছেন, ‘বিবিসির একটা ডকুমেন্টারি যদি ভারতকে ডিস্টেবিলাইজ (অস্থিতিশীল) করতে পারে, তাহলে ভারতের পরাশক্তি হয়ে ওঠার স্বপ্ন না-দেখাই ভালো।’ সেই তাভলিন সিং-ও বিবিসিকে বলছিলেন, ‘পুরো ঘটনাক্রম দেখে আমার মনে হয়েছে এই ডকুমেন্টারিতে যে অস্বস্তিকর প্রশ্নগুলো তোলা হয়েছে সেগুলোর সামনে দাঁড়ানোর মতো সৎ সাহস এদেশে ক্ষমতাসীনদের নেই। আর সে কারণেই তারা মিডিয়ার কণ্ঠরোধ করতে উঠেপড়ে লেগেছেন।’

মোদির ইমেজ রক্ষাই উদ্দেশ্য?
ভারত সরকার কেন এ ধরনের কঠোর প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে, তার আর একটি সম্ভাব্য ব্যাখ্যা দিচ্ছেন আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটির ইতিহাসের অধ্যাপক মোহাম্মদ সাজ্জাদ। তিনি বিবিসিকে বলেন, ‘এদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কিছুদিন আগেই প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছেন, ২০০২ সালে গুজরাটে মুসলিমরা উচিত শিক্ষা পেয়ে গেছে। কাজেই সেই একই বিষয় নিয়ে বিবিসির করা তথ্যচিত্র কেন তারা আটকাতে যাবেন, সেটা একটু অবাক করারই মতো বিষয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘আসলে এর একটাই কারণ হতে পারে, সারা দুনিয়ার সামনে ভারত নরেন্দ্র মোদির একটা অন্য রকমের ইমেজ তুলে ধরতে চায়। সেই ইমেজটা বিশ্বগুরুর, বিশ্বনেতার, সমাজ ও অর্থনীতির কান্ডারীর। কিন্তু বিবিসির তথ্যচিত্র মোদির জন্য বিব্রতকর অন্য একটা ছবি তুলে ধরছে বলেই সরকারের জন্য এটা হজম করা কঠিন।’ বস্তুত গত কয়েকদিনে বিজেপির একাধিক প্রথম সারির নেতাও বলেছেন, বিবিসি কেন এখন এই তথ্যচিত্রটি প্রচার করল, সেই ‘টাইমিং’-টা তাদের কাছে সন্দেহজনক ঠেকছে। নাম প্রকাশ না-করার শর্তে তাদের বক্তব্য ছিল, মাত্র কয়েক মাস আগেই সুপ্রিম কোর্ট নরেন্দ্র মোদিকে গুজরাট দাঙ্গার যাবতীয় দায় থেকে অব্যাহতি দিয়েছে।

পাশাপাশি, বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ২০টি দেশের জোট জি-টোয়েন্টির বর্তমান প্রেসিডেন্ট হিসেবে ভারত এখন সেপ্টেম্বরে শি-বাইডেন-পুতিন-মোদিসহ বিশ্বনেতাদের শীর্ষ সম্মেলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আর ঠিক তখনই নরেন্দ্র মোদির ভাবমূর্তিকে কালিমালিপ্ত করার চেষ্টা হচ্ছে বলে তাদেরও সন্দেহ। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচও মনে করছে, ভারতের সরকারি কর্মকর্তারা ও বিজেপি নেতাকর্মীরা গত কয়েক বছর ধরে বহু পরিশ্রমে ও সযত্নে মোদির একটি বিশেষ ধরনের ইমেজ গড়ে তুলেছেন।

সোমবার দেওয়া এক বিবৃতিতে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, ‘আন্তর্জাতিক স্তরেও গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য যখনই মোদির সামান্যতম সমালোচনা হয়েছে, ভারতের কূটনীতিকরা অত্যন্ত আগ্রাসীভাবে তা প্রতিহত করতে চেয়েছেন।’

স্বপন দাশগুপ্তর যুক্তি
বিবিসির ওই ডকুমেন্টারিতে ক্ষমতাসীন বিজেপির একমাত্র যে নেতা ‘অন রেকর্ড’ ইন্টারভিউ দিয়েছেন, তিনি দলের রাজ্যসভা এমপি স্বপন দাশগুপ্ত। এছাড়া এই তথ্যচিত্রের বিষয়বস্তু নিয়ে ভারত সরকারের বক্তব্য জানতে চেয়ে তাদের প্রতিও বিবিসি অ্যাপ্রোচ করেছিল (‘রাইট টু রেসপন্স’), কিন্তু সরকার তাতে কোনও সাড়া দেয়নি।

তবে ভারতের একটি টিভি চ্যানেলকে স্বপন দাশগুপ্ত মঙ্গলবার বলেছেন, বিবিসি কী উদ্দেশ্য নিয়ে তথ্যচিত্রটি বানাচ্ছে সে সম্পর্কে সাক্ষাৎকার দেওয়ার আগে তার কোনও ধারণাই ছিল না। তবে ‘প্রশ্নের ধরন দেখেই’ বিষয়টি তার কাছে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ভারত সরকার কেন এই তথ্যচিত্রটি উপেক্ষা না-করে এটি বন্ধ করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে, তারও নিজস্ব ব্যাখ্যা দিয়েছেন স্বপন দাশগুপ্ত। ভারতের এনডিটিভিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘সোজা কথা হলো, এই তথ্যচিত্রে ভারতকে এবং ভারতের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে হেয় করা হয়েছে, যার পর সরকারের পক্ষে চুপচাপ বসে থাকা সম্ভব নয়।’

তিনি আরও দাবি করেন, তথ্যচিত্রে এমন একটা ধারণা দেওয়া হয়েছে যে ভারতের বিচারবিভাগ পক্ষপাতপূর্ণ – এ দেশের আদালত শুধু শাসকগোষ্ঠীর পক্ষেই রায় দিয়ে থাকে। অথচ আমরা সবাই জানি এটা কত বড় মিথ্যে। তার দাবি, ‘গুজরাটে ২০০২ সালের দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার একটা অন্তিম ‘ক্লোজার’ কিন্তু আমরা গত বছরেই পেয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু এই ডকুমেন্টারি সেই ঘটনাকে নতুন আকারে প্যাকেজিং করে আবার সেই যন্ত্রণাকে খুঁচিয়ে তুলতে চেয়েছে।’

ব্রিটেনের একটি ‘প্রাইভেট’ প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে এই ধরনের অপচেষ্টার পর ভারত সরকারের পক্ষে চুপচাপ বসে থাকা সম্ভব ছিল না বলেই যুক্তি দিচ্ছেন স্বপন দাশগুপ্ত। তার দলের বহু সতীর্থও এই ব্যাখ্যাতেই সায় দিচ্ছেন।