ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পার হতেই সব জায়গায় পাক বাহিনী অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। পরস্পরের সংযোগ স্থাপনের সব সুযোগ হারাতে শুরু করে তারা। পক্ষান্তরে চারদিক থেকে যৌথ বাহিনীর সৈন্যরা একত্রিত হতে থাকলো। এরই মধ্যে ১৯৭১ সালের এই দিনে জেনারেল মানেকশ’র আত্মসমর্পণের বাণী আকাশবাণী থেকে বিভিন্ন ভাষায় প্রচারিত হতে থাকে।
কী বলেছিলেন তার বাণীতে? তিনি বলেন, পাক সেনারা পালাবার কোনও সুবিধা করতে পারবে না। চারদিক থেকে সম্মিলিত বাহিনী ঘিরে ধরেছে। এদিকে পূর্বদিক থেকে সবকটি ডিভিশন প্রচণ্ড গতিতে পশ্চিমের দিকে এগোচ্ছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া দখল করে একদল আশুগঞ্জের দিকে এগোচ্ছে। এই দিনেই পতন হয় কুমিল্লার। পাক বাহিনী আশ্রয় নিলো কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে। জেনারেল অরোরা হেলিকপ্টারে এসে ঘুরে গেলেন কুমিল্লা। কুমিল্লা তখন মুক্ত।
সর্বত্র বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে। চারদিক থেকে সম্মিলিত বাহিনী এগোচ্ছে ঢাকার দিকে। বিভিন্ন প্রবেশ মুখে পাক বাহিনীকে আক্রমণ করবে এই লক্ষ্য নিয়ে পরিকল্পনা মতো এগোচ্ছে তারা। একই সঙ্গে বিমান থেকে এলোপাতাড়ি পাকঘাঁটিতে বোমা বর্ষণ শুরু হয়ে গেছে, যাতে পাক সেনারা আর একাট্টা হতে না পারে। আর সম্মিলিত আক্রমণে যেন তাদের মনোবল ভেঙে যায়, তাহলে তারা আত্মসমর্পণে বাধ্য হবে। সবার মনে তখন একটাই প্রশ্ন— এত অঞ্চল মুক্ত হচ্ছে, ঢাকায় কি যুদ্ধ হবে না? যৌথ বাহিনী যখন ঢাকার দিকে এগোচ্ছে, তখন পিন্ডিতে চলছে নতুন ষড়যন্ত্র।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া কেন্দ্রে একটি কোয়ালিশন সরকার গঠনের জন্য নুরুল আমিনকে আহ্বান জানান। এতে নুরুল আমিন প্রধানমন্ত্রী, আর দোসর ভুট্টো সহকারী প্রধানমন্ত্রী হবেন বলেও ঘোষণা করা হয়। অধিকৃত বাংলায় তথাকথিত উপনির্বাচন স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তখন ঢাকায় চলছে কারফিউ আর ব্ল্যাক আউট। এর মধ্যে মিত্র বাহিনীর বিমান হামলায় রেডিও ঢাকা কেন্দ্র স্তব্ধ হয়ে যায়। বোমা-রকেট ছুড়ে বিধ্বস্ত করে দেওয়া হয় ঢাকার কুর্মিটোলা বিমানবন্দর। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের লেখা ডায়েরি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দলিল।
১৯৮৬ সালে ডায়েরিটি ‘একাত্তরের দিনগুলি’ নামে বই আকারে প্রকাশিত হয়। ৮ ডিসেম্বরের স্মৃতিতে তিনি লিখেছেন, আজ আবার রেডিওতে বললো—সন্ধ্যা ৫টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত কারফিউ এবং ব্ল্যাকআউট, পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত। ছিলই তো বাপু সন্ধ্যা থেকে সকাল পর্যন্ত কারফিউ, আবার নতুন করে এত ঘোষণা দেওয়ার কী আছে? সন্ধ্যাও আজকাল পাঁচটাতেই হয়। এদের দেখছি—মাথার ঘায়ে কুকুর পাগলের মতো হয়েছে।
এই ব্ল্যাকআউট বিষয়ে দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত ১৯৭২ সালের এই দিনের পত্রিকায় বলা হয়, ‘শহরে তখন যুদ্ধ। বাসাবাড়ি কালো কাপড়ে আচ্ছাদিত। ৩ থেকে ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতার চূড়ান্ত পর্যায়ের লড়াই হয়েছিল। বাংলাদেশের সর্বত্র আলোর ফুলকি দেখা যায় না। কোথাও চারদিকে ঘুরঘুরে অন্ধকার কোথাও মৃদু আলো, দরজার ফাঁক দিয়ে দেখলে রাজাকাররা হামলা করতো। অপরদিকে ততদিনে অনেক এলাকায় রাজাকাররা চিহ্নিত হতে শুরু করেছে।
ফলে মুক্তিযোদ্ধারাও নানা জায়গায় রাজাকারদের ওপর আক্রমণ করছে। সে সময় সব বাসাবাড়ির আলো নিভিয়ে দেওয়া, বা কালো কাপড়ে আচ্ছাদিত করে রাখা হতো। ঠিক সন্ধ্যার পরপরই রাস্তা ফাঁকা হয়ে যেতো। পথঘাট অন্ধকার। তখন দোকান খোলা পাওয়া মুশকিল। অধিকাংশ বিকালের পর ঝাঁপি নামিয়ে দিতো। সবকিছুর মধ্যে মানুষের কান থাকতো সজাগ, যদি আওয়াজ আসে আকাঙ্ক্ষিত বিমানের বা সাইরেনের ধ্বনির। বিমান হামলার সময় মানুষ প্রথম দিকে একটু ভয় পেলেও তারা বুঝতে শুরু করেছিল—সম্মিলিত বাহিনীর বিমানকে ভয়ের কিছু নেই।
ব্ল্যাকআউট প্রসঙ্গে জানতে চাইলে, ৮ ডিসেম্বর সম্মিলিত বাহিনীর চূড়ান্ত যুদ্ধ চলছে, উল্লেখ করে ইতিহাসবিদ মুনতাসির মামুন বলেন, বিমান আক্রমণের সঙ্গে ব্ল্যাকআউটের সম্পর্ক ছিল। সেসময় টানা কয়েক দিন তেমনই ছিল ঢাকায়। ততদিনে অনেক এলাকা মুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। বাহিনী তুমুল বেগে ঢাকার দিকে জড়ো হতে শুরু করেছে। তবে পাকিস্তানি বাহিনীর ষড়যন্ত্র তখনও শেষ হয়নি। কেবল যে নানা টোপ ব্যবহার করার অপকৌশল নিয়েছিল তা-ই নয়, ততদিনে তারা বাংলাকে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে ধ্বংস করে দেওয়ার নৃশংস ও জঘন্য পরিকল্পনা করে ফেলেছ। এই দিন যুদ্ধবিরতি ও সৈন্য প্রত্যাহার সম্পর্কিত প্রস্তাবটি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ১০৪ বনাম ১১ ভোটে গৃহীত হয়েছে। ব্রিটেন ও ফ্রান্সসহ ১০টি দেশ ভোটদানে বিরত ছিল।