ঢাকা ০৬:২৬ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৫ জানুয়ারী ২০২৫, ২ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::
নেত্রকোনায় কলেজ শিক্ষকের লাশ উদ্ধার, পুলিশ বলছে হত্যা লালমনিরহাটে কলা চাষে ঝুঁকছে চাষীরা। গরু চুরি করে ভূরিভোজন মাদারগঞ্জে সেই দম্পতিসহ তিনজনকে বিএনপি থেকে বহিষ্কার মাধবপুরে বিএনপি নেতাকর্মীদের মিলন মেলা ও আলোচনা সভা ঈশ্বরদীতে গভীর রাতে অসহায় ও শীতার্ত মানুষের মাঝে কম্বল বিতরণ করছেন, ঈশ্বরদী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোঃ শহিদুল ইসলাম শহীদ। ৩০ লক্ষাধিক টাকার আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে প্রমাণিত: প্রধান শিক্ষক শফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে : গোয়াইনঘাটে ৪৬তম জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সপ্তাহ উদ্বোধন ভোলা জেলার উন্নয়ন শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে খেলাধুলা বাধ্যতামূলক করা হবে : আমিনুল হক মহিলালীগ নেত্রী ও সাবেক ভাইস চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি ও এনজিওকর্মীকে প্রাণনাশের হুমকি

৩০ লক্ষাধিক টাকার আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে প্রমাণিত: প্রধান শিক্ষক শফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে :

ফুসে উঠেছে শিক্ষক, শিক্ষার্থী এলাকাবাসী

দুর্নীতি ও অনিয়ম- তদন্তে প্রমাণিত হলেও নেওয়া হয়নি পদক্ষেপ। এখনও স্বপদে বহাল

 

হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার গণেশপুরে আলহাজ মোজাফফর উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিভিন্ন সময় তাঁর এসব অভিযোগ প্রশাসনিক তদন্তে প্রমাণিত হলেও নেওয়া হয়নি পদক্ষেপ। এখনও স্বপদে বহাল থেকে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন শফিকুল ইসলাম।এরই মধ্যে এই প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে ৩০ লক্ষাধিক টাকার আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে। এ ছাড়া নিয়োগ বাণিজ্য, অবৈধভাবে পরিচালনা কমিটি নির্বাচন, অনিয়মিত এবং বিলম্বে বিদ্যালয়ে আসাসহ বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক অনিয়মের অভিযোগও প্রমাণিত।তথ্য অনুসন্ধানকালে জানা যায়, শফিকুল ইসলাম ২০১৫ সালে আলহাজ মোজাফফর উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। যোগদানের কিছু সময়ের মধ্যেই বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি পাইকপাড়ার ইউপি চেয়ারম্যান এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ওয়াহেদ আলীর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে।

এক পর্যায়ে ওয়াহেদ আলীর মদদে আর্থিক দুর্নীতিসহ বিভিন্ন অনিয়মে জড়াতে শুরু করেন শফিকুল।২০২২ সালের ৩ অক্টোবর বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটির নির্বাচনের সময় ভয়াবহ জালিয়াতির আশ্রয় নেন তিনি। এ সময় ওই বিদ্যালয়ের কর্তব্যরত শিক্ষকদের স্বাক্ষর জাল করে নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা করা হয়। পরে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে নির্বাচন করে নিজের মতো বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি গঠন করেন। এ নিয়ে বিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং স্থানীয় অভিভাবকদের মাঝে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। তবে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীদের প্রশ্রয়ে থাকা শফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে কেউ কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার সাহস করেনি।

৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ১১ আগস্ট বিদ্যালয়ের বর্তমান ও প্রাক্তন প্রায় দুই হাজার শিক্ষার্থী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর প্রধান শিক্ষকের দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে লিখিত অভিযোগ দেন। এতে তাঁর বিরুদ্ধে দেরিতে কর্মস্থলে আসা, নিয়োগ বাণিজ্য, অবৈধ কমিটি গঠনের মাধ্যমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আধিপত্য বিস্তার, উপবৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে চাঁদা আদায়, ফরম পূরণ ও রেজিস্ট্রেশনের সময় অতিরিক্ত টাকা আদায়, ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করাসহ বিভিন্ন বিষয়ে অভিযোগ আনা হয়। তৎকালীন ইউএনও আয়েশা আক্তার অভিযোগগুলো তদন্তের জন্য উপজেলা সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) আহ্বায়ক করে ৫ সদস্যের কমিটি করে দেন। তদন্ত কমিটি ওই প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে আনা সমস্ত অভিযোগের সত্যতা পায়। পরে এসব তথ্য তুলে ধরে ১১ সেপ্টেম্বর তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। ২৭ সেপ্টেম্বর এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর চিঠি প্রস্তুত করেন। তবে ওই চিঠি মহাপরিচালকের দপ্তরে পাঠানো হয় ১৯ ডিসেম্বর।সাবেক ইউএনও আয়েশা আক্তারের ভাষ্য মতে, তদন্ত দলের মাধ্যমে প্রধান শিক্ষক শফিকুল ইসলামের দুর্নীতির সত্যতা পাওয়া গেছে। তাঁর বদলিজনিত সময়স্বল্পতার কারণে তিনি সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে না পারলেও শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছেন।

তবে রহস্যজনক কারণে তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।এদিকে উপজেলা সমবায় কর্মকর্তা কান্তি ভূষণ সেন গুপ্তের নেতৃত্বে একটি নিরীক্ষণ কমিটির দেওয়া ১০ নভেম্বরের তদন্ত প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, প্রধান শিক্ষক শফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে ৩০ লাখ ১৩ হাজার ১৩ টাকা আত্মসাৎসহ নানা অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৭ নভেম্বর শিক্ষকরা তাঁর অপসারণ চেয়ে ইউএনও ও সভাপতি বরাবর আরেক দফা আবেদন করেন।প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি সময়ে প্রতিষ্ঠানের আয়-ব্যয় দেখানো হয়েছে প্রায় ৮৯ লাখ টাকা।

এর মধ্যে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে ৩০ লাখ ১৩ হাজার ১৩ টাকা আত্মসাতের সত্যতা প্রমাণিত হয়। প্রতিবেদনে তথ্য অনুযায়ী আর্থিক দুর্নীতির উল্লেখযোগ্য ক্ষেত্রগুলো হলো, সাদা কাগজে ভাউচার বানিয়ে ২১ লাখ ৮৩ হাজার ৭৯১ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে যেগুলো ক্রয় ও উন্নয়ন উপকমিটি এবং বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি দ্বারা অনুমোদিত নয়। নীতিমালা লঙ্ঘন করে স্কুল মার্কেটের ৮টি দোকানের ভুয়া ভাউচারে মোট ৭ লাখ ৬২ হাজার ২৭৪ টাকা লোপাট করা হয়। প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে রসিদ ছাড়া অর্থ গ্রহণ করা হয়েছে। এমনকি ব্যাংকে লেনদেনের ক্ষেত্রে বিদ্যালয়ের নীতিমালা লঙ্ঘন করে প্রধান শিক্ষক নিজের জিম্মায় টাকা রেখে লেনদেন করেছেন। এ ছাড়া ২০১৮ সাল হতে ২০২৩ সালের ১৬ অক্টোবর পর্যন্ত অর্থ লেনদেনের কোনো ব্যাংক নথিই পাওয়া যায়নি।অডিট বর্ষে মামলা খরচ দেখানো হয়েছে এক লাখ ১০ হাজার টাকা। অথচ এ সময় প্রতিষ্ঠানের নামে কোনো মামলাই হয়নি। এই খরচ বৈধ প্রমাণে জনৈক আইনজীবীর ভুয়া ভাউচার দেখানো হয়। নিয়োগ পরীক্ষার ৩৩ জন প্রার্থীর মধ্যে ভোকেশনাল ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্ট পদের ২৩ প্রার্থীর কাছ থেকে ২৩ হাজার টাকা ব্যাংকড্রাফটের নামে আদায় করা হয়।

অপরদিকে বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষায় ৫০০ টাকা করে ১০ জনের কাছ থেকে ৫ হাজার টাকাসহ সর্বমোট ২৮ হাজার টাকা আদায় করা হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় বিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারীদের কাছ থেকে ৯০ হাজার টাকা আদায় করা হয়েছে; যা বিদ্যালয় ফান্ডে জমা করা হয়নি।প্রশংসাপত্র দেওয়ার সময় শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায় করা অর্থ বিদ্যালয় ফান্ডে জমা করা হয়নি। খণ্ডকালীন শিক্ষকদের ডাবল বেতন দেখানো জমা-খরচ ও খরচের ভাউচার পর্যালোচনা করে দেখা যায়, অনুফা, রবিউল, সুজন ও রিমা নামে শিক্ষকদের ২০২৩ সালের ২৩ মাসের বেতন বাবদ ২১ হাজার টাকা, আবার একই সময় সুজন ও রবিউলের বেতন বাবদ ৮ হাজার টাকা ব্যয় দেখানো হয়। সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে সব স্টাফের বেতনে শিফা, অনুফা, রবিউল, সুজন ও রিমাদের দ্বিতীয়বার বেতন দেখানো হয়।মন্ত্রণালয়ের নিরীক্ষণের নামেও টাকা আত্মসাতের অভিযোগ পাওয়া গেছে, এই প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে। ২০১৮ সালে মন্ত্রণালয় অডিট কার্যক্রম সম্পন্ন হলেও ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে সাদা কাগজে ভাউচার বানিয়ে ২০ হাজার টাকা অডিট বাবদ খরচ দেখানো হয়েছে।

অথচ ২০১৮ সালের ওই অডিটের জন্য আগেই ২০ হাজার টাকা খরচ দেখানো হয়েছে। সংগীতের ভর্তুকি বাবদ অডিট বর্ষে আয় ও ব্যয়ের কোনো হিসাব জমা-খরচ বইতে লিপিবদ্ধ করা হয়নি। পরে তিনি সাদা কাগজে ৮টি ভাউচার বানিয়ে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা খরচ দেখান। অথচ শিক্ষকরা জানান, এই বিষয়ে বিদ্যালয়ে কোনো কার্যক্রমই হয়নি। তা ছাড়া ২০১৯ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ২ লাখ ৬ হাজার ৫০০ টাকা সংস্কৃত মন্ত্রণালয় থেকে অনুদান পাওয়া যায়। সেই টাকাও কৌশলে আত্মসাতের প্রমাণ মিলেছে প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে। করোনা মহামারির সময় স্কুলের বরাদ্দ করা দোকান ভাড়া মওকুফ ও বকেয়ার তথ্য উল্লেখ করে সেই টাকাও আত্মসাৎ করেছেন শফিকুল ইসলাম। একইভাবে তাঁর বিরুদ্ধে অন্যান্য আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগও প্রমাণিত হয়।এদিকে প্রাতিষ্ঠানিক অনিয়মের অভিযোগ তুলে ধরে শফিকুলের বিরুদ্ধে ৪ ডিসেম্বর হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসক বরাবর প্রতিষ্ঠানের ৭ শিক্ষক লিখিত অভিযোগ করেন। এতে বলা হয়, শফিকুল ইসলাম প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেই তাঁর পছন্দের লোকদের নিয়ে ম্যানেজিং কমিটি গঠন করেন।

ওই কমিটি এরই মধ্যে চুনারুঘাট উপজেলা সহকারী কমিশনার মাহবুব আলমের তদন্ত কমিটি দ্বারা অবৈধ বলে প্রমাণিত হয়েছে। প্রধান শিক্ষক দুইবার করে পূর্ণাঙ্গ ও অ্যাডহক কমিটিতে নিজের দ্বিতীয় স্ত্রীর মামা প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা, ইউপি চেয়ারম্যান ওয়াহেদ আলীকে সভাপতি করে নিজের অপকর্ম চালিয়ে যান।এর আগে ২০২৩ সালে অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা এবং অবৈধ কমিটি গঠনের মাধ্যমে বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিঘ্নিত করার অভিযোগ তুলে শফিকুলের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসক বরাবর অভিযোগ জানিয়েছেন আলহাজ মোজাফফর উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা মরহুম মোজাফ্ফর উদ্দিনের নাতি হালিমুর রশিদ। তাঁর এমন অনিয়ম-দুর্নীতির প্রতিবাদ করলে ওই এলাকার আব্দুর রউফ ও শিক্ষক আব্দুল মমিন নামে দুজনের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে হয়রানিমূলক মামলা করেন শফিকুল ইসলাম।যোগাযোগ করা হলে বর্তমান ইউএনও রবিন মিয়া জানান, তিনি মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের আদেশের অপেক্ষায় রয়েছেন। শিক্ষক শফিকুল ইসলামের অনিয়ম ও দুর্নীতি তদন্তে প্রমাণিত।

সবক’টি তদন্ত প্রতিবেদন শিক্ষা অধিদপ্তরে পাঠানো হয়েছে।এসব অভিযোগ এবং তদন্ত প্রতিবেদনের তথ্যের ব্যাপারে কথা বলতে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও সাড়া দেননি প্রধান শিক্ষক শফিকুল ইসলাম। এদিকে স্কুলের শিক্ষকরা জানান, স্কুলে কমেছে শিক্ষার্থী। শিক্ষার্থীরা বলেন স্যার আমাদের এক ছাত্রীকে বিয়ে করছেন এজন্য তারও রয়েছেন বেকায়দায়। শিক্ষকদের অভিযোগ ছাত্রী বিয়ের পর এখন অনেকেই স্যারের বদলে দুলাভাই ডাকেন ওই বিতর্কিত শিক্ষককে।

এলাকাবাসী বলেন, একজন শিক্ষকের কাছে আমাদের সন্তান নিরাপদ নয় তাই তারা তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবী জানান।

Tag :

আপনার মতামত লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল ও অন্যান্য তথ্য সঞ্চয় করে রাখুন

জনপ্রিয় সংবাদ

নেত্রকোনায় কলেজ শিক্ষকের লাশ উদ্ধার, পুলিশ বলছে হত্যা

৩০ লক্ষাধিক টাকার আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে প্রমাণিত: প্রধান শিক্ষক শফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে :

আপডেট সময় ০২:৫২:৩১ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৫ জানুয়ারী ২০২৫

ফুসে উঠেছে শিক্ষক, শিক্ষার্থী এলাকাবাসী

দুর্নীতি ও অনিয়ম- তদন্তে প্রমাণিত হলেও নেওয়া হয়নি পদক্ষেপ। এখনও স্বপদে বহাল

 

হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার গণেশপুরে আলহাজ মোজাফফর উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিভিন্ন সময় তাঁর এসব অভিযোগ প্রশাসনিক তদন্তে প্রমাণিত হলেও নেওয়া হয়নি পদক্ষেপ। এখনও স্বপদে বহাল থেকে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন শফিকুল ইসলাম।এরই মধ্যে এই প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে ৩০ লক্ষাধিক টাকার আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে। এ ছাড়া নিয়োগ বাণিজ্য, অবৈধভাবে পরিচালনা কমিটি নির্বাচন, অনিয়মিত এবং বিলম্বে বিদ্যালয়ে আসাসহ বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক অনিয়মের অভিযোগও প্রমাণিত।তথ্য অনুসন্ধানকালে জানা যায়, শফিকুল ইসলাম ২০১৫ সালে আলহাজ মোজাফফর উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। যোগদানের কিছু সময়ের মধ্যেই বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি পাইকপাড়ার ইউপি চেয়ারম্যান এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ওয়াহেদ আলীর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে।

এক পর্যায়ে ওয়াহেদ আলীর মদদে আর্থিক দুর্নীতিসহ বিভিন্ন অনিয়মে জড়াতে শুরু করেন শফিকুল।২০২২ সালের ৩ অক্টোবর বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটির নির্বাচনের সময় ভয়াবহ জালিয়াতির আশ্রয় নেন তিনি। এ সময় ওই বিদ্যালয়ের কর্তব্যরত শিক্ষকদের স্বাক্ষর জাল করে নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা করা হয়। পরে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে নির্বাচন করে নিজের মতো বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি গঠন করেন। এ নিয়ে বিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং স্থানীয় অভিভাবকদের মাঝে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। তবে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীদের প্রশ্রয়ে থাকা শফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে কেউ কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার সাহস করেনি।

৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ১১ আগস্ট বিদ্যালয়ের বর্তমান ও প্রাক্তন প্রায় দুই হাজার শিক্ষার্থী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর প্রধান শিক্ষকের দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে লিখিত অভিযোগ দেন। এতে তাঁর বিরুদ্ধে দেরিতে কর্মস্থলে আসা, নিয়োগ বাণিজ্য, অবৈধ কমিটি গঠনের মাধ্যমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আধিপত্য বিস্তার, উপবৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে চাঁদা আদায়, ফরম পূরণ ও রেজিস্ট্রেশনের সময় অতিরিক্ত টাকা আদায়, ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করাসহ বিভিন্ন বিষয়ে অভিযোগ আনা হয়। তৎকালীন ইউএনও আয়েশা আক্তার অভিযোগগুলো তদন্তের জন্য উপজেলা সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) আহ্বায়ক করে ৫ সদস্যের কমিটি করে দেন। তদন্ত কমিটি ওই প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে আনা সমস্ত অভিযোগের সত্যতা পায়। পরে এসব তথ্য তুলে ধরে ১১ সেপ্টেম্বর তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। ২৭ সেপ্টেম্বর এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর চিঠি প্রস্তুত করেন। তবে ওই চিঠি মহাপরিচালকের দপ্তরে পাঠানো হয় ১৯ ডিসেম্বর।সাবেক ইউএনও আয়েশা আক্তারের ভাষ্য মতে, তদন্ত দলের মাধ্যমে প্রধান শিক্ষক শফিকুল ইসলামের দুর্নীতির সত্যতা পাওয়া গেছে। তাঁর বদলিজনিত সময়স্বল্পতার কারণে তিনি সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে না পারলেও শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছেন।

তবে রহস্যজনক কারণে তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।এদিকে উপজেলা সমবায় কর্মকর্তা কান্তি ভূষণ সেন গুপ্তের নেতৃত্বে একটি নিরীক্ষণ কমিটির দেওয়া ১০ নভেম্বরের তদন্ত প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, প্রধান শিক্ষক শফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে ৩০ লাখ ১৩ হাজার ১৩ টাকা আত্মসাৎসহ নানা অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৭ নভেম্বর শিক্ষকরা তাঁর অপসারণ চেয়ে ইউএনও ও সভাপতি বরাবর আরেক দফা আবেদন করেন।প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি সময়ে প্রতিষ্ঠানের আয়-ব্যয় দেখানো হয়েছে প্রায় ৮৯ লাখ টাকা।

এর মধ্যে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে ৩০ লাখ ১৩ হাজার ১৩ টাকা আত্মসাতের সত্যতা প্রমাণিত হয়। প্রতিবেদনে তথ্য অনুযায়ী আর্থিক দুর্নীতির উল্লেখযোগ্য ক্ষেত্রগুলো হলো, সাদা কাগজে ভাউচার বানিয়ে ২১ লাখ ৮৩ হাজার ৭৯১ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে যেগুলো ক্রয় ও উন্নয়ন উপকমিটি এবং বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি দ্বারা অনুমোদিত নয়। নীতিমালা লঙ্ঘন করে স্কুল মার্কেটের ৮টি দোকানের ভুয়া ভাউচারে মোট ৭ লাখ ৬২ হাজার ২৭৪ টাকা লোপাট করা হয়। প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে রসিদ ছাড়া অর্থ গ্রহণ করা হয়েছে। এমনকি ব্যাংকে লেনদেনের ক্ষেত্রে বিদ্যালয়ের নীতিমালা লঙ্ঘন করে প্রধান শিক্ষক নিজের জিম্মায় টাকা রেখে লেনদেন করেছেন। এ ছাড়া ২০১৮ সাল হতে ২০২৩ সালের ১৬ অক্টোবর পর্যন্ত অর্থ লেনদেনের কোনো ব্যাংক নথিই পাওয়া যায়নি।অডিট বর্ষে মামলা খরচ দেখানো হয়েছে এক লাখ ১০ হাজার টাকা। অথচ এ সময় প্রতিষ্ঠানের নামে কোনো মামলাই হয়নি। এই খরচ বৈধ প্রমাণে জনৈক আইনজীবীর ভুয়া ভাউচার দেখানো হয়। নিয়োগ পরীক্ষার ৩৩ জন প্রার্থীর মধ্যে ভোকেশনাল ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্ট পদের ২৩ প্রার্থীর কাছ থেকে ২৩ হাজার টাকা ব্যাংকড্রাফটের নামে আদায় করা হয়।

অপরদিকে বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষায় ৫০০ টাকা করে ১০ জনের কাছ থেকে ৫ হাজার টাকাসহ সর্বমোট ২৮ হাজার টাকা আদায় করা হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় বিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারীদের কাছ থেকে ৯০ হাজার টাকা আদায় করা হয়েছে; যা বিদ্যালয় ফান্ডে জমা করা হয়নি।প্রশংসাপত্র দেওয়ার সময় শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায় করা অর্থ বিদ্যালয় ফান্ডে জমা করা হয়নি। খণ্ডকালীন শিক্ষকদের ডাবল বেতন দেখানো জমা-খরচ ও খরচের ভাউচার পর্যালোচনা করে দেখা যায়, অনুফা, রবিউল, সুজন ও রিমা নামে শিক্ষকদের ২০২৩ সালের ২৩ মাসের বেতন বাবদ ২১ হাজার টাকা, আবার একই সময় সুজন ও রবিউলের বেতন বাবদ ৮ হাজার টাকা ব্যয় দেখানো হয়। সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে সব স্টাফের বেতনে শিফা, অনুফা, রবিউল, সুজন ও রিমাদের দ্বিতীয়বার বেতন দেখানো হয়।মন্ত্রণালয়ের নিরীক্ষণের নামেও টাকা আত্মসাতের অভিযোগ পাওয়া গেছে, এই প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে। ২০১৮ সালে মন্ত্রণালয় অডিট কার্যক্রম সম্পন্ন হলেও ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে সাদা কাগজে ভাউচার বানিয়ে ২০ হাজার টাকা অডিট বাবদ খরচ দেখানো হয়েছে।

অথচ ২০১৮ সালের ওই অডিটের জন্য আগেই ২০ হাজার টাকা খরচ দেখানো হয়েছে। সংগীতের ভর্তুকি বাবদ অডিট বর্ষে আয় ও ব্যয়ের কোনো হিসাব জমা-খরচ বইতে লিপিবদ্ধ করা হয়নি। পরে তিনি সাদা কাগজে ৮টি ভাউচার বানিয়ে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা খরচ দেখান। অথচ শিক্ষকরা জানান, এই বিষয়ে বিদ্যালয়ে কোনো কার্যক্রমই হয়নি। তা ছাড়া ২০১৯ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ২ লাখ ৬ হাজার ৫০০ টাকা সংস্কৃত মন্ত্রণালয় থেকে অনুদান পাওয়া যায়। সেই টাকাও কৌশলে আত্মসাতের প্রমাণ মিলেছে প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে। করোনা মহামারির সময় স্কুলের বরাদ্দ করা দোকান ভাড়া মওকুফ ও বকেয়ার তথ্য উল্লেখ করে সেই টাকাও আত্মসাৎ করেছেন শফিকুল ইসলাম। একইভাবে তাঁর বিরুদ্ধে অন্যান্য আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগও প্রমাণিত হয়।এদিকে প্রাতিষ্ঠানিক অনিয়মের অভিযোগ তুলে ধরে শফিকুলের বিরুদ্ধে ৪ ডিসেম্বর হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসক বরাবর প্রতিষ্ঠানের ৭ শিক্ষক লিখিত অভিযোগ করেন। এতে বলা হয়, শফিকুল ইসলাম প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেই তাঁর পছন্দের লোকদের নিয়ে ম্যানেজিং কমিটি গঠন করেন।

ওই কমিটি এরই মধ্যে চুনারুঘাট উপজেলা সহকারী কমিশনার মাহবুব আলমের তদন্ত কমিটি দ্বারা অবৈধ বলে প্রমাণিত হয়েছে। প্রধান শিক্ষক দুইবার করে পূর্ণাঙ্গ ও অ্যাডহক কমিটিতে নিজের দ্বিতীয় স্ত্রীর মামা প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা, ইউপি চেয়ারম্যান ওয়াহেদ আলীকে সভাপতি করে নিজের অপকর্ম চালিয়ে যান।এর আগে ২০২৩ সালে অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা এবং অবৈধ কমিটি গঠনের মাধ্যমে বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিঘ্নিত করার অভিযোগ তুলে শফিকুলের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসক বরাবর অভিযোগ জানিয়েছেন আলহাজ মোজাফফর উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা মরহুম মোজাফ্ফর উদ্দিনের নাতি হালিমুর রশিদ। তাঁর এমন অনিয়ম-দুর্নীতির প্রতিবাদ করলে ওই এলাকার আব্দুর রউফ ও শিক্ষক আব্দুল মমিন নামে দুজনের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে হয়রানিমূলক মামলা করেন শফিকুল ইসলাম।যোগাযোগ করা হলে বর্তমান ইউএনও রবিন মিয়া জানান, তিনি মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের আদেশের অপেক্ষায় রয়েছেন। শিক্ষক শফিকুল ইসলামের অনিয়ম ও দুর্নীতি তদন্তে প্রমাণিত।

সবক’টি তদন্ত প্রতিবেদন শিক্ষা অধিদপ্তরে পাঠানো হয়েছে।এসব অভিযোগ এবং তদন্ত প্রতিবেদনের তথ্যের ব্যাপারে কথা বলতে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও সাড়া দেননি প্রধান শিক্ষক শফিকুল ইসলাম। এদিকে স্কুলের শিক্ষকরা জানান, স্কুলে কমেছে শিক্ষার্থী। শিক্ষার্থীরা বলেন স্যার আমাদের এক ছাত্রীকে বিয়ে করছেন এজন্য তারও রয়েছেন বেকায়দায়। শিক্ষকদের অভিযোগ ছাত্রী বিয়ের পর এখন অনেকেই স্যারের বদলে দুলাভাই ডাকেন ওই বিতর্কিত শিক্ষককে।

এলাকাবাসী বলেন, একজন শিক্ষকের কাছে আমাদের সন্তান নিরাপদ নয় তাই তারা তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবী জানান।