চারদলীয় জোট সরকারের (২০০১-২০০৬) শাসনামলকে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের স্বর্ণযুগ বলা হয়। কেননা, এই সময়কালে বাংলাদেশ অসংখ্য সন্ত্রাসী হামলা প্রত্যক্ষ করেছে, বোমা হামলায় প্রাণ দিতে হয়েছে মানুষকে, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সম্পত্তি এবং আহতরা ভুগে ভুগে জীবন পার করছে।
৭ ডিসেম্বর ২০০২ সালে ময়মনসিংহের ৪টি সিনেমা হলে বোমা হামলার ঘটনা ঘটে এবং এতে ২৭ জন নিহত হয় ও আহত হয় ২৯৮ জন। ২০০৩ সনের ১৭ জানুয়ারি টাঙ্গাইলের সখীপুরে সুফি সমাধিতে বোমা বিস্ফোরণে ৯ জন নিহত হয় এবং আহত হয় ২৬ জন। ১৩ ফেব্রুয়ারি দিনাজপুর মেসে বোমা বিস্ফোরণে ৩ জন মানুষ নিহত হয়। ১২ জানুয়ারি ২০০৪ সালে সিলেটের শাহজালালের মাজারে বোমা বিস্ফোরণে ৫ জন নিহত হয় এবং ৫২ জন আহত হয়।
প্রখ্যাত লেখক অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের উপর আকস্মিক আক্রমণ হয় ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০০৪ সালে এবং এতে তিনি গুরুতর আহত ও পরে মৃত্যুবরণ করেন। ২ এপ্রিল ২০০৪ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে ১০ ট্রাক অস্ত্রবাহী জাহাজের চালান আটক হয়, ২০০৪ সালের ২১ মে শাহজালালের মাজারে বোমা বিস্ফোরণে ৮ জন নিহত হয় ও ব্রিটিশ হাইকমিশনারসহ ১০১ জন আহত হয়।
একজন বিদেশি কূটনৈতিকের উপর পরিকল্পিতভাবে এই ধরনের ঘটনা বিশ্ব গণমাধ্যমে ব্যাপক সাড়া ফেলে। উল্লেখ্য, হাইকমিশনার সিলেটেই জন্ম গ্রহণ করেছিলেন, নিজ ভূমিতে এই ধরনের হামলায় তিনি হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিলেন। ঘটনাগুলোর বিবরণ হয়তো খুব স্বাভাবিকভাবে উল্লেখ করা হয়েছে কিন্তু অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে ভাবলে ঘটনাগুলোর ভয়াবহতা সন্ত্রাসের রাজত্বের প্রতিচ্ছবিকে তুলে ধরে। অবশ্য একটি পক্ষ সন্ত্রাসের রাজত্বকে বৈধতা দিয়ে ক্ষমতাকে দীর্ঘমেয়াদি করার বন্দোবস্ত করেছিল।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে সব থেকে ন্যক্কারজনক ও প্রতিহিংসার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল ২১ আগস্টে আওয়ামী লীগের জনসমাবেশে। শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে সভাস্থলে গ্রেনেড হামলায় ২৪ জন নিহত হয় এবং আহত হয় ৫০৩ জন। অল্পের জন্য তিনি বেঁচে ফিরেন এবং আহতদের অনেকের মতো তিনিও হামলার রেশ বয়ে বেড়াচ্ছেন। এই ঘটনাকে তৎকালীন সরকার নানাভাবে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে জজ মিয়া নাটক মঞ্চস্থ করলেও বর্তমানে বিষয়টি খোলাসা হয়েছে এবং প্রকৃত দোষীদের বিরুদ্ধে রায় ঘোষিত হয়েছে।
এখন অপেক্ষা কার্যকরের, পরবর্তীতে ২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি শাহ এ এম এস কিবরিয়ার জনসমাবেশে গ্রেনেড হামলায় অর্থমন্ত্রী কিবরিয়াসহ ৫ জন নিহত হয় এবং আহত হয় ১৫০ জন। জঙ্গিবাদের স্বরূপ পরিপূর্ণরূপে প্রতিস্থাপিত হয় ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট, সারাদেশে একযোগে ৬৩ জেলায় বোমা হামলার ঘটনা ঘটায় জঙ্গিরা এবং এতে ৩ জন নিহত হয় ও আহত হয় কমপক্ষে ১০০ জন।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে সব থেকে ন্যক্কারজনক ও প্রতিহিংসার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল ২১ আগস্টে আওয়ামী লীগের জনসমাবেশে…
এছাড়া আদালত ভবনে বোমা হামলা, উদীচী অফিসে হামলা, জেলা প্রশাসক অফিসে বোমা হামলা, আইনজীবী অফিসে বোমা বিস্ফোরণ, পুলিশ বক্সে বোমা হামলার মতো অসংখ্য ঘটনাবলীর চিত্র দেখেছে বাংলাদেশ। অর্থাৎ মানুষের মধ্যে ভয়ের আশঙ্কা ও আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনায় সাধারণ জনগণ সর্বদা তটস্থ থাকত এবং একটি অজানা শঙ্কায় মানুষকে জীবনধারণ করতে হয়েছে।
বাংলাদেশের মানুষ কি আবারও এই ধরনের জঙ্গিবাদ, নিদারুণ, বিভীষিকাময় পরিস্থিতির যুগে প্রবেশ করতে চায়? অবশ্যই না। কেননা আমরা দেখেছি, হলি আর্টিজান হামলা ও কল্যাণপুরে নিহত জঙ্গিদের লাশ পরিবার গ্রহণ করেনি। অর্থাৎ জঙ্গিবাদের মতো জঘন্য অপকর্মকে কোনো অভিভাবক ও পরিবার সমর্থন করতে পারে না, তবে কিশোরদের জঙ্গিবাদে সম্পৃক্ত হওয়ার পেছনে পরিবারেরও দায় রয়েছে। ছেলেমেয়েরা কাদের সঙ্গে মিশছে, কোথায় পড়াশোনা করছে, অবসর সময়ে কীভাবে সময় কাটাচ্ছে ইত্যাদি বিষয়ে অভিভাবকদের নজরদারির প্রয়োজন রয়েছে। তা না হলে ছেলেমেয়েরা যেকোনো পরিস্থিতিতে বিপথগামী হয়ে উঠতে পারে।
জঙ্গিরা যে প্রক্রিয়ায় এদেশের শান্তিপ্রিয়, মুক্তচিন্তার মানুষকে নৃশংস ও বর্বরতম উপায়ে হত্যা করেছে, অর্থনীতিকে বিকল করার অপচেষ্টা করেছে, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলো টার্গেট করে আঘাত করেছে, বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব নিয়ে ছেলেখেলা করেছে সেসব যৌক্তিক কারণে এই দেশের আপামর জনসাধারণ কখনোই জঙ্গিবাদকে সমর্থন করতে পারে না। যেখানে মানুষের জীবনের নিশ্চয়তা নেই, স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার অধিকার নেই, পরিবার পরিজনকে নিয়ে সর্বত্র ভয়ে থাকতে হয় সেই রকম জঙ্গিবাদের যুগে বাংলাদেশের সংগ্রামী ও শান্তিপ্রিয় মানুষ কখনোই ফিরে যেতে চাইবে না।
যারা জঙ্গিদের পৃষ্ঠপোষকতা করে, ক্ষমতায় থাকার উৎস হিসেবে জঙ্গিদের ব্যবহার করে তাদের বাংলাদেশের মানুষ কখনোই সমর্থন দেবে না, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় দেখতে চায় না। নিয়মিতভাবে এই ধরনের বোমা হামলা কোনো সমাজ ও রাষ্ট্রে ঘটতে থাকলে সেই রাষ্ট্রে বসবাসরত মানুষ শঙ্কা ও দ্বিধার মধ্য দিয়ে পার হয়। কেননা যেকোনো সময় যেকোনো অবস্থাতেই তাদের পরিবার পরিজনের ওপর এই ধরনের হামলার আশঙ্কা থাকে।
অন্যদিকে এই ধরনের বোমাবাজি, গ্রেনেড বিস্ফোরণের ঘটনা মূলত দুর্বল নিরাপত্তা ব্যবস্থা তথা নিরাপত্তাহীনতায় নির্দেশ করে। কাজেই ২০০১-২০০৬ সময়কাল বাংলাদেশ জঙ্গিদের বিচরণক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে এবং সাধারণ নাগরিকেরা মানবাধিকার ও মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
পাকিস্তানের দিকে তাকালে বোঝা যায়, পাকিস্তান একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা প্রভৃতির ক্ষেত্রে একটি রাষ্ট্র যখন তার নাগরিকদের সঠিকভাবে প্রদানে ব্যর্থ হয় তখনই সেটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হয়। তৎকালীন সময়ে জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীগুলো রাষ্ট্রীয় মদদে বাংলাদেশকে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার প্রক্রিয়া অনুসরণ করেছিল।
যদি বাংলাদেশে জঙ্গি ও জঙ্গিবাদের অবাধ বিচরণ বিদ্যমান থাকে তাহলে বাংলাদেশে কালো টাকার দাপট বেড়ে যাবে, অবৈধভাবে অর্থ উপার্জনের নেশায় মত্ত হয়ে পড়বে একশ্রেণির অসাধু মানুষ। আর্থিকভাবে যেসব প্রতিষ্ঠান জঙ্গিদের সহায়তা করে তারা দেশি বিদেশি আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে বিভিন্ন উপায়ে সহজেই ফান্ড সংগ্রহ করতে পারে।
জঙ্গিদের হাতে নিয়ন্ত্রণ চলে গেলে সরকারের ভারসাম্য নষ্ট হবে, দেশের অভ্যন্তরে গভীর সংকটের সৃষ্টি হবে। জঙ্গিদের নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্র চলে গেলে ধর্ম ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য বাড়বে, মৌলবাদী শক্তিগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে।
আমরা জানি, জঙ্গিদের আর্থিকভাবে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহ, আন্তর্জাতিক এনজিও ও বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান। শুধু তাই নয়, জঙ্গিদের দিয়ে তারা তাদের আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থা, সংবাদমাধ্যম, ট্রাস্ট, ফাউন্ডেশন, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান নামমাত্র পরিচালনা করে সম্পূর্ণ মুনাফা গ্রহণ করে।
যদি বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটে তাহলে মানি লন্ডারিংয়ের ঘটনা অহরহ ঘটবে। হুন্ডি, বাট্টা ইত্যাদির মাধ্যমে দেশে বিদেশে অর্থ লেনদেন হবে, পাচার হবে। ধীরে ধীরে রেমিটেন্সের পরিমাণ কমে আসবে, রিজার্ভে সংকট দেখা যাবে। রিজার্ভ সংকট ঘটলে বাংলাদেশের স্থিতাবস্থা নষ্ট হয়ে যাবে।
ইউক্রেন-রাশিয়া সংকট ও করোনা মহামারিতে যখন বিশ্বের অনেক দেশই নাকানিচুবানি খাচ্ছে সেখানে বাংলাদেশের রিজার্ভের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে থাকায় বাংলাদেশকে কোনো ধরনের সমস্যায় পড়তে হয়নি। কাজেই বাংলাদেশের মানুষ কখনোই জঙ্গিবাদের যুগে ফেরত আসতে চাইবে না, জঙ্গিদের হাতে নিয়ন্ত্রণ চলে গেলে সরকারের ভারসাম্য নষ্ট হবে, দেশের অভ্যন্তরে গভীর সংকটের সৃষ্টি হবে।
জঙ্গিদের নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্র চলে গেলে ধর্ম ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য বাড়বে, মৌলবাদী শক্তিগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। যেখানে সেখানে তাদের মতো করে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যাবে, সেখানে বাস্তবতার মিশেলে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে না। এরূপ পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ বিপদগ্রস্থ হয়ে পড়বে, মাথা তুলে দাঁড়াবার সুযোগ পাবে না।
জঙ্গিদের দৌরাত্ম্য বৃদ্ধি পেলে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পের লেলিহান শিখায় সাধারণ জনগণের জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে, সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা বেড়ে যাবে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির উত্থান হবে, দখলদারিত্বের রাজনীতি বাড়বে এবং দেশীয় উৎপাদন কমে যাবে। বিদেশি বিনিয়োগ কমে যাবে, অর্থনীতিতে ধ্বস নেমে আসবে। ক্যাডারভিত্তিক রাজনীতির আবির্ভাব ঘটবে।
প্রতিক্রিয়াশীলদের দাপটে প্রগতিশীলদের স্বাভাবিক বেঁচে থাকাই মুশকিল হয়ে যাবে, সবকিছু নষ্টদের দখলে চলে যাবে। কাজেই বাংলাদেশের মানুষ কখনোই এই ধরনের প্রতিক্রিয়াশীল কর্মকাণ্ড সমর্থন করবে না অর্থাৎ জঙ্গিবাদের মদদপুষ্ট সরকার বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হোক এটা কখনোই চাইবে না।