আমি কোনো দল-মত-সংগঠন নিষিদ্ধ করার বিরুদ্ধে। আর অপরাধপ্রবণ ছাত্রলীগ সমাজে সব বিরুদ্ধমত বিনাশ করতে চায়। তাই আমি ছাত্রলীগ ব্যান্ড করে দেওয়ার সিদ্ধান্তের প্রতি সমর্থন জানাচ্ছি।
আমি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। গণতন্ত্রের রীতি হচ্ছে দেশে-সমাজে সব মতই থাকবে। প্রতিটি মতই যুক্তি ও পালটা যুক্তির মাধ্যমে একে অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করবে। এর মধ্য দিয়ে সত্যটা বেরিয়ে আসবে। অথবা মানুষ দেখে-শুনে তার পছন্দের মতটিকে গ্রহণ ও অপছন্দেরটিকে বর্জন করতে পারবে।
মতামত, আদর্শ ও কর্মসূচিকে ভিত্তি করে সংগঠন গড়ে ওঠে। সেই সংগঠনের কেউ একজন, কিংবা অনেকে কখনো অন্যায়-অপরাধ করলে তার জন্য দায়ী ব্যক্তির বিচার হবে। তবে পুরো সংঠনকে দায়ী করে নিষিদ্ধ করে দেওয়াটা উচিৎ নয়। এটাই গণতন্ত্রের পথ। কারণ, অপরাধ করে ব্যক্তি কিংবা ব্যক্তির সমষ্টি। সাজা হওয়া উচিৎ তার কিংবা তাদেরই।
তাছাড়া একটি সংগঠন নির্দিষ্ট কোনো অপরাধ সংঘটনকালে সীমাবদ্ধ নয়। তার অতীত ও ভবিষ্যৎ থাকে। কাজেই একটি নির্দিষ্ট সময়ের অন্যায়-অপরাধের জন্য সেই সংগঠনের নিরপরাধ অতীত ও ভবিষ্যতকে শাস্তির আওতায় আনা যায় না।
তবে সব কিছুরই ব্যাতিক্রম আছে। দ্বিতীয় মহাসমরের পর ইতালির ফ্যাসিস্ট ও জার্মানির নাৎসি মতকে নিজ নিজ দেশে তো বটেই, সারা ইউরোপেই নিষিদ্ধ করা হয়। সেটা গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তই ছিল। সে সিদ্ধান্ত বহাল আছে এখনও। ওই মতের ভিত্তিতে গঠিত সে সময়কার সব সংগঠন ব্যান্ড করা হয়। ভবিষ্যতের জন্যও এইসব মতাদর্শের ভিত্তিতে কোনো সংগঠন গড়া নিষিদ্ধ করা আছে।
ব্যান্ড করার এ সিদ্ধান্ত কেমন করে গণতান্ত্রিক হলো? এক্ষেত্রে যুক্তি হলো, যে মতাদর্শ সমাজে অন্যায়-অপরাধকে উৎসাহিত করে এবং লক্ষ্য অর্জনের পন্থা হিসেবে বেছে নেয় সেই মতাদর্শ আসলে কোনো মত নয়, সেটি একটি অপরাধ এবং প্রতিটি অপরাধই শাস্তিযোগ্য। কাজেই অপরাধ সংঘটনে উৎসাহিত করার মতো কোনো মতবাদ সমাজে অনুমোদনযোগ্য নয়। এর ভিত্তিতে কোনো সংগঠন করতে দেওয়াও অপরাধকে প্রশ্রয় দেওয়ার সমতুল্য।
এখন কোথাও দ্বিতীয় মহাসমরকালীন পরিস্থিতি ও বাস্তবতা বিরাজ করছে না। তাছাড়া ছাত্রলীগের কাগজে ছাপা যে আদর্শ ও কর্মসূচি তাতে অনেক মহৎ কথাই লেখা আছে। ওতে অন্যায়-অপরাধকে উৎসাহ যোগানো হয়নি কিংবা অপরাধকে লক্ষ্য হাসিলের কর্মপন্থা হিসেবে বেছে নেওয়ার কথাও বলা নেই। তবুও কেন ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ?
ছাত্রলীগ ব্যান্ড করার পেছনে সরকার কিছু কারণ দেখিয়েছে ও যুক্তি দিয়েছে৷ সেগুলো হচ্ছে- বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে বিশেষ করে গত ১৫ বছরের স্বৈরাচারী শাসনামলে আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগ হত্যা, নির্যাতন, গণরুমকেন্দ্রিক নিপীড়ন, ছাত্রাবাসে সিট বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নসহ নানান রকম জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল। যার প্রামাণ্য তথ্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে এবং কিছু সন্ত্রাসী ঘটনায় সংগঠনটির নেতা-কর্মীদের অপরাধ আদালতেও প্রমাণিত হয়েছে।
এছাড়া, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আন্দোলনরত ছাত্র-ছাত্রী ও সাধারণ জনগণের ওপর উন্মত্ত ও বেপরোয়া সশস্ত্র আক্রমণ চালিয়ে শত শত নিরপরাধ শিক্ষার্থী ও ব্যক্তিদের হত্যা এবং অসংখ্য মানুষের জীবন বিপন্ন করেছে।
সরকার আরও দাবি করেছে যে, গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরও ছাত্রলীগ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক, ধ্বংসাত্মক ও উস্কানিমূলক কর্মকাণ্ড এবং বিভিন্ন সন্ত্রাসী কার্যকলাপে জড়িত রয়েছে এমন যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ তাদের হাতে রয়েছে।
এই কথাগুলোর প্রায় সবই ঠিক, কোনোটাই মিথ্যে নয়। তবুও এই কারণ ও যুক্তিগুলো ছাত্রলীগকে ব্যান্ড করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট বলে আমার মনে হয় না। ছাত্রলীগের ইতিহাস স্বাধীনতার পর থেকে শুরু হয়নি কিংবা গত ১৫ বছরেই সীমাবদ্ধ নয়। ভবিষ্যতেও ছাত্রলীগ টিকে থাকলে সেই সংগঠনের আগামী দিনের নেতা-কর্মীরাও যে অপরাধমূলক তৎপরতাতেই লিপ্ত থাকবে তাও নিশ্চিত করে বলা যায় না। কাজেই সমকালের নেতা-কর্মীদের অন্যায়-অপরাধের জন্য অতীত-ভবিষ্যৎসহ পুরো সংগঠনকে শাস্তির আওতায় আনা উচিৎ নয়। বরং ‘অপরাধীর কোনো দল নেই’ নীতির আলোকে প্রতিটি অপরাধের ঘটনায় জড়িত ব্যক্তির বিচার ও উপযুক্ত সাজা নিশ্চিত করাটাই সঠিক পদক্ষেপ।
এই যুক্তির ওপরে দাঁড়িয়েও আমি ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত সমর্থন করছি। আমি মনে করি, চিরকালের জন্য নয়, অন্ততপক্ষে কিছুকালের জন্য হলেও ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ থাকা উচিৎ। ছাত্রলীগে থেকে যে নেতা-কর্মীরা বিভিন্ন অন্যায়-অপরাধ করেছে তার জন্য তারা প্রত্যেকে ব্যক্তিগতভাবে যেমন দায়ী সেই সঙ্গে সমান সত্য হচ্ছে ছাত্রলীগের সাংগঠনিক শক্তির মদত ছাড়া তারা এসব করতে পারেনি। কাজেই তাদের অপরাধ কেবল ব্যক্তিগত নয়, সংগঠনও এড়াতে পারে না এর দায়। কান টানলে যেমন মাথা আসে, তেমনই সংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগের পেছনে আওয়ামী ক্ষমতাসীনদের দায়ও চলে আসে। ন্যায়বিচার হলে তা অবশ্যই চলে আসবে। ক্ষমতাহীনদের চেয়ে ক্ষমতাসীনদের অন্যায় অনেক বেশি গুরুতর এবং এর সঠিক বিচার না হওয়াটা রাষ্ট্রীয় পাপাচার বলে গণ্য হয়ে থাকে।
এই যে এতো অন্যায়-অপরাধ, তার জন্য সংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগ একফোঁটা অনুশোচনাও প্রকাশ করেনি। বরঞ্চ তারা তাদের সব কার্যকলাপকে মহিমামণ্ডিত এবং অভিযোগনামাকে চক্রান্ত হিসেবে অভিহিত করে চলেছে। এর মাধ্যমে তারা সংগঠন হিসেবেই নেতা-কর্মীদের অন্যায়-অপরাধকে আশকারা দিয়ে আসছে। তারা সমাজে সব মতের অবাধ প্রতিযোগিতায় বিশ্বাস করে না। বরং সব বিরুদ্ধমতকে বলপ্রয়োগে বিলুপ্ত করতে চায়। এ ধরণের একটি সংগঠনকে সমাজে অবাধ তৎপরতার অনুমোদন দিয়ে রাখাটা অপরাধকে প্রশ্রয় দেওয়ারই শামিল।
ছাত্রলীগকে ব্যান্ড করার সিদ্ধান্তটিকে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বলে মনে হয় না আমার। বরং এটি অনেক বেশি সম্পর্কিত আইন-শৃঙ্খলা ও ন্যায়বিচারের সঙ্গে। ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা একটা সময়জুড়ে নিজেদেরকে আইনের ঊর্ধে বিবেচনা করে বিভিন্ন অপরাধমূলক তৎপরতা চালাতে পেরেছে। তখন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত বাহিনীগুলোকেও তারা তাদের অপরাধকর্মের দোসর বা প্রহরী হিসেবে ব্যবহার করতে পেরেছে। এখন ছাত্রলীগকে একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ব্যান্ড বা ডিজমেন্টাল করার মাধ্যমে সংঘবদ্ধতা থেকে বিযুক্ত করেই তাদেরকে আইনের আওতায় আনতে হবে; আর কোনও পথ নেই। এছাড়া নাগরিকদের সমতা ও ন্যায়বিচারের দাবি প্রতিষ্ঠাও সম্ভব হবে না।