সাধারণ বীমা গ্রহীতাদের জমা করা প্রিমিয়ামের টাকা (লাইফ ফান্ড) নিজের এবং পরিবারের সদস্যদের ব্যক্তিগত কাজে ইচ্ছা মতো খরচ করছেন সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির চেয়ারম্যান মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস। স্বজনপ্রীতি অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে। পরিচালনা পর্ষদে থাকা তাঁর পরিবারের সদস্যরাও একইভাবে নগদে ও চেকে অর্থ নিয়েছেন। এভাবে প্রায় ৯০০ কোটি টাকার লাইফ ফান্ড থেকে অন্তত ৩০০ কোটি টাকা তছনছ করেছেন তারা।
এ বিষয়ে স্বচ্চার হয়ে শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির এমডি ও সিইও মীর রাশেদ বিন আমান এমন। বিএসইসি সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। গত সোমবার জমা দেওয়া অভিযোগপত্রে সোনালী লাইফের এমডি বলেছেন, পরিচালনা পর্ষদের দুর্নীতির তথ্য উদ্ঘাটনে এরই মধ্যে বীমা নিয়ন্ত্রক ও উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) বিশেষ নিরীক্ষক হিসেবে হুদা ভাসি অ্যান্ড কোংকে নিয়োগ দিয়েছে। অডিট প্রতিষ্ঠানটি যাতে সঠিক তথ্য পেতে না পারে, সে জন্য গত এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে অফিস করতে দিচ্ছেন না চেয়ারম্যান। তিনি জেনেছেন, অডিট প্রতিষ্ঠানকেও অডিট করতে অফিসে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না।
তবে মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস বর্তমান এমডির আনা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, ‘রাশেদ আমার মেয়ের জামাই। সে বীমা কোম্পানির এক নারী কর্মকর্তার সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে বিয়েও করেছে। মানসম্মান হারানোর ভয়ে বিষয়টি গোপন রেখেছি। কিন্তু সে প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে আমার এবং আমার পরিবারের সদস্যদের সম্মানহানি করছে, আমাকে চোর সাব্যস্ত করার চেষ্টা করছে।’
কিন্তু এমডির যত অভিযোগ, সোনালী লাইফের এমডি বিএসইসিতে জমা দেওয়া অভিযোগপত্রে চেয়ারম্যান মোস্তফা গোলাম কুদ্দুসের বিরুদ্ধে মোট ২৪ প্রক্রিয়ায় লাইফ ফান্ডের অর্থ তছরুপের অভিযোগ এনেছেন। বিনা টাকায় কোম্পানির শেয়ারের মালিকানা নেওয়া ছাড়াও কোম্পানির টাকা হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে পাঠানোর গুরুতর অভিযোগ এনেছেন তিনি। এছাড়াও চেয়ারম্যান গোলাম কুদ্দুসের অপর কোম্পানি ড্রাগন সোয়েটারের কর্মচারীদের বেতনের টাকাও সোনালী লাইফ থেকে দিয়েছেন পরিচালকরা। নিজের ব্যক্তিগত ভ্রমণ, গাড়ি ও বিলাসী পণ্য ক্রয়সহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের ব্যয়ও নগদ অর্থে সোনালী লাইফ থেকে পরিশোধ করা হয়েছে।
এমডির আরও অভিযোগ, ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠার পরের বছর ২০১৪ সাল থেকে গত বছর ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ বছরে ব্যক্তিগত ব্যয় নির্বাহের জন্য নগদে ২৩ কোটি ৬৮ লাখ টাকার অর্থ উত্তোলন করেছেন চেয়ারম্যানসহ পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা। এর ফিরিস্তিও অভিযোগপত্রের সঙ্গে সংযুক্ত করেছেন এমডি। এর একটি নথিতে দেখা গেছে, ২০১৪ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ৭ লাখ ৫২ হাজার টাকা উত্তোলন করা হয়। ২০১৫ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি সাউথবাংলা এগ্রিকালচার ব্যাংকের চেকের মাধ্যমে ২ কোটি টাকা তোলা হয়। একইভাবে ২০১৭ সালের ৭ আগস্ট ২ কোটি টাকা, ২০১৯ সালের ১১ এপ্রিল ১ কোটি টাকা, ২০২১ সালের ৬ অক্টোবর ১ কোটি টাকা, ২০২২ সালের ১৩ জুন ১ কোটি ২৬ লাখ টাকা নেওয়া হয়েছে। এর বাইরে আলাদাভাবে ১ লাখ থেকে ৪০ লাখ টাকা পর্যন্ত নগদে বা চেকে লাইফ ফান্ডের টাকা তুলে নিয়েছেন চেয়ারম্যান ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা। ব্যক্তিগত বিলাসী পণ্য ক্রয় এবং ভ্রমণের জন্য সোনালী লাইফের কোটি কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। যেমন– গত বছরের ১৫ মে চেয়ারম্যান গোলাম কুদ্দুস ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের দুবাই ও লন্ডন ভ্রমণ বাবদ গ্যালাক্সি হলিডেজকে ১ কোটি ১৬ লাখ ৮২ হাজার টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। ২০২১ সালের ২৫ জুলাই ভাইস চেয়ারম্যান ফৌজিয়া কামরুন তানিয়ার জন্য ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড থেকে ৭ লাখ টাকার ডায়মন্ড রিং কেনার অর্থ পরিশোধ করা হয়েছে।
ব্যক্তিগত খরচের বাইরে গোলাম কুদ্দুসের বিরুদ্ধে নিজের অপর তালিকাভুক্ত কোম্পানি ড্রাগন সোয়েটার বাংলাদেশ লিমিটেডের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জীবন বীমা পলিসি বাবদও কোটি কোটি টাকা সোনালী লাইফের টাকা থেকে পরিশোধ করা হয়েছে।
লিখিত অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সোনালী লাইফের এমডি মীর রাশেদ বিন আমান বলেন, চেয়ারম্যান ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা কোম্পানির লাইফ ফান্ডের টাকা নিজেদের ব্যক্তিগত টাকা মনে করে খরচ করেছেন। গত ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কোম্পানির লাইফ ফান্ড ছিল ৮৬৮ কোটি টাকা। এর প্রায় ৩০০ কোটি টাকাই তারা তুলে নিয়েছেন।
এমডির এসব অভিযোগ অসত্য দাবি করে সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের চেয়ারম্যান মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস বলেন, ‘রাশেদ যে সময়ের বিষয়ে অভিযোগ এনেছে, ওই সময় সে এ কোম্পানির এমডি ছিল। তাহলে সে কী করে অবৈধভাবে টাকা আত্মসাৎ হতে দিল। আর এতদিন কেন এসব নিয়ে অভিযোগ করেনি। আমি ২০২১ সালে শেয়ার কিনেছি। এবারই চেয়ারম্যান হলাম।’ এখন কেন এ অভিযোগ–এমন প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, ‘তার (এমডি) বিরুদ্ধে বীমার নারী কর্মচারীর সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কের তথ্য জানা ও ছবি পাওয়ার পর সে আমাদের চরিত্র হরণ করতে এসব মিথ্যা অভিযোগ করছে।’
সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের চেয়ারম্যান মোস্তফা গোলাম কুদ্দুসের পরিবারের বাকি সদস্যদের দুর্নীতির তথ্যনির্ভর সংবাদ আগামী পর্বগুলোতে চলবে…