‘আপনি বিদেশে। দেশে আপনার স্ত্রী কী করছেন, কার সঙ্গে কথা বলছেন— জানতে চান? মাত্র এক হাজার টাকায় পাঁচ মিনিটে স্ত্রীর ফেসবুক অ্যাকাউন্ট হ্যাক করুন। দেখে নিন কী করছেন তিনি।’ বাংলাদেশের অনেক ফেসবুক গ্রুপে এমন বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে। বিশেষ করে যেসব গ্রুপে প্রবাসী বাংলাদেশিদের সংখ্যা বেশি। সত্যি কি স্ত্রীর ফেসবুক অ্যাকাউন্ট হ্যাক করা সম্ভব? এটা জানতে অনুসন্ধানে নামে ঢাকা পোস্ট।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, প্রবাসীদের বড় বড় কয়েকটি ফেসবুক গ্রুপ টার্গেট করেন হ্যাকাররা। সেসব গ্রুপের সদস্য সংখ্যা দুই থেকে নয় লাখ পর্যন্ত। গ্রুপগুলোর মধ্যে ‘প্রবাসী জীবন/PROBASHI JIBON’, ‘সিঙ্গাপুরে আমরা প্রবাসী বাংলাদেশী’, ‘আমরা সৌদি আরব প্রবাসী বাংলাদেশী ☑’, ‘বাংলাদেশ প্রবাসী অধিকার পরিষদ’, ‘মালয়েশিয়া প্রবাসী বাংলাদেশী- Malaysia Probashi Bangladeshi’, ‘বিশ্ব প্রবাসী কল্যাণ পরিষদ’ উল্লেখযোগ্য। এমন প্রায় ৫০টি গ্রুপ রয়েছে সেখানে।
জানা যায়, ‘হ্যাকার বিডি’ ও ‘হ্যাকিং গ্রুপ বিডি’নামের দুটি হ্যাকার গ্রুপ ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ ও ইমো আইডি হ্যাক করার মতো পোস্ট দিচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
প্রবাসীদের বড় বড় কয়েকটি ফেসবুক গ্রুপ টার্গেট করেন হ্যাকাররা। সেসব গ্রুপের সদস্য সংখ্যা দুই থেকে নয় লাখ পর্যন্ত। গ্রুপগুলোর মধ্যে ‘প্রবাসী জীবন/PROBASHI JIBON’, ‘সিঙ্গাপুরে আমরা প্রবাসী বাংলাদেশী’, ‘আমরা সৌদি আরব প্রবাসী বাংলাদেশী ☑’, ‘বাংলাদেশ প্রবাসী অধিকার পরিষদ’, ‘মালয়েশিয়া প্রবাসী বাংলাদেশী- Malaysia Probashi Bangladeshi’, ‘বিশ্ব প্রবাসী কল্যাণ পরিষদ’ উল্লেখযোগ্য। এমন প্রায় ৫০টি গ্রুপ রয়েছে
মূলত এসব হ্যাকার গ্রুপের প্রধান টার্গেট বিবাহিত প্রবাসীরা। দেশে স্ত্রী রেখে তারা বছরে পর বছর প্রবাসে জীবন কাটাচ্ছেন। সন্দেহ ও প্রতিশোধপরায়ণতাসহ বিভিন্ন কারণে প্রিয় মানুষদের ফেসবুক অথবা ইমো আইডি হ্যাক করাতে এসব গ্রুপের শরণাপন্ন হচ্ছেন প্রবাসীরা। এ সুযোগে প্রবাসীদের বোকা বানিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন প্রতারক সাইবার অপরাধীরা
যেভাবে ফাঁদ তৈরি করছে কথিত হ্যাকার গ্রুপ
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে প্রবাসীদের বিভিন্ন গ্রুপে কথিত হ্যাকার গ্রুপগুলো বিজ্ঞাপন দিচ্ছে, ‘মাত্র ৫ মিনিটে যেকোনো ফেসবুক আইডি হ্যাক করে দেব’। সেখানে বলা হচ্ছে, ‘কাজ হওয়ার পর টাকা বিকাশে গ্রহণ করা হবে’। এমন বিজ্ঞাপন দেখে প্রবাসীরা স্ত্রীর প্রতি সন্দেহ বা প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে এসব গ্রুপের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। যোগাযোগের পর কথিত হ্যাকার গ্রুপগুলো প্রবাসীদের এমনভাবে বিশ্বাস অর্জন করে যেন তারা পাঁচ মিনিটে কাঙ্ক্ষিত ফেসবুক অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে দেবে। বিশ্বাস অর্জনের পর তারা কয়েক ধাপে প্রবাসীদের কাছ থেকে টাকা নেওয়া শুরু করে। টাকা নেওয়ার পর অধিকাংশ সময় নম্বর কিংবা ফেসবুক আইডি ব্লক করে দেয় তারা। যাতে কথিত হ্যাকার গ্রুপগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পারেন ভুক্তভোগীরা।
মূলত এসব হ্যাকার গ্রুপের প্রধান টার্গেট বিবাহিত প্রবাসীরা। দেশে স্ত্রী রেখে তারা বছরে পর বছর প্রবাসে জীবন কাটাচ্ছেন। সন্দেহ ও প্রতিশোধপরায়ণতাসহ বিভিন্ন কারণে প্রিয় মানুষদের ফেসবুক অথবা ইমো আইডি হ্যাক করাতে এসব গ্রুপের শরণাপন্ন হচ্ছেন প্রবাসীরা। এ সুযোগে প্রবাসীদের বোকা বানিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন প্রতারক সাইবার অপরাধীরা
এক্ষেত্রে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দিকটি হলো, প্রবাসীদের ফিশিং লিংক (প্রতারণার মাধ্যমে কারও কাছ থেকে ব্যক্তিগত তথ্য হাতিয়ে নেওয়া) পাঠিয়ে হ্যাকার গ্রুপগুলো তাদের ফেসবুক আইডি হ্যাক করে। পরে তাদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেয়।
হ্যাকার কারা
ঢাকা পোস্টের অনুসন্ধান এবং পুলিশের হাতে বিভিন্ন সময় গ্রেপ্তার হওয়া আসামিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হ্যাকিংয়ের প্রলোভন দেখানো পেজগুলো সাধারণত দুই ধরনের সাইবার অপরাধীরা পরিচালনা করেন। তাদের মধ্যে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করা এক শ্রেণির শিক্ষার্থী রয়েছেন। যাদের যথেষ্ট প্রযুক্তিগত জ্ঞান রয়েছে। সমমনা কয়েকজন শিক্ষার্থী একসঙ্গে কথিত ওই হ্যাকিং ফেসবুক পেজ ওপেন করেন। পরে তারা পেজগুলো বুস্ট (প্রচার) করে অনলাইনে ভাইরাল করেন। এসব বিজ্ঞাপন দেখে মানুষ তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। শুরু হয় তাদের কথিত হ্যাকিং প্রতারণা। প্রতারণা শেষে তারা সেই পেজগুলো মাসখানেকের জন্য ডিজেবল (নিষ্ক্রিয়) করে ফেলেন।
পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়া হ্যাকারদের মধ্যে অধিকাংশই ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী বলে জানা গেছে। মেসেজে আমার এবং আমার স্ত্রীর কিছু স্পর্শকাতর ছবি যা আমরা মেসেঞ্জারে আদান-প্রদান করেছিলাম। ইমোতে হ্যাকিং বিডির অ্যাডমিন আমাকে জানায়, সে আমার ফেসবুক আইডি হ্যাক করেছে। এক লাখ টাকা না দিলে এসব ছবি সে ছড়িয়ে দেবে। পরে টানা কয়েকদিন অ্যাডমিনের সঙ্গে কথা বলে ৫০ হাজার টাকা পাঠিয়ে ফেসবুক আইডি নিজের নিয়ন্ত্রণে পাই। স্ত্রীর আইডি হ্যাক করাতে গিয়ে তাদের প্রতারণার শিকার হয়েছি, এ কারণে কাউকে কিছু বলিনিভুক্তভোগী মো. সুমন, মালয়েশিয়া প্রবাসী
এছাড়া কিছু গ্রুপ পরিচালিত হয় দেশের বিভিন্ন মফস্বল শহর থেকে। স্কুল কিংবা কলেজে পড়া শিক্ষার্থীরা এমন অপরাধ করেন। হ্যাকিংয়ের কথা বলে প্রবাসীদের কাছ থেকে ২০০-৫০০ টাকা নিয়ে সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে দেন তারা। তবে, তাদের ফিশিং লিংক পাঠিয়ে ফেসবুক হ্যাক করার সক্ষমতা নেই।
স্ত্রীকে সন্দেহ করে নিজেই বিপাকে সুমন
সম্প্রতি এমন এক সাইবার অপরাধী গ্রুপের খপ্পরে পড়ে অর্ধলাখ টাকা খুইয়েছেন মালয়েশিয়া প্রবাসী মো. সুমন। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে দেশে এসে নিজ জেলার শান্তা রহমান (ছদ্মনাম) নামের এক তরুণীকে বিয়ে করেন তিনি। তিন মাস সংসার করে মে মাসে আবারও জীবিকার তাগিদে মালয়েশিয়াতে পাড়ি জমান সুমন। মালয়েশিয়াতে আসার পর প্রায় দিনই স্ত্রীকে ফোনে ওয়েটিং (ব্যস্ত) পান তিনি। পরিবারও জানায়, তার স্ত্রী দীর্ঘ সময় ধরে কার সঙ্গে ফোনে কথা বলেন। সুমনের মনে সন্দেহ জাগে, হয়তো শান্তা তার অবর্তমানে পরকীয়া সম্পর্কে জড়িয়েছেন। সন্দেহ যাচাই করতে সুমন ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দেওয়া ‘হ্যাকিং বিডি’ নামের কথিত একটি ফেসবুক হ্যাকিং গ্রুপের অ্যাডমিনের সঙ্গে মেসেঞ্জারে যোগাযোগ করেন।
গ্রুপটির সঙ্গে পাঁচ হাজার টাকায় স্ত্রীর ফেসবুক ও ইমো আইডি হ্যাক করে নিজের দখলে নেওয়ার চুক্তি করেন সুমন। কিন্তু স্ত্রীর আইডি হ্যাক করাতে গিয়ে উল্টো হ্যাকিংয়ের শিকার হন তিনি। দৈনিক আমাদের মাতৃভূমিকে বলেন, ‘চুক্তি অনুযায়ী স্ত্রীর মোবাইল হ্যাক করার জন্য আমি দুই হাজার টাকা বিকাশে পাঠাই। আইডি হ্যাক করার জন্য গ্রুপের অ্যাডমিন আমার স্ত্রীর মোবাইল নম্বর ও ফেসবুক আইডির লিংক নেয়। এছাড়া আমার ইমো নম্বরও নেয় যোগাযোগের জন্য। একদিন রাতে অ্যাডমিন মেসেঞ্জারে একটি লিংক (ফিশিং লিংক) পাঠিয়ে বলে, ক্লিক করলে আমার স্ত্রীর ফেসবুকে ঢুকতে পারব। ক্লিক করার পর আমার স্ত্রীর আইডি না এসে কী জানি সব ইংরেজি লেখা আসে। পরে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। পরের দিন সকালে উঠে দেখি আমার ফেসবুকে আর ঢোকা যাচ্ছে না। আমার আইডি হ্যাক হয়ে গেছে।’
‘এরই মধ্যে আমার ইমো নম্বরে দেখি ৫-৬ টি মেসেজ এসেছে। মেসেজে আমার এবং আমার স্ত্রীর কিছু স্পর্শকাতর ছবি যা আমরা মেসেঞ্জারে আদান-প্রদান করেছিলাম। ইমোতে হ্যাকিং বিডির অ্যাডমিন আমাকে জানায়, সে আমার ফেসবুক আইডি হ্যাক করেছে। এক লাখ টাকা না দিলে এসব ছবি সে ছড়িয়ে দেবে। পরে টানা কয়েকদিন অ্যাডমিনের সঙ্গে কথা বলে ৫০ হাজার টাকা পাঠিয়ে ফেসবুক আইডি নিজের নিয়ন্ত্রণে পাই। স্ত্রীর আইডি হ্যাক করাতে গিয়ে তাদের প্রতারণার শিকার হয়েছি, এ কারণে কাউকে কিছু বলিনি।’
শুধু সুমন নয়, তার মতো অনেক প্রবাসী কথিত এসব হ্যাকার গ্রুপের শরণাপন্ন হয়ে লাখ লাখ টাকা খুইয়েছেন। কেউ ফেসবুকের আইডি উদ্ধারের জন্য, আবার কেউ ফেসবুক আইডি হ্যাক করানোর জন্য এসব গ্রুপের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রতারিত হয়েছেন।
ফেসবুকে যেমন থাকে হ্যাকিং পেজগুলো
ফেসবুক টাইম লাইনে ভাসতে থাকা পেজগুলোর অধিকাংশ থাকে ‘লকড’। তবে, পেজগুলোর নাম এমনভাবে থাকে যা দেখে সহজেই বোঝা যায় এখানে হ্যাকিং সংক্রান্ত তথ্য দেওয়া আছে। কোনো নেটিজেন (ইন্টারনেট ব্যবহারকারী) যদি আগ্রহবশত ওই পেজগুলো লাইক দিয়ে সদস্য হওয়ার আবেদন করেন, সঙ্গে সঙ্গে অ্যাডমিন তা গ্রহণ করেন। সদস্য হওয়ার পর নেটিজেনরা এসব গ্রুপের আসল চিত্র দেখতে পান। অ্যাডমিনরা হ্যাকিংয়ের নানা বিজ্ঞাপন দিয়ে পেজগুলো সাজিয়ে রাখেন। মাত্র এক হাজার টাকায় ফেসবুক, ইমো ও জি-মেইল আইডি হ্যাকসহ নানা বিজ্ঞাপন থাকে পেজে। নমুনা হিসেবে কিছু ভুয়া আইডি হ্যাকিংয়ের স্ক্রিনশটও এসব গ্রুপে দেওয়া থাকে।
আসলেই কি আইডি হ্যাক করেন তারা
প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলে জানা গেছে, এসব কথিত হ্যাকার গ্রুপের অধিকাংশই ভুয়া। তারা আসলে গ্রাম থেকে যাওয়া প্রবাসীদের টার্গেট করে ভুয়া হ্যাকিংয়ের কথা বলে টাকা আত্মসাৎ করেন। মূলত, দেশে থাকা প্রিয়জনদের প্রতি সন্দেহ ও প্রতিশোধপরায়ণতাসহ বিভিন্ন কারণে তারা তাদের পাতা ফাঁদে পা দেন। আসলে কথিত এসব হ্যাকার গ্রুপের আইডি হ্যাক করার মতো কোনো সক্ষমতা নেই। তবে, তাদের মধ্যে কিছু কিছু গ্রুপের সদস্যরা ফিশিং লিংক দিয়ে উল্টো প্রবাসীদের আইডি হ্যাক করে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেন।
এ বিষয়ে তথ্যপ্রযুক্তিবিদ আবুল হাসান দৈনিক আমাদের মাতৃভূমিকে বলেন, এক বা দুই হাজার টাকার বিনিময়ে ফেসবুক আইডি হ্যাকের যারা বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন, তারা আসলে ভুয়া। মানুষকে বোকা বানিয়ে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন তারা। তবে, কিছু কিছু হ্যাকার আছেন যারা টাকার বিনিময়ে ফেসবুক আইডি হ্যাক করেন। এক্ষেত্রে তারা বেশকিছু টুল ব্যবহার করেন। কিছু কিছু সফটওয়্যারও ব্যবহার করেন তারা। এসব সফটওয়্যার পিসিতে বা মোবাইল ফোনে কেউ অসাবধানতাবশত ইনস্টল করলে হ্যাকাররা ওই ব্যক্তির ফেসবুক আইডি ও পাসওয়ার্ড পেয়ে যান। ফলে সহজেই আইডি হ্যাক করা যায়। অনেক ক্ষেত্রে ফিশিং লিংকের মাধ্যমেও খুব সহজে আইডি হ্যাক করা যায়।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজি (বিইউবিটি)-এর সহযোগী অধ্যাপক প্রযুক্তিবিদ তানভীর হাসান জোহা দৈনিক আমাদের মাতৃভূমিকে বলেন, ‘অনলাইনে ডিসটেন্স রিলেশনের ক্ষেত্রে প্রবাসীরা এসব গ্রুপের খপ্পরে পড়ছেন। অনেক সময় দেখা যায় কোনো প্রবাসী তার স্ত্রী বা বান্ধবীর ওপর নজরদারির জন্য আইডি হ্যাক করতে এসব গ্রুপের শরণাপন্ন হন। আবার স্ত্রী বা বান্ধবীর সঙ্গে ঝামেলা হয়েছে, প্রতিশোধ নিতেও অনেকে আইডি হ্যাকের চেষ্টা করেন। তখন তারা অনলাইনে এ জাতীয় গ্রুপগুলো খুঁজতে থাকেন। যারা টাকার বিনিময়ে তার স্ত্রী বা প্রেমিকার ফেসবুক আইডি হ্যাক করে দেবেন। পরবর্তীতে টাকা-পয়সার নেওয়ার পর তারা আর ফোন ধরেন না।’
যারা ফেসবুক আইডি হ্যাক করার মানসিকতা নিয়ে প্রতারিত হচ্ছেন তারাও সাইবার অপরাধী— মত দেন এ প্রযুক্তিবিদ।
হ্যাকাররা যা বলছেন
বিশেষজ্ঞদের এসব কথার সত্যতা পাওয়া যায় কথিত একটি হ্যাকার গ্রুপের সদস্যের সঙ্গে কথা বলে। এমন একটি গ্রুপের সঙ্গে মেসেঞ্জারে কথা হয় ঢাকা পোস্টের এ প্রতিবেদকের। নিজের পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে ওই কথিত হ্যাকার বলেন, আসলে আমরা হ্যাকিং করতে পারি না। হ্যাকিংয়ের বিষয়ে আমাদের অনেকের তেমন কিছু জানা নেই। ইউটিউব দেখে নানা কৌশল শিখে অন্ধকারে ঢিল মারার মতো আমরা বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকি।
‘ফেসবুকে এমন চটকদার বিজ্ঞাপন দেখে মধ্যপ্রাচ্যে থাকা অনেক প্রবাসী আমাদের সঙ্গে মেসেঞ্জারে যোগাযোগ করেন। শুরুতে তাদের সঙ্গে আমরা এমন ভাবে কথা বলি, তারা আমাদের ওপর আস্থা রাখেন। পরে তাদের স্ত্রী বা বান্ধবীর আইডির লিংক নেই। সঙ্গে অগ্রিম টাকাও নেওয়া হয়। পরে হচ্ছে বা হয়ে যাচ্ছে— এমন কথা বলে আরও দুই-তিন হাজার টাকা বিকাশে নিয়ে ওই প্রবাসীর মোবাইল নম্বর ও আইডি ব্লক করে দেই। পরে সে আমাদের সঙ্গে আর যোগাযোগ করতে পারে না। এটাই হচ্ছে আমাদের আসল কার্যক্রম। তবে কয়েকজন আছেন তারা ফিশিং লিংক পাঠিয়ে আইডি হ্যাক করে থাকেন।’
আইডি-পেজ উদ্ধারের নামেও চলে প্রতারণা
ঢাকা পোস্টের কাছে বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগী জানান, তারা তাদের বন্ধ হয়ে যাওয়া বা লগইন করতে না পারা ফেসবুক আইডি বা পেজ উদ্ধারের জন্য বিভিন্ন হ্যাকার গ্রুপকে টাকা দিয়েছেন। টাকার পরিমাণ ১০-১৫ হাজারও দাঁড়ায়। এমন একজন ভুক্তভোগী আনোয়ার হোসেন। দৈনিক আমাদের মাতৃভূমিকে তিনি বলেন, আমার ‘শপিং হাব’ নামের একটি ফেসবুক পেজ ছিল। সেখান থেকে মাসে ২০-২৫ হাজার টাকা আয় হতো। গত মাসে আমার পেজটা হঠাৎ করে আর লগইন করা যাচ্ছিল না। বিভিন্নজনকে দেখিয়ে শত চেষ্টা করেও পেজে প্রবেশ করতে পারছিলাম না। তখন বিডি হ্যাকার গ্রুপের বিজ্ঞাপন দেখে মেসেঞ্জারে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করি। ১০ হাজার টাকায় চুক্তিও হয়। তারা এক দিনের মধ্যে আমার পেজ উদ্ধার করে দেবে বলে জানায়।
সাইবার অপরাধের ১৯ শতাংশ ফেসবুক আইডি হ্যাকজনিত, এক শতাংশ ই-মেইল আইডি হ্যাকজনিত, ১৫ শতাংশ ফেক (ভুয়া) আইডি সংক্রান্ত, ১৫ শতাংশ সেক্সটরশন সংক্রান্ত, ২২ শতাংশ মোবাইল ব্যাংকিং সংক্রান্ত এবং ২৮ শতাংশ অন্যান্য হ্যারাজমেন্ট সংক্রান্ত। অধিকাংশ হ্যাকিংয়ের ঘটনায় ভুক্তভোগী নিজেই দায়ী— জানায় সিটিটিসি
‘কথা অনুযায়ী তাদের অগ্রিম পাঁচ হাজার টাকা দিই। টাকা পরিশোধের একদিন পর গ্রুপটি থেকে আমাকে ফোন করে বলা হয়, আমার পেজ উদ্ধার হয়েছে। আরও পাঁচ হাজার টাকা দিলে তারা আমাকে পেজটা ফিরিয়ে দেবে। আমি কথা মতো আরও পাঁচ হাজার টাকা বিকাশে পাঠাই। এরপর তারা আমার মেসেঞ্জার ও ফোন নম্বর ব্লক করে দেয়। আজ এক মাস হলো আমার পেজটা ফিরে পাইনি এবং টাকাও হাওয়া।’
সাইবার অপরাধের শিকার অধিকাংশই পুরুষ
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সাতটি ফেসবুকসহ অন্যান্য হ্যাকিংয়ের অভিযোগ এসেছে তাদের কাছে। এসব অভিযোগের ভিত্তিতে ইতোমধ্যে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে ডিবি। এছাড়া এ সময়ে হ্যাকিং সংক্রান্ত জিডি হয়েছে ১৩১টি। ওই বিভাগের গত বছরের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, মোট ২০৬টি সাইবার ক্রাইম সংক্রান্ত অভিযোগ তাদের কাছে এসেছে। এর মধ্যে ফেসবুক আইডি হ্যাক সংক্রান্ত অভিযোগ ১৭টি।
অন্যদিকে, সিটিটিসির সিটি-সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিভিশন সূত্রে জানা যায়, গত বছর তাদের কাছে আসা সাইবার অপরাধগুলোর মধ্যে ১৯ শতাংশ ফেসবুক আইডি হ্যাকজনিত। তাদের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২১ সালে সাইবার অপরাধের শিকার হয়েছেন মোট ৯৬৩ জন। এর মধ্যে নারী ৪৮০, পুরুষ ৪৮৩ জন। ভুক্তভোগীদের মধ্যে ৮ শতাংশের বয়স ১৮ বছরের নিচে, ৩১ শতাংশের বয়স ১৯ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে, ৩৪ শতাংশের বয়স ২৬ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে, ২৩ শতাংশের বয়স ৩৬ থেকে ৫৫ বছরের মধ্যে এবং চার শতাংশের বয়স ৫৫ বছরের ওপরে।
ওই তালিকা অনুযায়ী, অপরাধের ১৯ শতাংশ ফেসবুক আইডি হ্যাকজনিত, এক শতাংশ ই-মেইল আইডি হ্যাকজনিত, ১৫ শতাংশ ফেক (ভুয়া) আইডি সংক্রান্ত, ১৫ শতাংশ সেক্সটরশন সংক্রান্ত, ২২ শতাংশ মোবাইল ব্যাংকিং সংক্রান্ত এবং ২৮ শতাংশ অন্যান্য হ্যারাজমেন্ট সংক্রান্ত সাইবার অপরাধ। অধিকাংশ হ্যাকিংয়ের ঘটনায় ভুক্তভোগী নিজেই দায়ী— জানায় সিটিটিসি।
কথিত হ্যাকারদের নিয়ে যা বলছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ বলছে, এ ধরনের কথিত হ্যাকার গ্রুপের বিজ্ঞাপন এখনও তাদের নজরে আসেনি। তবে, তাদের অনলাইন মনিটরিং ব্যবস্থায় কথিত এসব হ্যাকার গ্রুপ আসলে তারা ব্যবস্থা নেবেন।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (এডিসি) মো. নাজমুল হক দৈনিক আমাদের মাতৃভূমিকে বলেন, ‘আসলে এ ধরনের গ্রুপ আমাদের নজরে এখনও আসেনি বা কেউ অভিযোগও করেনি। তবে, আমরা নজরদারি রাখছি। আমাদের নজরে আসলে কিংবা অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেব।’
‘ফেসবুক আইডি হ্যাক করা এখন আর সহজ বিষয় নয়। তবে, অনেক সময় দেখা যায় প্রবাসীদের স্ত্রী কিংবা অন্য কারও ইমো আইডি হ্যাক হয়ে যাচ্ছে এবং নানা প্রতারণার ঘটনা ঘটছে। তাদের বিরুদ্ধে আমরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি এবং গ্রেপ্তার করছি।’
সাইবার ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড রিস্ক ম্যানেজমেন্ট বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার রেজাউল মাসুদ বলেন, নামসর্বস্ব এসব পেজ আসলে ভুয়া। তারা বিভিন্নজনকে হ্যাকিংয়ের নামে বোকা বানিয়ে টাকা আত্মসাৎ করে মাত্র। ফেসবুক আইডি হ্যাক করা এখন সহজ নয়। তবে, আমরা এসব গ্রুপের বিরুদ্ধে সাইবার মনিটরিং করছি। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নিচ্ছি।