ঢাকা ০৫:২৬ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::
তাসাউফ রিয়েল এস্টেট লিঃ এর চেয়ারম্যান ভূমি দস্যু শরীফ বিন আকবর খান সাদুল্লাপুরের এক মূর্তিমান আতঙ্কের নাম ‘জিনের বাদশা’ আবু বকর অবৈধ সম্পদেও বাদশা জাজিরায় বালুর নিচে পুঁতে রাখা অজ্ঞাত এক নারীর লাশ উদ্ধার গোয়াইনঘাট প্রেসক্লাবের অসাংবিধানিক নির্বাচন বাতিলের দাবি মিঠাপুকুরে শিক্ষকদের মানববন্ধন ও শিক্ষা উপদেষ্টা বরাবর স্মারকলিপি প্রদান রাজনৈতিক চাপে ধামাচাপা পড়েছে ফাইল গাজীপুর কাস্টমসের পিওন কাওসারের কোটি টাকার সম্পত্তি ক্ষমতার সান্নিধ্যে বিত্তবান সাবেক সচিব খাইরুল কুমিল্লায় হাসপাতাল দখলের অভিযোগ বিএনপি নেতার বিরুদ্ধে কেজি দরে বিআরটিসির বাস বিক্রি করে দিয়েছেন কর্মকর্তা

বাংলাদেশে পালাবদল ও ‘আমরা-ওরা’ বিভাজন নিয়ে যা বললেন ভারতের বিশেষজ্ঞ

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিত, নেতৃত্ব বা ক্ষমতার পালাবদল এবং ‘আমরা-ওরা’ বিভাজন নিয়ে কথা বললেন ভারতের রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ ও ইতিহাসবিদ অন্বেষা সেনগুপ্ত। তিনি বলেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পালাবদল কয়েকটি আশঙ্কার জন্ম দিয়েছে। সেখানে ‘আমরা-ওরা’ বিভাজন যত কমবে, কমবে সেই সব আশঙ্কাও।

বুধবার ভারতীয় সংবাদমাধ্যম হিন্দুস্তান টাইমসে প্রকাশিত এক নিবন্ধে এমনটাই দাবি করেন তিনি।

কলকাতার ইন্সটিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের এ অধ্যাপক লেখেন, ‘বাংলাদেশ উত্তাল। কেউ শঙ্কিত, কেউ পুলকিত, কেউ হতাশ। কত রকম ছবি আমরা দেখছি খবরের কাগজে, টিভি চ্যানেলে, সামাজিক মাধ্যমে। উচ্ছ্বাস, হিংসা, লুঠপাট, রক্ষা, সংহতি— নানা আবেগ। বারবার উঠে আসছে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সুরক্ষার প্রশ্ন। ছাত্র, সমাজকর্মী, শিক্ষক, বিএনপি নেতৃত্ব, সামরিক বাহিনীর অনেকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য ক্রমাগত আবেদন জানিয়ে চলেছেন। নাগরিক সমাজ দল বেঁধে নানা জায়গায় পাহারা দিচ্ছে হিন্দু মন্দির। তার মধ্যেও আসছে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার খবর’।

তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু কারা? ধর্মের নিরিখে দেখলে হিন্দু, খৃস্টান, বৌদ্ধরা। ভাষার ভিত্তিতে অবাঙালি যারা তারা, তাদের মধ্যে রয়েছেন দেশভাগের পর বিহার, উত্তর প্রদেশ থেকে আসা মুহাজির, আবার রয়েছেন পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা সম্প্রদায়। জাতি পরিচিতির দিক থেকে দেখলে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য চাকমা, গারো, সাঁওতাল, হাজং ইত্যাদি সম্প্রদায়ের মানুষ। দক্ষিণ এশিয়ার অন্য সব দেশের মতই বাংলাদেশে সংখ্যালঘুরা ভালো নেই।

অন্বেষা সেনগুপ্ত লেখেন, বাংলাদেশের জাতি-রাষ্ট্রের যে ধারণা বা কল্পনা, তা ভারত পাকিস্তানের তুলনায় অস্থির, ভঙ্গুর ও পরিবর্তনশীল। ১৯৪৭ সালে যখন ব্রিটিশ শাসন শেষ হয় এবং ভারত ও পাকিস্তান দুটি পৃথক দেশ তৈরি হয়, আজকের বাংলাদেশ তখন ছিল পাকিস্তানের অংশ। সে সময়ের বাঙালি মুসলমান নেতা, বুদ্ধিজীবী, ছাত্র, চাষি, শ্রমিক— সবারই কিন্তু পাকিস্তান নিয়ে অনেক আশা-আকাঙ্ক্ষা ছিল। যুক্তবঙ্গে হিন্দু জমিদার-জোতদারের দাপট, সাংস্কৃতিক জগতে হিন্দুয়ানী নান্দনিকতার রমরমা, চাকরি-বাকরিতে হাতেগোণা মুসলমান উপস্থিতি— এসবই পাকিস্তানের প্রতি বাঙালি মুসলমানদের বড় অংশকে আকৃষ্ট করে। কিন্তু আমরা যদি আবুল মনসুর আহমদের আত্মজীবনী বা তাজউদ্দিন আহমদের ডাইরি পড়ি, দেখব প্রথম থেকেই তাদের কাছে বাঙালি ও মুসলমান দু’টি পরিচিতিই একই রকম গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বাঙালি মুসলমান বাঙালি হিন্দুর থেকে সাংস্কৃতিকভাবে আলাদা এবং পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি-মুসলমানি সংস্কৃতির লালন পালন হবে- এ ছিল আবুল মনসুরদের মতো বুদ্ধিজীবীদের ধারণা। এ ধারণায় একটা ভারসাম্য রক্ষার ব্যাপার আছে। একজনের কাছে বাঙালি হওয়া ও মুসলমান হওয়া সমান গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে, আবার কারও কাছে একটা অন্যটার চেয়ে বেশি। এ ভারসাম্যের রাজনীতি পূর্ব পাকিস্তান/ বাংলাদেশে নানা মুহূর্তে সংখ্যালঘু মানুষের অবস্থা বোঝার জন্য মাথায় রাখা জরুরি।

পাকিস্তানের উর্দু নিয়ে পদক্ষেপ বেশিরভাগ বাঙালি-মুসলমানের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। অবশ্য যারা তাদের মুসলমান পরিচিতিকেই একমাত্র পরিচিতি হিসেবে দেখতেন, তাদের কথা আলাদা। কিন্তু বিশেষ করে বাঙালি মুসলমান ছাত্র, শিক্ষক, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক কর্মী ও অন্যান্য বুদ্ধিজীবীরা প্রতিবাদে নেমেছিলেন। ১৯৪৮ থেকেই এ প্রতিবাদের শুরু। এখানে উল্লেখযোগ্য— আজকের মতো তখনও ছাত্ররা ছিলেন প্রতিবাদের সামনের সারিতে। আর নাজিমুদ্দিন বা নুরুল আমিন যখন উর্দু বিরোধী আন্দোলনকে ভারতীয়/হিন্দু ষড়যন্ত্র হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছিলেন, আন্দোলনকারী ছাত্ররা বারবার জোরের সঙ্গে বলেছিলেন, এ আন্দোলন ‘আমাদের’ আন্দোলন, অভ্যন্তরীণ আন্দোলন।

প্রশ্ন ওঠে আমরা কারা? নেপথ্যে কী? তাদের মধ্যে কী বাঙালি হিন্দুরা নেই? পাকিস্তানি আইনসভায় উর্দু নীতিবিরোধী প্রস্তাব সবার প্রথম আনেন কুমিল্লার কংগ্রেস নেতা ধীরেন দত্ত। ১৯৭১ পর্যন্ত তিনি পূর্ব পাকিস্তানেই ছিলেন, মৃত্যু হয় পাক সেনার গুলিতে। কিন্তু তার কংগ্রেসি, হিন্দু, বাঙালি পরিচয়কে সামনে রেখে মুসলিম লীগের একটা অংশ সহজেই বাংলার দাবিকে ভারতীয় ষড়যন্ত্র/বিদেশি দাবি হিসেবে উপস্থাপন করে। আসলে দেশভাগের আসল ভিত্তি ছিল ধর্ম। দ্বিজাতিতত্ত্ব অনুসারে পাকিস্তান হলো মুসলমানদের দেশ আর ভারত হলো হিন্দুদের। দুই দেশের প্রথম সারির নেতারাই অবশ্য ১৯৪৭ থেকেই একাধিকবার বলেছিলেন, তাদের দেশে নাগরিকত্ব ধর্ম, বর্ণ, জাতি ভিত্তিক হবে না। কিন্তু দেশভাগ মেনে নেওয়া, পাঞ্জাবে জন-বিনিময়, ইভাকুই প্রপার্টি সংক্রান্ত নানা আইন, নারীদের ‘উদ্ধার ও পুনর্বাসন’ নীতি— এ সবই এক রকম দ্বিজাতিতত্ত্বের বাস্তবায়ন বললে ভুল হয় না। (এ নিয়ে বিশদে জানতে দেখুন জয়া চ্যাটার্জির South Asian Histories of Citizenship)। এ প্রেক্ষিতে ধীরেন দত্তের প্রস্তাব, তার ধর্মীয় ও রাজনৈতিক পরিচিতি, খুব সহজেই তার আনা বাংলা ভাষার দাবিকে পাকিস্তান বিরোধী ও ইসলাম বিরোধী তকমা দিয়েছিল।

কিন্তু এ তকমা মানতে নারাজ ছিলেন সেইসব বাঙালি মুসলমান বুদ্ধিজীবীরা যাদের কল্পনায় পূর্ব পাকিস্তান মুসলমানি বাংলার বিকাশ স্থল৷ বাঙালি হিন্দুও তাদের কাছে সে সময়ে অপর, হয়তো বিদেশি বা সম্ভাব্য বিদেশি; উর্দুভাষী পশ্চিমী মুসলমানও অপর। এই আমরা-ওরার লড়াইয়ে ১৯৪৮ বা ১৯৫২ তে পাকিস্তানি সরকারি ডিসকোর্সে ‘আমরা’ হল সমস্ত পাকিস্তানি মুসলমান, ওরা হল হিন্দুরা— পাকিস্তানি হিন্দুই হোক, বা ভারতীয়। অন্যদিকে, পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি মুসলমান বুদ্ধিজীবীদের ‘আমরা’ ছিলেন তারাই যারা পাকিস্তানি, বাঙালি, এবং মুসলমান। বাকি সবাই ওরা। তাই অভ্যন্তরের ধারণা শুধু ভাষা-ভিত্তিক তা ভাবার কারণ নেই, এ সময় সেখানে স্থান ও ধর্মের গুরুত্ব ছিল।

১৯৫২ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত জল গড়াল বহু দূর। বাঙালি পরিচিতি ও বাংলা ভাষার গুরুত্ব পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলনে বরাবর ছিল, কিন্তু তার সঙ্গে অর্থনৈতিক নীতি নিয়ে ক্ষোভ, খাদ্যাভাব, ভোলা সাইক্লোনে ত্রাণের রাজনীতি ও আওয়ামী মুসলিম লীগের রাজনীতির কন্ঠরোধ করার চেষ্টাও এ আন্দোলনকে পোক্ত করেছিল। যা এক গৃহযুদ্ধ হতে পারত, তাতে ভারতের অংশগ্রহণ, ভারতে লক্ষ লক্ষ বাঙালি উদ্বাস্তুকে আশ্রয় দেওয়া, বাঙালি আবেগের উত্থান— সবমিলিয়ে ’৭১ এর মুহূর্ত দেশভাগের রাজনীতিকে ধাক্কা দিয়েছিল। কিন্তু ভাষা, ধর্ম, স্থানের জটিল রাজনীতিকে চিরতরে মসৃণ করতে পারেনি ’৭১। অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যার্পণ আইন বাতিল হয়নি, হিন্দু বিরোধী হিংসা থামেনি, বন্ধ হয়নি হিন্দু অভিবাসন। পাশাপাশি চলেছে বিহারি মুসলমানদের ওপর আক্রমণ, চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চলে নানা জনজাতির ওপর আক্রমণ।

একদিকে আমরা ২০০১ সালের সাম্প্রদায়িক হামলা দেখেছি, অন্যদিকে শাহবাগ আন্দোলন দেখেছি, তেমনি দেখেছি নাস্তিক ব্লগারদের ওপর আক্রমণ, হেফাজতে ইসলাম বা জামায়াতের মতো ইসলামিক শক্তির প্রভাব। বাংলাদেশ গঠনের পর, আমরা-ওরার সীমানা যেন আরও জটিল হয়েছে। বাঙালি হলেই আমরা, অবাঙালিরা ওরা- এটা এক ধরনের মত। এ মতের সঙ্গে হয়তো আওয়ামী লীগের সম্পর্কও কম। কিন্তু সেই কল্পনায় দুই বাংলার মধ্যের সীমানাকে ব্যাখ্যা করা মুশকিল। তাই শুধু বাঙালি নয়, তার সঙ্গে মুসলমান হওয়াও ‘আমরা’ হওয়ার জন্য জরুরি অনেকের কাছে। আবার কেউ কেউ মুসলমান পরিচয়কেই প্রধান পরিচয় করতে চান।

এ জটিল জাতিরাষ্ট্রের ধারণায় নতুন মাত্রা যোগ হলো ২০২-এর আগস্টের ৫ তারিখ। ক্ষমতা ছেড়ে পালালেন আওয়ামী লীগের প্রধান শেখ হাসিনা। কোটা বিরোধী আন্দোলন থামাতে গিয়ে উনি পরিচিত বুলি আওড়েছিলেন। বলেছিলেন, বিরোধীরা রাজাকার— অর্থাৎ পাকিস্তানপন্থি, সাম্প্রদায়িক শক্তি। সেই আমরা-ওরার সেই প্রশ্ন। কিন্তু এ ডিসকোর্স যেন মানুষকে আরও খেপিয়ে তুলল। আমরা রাজাকার, তাহলে তুমি স্বৈরাচার— এই বলে রাজাকার শব্দকে লঘু করা হলো। একটু হলেও ’৭১-এর মুহূর্ত প্রশ্নের মুখে পড়ল। তারপর আমরা জানি মুজিবের মূর্তি ভাঙা হয়েছে, পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে তার বাসভবন/জাদুঘর। দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলেছেন অনেকে।

এ দ্বিতীয় স্বাধীনতায় আমরা-ওরা কারা? এটা কি ’৪৭-এর মুহূর্তকে জোরালো করল আবার? হিন্দু আক্রমণ, তাদের অনেকের ভারতে ঢোকার চেষ্টা- সে রকম ইঙ্গিত দেয় হয়তো। কিন্তু পাশাপাশি এও ঠিক, ছাত্রছাত্রীদের বড় অংশ বারবার বলেছেন তারা ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ চান। আপাতত দেশের ক্ষমতায় যারা, তাদের অনেকেরই মানবাধিকার কর্মী হিসেবে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা আছে, সাম্প্রদায়িক হওয়ার বদনাম নেই। এ উপদেষ্টাদের মধ্যে সংখ্যালঘু (হিন্দু, চাকমা) প্রতিনিধিও আছেন। আর অনেকেই বলছেন, হামালার ধরন রাজনৈতিক— আক্রান্ত মূলত আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকরাই; সাম্প্রদায়িক নয়। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, সংখ্যালঘু বিরোধী দাঙ্গা, ধর্মীয় রক্ষণশীলতার রাজনৈতিক উত্থান— কোনোটাই কাম্য নয়। তবে যে কোনো জাতি-রাষ্ট্রের ধারণাই আমরা-ওরার ওপর দাঁড়িয়ে থাকে। এই ধারণার মধ্যেই নিহিত থাকে হামলার আশঙ্কা।

মোটের ওপর গণতন্ত্র, অর্থনৈতিক বিকাশ, মোটামুটি স্বাধীন আইন-আদালত, আমলাতন্ত্র, পুলিশ— এ হামলাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে। বাংলাদেশে আমরা কারা হবে, আর ওরা কারা হবে- তা বুঝতে সময় লাগবে আরও। আর আমরা-ওরার মধ্যে দ্বন্দ্ব নিয়ন্ত্রণে থাকবে তখনই, যখন সাধারণ নির্বাচন হবে। আর তা হবে মোটের ওপর স্বচ্ছভাবে। আর যত দিন এ উপদেষ্টামণ্ডলীর হাতে ক্ষমতা, তত দিন সবরকম দ্বন্দ্ব-হামলা নিয়ন্ত্রণের দায় তাদের।

 

Tag :

আপনার মতামত লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল ও অন্যান্য তথ্য সঞ্চয় করে রাখুন

জনপ্রিয় সংবাদ

তাসাউফ রিয়েল এস্টেট লিঃ এর চেয়ারম্যান ভূমি দস্যু শরীফ বিন আকবর খান সাদুল্লাপুরের এক মূর্তিমান আতঙ্কের নাম

বাংলাদেশে পালাবদল ও ‘আমরা-ওরা’ বিভাজন নিয়ে যা বললেন ভারতের বিশেষজ্ঞ

আপডেট সময় ১২:০৫:০৪ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৫ অগাস্ট ২০২৪

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিত, নেতৃত্ব বা ক্ষমতার পালাবদল এবং ‘আমরা-ওরা’ বিভাজন নিয়ে কথা বললেন ভারতের রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ ও ইতিহাসবিদ অন্বেষা সেনগুপ্ত। তিনি বলেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পালাবদল কয়েকটি আশঙ্কার জন্ম দিয়েছে। সেখানে ‘আমরা-ওরা’ বিভাজন যত কমবে, কমবে সেই সব আশঙ্কাও।

বুধবার ভারতীয় সংবাদমাধ্যম হিন্দুস্তান টাইমসে প্রকাশিত এক নিবন্ধে এমনটাই দাবি করেন তিনি।

কলকাতার ইন্সটিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের এ অধ্যাপক লেখেন, ‘বাংলাদেশ উত্তাল। কেউ শঙ্কিত, কেউ পুলকিত, কেউ হতাশ। কত রকম ছবি আমরা দেখছি খবরের কাগজে, টিভি চ্যানেলে, সামাজিক মাধ্যমে। উচ্ছ্বাস, হিংসা, লুঠপাট, রক্ষা, সংহতি— নানা আবেগ। বারবার উঠে আসছে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সুরক্ষার প্রশ্ন। ছাত্র, সমাজকর্মী, শিক্ষক, বিএনপি নেতৃত্ব, সামরিক বাহিনীর অনেকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য ক্রমাগত আবেদন জানিয়ে চলেছেন। নাগরিক সমাজ দল বেঁধে নানা জায়গায় পাহারা দিচ্ছে হিন্দু মন্দির। তার মধ্যেও আসছে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার খবর’।

তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু কারা? ধর্মের নিরিখে দেখলে হিন্দু, খৃস্টান, বৌদ্ধরা। ভাষার ভিত্তিতে অবাঙালি যারা তারা, তাদের মধ্যে রয়েছেন দেশভাগের পর বিহার, উত্তর প্রদেশ থেকে আসা মুহাজির, আবার রয়েছেন পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা সম্প্রদায়। জাতি পরিচিতির দিক থেকে দেখলে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য চাকমা, গারো, সাঁওতাল, হাজং ইত্যাদি সম্প্রদায়ের মানুষ। দক্ষিণ এশিয়ার অন্য সব দেশের মতই বাংলাদেশে সংখ্যালঘুরা ভালো নেই।

অন্বেষা সেনগুপ্ত লেখেন, বাংলাদেশের জাতি-রাষ্ট্রের যে ধারণা বা কল্পনা, তা ভারত পাকিস্তানের তুলনায় অস্থির, ভঙ্গুর ও পরিবর্তনশীল। ১৯৪৭ সালে যখন ব্রিটিশ শাসন শেষ হয় এবং ভারত ও পাকিস্তান দুটি পৃথক দেশ তৈরি হয়, আজকের বাংলাদেশ তখন ছিল পাকিস্তানের অংশ। সে সময়ের বাঙালি মুসলমান নেতা, বুদ্ধিজীবী, ছাত্র, চাষি, শ্রমিক— সবারই কিন্তু পাকিস্তান নিয়ে অনেক আশা-আকাঙ্ক্ষা ছিল। যুক্তবঙ্গে হিন্দু জমিদার-জোতদারের দাপট, সাংস্কৃতিক জগতে হিন্দুয়ানী নান্দনিকতার রমরমা, চাকরি-বাকরিতে হাতেগোণা মুসলমান উপস্থিতি— এসবই পাকিস্তানের প্রতি বাঙালি মুসলমানদের বড় অংশকে আকৃষ্ট করে। কিন্তু আমরা যদি আবুল মনসুর আহমদের আত্মজীবনী বা তাজউদ্দিন আহমদের ডাইরি পড়ি, দেখব প্রথম থেকেই তাদের কাছে বাঙালি ও মুসলমান দু’টি পরিচিতিই একই রকম গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বাঙালি মুসলমান বাঙালি হিন্দুর থেকে সাংস্কৃতিকভাবে আলাদা এবং পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি-মুসলমানি সংস্কৃতির লালন পালন হবে- এ ছিল আবুল মনসুরদের মতো বুদ্ধিজীবীদের ধারণা। এ ধারণায় একটা ভারসাম্য রক্ষার ব্যাপার আছে। একজনের কাছে বাঙালি হওয়া ও মুসলমান হওয়া সমান গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে, আবার কারও কাছে একটা অন্যটার চেয়ে বেশি। এ ভারসাম্যের রাজনীতি পূর্ব পাকিস্তান/ বাংলাদেশে নানা মুহূর্তে সংখ্যালঘু মানুষের অবস্থা বোঝার জন্য মাথায় রাখা জরুরি।

পাকিস্তানের উর্দু নিয়ে পদক্ষেপ বেশিরভাগ বাঙালি-মুসলমানের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। অবশ্য যারা তাদের মুসলমান পরিচিতিকেই একমাত্র পরিচিতি হিসেবে দেখতেন, তাদের কথা আলাদা। কিন্তু বিশেষ করে বাঙালি মুসলমান ছাত্র, শিক্ষক, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক কর্মী ও অন্যান্য বুদ্ধিজীবীরা প্রতিবাদে নেমেছিলেন। ১৯৪৮ থেকেই এ প্রতিবাদের শুরু। এখানে উল্লেখযোগ্য— আজকের মতো তখনও ছাত্ররা ছিলেন প্রতিবাদের সামনের সারিতে। আর নাজিমুদ্দিন বা নুরুল আমিন যখন উর্দু বিরোধী আন্দোলনকে ভারতীয়/হিন্দু ষড়যন্ত্র হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছিলেন, আন্দোলনকারী ছাত্ররা বারবার জোরের সঙ্গে বলেছিলেন, এ আন্দোলন ‘আমাদের’ আন্দোলন, অভ্যন্তরীণ আন্দোলন।

প্রশ্ন ওঠে আমরা কারা? নেপথ্যে কী? তাদের মধ্যে কী বাঙালি হিন্দুরা নেই? পাকিস্তানি আইনসভায় উর্দু নীতিবিরোধী প্রস্তাব সবার প্রথম আনেন কুমিল্লার কংগ্রেস নেতা ধীরেন দত্ত। ১৯৭১ পর্যন্ত তিনি পূর্ব পাকিস্তানেই ছিলেন, মৃত্যু হয় পাক সেনার গুলিতে। কিন্তু তার কংগ্রেসি, হিন্দু, বাঙালি পরিচয়কে সামনে রেখে মুসলিম লীগের একটা অংশ সহজেই বাংলার দাবিকে ভারতীয় ষড়যন্ত্র/বিদেশি দাবি হিসেবে উপস্থাপন করে। আসলে দেশভাগের আসল ভিত্তি ছিল ধর্ম। দ্বিজাতিতত্ত্ব অনুসারে পাকিস্তান হলো মুসলমানদের দেশ আর ভারত হলো হিন্দুদের। দুই দেশের প্রথম সারির নেতারাই অবশ্য ১৯৪৭ থেকেই একাধিকবার বলেছিলেন, তাদের দেশে নাগরিকত্ব ধর্ম, বর্ণ, জাতি ভিত্তিক হবে না। কিন্তু দেশভাগ মেনে নেওয়া, পাঞ্জাবে জন-বিনিময়, ইভাকুই প্রপার্টি সংক্রান্ত নানা আইন, নারীদের ‘উদ্ধার ও পুনর্বাসন’ নীতি— এ সবই এক রকম দ্বিজাতিতত্ত্বের বাস্তবায়ন বললে ভুল হয় না। (এ নিয়ে বিশদে জানতে দেখুন জয়া চ্যাটার্জির South Asian Histories of Citizenship)। এ প্রেক্ষিতে ধীরেন দত্তের প্রস্তাব, তার ধর্মীয় ও রাজনৈতিক পরিচিতি, খুব সহজেই তার আনা বাংলা ভাষার দাবিকে পাকিস্তান বিরোধী ও ইসলাম বিরোধী তকমা দিয়েছিল।

কিন্তু এ তকমা মানতে নারাজ ছিলেন সেইসব বাঙালি মুসলমান বুদ্ধিজীবীরা যাদের কল্পনায় পূর্ব পাকিস্তান মুসলমানি বাংলার বিকাশ স্থল৷ বাঙালি হিন্দুও তাদের কাছে সে সময়ে অপর, হয়তো বিদেশি বা সম্ভাব্য বিদেশি; উর্দুভাষী পশ্চিমী মুসলমানও অপর। এই আমরা-ওরার লড়াইয়ে ১৯৪৮ বা ১৯৫২ তে পাকিস্তানি সরকারি ডিসকোর্সে ‘আমরা’ হল সমস্ত পাকিস্তানি মুসলমান, ওরা হল হিন্দুরা— পাকিস্তানি হিন্দুই হোক, বা ভারতীয়। অন্যদিকে, পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি মুসলমান বুদ্ধিজীবীদের ‘আমরা’ ছিলেন তারাই যারা পাকিস্তানি, বাঙালি, এবং মুসলমান। বাকি সবাই ওরা। তাই অভ্যন্তরের ধারণা শুধু ভাষা-ভিত্তিক তা ভাবার কারণ নেই, এ সময় সেখানে স্থান ও ধর্মের গুরুত্ব ছিল।

১৯৫২ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত জল গড়াল বহু দূর। বাঙালি পরিচিতি ও বাংলা ভাষার গুরুত্ব পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলনে বরাবর ছিল, কিন্তু তার সঙ্গে অর্থনৈতিক নীতি নিয়ে ক্ষোভ, খাদ্যাভাব, ভোলা সাইক্লোনে ত্রাণের রাজনীতি ও আওয়ামী মুসলিম লীগের রাজনীতির কন্ঠরোধ করার চেষ্টাও এ আন্দোলনকে পোক্ত করেছিল। যা এক গৃহযুদ্ধ হতে পারত, তাতে ভারতের অংশগ্রহণ, ভারতে লক্ষ লক্ষ বাঙালি উদ্বাস্তুকে আশ্রয় দেওয়া, বাঙালি আবেগের উত্থান— সবমিলিয়ে ’৭১ এর মুহূর্ত দেশভাগের রাজনীতিকে ধাক্কা দিয়েছিল। কিন্তু ভাষা, ধর্ম, স্থানের জটিল রাজনীতিকে চিরতরে মসৃণ করতে পারেনি ’৭১। অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যার্পণ আইন বাতিল হয়নি, হিন্দু বিরোধী হিংসা থামেনি, বন্ধ হয়নি হিন্দু অভিবাসন। পাশাপাশি চলেছে বিহারি মুসলমানদের ওপর আক্রমণ, চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চলে নানা জনজাতির ওপর আক্রমণ।

একদিকে আমরা ২০০১ সালের সাম্প্রদায়িক হামলা দেখেছি, অন্যদিকে শাহবাগ আন্দোলন দেখেছি, তেমনি দেখেছি নাস্তিক ব্লগারদের ওপর আক্রমণ, হেফাজতে ইসলাম বা জামায়াতের মতো ইসলামিক শক্তির প্রভাব। বাংলাদেশ গঠনের পর, আমরা-ওরার সীমানা যেন আরও জটিল হয়েছে। বাঙালি হলেই আমরা, অবাঙালিরা ওরা- এটা এক ধরনের মত। এ মতের সঙ্গে হয়তো আওয়ামী লীগের সম্পর্কও কম। কিন্তু সেই কল্পনায় দুই বাংলার মধ্যের সীমানাকে ব্যাখ্যা করা মুশকিল। তাই শুধু বাঙালি নয়, তার সঙ্গে মুসলমান হওয়াও ‘আমরা’ হওয়ার জন্য জরুরি অনেকের কাছে। আবার কেউ কেউ মুসলমান পরিচয়কেই প্রধান পরিচয় করতে চান।

এ জটিল জাতিরাষ্ট্রের ধারণায় নতুন মাত্রা যোগ হলো ২০২-এর আগস্টের ৫ তারিখ। ক্ষমতা ছেড়ে পালালেন আওয়ামী লীগের প্রধান শেখ হাসিনা। কোটা বিরোধী আন্দোলন থামাতে গিয়ে উনি পরিচিত বুলি আওড়েছিলেন। বলেছিলেন, বিরোধীরা রাজাকার— অর্থাৎ পাকিস্তানপন্থি, সাম্প্রদায়িক শক্তি। সেই আমরা-ওরার সেই প্রশ্ন। কিন্তু এ ডিসকোর্স যেন মানুষকে আরও খেপিয়ে তুলল। আমরা রাজাকার, তাহলে তুমি স্বৈরাচার— এই বলে রাজাকার শব্দকে লঘু করা হলো। একটু হলেও ’৭১-এর মুহূর্ত প্রশ্নের মুখে পড়ল। তারপর আমরা জানি মুজিবের মূর্তি ভাঙা হয়েছে, পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে তার বাসভবন/জাদুঘর। দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলেছেন অনেকে।

এ দ্বিতীয় স্বাধীনতায় আমরা-ওরা কারা? এটা কি ’৪৭-এর মুহূর্তকে জোরালো করল আবার? হিন্দু আক্রমণ, তাদের অনেকের ভারতে ঢোকার চেষ্টা- সে রকম ইঙ্গিত দেয় হয়তো। কিন্তু পাশাপাশি এও ঠিক, ছাত্রছাত্রীদের বড় অংশ বারবার বলেছেন তারা ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ চান। আপাতত দেশের ক্ষমতায় যারা, তাদের অনেকেরই মানবাধিকার কর্মী হিসেবে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা আছে, সাম্প্রদায়িক হওয়ার বদনাম নেই। এ উপদেষ্টাদের মধ্যে সংখ্যালঘু (হিন্দু, চাকমা) প্রতিনিধিও আছেন। আর অনেকেই বলছেন, হামালার ধরন রাজনৈতিক— আক্রান্ত মূলত আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকরাই; সাম্প্রদায়িক নয়। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, সংখ্যালঘু বিরোধী দাঙ্গা, ধর্মীয় রক্ষণশীলতার রাজনৈতিক উত্থান— কোনোটাই কাম্য নয়। তবে যে কোনো জাতি-রাষ্ট্রের ধারণাই আমরা-ওরার ওপর দাঁড়িয়ে থাকে। এই ধারণার মধ্যেই নিহিত থাকে হামলার আশঙ্কা।

মোটের ওপর গণতন্ত্র, অর্থনৈতিক বিকাশ, মোটামুটি স্বাধীন আইন-আদালত, আমলাতন্ত্র, পুলিশ— এ হামলাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে। বাংলাদেশে আমরা কারা হবে, আর ওরা কারা হবে- তা বুঝতে সময় লাগবে আরও। আর আমরা-ওরার মধ্যে দ্বন্দ্ব নিয়ন্ত্রণে থাকবে তখনই, যখন সাধারণ নির্বাচন হবে। আর তা হবে মোটের ওপর স্বচ্ছভাবে। আর যত দিন এ উপদেষ্টামণ্ডলীর হাতে ক্ষমতা, তত দিন সবরকম দ্বন্দ্ব-হামলা নিয়ন্ত্রণের দায় তাদের।