ঢাকা ০১:২৯ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৯ অক্টোবর ২০২৪, ৪ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

গুলিতে ঝাঁঝরা সাঈদের বুক, আসামি করা হলো আন্দোলনকারীদের

কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় সংঘর্ষে রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যায়। তার গলা থেকে ঊরু পর্যন্ত গুলির আঘাত পাওয়া যায়। তবে পুলিশের করা মামলার প্রাথমিক তথ্য বিবরণীতে (এফআইআর) বলা হয়েছে, আন্দোলনকারীদের ছোড়া গুলি ও ইটপাটকেল নিক্ষেপের এক পর্যায়ে আবু সাঈদের মৃত্যু হয়েছে।

সংঘর্ষের একাধিক ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, ১৬ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের কর্মসূচি চলাকালে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের সড়কে পুলিশ আবু সাঈদকে খুব কাছ থেকে গুলি করে। আর আবু সাঈদ এক হাতে লাঠি নিয়ে দুই হাত প্রসারিত করে বুক পেতে দেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি লুটিয়ে পড়েন।

সাঈদের লাশ ময়নাতদন্ত করেন রংপুর মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান সহকারী অধ্যাপক রাজিবুল ইসলাম। তিনি শনিবার গণমাধ্যমকে বলেন, বেরোবির শিক্ষার্থী আবু সাঈদের বুক ও পেট ছররা গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যায়। লুকোচুরির কিছু নেই। রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু হয়।

আগামী কয়েক দিনের মধ্যে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া হবে বলে জানান তিনি।

কিন্তু মামলার এফআইআরে আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ নেই। আবু সাঈদ নিহত হওয়ার পরদিন ১৭ জুলাই তাজহাট থানায় একটি মামলা হয়েছে। মামলার বাদী ওই থানার উপপরিদর্শক ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ বিভূতি ভূষণ রায়।

গুলির নির্দেশ ছিল না: নৌপরিবহণ প্রতিমন্ত্রী

মামলার এফআইআরে বলা হয়েছে, গত ১৬ জুলাই বেলা ২টা ১৫ মিনিটের দিকে ছাত্র নামধারী সুবিধাভোগী রাষ্ট্রবিরোধী আন্দোলনরত দুর্বৃত্তগণ বিভিন্ন দিক থেকে বৃষ্টির মতো ইটপাটকেল ও তাদের নিকটে থাকা আগ্নেয়াস্ত্র হতে এলোপাতাড়ি গুলি করতে শুরু করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার লক্ষ্যে তাদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশও এপিসি গাড়ির মধ্য হতে কং/ ১১৮৬ সোহেল তার নামীয় সরকারি ইস্যুকৃত শটগান হইতে ১৬৯ রাউন্ড রাবার বুলেট ফায়ার করে। পুরো বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।

আবু সাঈদের মৃত্যুর বিষয়ে বলা হয়, বিভিন্ন দিক থেকে আন্দোলনকারীদের ছোড়া গুলি ও ইট নিক্ষেপের এক পর্যায়ে এক শিক্ষার্থীকে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। সহপাঠীরা ধরাধরি করে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় অজ্ঞাতনামা ২-৩ হাজার ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে।

এ বিষয়ে মামলার বাদী বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ বিভূতি ভূষণ রায় এজাহার দায়েরের কথা নিশ্চিত করেন। তবে তিনি বিস্তারিত কিছু জানানি।

মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা এসআই জিল্লুর রহমান জানিয়েছেন, তিনি মামলার তদন্ত শুরু করেছেন। মামলাটির তদন্ত প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। তাই কোনো কিছু পূর্ণাঙ্গ না জেনে মন্তব্য করা যাবে না। তিনি আশা করেন দু-তিন দিনের মধ্যে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন হাতে পাবেন।

শনিবার রংপুর মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. মনিরুজ্জামান গণমাধ্যমকে বলেন, প্রাথমিক তথ্য বিবরণীতে ঘটনার বিবরণ দেওয়া হয়। বিবরণীতে আবু সাঈদের মৃত্যুর বিষয়টি আছে; কিন্তু এটা চূড়ান্ত কিছু নয়। অনুসন্ধান কমিটির প্রতিবেদন ও চিকিৎসকের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন এবং ঘটনার আশপাশের ফুটেজ পর্যবেক্ষণ করে তদন্তে পুরো বিষয়টি উঠে আসবে।

তিনি আরও বলেন, ঘটনার দিন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কাঁদানে গ্যাস, সাউন্ড গ্রেনেড ও শটগানের ছররা গুলি ব্যবহার করেছিল পুলিশ। পুলিশের কাউকে গুলি করার অনুমোদন দেওয়া হয়নি বা আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা হয়নি। বিস্তারিত তদন্তে পুলিশের কোনো সদস্যের গুলি করার প্রমাণ পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

নৌপরিবহণ প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কোনো ধরনের গুলির নির্দেশনা দেওয়া ছিল না। কিন্তু রংপুরের ছাত্রটি কিভাবে গুলিবিদ্ধ হয়ে হত্যাকাণ্ডের শিকার হলো সেটি তদন্তের বিষয়। আমরা সেটার সঠিক তদন্তের দাবি জানাই। একইসঙ্গে রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুলের শিক্ষার্থীটিকে কে বা কারা গুলি করেছে আমরা তারও সুষ্ঠু বিচার দাবি করি। কারণ ওই শিক্ষার্থী যেখানে গুলিবিদ্ধ হয়েছে সেখানে তার যাওয়ার কথা নয়।

আবু সাঈদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ১২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি কোটা সংস্কার আন্দোলনের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সমন্বয়ক ছিলেন। তার বাড়ি রংপুরের পীরগঞ্জের জাফরপাড়া বাবরপুর গ্রামে।

প্রত্যক্ষদর্শী শিক্ষার্থীরা বলেন, আবু সাঈদ আহত হয়ে পড়ে গেলেও পুলিশ নির্বিচার গুলি ছোড়ে। রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়ক সাবিনা আক্তার বলেন, সাঈদকে ‘টার্গেট’ করে হত্যা করা হয়েছে।

ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, সাঈদ গুলিতে আহত হয়ে রাস্তায় পড়ে যেতে থাকলে তার কাছে দৌড়ে ছুটে যান সহপাঠীরা। তারা আবু সাঈদকে রিকশায় তুলে নিয়ে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দিকে রওনা হন।

আবু সাঈদের মৃত্যুর ঘটনায় পুলিশের এফআইআর নিয়ে শিক্ষক–শিক্ষার্থীদের মধ্যে নতুন করে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে।

 

Tag :

আপনার মতামত লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল ও অন্যান্য তথ্য সঞ্চয় করে রাখুন

আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

গুলিতে ঝাঁঝরা সাঈদের বুক, আসামি করা হলো আন্দোলনকারীদের

আপডেট সময় ১২:২৮:৩৬ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৮ জুলাই ২০২৪

কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় সংঘর্ষে রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যায়। তার গলা থেকে ঊরু পর্যন্ত গুলির আঘাত পাওয়া যায়। তবে পুলিশের করা মামলার প্রাথমিক তথ্য বিবরণীতে (এফআইআর) বলা হয়েছে, আন্দোলনকারীদের ছোড়া গুলি ও ইটপাটকেল নিক্ষেপের এক পর্যায়ে আবু সাঈদের মৃত্যু হয়েছে।

সংঘর্ষের একাধিক ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, ১৬ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের কর্মসূচি চলাকালে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের সড়কে পুলিশ আবু সাঈদকে খুব কাছ থেকে গুলি করে। আর আবু সাঈদ এক হাতে লাঠি নিয়ে দুই হাত প্রসারিত করে বুক পেতে দেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি লুটিয়ে পড়েন।

সাঈদের লাশ ময়নাতদন্ত করেন রংপুর মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান সহকারী অধ্যাপক রাজিবুল ইসলাম। তিনি শনিবার গণমাধ্যমকে বলেন, বেরোবির শিক্ষার্থী আবু সাঈদের বুক ও পেট ছররা গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যায়। লুকোচুরির কিছু নেই। রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু হয়।

আগামী কয়েক দিনের মধ্যে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া হবে বলে জানান তিনি।

কিন্তু মামলার এফআইআরে আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ নেই। আবু সাঈদ নিহত হওয়ার পরদিন ১৭ জুলাই তাজহাট থানায় একটি মামলা হয়েছে। মামলার বাদী ওই থানার উপপরিদর্শক ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ বিভূতি ভূষণ রায়।

গুলির নির্দেশ ছিল না: নৌপরিবহণ প্রতিমন্ত্রী

মামলার এফআইআরে বলা হয়েছে, গত ১৬ জুলাই বেলা ২টা ১৫ মিনিটের দিকে ছাত্র নামধারী সুবিধাভোগী রাষ্ট্রবিরোধী আন্দোলনরত দুর্বৃত্তগণ বিভিন্ন দিক থেকে বৃষ্টির মতো ইটপাটকেল ও তাদের নিকটে থাকা আগ্নেয়াস্ত্র হতে এলোপাতাড়ি গুলি করতে শুরু করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার লক্ষ্যে তাদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশও এপিসি গাড়ির মধ্য হতে কং/ ১১৮৬ সোহেল তার নামীয় সরকারি ইস্যুকৃত শটগান হইতে ১৬৯ রাউন্ড রাবার বুলেট ফায়ার করে। পুরো বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।

আবু সাঈদের মৃত্যুর বিষয়ে বলা হয়, বিভিন্ন দিক থেকে আন্দোলনকারীদের ছোড়া গুলি ও ইট নিক্ষেপের এক পর্যায়ে এক শিক্ষার্থীকে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। সহপাঠীরা ধরাধরি করে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় অজ্ঞাতনামা ২-৩ হাজার ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে।

এ বিষয়ে মামলার বাদী বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ বিভূতি ভূষণ রায় এজাহার দায়েরের কথা নিশ্চিত করেন। তবে তিনি বিস্তারিত কিছু জানানি।

মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা এসআই জিল্লুর রহমান জানিয়েছেন, তিনি মামলার তদন্ত শুরু করেছেন। মামলাটির তদন্ত প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। তাই কোনো কিছু পূর্ণাঙ্গ না জেনে মন্তব্য করা যাবে না। তিনি আশা করেন দু-তিন দিনের মধ্যে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন হাতে পাবেন।

শনিবার রংপুর মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. মনিরুজ্জামান গণমাধ্যমকে বলেন, প্রাথমিক তথ্য বিবরণীতে ঘটনার বিবরণ দেওয়া হয়। বিবরণীতে আবু সাঈদের মৃত্যুর বিষয়টি আছে; কিন্তু এটা চূড়ান্ত কিছু নয়। অনুসন্ধান কমিটির প্রতিবেদন ও চিকিৎসকের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন এবং ঘটনার আশপাশের ফুটেজ পর্যবেক্ষণ করে তদন্তে পুরো বিষয়টি উঠে আসবে।

তিনি আরও বলেন, ঘটনার দিন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কাঁদানে গ্যাস, সাউন্ড গ্রেনেড ও শটগানের ছররা গুলি ব্যবহার করেছিল পুলিশ। পুলিশের কাউকে গুলি করার অনুমোদন দেওয়া হয়নি বা আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা হয়নি। বিস্তারিত তদন্তে পুলিশের কোনো সদস্যের গুলি করার প্রমাণ পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

নৌপরিবহণ প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কোনো ধরনের গুলির নির্দেশনা দেওয়া ছিল না। কিন্তু রংপুরের ছাত্রটি কিভাবে গুলিবিদ্ধ হয়ে হত্যাকাণ্ডের শিকার হলো সেটি তদন্তের বিষয়। আমরা সেটার সঠিক তদন্তের দাবি জানাই। একইসঙ্গে রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুলের শিক্ষার্থীটিকে কে বা কারা গুলি করেছে আমরা তারও সুষ্ঠু বিচার দাবি করি। কারণ ওই শিক্ষার্থী যেখানে গুলিবিদ্ধ হয়েছে সেখানে তার যাওয়ার কথা নয়।

আবু সাঈদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ১২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি কোটা সংস্কার আন্দোলনের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সমন্বয়ক ছিলেন। তার বাড়ি রংপুরের পীরগঞ্জের জাফরপাড়া বাবরপুর গ্রামে।

প্রত্যক্ষদর্শী শিক্ষার্থীরা বলেন, আবু সাঈদ আহত হয়ে পড়ে গেলেও পুলিশ নির্বিচার গুলি ছোড়ে। রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়ক সাবিনা আক্তার বলেন, সাঈদকে ‘টার্গেট’ করে হত্যা করা হয়েছে।

ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, সাঈদ গুলিতে আহত হয়ে রাস্তায় পড়ে যেতে থাকলে তার কাছে দৌড়ে ছুটে যান সহপাঠীরা। তারা আবু সাঈদকে রিকশায় তুলে নিয়ে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দিকে রওনা হন।

আবু সাঈদের মৃত্যুর ঘটনায় পুলিশের এফআইআর নিয়ে শিক্ষক–শিক্ষার্থীদের মধ্যে নতুন করে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে।