ঢাকা ০৬:২৩ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২০ অক্টোবর ২০২৪, ৫ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::
বিএনপি এক ব্যক্তির শাসন দেখতে চায় নাশহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি গণতন্ত্র কিংবা অন্য কোন মানব রচিত ব্যবস্থার মাধ্যমে দুর্নীতি ও বৈষম্য মুক্ত কল্যাণকর সমাজ এবং রাষ্ট্র গঠন সম্ভব নয়- আমীর, ইসলামী সমাজ। ঈশ্বরদীর আরামবাড়িয়া বাজারে গুলি: যুবদল কর্মী বিপু গুলিবিদ্ধ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাথে মতবিনিময় সভায় সাবেক এমপি আলহাজ্ব শাহজাহান চৌধুরী। ফের বাড়ল সোনার দাম মুসলমানদেরকে শিরক মুক্ত ঈমান ও ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তোষ অর্জন করতে হবে ভোলায় গণ অধিকার পরিষদের সদস্য সংগ্রহের লিফলেট বিতরণ মধ্যরাতে ছাত্রলীগ-যুবলীগের ঝটিকা মিছিল নভেম্বরেও হচ্ছে না হামজার অভিষেক! ইউএনও’র বাসভবনে সিন্দুক ভরা পোড়া টাকার ভিডিও ভাইরাল, সমালোচনা

কর্মকর্তা হয়েই নাঈমের সাড়ে ৪ কোটি টাকার ডুপ্লেক্স বাড়ি

নরসিংদী জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের অধিগ্রহণ শাখার প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. নাঈম মিয়া। ২০২২ সালের ২৯ মে তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী থেকে পদোন্নতি পেয়ে দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা হয়েছেন। এরপর ২ জুন জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অধিগ্রহণ শাখার প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেন। আর চলতি বছরের মার্চ মাসে সাড়ে চার কোটি টাকায় একটি ডুপ্লেক্স বাড়ি কিনে আলোচনায় আসেন।

অভিযোগ উঠেছে, ১৬ হাজার টাকা স্কেলে ২৪ হাজার ৮৭০ টাকা বেতনে চাকরি করা মো. নাঈম ডুপ্লেক্স বাড়ি কিনতে এত টাকা কোথায় পেয়েছেন? আবার রাজস্ব ফাঁকি দিতে বাড়ি কেনার দলিলেও তিনি জালিয়াতি করেছেন। বাড়ির প্রকৃত মূল্য না দেখিয়ে শুধু মৌজার মূল্যে দলিল করেছেন। ক্রয় করা জমিতে ডুপ্লেক্স বাড়ি থাকলেও দলিলে উল্লেখ করেছেন স্থাপনাবিহীন। ফলে বিপুল টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছে সরকার।

জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. নাঈম মিয়া কয়েক বছরে ভাড়াটিয়া থেকে ডুপ্লেক্স বাড়ির মালিক হলেও উন্নতি হয়নি তাঁর সমমর্যাদার সহকর্মীদের।

স্থানীয়রা জানায়, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ছয় লেন প্রকল্পের জন্য নরসিংদী জেলার ৫২ কিলোমিটার অংশে ১৮২ একর ভূমি অধিগ্রহণ করা হচ্ছে। এই ভূমি অধিগ্রহণে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। ভুক্তভোগীরা বলছেন, ভূমি অধিগ্রহণ শাখার কানুনগো মোস্তফা কামাল, সার্ভেয়ার মাহাবুব ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. নাঈম মিয়ার স্বেচ্ছাচারিতায় সর্বস্বান্ত হচ্ছেন তাঁরা।

অধিগ্রহণ করা ভূমির ক্ষতিপূরণের অর্থ ছাড় করাতে তাঁদের দিতে হচ্ছে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ হারে ঘুষ। বিষয়টি নিয়ে জেলা প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনারের কাছে একাধিক লিখিত অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা। এ বিষয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন বিভাগীয় কমিশনার।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ১৪ মার্চ নরসিংদী পৌর এলাকার পূর্ব ব্রাহ্মন্দী মহল্লার মৃত মো. তোতা মিয়ার ছেলে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী জহিরুল ইসলামের কাছ থেকে সাড়ে চার কোটি টাকায় একটি ডুপ্লেক্স বাড়িসহ ১৫ শতাংশ জমি কেনেন জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের অধিগ্রহণ শাখার প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. নাঈম মিয়া। যার দলিল নম্বর ৩৫৭৫/২৪।

ঝামেলা এড়াতে তিনি দলিলে নিজের নাম ব্যবহার না করে বাবা মো. জাকারিয়া এবং স্ত্রী রোকসানা আক্তারের নাম ব্যবহার করেছেন।
জানা যায়, নরসিংদী সদর সাবরেজিস্ট্রারের কার্যালয়ের নির্ধারিত বাড়ি শ্রেণির প্রতি শতাংশ জমির নির্ধারিত মূল্য ১৫ লাখ ৪৪ হাজার ৫৮৯ টাকা। সে হিসাবে ১৫ শতাংশ জমির মূল্য প্রায় দুই কোটি ৩১ লাখ ৬৮ হাজার ৮৩৫ টাকা। নাঈম দলিলে জমির মূল্য দেখিয়েছেন দুই কোটি ৩২ লাখ টাকা। তবে বর্তমানে পূর্ব ব্রাহ্মন্দী সড়কের পাশে প্রতি শতাংশ জমির প্রকৃত বাজারমূল্য ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকা। স্থানীয়রা জানায়, নাঈম মিয়া জমির বর্তমান বাজার মূল্যে প্রায় সাড়ে চার কোটি টাকায় ডুপ্লেক্স বাড়িটিসহ ১৫ শতাংশ জমি ক্রয় করেছেন। এ ছাড়া দলিলে নাঈম মিয়া জমিটি স্থাপনাবিহীন উল্লেখ করেছেন। কিন্তু ওই জমিতে কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত একটি ডুপ্লেক্স বাড়ি রয়েছে। দলিলে সেটি গোপন করে বিপুল রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছেন নাঈম।

প্রবাসী জহিরুল ইসলামের একজন নিকটাত্মীয় কালের কণ্ঠকে জানান, পৌরসভার ১৮ ফুট সড়কের পাশে ওই ১৫ শতাংশ জমির প্রকৃত মূল্য পাঁচ কোটি টাকার বেশি। তাঁরা জানতে পেরেছেন, জহির সাড়ে চার কোটি টাকায় ওই জমি বিক্রি করেছেন ডিসি অফিসের এলএ শাখার নাঈমের কাছে।

পূর্ব ব্রাহ্মন্দী এলাকার বাসিন্দা তানভীর আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি নাঈমের প্রতিবেশী। তিনি আগে আমাদের মহল্লায় ভাড়া থাকতেন। চার বছর আগে আমার এক চাচির কাছ থেকে ৬ শতাংশ জমি কিনেন ৬০ থেকে ৬৫ লাখ টাকায়। তখন তিনি ডিসি অফিসের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী ছিলেন। সম্প্রতি তিনি দ্বিতীয় শ্রেণিতে পদোন্নতি পেয়েই নিজের বাড়িটি রায়পুরা বটতলী এলাকার গোলাম মাওলা নামের একজনের কাছে ৮০ থেকে ৯০ লাখ টাকায় বিক্রি করে জহিরের ডুপ্লেক্স বাড়িটি কিনেছেন। পদের সঙ্গে বাড়িরও উন্নতি হয়েছে। বাড়িটির দাম নিয়ে বিভ্রান্তি থাকলেও কেউ বলছেন চার কোটি আবার কেউ বলছেন সাড়ে চার কোটি, কেউ কেউ পাঁচ কোটি টাকাও বলছেন।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, ডুপ্লেক্স বাড়িটির মূল ফটকে কোনো নামফলক নেই। ভেতরে ঢালাই করা পথ। তার মাথায় রয়েছে অত্যাধুনিক ডিজাইনের একটি ডুপ্লেক্স বাড়ি। সামনে ফলফলাদি গাছের সমাহার। ওই বাড়ির নিচতলায় ভাড়া থাকেন মিজানুর রহমান নামের এক ভাড়াটিয়া। বাড়িটির মালিকানা পরিবর্তন হওয়ায় বাড়িটি ছেড়ে যাবেন বলে জানান তিনি। গত রবিবার ওই বাড়ির দোতলায় উঠেছেন মো. নাঈম মিয়ার পুরনো বাড়ির খরিদদার গোলাম মাওলা।

গোলাম মাওলা বলেন, ‘আমি প্রায় কোটি টাকা দিয়ে নাঈম সাহেবের বাড়িটি কিনেছি। পুরনো বাড়িটি ছাড়তে তিনি দুই মাস সময় চেয়েছেন। তাই আপাতত আমাকে তাঁর এই বাড়িতে উঠিয়েছেন। ভাড়া দিতে হবে না।’

এ বিষয়ে জানতে মোবাইলে মো. নাঈম মিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘ব্রাহ্মন্দী এলাকায় আমার যে জায়গা ছিল সেটা বিক্রি করে নতুন এই বাড়ি কিনেছি।’ কত টাকায় কিনেছেন জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ‘মনে নেই। দলিল দেখে বলতে হবে।’ এরপর অফিসে ব্যস্ত আছেন বলে ফোন কেটে দেন তিনি।

জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের অধিগ্রহণ শাখার অনিয়ম ও হয়রানি
জমির মালিকদের অভিযোগ, ক্ষতিপূরণের অর্থ ছাড় করাতে তাঁদের ঘুষ দিতে হচ্ছে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ হারে। টাকা দিলে নামসর্বস্ব স্থাপনার দাম বাড়িয়ে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হচ্ছে কয়েক গুণ। আর কমিশন না দিলে ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে প্রকৃত মালিকদের। সেই সঙ্গে আবাসিক ও বাণিজ্যিক জমি দেখানো হচ্ছে কৃষিজমি হিসেবে।

শিবপুরের বাঘাব ইউনিয়নের কুন্দারপাড়া এলাকার মো. মকবুল হোসেন ভূইয়া বলেন, ‘আমরা তিন ভাই ও দুই বোন শিবপুর উপজেলার চৌপট মৌজায় ওয়ারিশসূত্রে ১৫ শতাংশ জমির মালিক। এর মধ্যে ০.০৬৩৩ শতাংশ জমি অধিগ্রহণ করা হয়। ওই জমিতে মুরগির খামারের দুটি শেড, গাছপালা ও মার্কেট নির্মাণের ভিত্তিস্থাপন অংশ অন্তর্ভুক্ত না করেই ৮ ধারায় নোটিশ করা হয়েছে। দালাল মারফত আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। ঘুষ দিতে রাজি না হওয়ায় এসব স্থাপনা অন্তর্ভুক্ত করেনি।’

একই এলাকার আরেকজন জমির মালিক ওবায়দুল সরকার বলেন, ‘চৌপট মৌজায় তাঁর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। নরসিংদী জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণ শাখার কানুনগো মোস্তফা কামাল জমিতে থাকা স্থাপনা, গাছপালা লিপিবদ্ধ করে নিয়ে যায়। পরে বিভিন্ন দালাল মারফত তিন লাখ টাকা দাবি করেন তিনি। টাকা না দেওয়ায় জমি ছাড়া আর কিছু তালিকাভুক্ত করা হয়নি। বর্তমানে জমির দাম থেকেও ২০ শতাংশ কমিশন দাবি করছেন তিনি। কমিশনের টাকা না দিলে জমির বিল পাব না বলে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে আমি বিভাগীয় কমিশনার বরাবর লিখিত অভিযোগ করেছি।’

বেলাব উপজেলার বারৈচা বাসস্ট্যান্ড এলাকার সওদাগর হোটেল অ্যান্ড মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের স্বত্বাধিকারী সিরাজুল ইসলাম সিরাজ বলেন, ‘ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে আমার ৭ শতাংশ জমি পড়েছে। ওই জায়গায় আমি পাঁচতলা ফাউন্ডেশন দিয়ে একটি বিল্ডিং করেছি। তিনতলা পর্যন্ত কাজ সম্পন্ন হয়েছে। কানুনগো মোস্তফা কামাল আমাকে বলেছেন, তাঁকে ২০ শতাংশ কমিশন দিলে জায়গা ও ভবনের ন্যায্যমূল্য দিয়ে দেবেন। কিন্তু তাঁর কথামতো কমিশন না দেওয়ায় আমার বিল অনেক কম করে পাস করেছেন। আমার ভবনের তথ্য ও ক্ষতিপূরণের অর্থ পাসই করেননি। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে আমার ভবন ও জায়গার বর্তমান মূল্য প্রায় তিন কোটি টাকা। অথচ পাস করা হয়েছে ৬৯ লাখ টাকা। ২০ শতাংশ হারে কমিশন দিলে তিন কোটি টাকার বিলই পাস করতেন। ন্যায্যমূল্য পেতে আমি উচ্চ আদালতে মামলা করেছি।’

বারৈচা বাজার বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক কবির হোসেন বলেন, ‘জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ শাখার কানুনগো মোস্তফা কামাল, সার্ভেয়ার মাহাবুব ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. নাঈম মিয়ার কথামতো কমিশন দিতে রাজি হলে অধিগ্রহণ করা এলাকায় পড়া জমি ও স্থাপনার দাম বেশি ধরা হয়। বাসস্ট্যান্ড এলাকায় স্বাভাবিকভাবেই জমি ও স্থাপনার দাম বেশি। অথচ তাঁরা গ্রামের জমি ও স্থাপনার যে হারে ক্ষতিপূরণের দাম দিচ্ছেন, বাসস্ট্যান্ড এলাকায়ও একই হারে দাম দিচ্ছেন। এ কারণে ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বারৈচা বাসস্ট্যান্ডের কয়েক শ ব্যবসায়ী।’

এসব অভিযোগের বিষয়ে ভূমি অধিগ্রহণ শাখার কানুনগো মোস্তফা কামাল বলেন, ‘দালালরা কাজ নিয়ে এলে কিছু হলেও তাদের কাজ করে দিতে হয়। আমার নিজেরও তো নিরাপত্তার বিষয় আছে। এই অফিসের ভেতরে আমি অফিসার, অফিসের বাইরে কিন্তু আমি অফিসার না।’

Tag :

আপনার মতামত লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল ও অন্যান্য তথ্য সঞ্চয় করে রাখুন

আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

বিএনপি এক ব্যক্তির শাসন দেখতে চায় নাশহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি

কর্মকর্তা হয়েই নাঈমের সাড়ে ৪ কোটি টাকার ডুপ্লেক্স বাড়ি

আপডেট সময় ০৮:৫৮:০১ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৫ জুলাই ২০২৪

নরসিংদী জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের অধিগ্রহণ শাখার প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. নাঈম মিয়া। ২০২২ সালের ২৯ মে তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী থেকে পদোন্নতি পেয়ে দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা হয়েছেন। এরপর ২ জুন জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অধিগ্রহণ শাখার প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেন। আর চলতি বছরের মার্চ মাসে সাড়ে চার কোটি টাকায় একটি ডুপ্লেক্স বাড়ি কিনে আলোচনায় আসেন।

অভিযোগ উঠেছে, ১৬ হাজার টাকা স্কেলে ২৪ হাজার ৮৭০ টাকা বেতনে চাকরি করা মো. নাঈম ডুপ্লেক্স বাড়ি কিনতে এত টাকা কোথায় পেয়েছেন? আবার রাজস্ব ফাঁকি দিতে বাড়ি কেনার দলিলেও তিনি জালিয়াতি করেছেন। বাড়ির প্রকৃত মূল্য না দেখিয়ে শুধু মৌজার মূল্যে দলিল করেছেন। ক্রয় করা জমিতে ডুপ্লেক্স বাড়ি থাকলেও দলিলে উল্লেখ করেছেন স্থাপনাবিহীন। ফলে বিপুল টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছে সরকার।

জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. নাঈম মিয়া কয়েক বছরে ভাড়াটিয়া থেকে ডুপ্লেক্স বাড়ির মালিক হলেও উন্নতি হয়নি তাঁর সমমর্যাদার সহকর্মীদের।

স্থানীয়রা জানায়, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ছয় লেন প্রকল্পের জন্য নরসিংদী জেলার ৫২ কিলোমিটার অংশে ১৮২ একর ভূমি অধিগ্রহণ করা হচ্ছে। এই ভূমি অধিগ্রহণে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। ভুক্তভোগীরা বলছেন, ভূমি অধিগ্রহণ শাখার কানুনগো মোস্তফা কামাল, সার্ভেয়ার মাহাবুব ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. নাঈম মিয়ার স্বেচ্ছাচারিতায় সর্বস্বান্ত হচ্ছেন তাঁরা।

অধিগ্রহণ করা ভূমির ক্ষতিপূরণের অর্থ ছাড় করাতে তাঁদের দিতে হচ্ছে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ হারে ঘুষ। বিষয়টি নিয়ে জেলা প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনারের কাছে একাধিক লিখিত অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা। এ বিষয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন বিভাগীয় কমিশনার।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ১৪ মার্চ নরসিংদী পৌর এলাকার পূর্ব ব্রাহ্মন্দী মহল্লার মৃত মো. তোতা মিয়ার ছেলে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী জহিরুল ইসলামের কাছ থেকে সাড়ে চার কোটি টাকায় একটি ডুপ্লেক্স বাড়িসহ ১৫ শতাংশ জমি কেনেন জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের অধিগ্রহণ শাখার প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. নাঈম মিয়া। যার দলিল নম্বর ৩৫৭৫/২৪।

ঝামেলা এড়াতে তিনি দলিলে নিজের নাম ব্যবহার না করে বাবা মো. জাকারিয়া এবং স্ত্রী রোকসানা আক্তারের নাম ব্যবহার করেছেন।
জানা যায়, নরসিংদী সদর সাবরেজিস্ট্রারের কার্যালয়ের নির্ধারিত বাড়ি শ্রেণির প্রতি শতাংশ জমির নির্ধারিত মূল্য ১৫ লাখ ৪৪ হাজার ৫৮৯ টাকা। সে হিসাবে ১৫ শতাংশ জমির মূল্য প্রায় দুই কোটি ৩১ লাখ ৬৮ হাজার ৮৩৫ টাকা। নাঈম দলিলে জমির মূল্য দেখিয়েছেন দুই কোটি ৩২ লাখ টাকা। তবে বর্তমানে পূর্ব ব্রাহ্মন্দী সড়কের পাশে প্রতি শতাংশ জমির প্রকৃত বাজারমূল্য ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকা। স্থানীয়রা জানায়, নাঈম মিয়া জমির বর্তমান বাজার মূল্যে প্রায় সাড়ে চার কোটি টাকায় ডুপ্লেক্স বাড়িটিসহ ১৫ শতাংশ জমি ক্রয় করেছেন। এ ছাড়া দলিলে নাঈম মিয়া জমিটি স্থাপনাবিহীন উল্লেখ করেছেন। কিন্তু ওই জমিতে কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত একটি ডুপ্লেক্স বাড়ি রয়েছে। দলিলে সেটি গোপন করে বিপুল রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছেন নাঈম।

প্রবাসী জহিরুল ইসলামের একজন নিকটাত্মীয় কালের কণ্ঠকে জানান, পৌরসভার ১৮ ফুট সড়কের পাশে ওই ১৫ শতাংশ জমির প্রকৃত মূল্য পাঁচ কোটি টাকার বেশি। তাঁরা জানতে পেরেছেন, জহির সাড়ে চার কোটি টাকায় ওই জমি বিক্রি করেছেন ডিসি অফিসের এলএ শাখার নাঈমের কাছে।

পূর্ব ব্রাহ্মন্দী এলাকার বাসিন্দা তানভীর আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি নাঈমের প্রতিবেশী। তিনি আগে আমাদের মহল্লায় ভাড়া থাকতেন। চার বছর আগে আমার এক চাচির কাছ থেকে ৬ শতাংশ জমি কিনেন ৬০ থেকে ৬৫ লাখ টাকায়। তখন তিনি ডিসি অফিসের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী ছিলেন। সম্প্রতি তিনি দ্বিতীয় শ্রেণিতে পদোন্নতি পেয়েই নিজের বাড়িটি রায়পুরা বটতলী এলাকার গোলাম মাওলা নামের একজনের কাছে ৮০ থেকে ৯০ লাখ টাকায় বিক্রি করে জহিরের ডুপ্লেক্স বাড়িটি কিনেছেন। পদের সঙ্গে বাড়িরও উন্নতি হয়েছে। বাড়িটির দাম নিয়ে বিভ্রান্তি থাকলেও কেউ বলছেন চার কোটি আবার কেউ বলছেন সাড়ে চার কোটি, কেউ কেউ পাঁচ কোটি টাকাও বলছেন।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, ডুপ্লেক্স বাড়িটির মূল ফটকে কোনো নামফলক নেই। ভেতরে ঢালাই করা পথ। তার মাথায় রয়েছে অত্যাধুনিক ডিজাইনের একটি ডুপ্লেক্স বাড়ি। সামনে ফলফলাদি গাছের সমাহার। ওই বাড়ির নিচতলায় ভাড়া থাকেন মিজানুর রহমান নামের এক ভাড়াটিয়া। বাড়িটির মালিকানা পরিবর্তন হওয়ায় বাড়িটি ছেড়ে যাবেন বলে জানান তিনি। গত রবিবার ওই বাড়ির দোতলায় উঠেছেন মো. নাঈম মিয়ার পুরনো বাড়ির খরিদদার গোলাম মাওলা।

গোলাম মাওলা বলেন, ‘আমি প্রায় কোটি টাকা দিয়ে নাঈম সাহেবের বাড়িটি কিনেছি। পুরনো বাড়িটি ছাড়তে তিনি দুই মাস সময় চেয়েছেন। তাই আপাতত আমাকে তাঁর এই বাড়িতে উঠিয়েছেন। ভাড়া দিতে হবে না।’

এ বিষয়ে জানতে মোবাইলে মো. নাঈম মিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘ব্রাহ্মন্দী এলাকায় আমার যে জায়গা ছিল সেটা বিক্রি করে নতুন এই বাড়ি কিনেছি।’ কত টাকায় কিনেছেন জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ‘মনে নেই। দলিল দেখে বলতে হবে।’ এরপর অফিসে ব্যস্ত আছেন বলে ফোন কেটে দেন তিনি।

জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের অধিগ্রহণ শাখার অনিয়ম ও হয়রানি
জমির মালিকদের অভিযোগ, ক্ষতিপূরণের অর্থ ছাড় করাতে তাঁদের ঘুষ দিতে হচ্ছে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ হারে। টাকা দিলে নামসর্বস্ব স্থাপনার দাম বাড়িয়ে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হচ্ছে কয়েক গুণ। আর কমিশন না দিলে ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে প্রকৃত মালিকদের। সেই সঙ্গে আবাসিক ও বাণিজ্যিক জমি দেখানো হচ্ছে কৃষিজমি হিসেবে।

শিবপুরের বাঘাব ইউনিয়নের কুন্দারপাড়া এলাকার মো. মকবুল হোসেন ভূইয়া বলেন, ‘আমরা তিন ভাই ও দুই বোন শিবপুর উপজেলার চৌপট মৌজায় ওয়ারিশসূত্রে ১৫ শতাংশ জমির মালিক। এর মধ্যে ০.০৬৩৩ শতাংশ জমি অধিগ্রহণ করা হয়। ওই জমিতে মুরগির খামারের দুটি শেড, গাছপালা ও মার্কেট নির্মাণের ভিত্তিস্থাপন অংশ অন্তর্ভুক্ত না করেই ৮ ধারায় নোটিশ করা হয়েছে। দালাল মারফত আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। ঘুষ দিতে রাজি না হওয়ায় এসব স্থাপনা অন্তর্ভুক্ত করেনি।’

একই এলাকার আরেকজন জমির মালিক ওবায়দুল সরকার বলেন, ‘চৌপট মৌজায় তাঁর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। নরসিংদী জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণ শাখার কানুনগো মোস্তফা কামাল জমিতে থাকা স্থাপনা, গাছপালা লিপিবদ্ধ করে নিয়ে যায়। পরে বিভিন্ন দালাল মারফত তিন লাখ টাকা দাবি করেন তিনি। টাকা না দেওয়ায় জমি ছাড়া আর কিছু তালিকাভুক্ত করা হয়নি। বর্তমানে জমির দাম থেকেও ২০ শতাংশ কমিশন দাবি করছেন তিনি। কমিশনের টাকা না দিলে জমির বিল পাব না বলে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে আমি বিভাগীয় কমিশনার বরাবর লিখিত অভিযোগ করেছি।’

বেলাব উপজেলার বারৈচা বাসস্ট্যান্ড এলাকার সওদাগর হোটেল অ্যান্ড মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের স্বত্বাধিকারী সিরাজুল ইসলাম সিরাজ বলেন, ‘ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে আমার ৭ শতাংশ জমি পড়েছে। ওই জায়গায় আমি পাঁচতলা ফাউন্ডেশন দিয়ে একটি বিল্ডিং করেছি। তিনতলা পর্যন্ত কাজ সম্পন্ন হয়েছে। কানুনগো মোস্তফা কামাল আমাকে বলেছেন, তাঁকে ২০ শতাংশ কমিশন দিলে জায়গা ও ভবনের ন্যায্যমূল্য দিয়ে দেবেন। কিন্তু তাঁর কথামতো কমিশন না দেওয়ায় আমার বিল অনেক কম করে পাস করেছেন। আমার ভবনের তথ্য ও ক্ষতিপূরণের অর্থ পাসই করেননি। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে আমার ভবন ও জায়গার বর্তমান মূল্য প্রায় তিন কোটি টাকা। অথচ পাস করা হয়েছে ৬৯ লাখ টাকা। ২০ শতাংশ হারে কমিশন দিলে তিন কোটি টাকার বিলই পাস করতেন। ন্যায্যমূল্য পেতে আমি উচ্চ আদালতে মামলা করেছি।’

বারৈচা বাজার বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক কবির হোসেন বলেন, ‘জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ শাখার কানুনগো মোস্তফা কামাল, সার্ভেয়ার মাহাবুব ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. নাঈম মিয়ার কথামতো কমিশন দিতে রাজি হলে অধিগ্রহণ করা এলাকায় পড়া জমি ও স্থাপনার দাম বেশি ধরা হয়। বাসস্ট্যান্ড এলাকায় স্বাভাবিকভাবেই জমি ও স্থাপনার দাম বেশি। অথচ তাঁরা গ্রামের জমি ও স্থাপনার যে হারে ক্ষতিপূরণের দাম দিচ্ছেন, বাসস্ট্যান্ড এলাকায়ও একই হারে দাম দিচ্ছেন। এ কারণে ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বারৈচা বাসস্ট্যান্ডের কয়েক শ ব্যবসায়ী।’

এসব অভিযোগের বিষয়ে ভূমি অধিগ্রহণ শাখার কানুনগো মোস্তফা কামাল বলেন, ‘দালালরা কাজ নিয়ে এলে কিছু হলেও তাদের কাজ করে দিতে হয়। আমার নিজেরও তো নিরাপত্তার বিষয় আছে। এই অফিসের ভেতরে আমি অফিসার, অফিসের বাইরে কিন্তু আমি অফিসার না।’