নড়াইলে কৃষি ব্যাংকের আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক (সহকারী মহাব্যবস্থাপক) প্রতাপ কুমার বিশ্বাস মামাতো ভাইয়ের নামে অস্তিত্বহীন ভুয়া প্রতিষ্ঠান দেখিয়ে ১০ লাখ টাকা ঋণ বিতরণ করেছেন। একই সঙ্গে তার বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ উঠেছে। এ ব্যাপারে মঙ্গলবার তার বিরুদ্ধে তদন্তপূর্বক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে মো. আলমগীর হোসেন নামের এক ভুক্তভোগী গ্রাহক ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং বাংলাদেশ ব্যাংক বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।
অভিযোগে বলা হয়েছে, আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় কুটির, মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (সিএমএসএমই) খাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার উপেক্ষা করে কৃষি ব্যাংকের নড়াইল আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক প্রতাপ কুমার বিশ্বাস আপন মামাতো ভাই শক্তিপদ বিশ্বাস ও তার স্ত্রী তন্দ্রা রায়কে অস্তিত্বহীন ‘বিশ্বাস ডেইরি ফার্র্মের’ স্বত্বাধিকারী সাজিয়ে ভুয়া ও জাল কাগজপত্র তৈরি করে ১০ লাখ টাকা ঋণ মঞ্জুর করেছেন। বাস্তবে ‘বিশ্বাস ডেইরি ফার্ম’ নামে কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারে বলা হয়েছে, প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় শুধু করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন-এমন সিএমএসএমই উদ্যোক্তা এ সুবিধার আওতাভুক্ত হবেন। ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানের নামে বিতরণ করা ঋণের ৯ শতাংশের ৪ শতাংশ ঋণগ্রহীতা এবং বাকি ৫ শতাংশ সরকার থেকে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ভর্তুকি হিসাবে পাবে। এ নিয়মনীতিকে উপেক্ষা করে আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক (আরএম) প্রতাপ কুমার বিশ্বাস আপনজনের নামে ভুয়া প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী সাজিয়ে ঋণ বিতরণ করলেন।
ঋণ মঞ্জুরিপত্রে দেখা যায়, জেলার সদর উপজেলার রায়খালী গ্রামে অবস্থিত কথিত ‘বিশ্বাস ডেইরি ফার্মের’ জন্য ঋণের আবেদন করেন তন্দ্রা রায় ও তার স্বামী শক্তিপদ বিশ্বাস। প্রকৃতপক্ষে তন্দ্রা রায় বল্লারটোপ আইডিয়াল কলেজের প্রভাষক এবং শক্তিপদ বিশ্বাস নড়াইল সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের গণিতের সিনিয়র শিক্ষক। ঋণগ্রহীতারা চাকরিজীবী হলেও তাদেরকে ভুয়া খামারি সাজানো হয়েছে। তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আরএম প্রতাপ কুমার বিশ্বাসের আর্থিক সর্বোচ্চ ক্ষমতার অপব্যবহার করে ২০২৩ সালের ৩০ মে মেসার্স বিশ্বাস ডেইরি ফার্মের অনুকূলে ১০ লাখ টাকা প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় সিএমএসএমই খাতে চলতি মূলধন ঋণ মঞ্জুর করা হয়। যার ঋণ হিসাব নং ২২০১-০১৩৪০০১৬৯৮। এ ঋণের মঞ্জুরিপত্রের ৯ নম্বর শর্ত মোতাবেক ঋণের টাকা দিয়ে দুগ্ধবতী গাভির খাদ্যসামগ্রী ক্রয় ও খামার পরিচালনার কাজে ব্যয় করতে হবে। কিন্তু ঋণগ্রহীতাদের কোনো খামারই নেই। অতীতেও ছিল না। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবহৃত ঠিকানায় সরেজমিন সেখানে এ ধরনের কোনো খামারের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি।
ব্যাংকের ঋণপত্রে প্রতিষ্ঠানটির যে নাম ও ঠিকানা উল্লেখ করা হয়েছে, সেখানে সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা যায়, এটি কথিত ঋণগ্রহীতাদের পৈতৃক বাড়ি হলেও ‘বিশ্বাস ডেইরি ফার্ম’ নামে কোনো খামার নেই। এ ঠিকানায় ঋণগ্রহীতা শক্তিপদ বিশ্বাসের বৃদ্ধ বাবা-মা বাস করেন। শক্তিপদ বিশ্বাসের বাবা সদানন্দ বিশ্বাস ও মাতা সুনিতী বিশ্বাস বলেন, ‘আমাদের কোনো ডেইরি ফার্ম নেই। অতীতেও ছিল না। প্রায় ১০ বছর আগে একটি মাত্র গরু পালন করতেন তারা। আরএম প্রতাপ কুমার বিশ্বাস তার আত্মীয়ের নামে ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে ঋণ নিয়ে নিজেই খরচ করেছেন বলে অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগী অভিযোগকারী।
অভিযোগপত্রে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, করোনার প্রভাবে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত নড়াইল আধুনিক সদর হাসপাতাল সড়কে অবস্থিত গ্রিন লাইফ ডায়াগনস্টিক সেন্টারের স্বত্বাধিকারী গৌরপদ তরফদার ও পল্লব কুমার ওরফে বাবলু তরফদার প্রণোদনার ঋণ পেতে ২০২৩ সালের ১৭ এপ্রিল আবেদন করেন। যার ঋণ কেস (এলসি) নং-৫৫। আরএম প্রতাপ কুমার বিশ্বাস এই প্রতিষ্ঠানটিকে ঋণ প্রদানে নানা ধরনের টালবাহানা করে তার (প্রতাপের) অনৈতিক দাবি পূরণ না হওয়ায় ছয় মাস আটকে রেখে ফাইলটি ফেরত দেন বলে অভিযোগ করা হয়েছে। জানা যায়, প্রতাপ কুমার বিশ্বাস কৃষি ব্যাংকের আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক হিসাবে যোগদানের পর থেকে অনৈতিক সুবিধা নিয়ে নামমাত্র প্রতিষ্ঠান দেখিয়ে ভুয়া কাগজপত্রে কয়েক কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছেন।
কথিত ‘বিশ্বাস ডেইরি ফার্মের’ স্বত্বাধিকারী শক্তিপদ বিশ্বাস বলেন, ‘আমি ঋণ নিয়েছিলাম ঠিক; কিন্তু সেটি পরিশোধ করে দিয়েছি।’ আরএম প্রতাপ কুমার বিশ্বাস তার নিকটাত্মীয় স্বীকার করলেও অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে কীভাবে ঋণ নেওয়া হয়েছে-এমন প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে যান তিনি।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে নড়াইল কৃষি ব্যাংকের আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক প্রতাপ কুমার বিশ্বাস বলেন, ‘যথাযথ নিয়ম মেনেই ঋণ প্রদান করা হয়েছে। এখানে আত্মীয়ের বিষয়টি প্রাধান্য দেওয়া হয়নি।’