আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ পাওয়ার মতো সম্পদ বেড়েছে পাসপোর্ট ও ইমিগ্রেশন অধিদপ্তরের পরিচালক মো. আব্দুল্লাহ আল মামুনের। একজন সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত অবস্থায় ৯টি ফ্ল্যাট ও দুটি প্লটের মালিক হয়েছেন। আইনগত বৈধতা নিতে কালো টাকা সাদাও করেছেন তিনি।
বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিকানার প্রমাণ পাওয়ায় ২০২২ সালের ২১ জুন মামলা দায়ের করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। প্রায় দুই বছর পেরিয়ে গেলেও তদন্ত কাজ শেষ করতে পারিনি দুদক। এ সুযোগে বহাল তবিয়তে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন মামুন।
অভিযোগ রয়েছে, দুদকের আসামি হওয়ার পর ভয় পাওয়ার পরিবর্তে আরও বেপরোয়া হয়েছেন তিনি। পাসপোর্ট অধিদপ্তরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দৈনিক আমাদের মাতৃভূমিকে বলেন, পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলার অভিযোগ রয়েছে, তা অনতিবিলম্বে আমলে নিয়ে কার্যকরী ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। তার বিরুদ্ধে একের পর এক দুর্নীতি, অনিয়ম ও শৃঙ্খলা ভঙ্গের গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। যা সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে।
তিনি বলেন, তার বিরুদ্ধে এমআরপি জমা ও বিতরণে অনিয়মের জন্য উচ্চ পর্যায়ের একটি তদন্ত কমিটি হয়েছিল। যেখানে তার বিরুদ্ধে এমআরপি আবেদন গ্রহণ ও বিতরণে প্রচুর অনিয়মের সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেলেও অদৃশ্য কারণে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
অন্যদিকে দুদকের তদন্ত প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দুদকের উপপরিচালক (জনসংযোগ) মো. আকতারুল ইসলাম দৈনিক আমাদের মাতৃভূমিকে বলেন, মামলা হলেও বিভিন্ন কারণে চার্জশিট দিতে দেরি হতে পারে। এ বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে এটুকু বলতে পারি দুদকের যেকোনো অনুসন্ধান কিংবা তদন্ত আইন ও বিধি অনুসরণ করে হয়ে থাকে। এ বিষয়ে কমিশনের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।
পাসপোর্ট ও ইমিগ্রেশন অধিদপ্তরের পরিচালক মো. আব্দুল্লাহ আল মামুনের মালিকানাধীন ১১ ফ্ল্যাট ও প্লটের মধ্যে রয়েছে– মোহাম্মদপুরের কাটাসুরে হলি হাসিনা নামের ৭ তলা ভবনে গ্যারেজসহ ১১০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট, নিউ এলিফ্যান্ট রোডের ২২৩ হোল্ডিংয়ের ৭ তলা ভবনে গ্যারেজসহ ১৩০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট, ধানমন্ডির নর্থ ভূতের গলির ৫০ নম্বর হোল্ডিংয়ে গ্যারেজসহ ৮৫০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট, হাজারিবাগ চরকঘাটার ৭নং রোডের সিকদার রিয়েল এস্টেটের ১৪০০ বর্গফুটের দুটি ফ্ল্যাট, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ৪ নম্বর রোডের এফ ব্লকে ৮০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট, মোহাম্মদপুরের চাঁদ হাউজিংয়ের বি ব্লকে ৭৬০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট, মোহাম্মদপুরের কাটাসুরে ৪৩/৩ এ ১১০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট, ধানমন্ডির ১১/৩ নম্বর রোডের ৭৭ নম্বরে নিজ ও স্ত্রীর যৌথ নামে ২২৫১ বর্গফুটের ফ্ল্যাট, রাজধানীর মোহাম্মদপুরে আউট প্ল্যানের ৮ নম্বর রোডে ১০৭ নম্বর প্লটের সিকদার রিয়েল এস্টেট লিমিটেডের অর্ধ কাঠা জমি এবং রাজধানীর কাফরুলের ইব্রাহিমপুর মৌজার ১৬ নম্বর ওয়ার্ডে ০.১৮৩ অযুতাংশ নাল জমি।
এর মধ্যে ২০০৬ সাল থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে ক্রয় করা কিছু জমিসহ ছয়টি ফ্ল্যাট ক্রয়বাবদ ২ কোটি ৫২ লাখ ৫০ হাজার টাকা ও নগদ ৫০ লাখ টাকা বিনিয়োগ দেখিয়ে ২০২০-২০২১ করবর্ষে আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪-এর ১৯ (এএএএএ) ধারায় বৈধ করেছেন।
জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ২০২২ সালের ২১ জুন আব্দুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। মামলা দায়ের করার পরপরই এসব বিষয়ে জানতে চাইলে পাসপোর্ট ও ইমিগ্রেশন অধিদপ্তরের পরিচালক (বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিস) মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন দৈনিক আমাদের মাতৃভূমিকে বলেন, দুদকের মামলা যেহেতু দায়ের হয়ে গেছে, আমি আইনিভাবেই বিষয়টি মোকাবিলা করব।
মামুনের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তির বিষয়ে এনবিআর ও দুদক সূত্রে যা জানা যায়
পাসপোর্ট ও ইমিগ্রেশন অধিদপ্তরের পরিচালক মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন ২০০৪ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে যে-সব স্থাবর সম্পত্তির মালিক হয়েছেন তার মধ্যে টাঙ্গাইলের গোপালপুরে ৪ শতাংশ কৃষি জমি ও ৫০ শতাংশ কৃষি ও বসতভিটা ছাড়া সব সম্পত্তির সরাসরি ক্রয়সূত্রে মালিক হয়েছেন। ক্রয় করা স্থাবর সম্পদের মধ্যে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে আউট প্ল্যানের ৮ নম্বর রোডে ১০৭ নম্বর প্লটের সিকদার রিয়েল এস্টেট লিমিটেডের অর্ধ কাঠা জমির মালিক হয়েছেন ২০০৫ সালে।
মোহাম্মদপুরের কাটাসুরে হলি হাসিনা নামের ৭ তলা ভবনে গ্যারেজসহ ১১০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট ক্রয় করেন ২০১২ সালে, নিউ এলিফ্যান্ট রোডের ২২৩ নম্বর হোল্ডিংয়ের ৭ তলা ভবনে গ্যারেজসহ ১৩০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাটের মালিক হন ২০০৬ সালে এবং ধানমন্ডির নর্থ ভূতের গলির ৫০ নম্বর হোল্ডিংয়ে গ্যারেজসহ ৮৫০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট ক্রয় করেন ২০০৯ সালে।
এছাড়া ২০০৬-০৭ সালে মালিক হন হাজারিবাগ চরকঘাটার ৭ নম্বর রোডের সিকদার রিয়েল এস্টেটের ১৪০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট। একই রিয়েল এস্টেটের ১৪০০ বর্গফুটের আরও একটি ফ্ল্যাট ২০০৯ সালে ক্রয় করেন। আর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ৪ নম্বর রোডের এফ ব্লকে ৮০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাটটি কেনেন ২০১০ সালে। মোহাম্মদপুরের চাঁদ হাউজিংয়ের বি ব্লকে ৭৬০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট ২০১০ সালে এবং ২০১১ সালে মোহাম্মদপুরের কাটাসুরে ৪৩/৩ এ ১১০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাটের মালিক হন ক্রয় সূত্রে।
অন্যদিকে ধানমন্ডির ১১/৩ নং রোডের ৭৭ নম্বরে নিজ ও স্ত্রীর যৌথ নামে ২২৫১ বর্গফুটের ফ্ল্যাটটি তারা কেনেন ২০১৮ সালে। এছাড়া রাজধানীর কাফরুলের ইব্রাহিমপুরের ১৬ নম্বর ওয়ার্ডে ০.১৮৩ অযুতাংশ নাল জমি নিজ নামে রেজিস্ট্রেশন করেছেন ২০০৯ সালে। আর ওই সকল সম্পত্তি তিনি ২০২০-২০২১ অর্থ বছরের আয়কর নথিতে ১৯ (এএএএএ) ধারায় ঘোষণা দিয়ে বৈধ করার চেষ্টা করেন।
অন্যদিকে মামুনের অস্থাবর সম্পত্তির বর্ণনায় রয়েছে– সাধারণ ভবিষ্যৎ তহবিলের (জিপিএফ) সুদসহ প্রায় ৪০ লাখ টাকা, ইসলামি ব্যাংকের বাংলাদেশের আগারগাঁও শাখার গচ্ছিত তিন হিসাবে ৭০ লাখ, ৭৫ লাখ ৩৬ হাজার ও ৮ লাখ ২৬ হাজার টাকা এবং আলিকো ইন্স্যুরেন্স বাবদ ৩ লাখ ৫৫ হাজার টাকাসহ ২ কোটি ৪৪ লাখ ৬৪ হাজার টাকা।
এজাহারে যা বলা হয়েছে
মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, ২০১৯ সালের ২৯ অক্টোবর আবদুল্লাহ আল মামুন দুদকে সম্পদ বিবরণী দাখিল করেন। দাখিল করা সম্পদের হিসাবে ২০০২-২০০৩ থেকে ২০২১-২০২২ করবর্ষ পর্যন্ত হিসাবের বর্ণনা দেওয়া রয়েছে। যেখানে তিনি ২ কোটি ৯২ লাখ ৭৬ হাজার ৫০০ টাকার স্থাবর সম্পত্তির বর্ণনা দিয়েছেন। আর অস্থাবর সম্পদ হলো ২ কোটি ৪৪ লাখ ৬৪ হাজার ৭৫০ টাকা। সবমিলিয়ে ১৮ বছরে তিনি মোট ৫ কোটি ৩৭ লাখ ৪১ হাজার ২৫৩ টাকার সম্পদের হিসাব জমা দিয়েছেন।
ওই সময়ে কর পরিশোধ ও পারিবারিক খরচ বাবদ ৫৪ লাখ ৭২ হাজার ৮৯৫ টাকা বাদ দিয়ে তার নিট আয় দেখিয়েছেন ৪ কোটি ৭৮ লাখ ৩৬ হাজার ১২৪ টাকা। ২০০৬ সাল থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে ক্রয় করা কিছু জমিসহ ৬টি ফ্ল্যাট ক্রয়বাবদ ২ কোটি ৫২ লাখ ৫০ হাজার টাকা এবং নগদ ৫০ লাখ টাকা বিনিয়োগ দেখিয়ে ২০২০-২০২১ করবর্ষে আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪-এর ১৯ (এএএএএ) ধারা অনুযায়ী বৈধ করেছেন। সেখানে তিনি ফ্ল্যাটে বর্গমিটার অনুযায়ী কর পরিশোধ করেছেন। সবমিলিয়ে ৩ কোটি ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা বৈধ করেছেন বলে জানা গেছে।
মামলার বিবরণ অনুসারে মামুনের মোট অর্জিত ৫ কোটি ৯২ লাখ ১৪ হাজার ১৪৮ টাকার সম্পদের বিপরীতে তার অর্জিত আয় পাওয়া যায় ২ কোটি ৩০ লাখ ৫৯ হাজার ১৯ টাকা। সেক্ষেত্রে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ কোটি ৬১ লাখ ৫৫ হাজার ১২৯ টাকা। অর্জিত অবৈধ সম্পদের মধ্যে ৩ কোটি ২ লাখ ৫০ হাজার টাকার সম্পদের তথ্য গোপন করেছেন বলে দুদক প্রমাণ পেয়েছে। যে কারণে সম্পদের তথ্য গোপনসহ আবদুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে ৩ কোটি ৬১ লাখ ৫৫ হাজার ১২৯ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়েছে মামলায়। সংস্থাটির তৎকালীন উপপরিচালক মো. ফরিদ আহমেদ পাটোয়ারী বাদী হয়ে দুদক আইন ২০০৪-এর ২৬ (২) ও ২৭ (১) ধারা এবং মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২-এর ৪ (২) ও ৪ (৩) ধারায় মামলা দায়ের করেছিলেন।