ঢাকা ১২:৫৩ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আশুলিয়া ছিল মৃত্যুর মিছিল, নিহত ৯০ ছাত্র জনতা পুলিশ আগুনে পুড়িয়ে ফেলে ৭ ছাত্রের লাশ নেতৃত্ব দেন থানার ওসি ও স্থানীয় এমপি

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন আশুলিয়া ছিল মৃত্যুর মিছিল, নিহত ৯০ ছাত্র জনতা পুলিশ আগুনে পুড়িয়ে ফেলে ৭ ছাত্রের লাশ
নেতৃত্ব দেন থানার ওসি ও স্থানীয় এমপি সাইফুল ইসলাম। সারাদেশের ন্যায় আশুলিয়া এলাকায় আশপাশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ছাত্ররা আন্দোলনে ঝাঁকে ঝাঁকে মিছিল নিয়ে রাজপথে নেমে পড়ে। তাদেরকে দমন করতে পুলিশ, আওয়ামী লীগের সকল অঙ্গ সংগঠন স্বশস্ত্র অবস্থায় ঝাঁপিয়ে পড়ে বৃষ্টির মতো গুলি করতে থাকে। হায়েনাদের গুলিতে রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে প্রায় শতাধিক লাশ। গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয় কয়েক শতাধিক। হামলায় অংশ নিয়ে আশুলিয়া থানার কয়েক জন এস আই ,ওসি এ এফ এম সায়েদের নির্দেশ ডায়রেক্ট গুলি করে। আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীরা ঘটনাস্থলে ঘট স্থলে বিদেশি অস্ত্র দিয়ে গুলি করে ছত্রভঙ্গ করে দেয় আন্দোলনকারীদের যা অকপটে বর্ণনা করেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।
নারকীয় তান্ডব চলে ৪ ঠা আগস্ট থেকে ৬ অগষ্ট পর্যন্ত। স্থানীয়দের বর্ণনা মতে ঘটনা বিস্তারিত বলেন,
৪ঠা আগস্ট সকাল ১০টা ২০ মিনিট। ছাত্র-জনতার মিছিলে মিছিলে প্রকম্পিত হয় আশুলিয়ার বাইপাইল বাসস্ট্যান্ড। বেপজা স্কুল অ্যান্ড কলেজ, গাজিরচট এএম হাই স্কুল, গাজিরচট আকবর মণ্ডল উচ্চবিদ্যালয় অ্যান্ড কলেজের প্রায় ৮ শতাধিক শিক্ষার্থী বাইপাইল বাসস্ট্যান্ডে অবস্থান নেন। পরে অলিগলি থেকে শত শত লোক এসে ছাত্রদের সঙ্গে যোগ দেন। শিক্ষার্থীরা ২০ মিনিট ধরে রাজপথ দখলে রাখেন। তবে সকাল ১০টা ৪৫ মিনিটের দিকে স্থানীয় এমপি সাইফুল ইসলামের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও শ্রমিক লীগের শত শত নেতাকর্মী বিপুল সংখ্যক আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায়। এতে মুহূর্তেই বাইপাইল বাসস্ট্যান্ড এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। ঘণ্টা ধরে দু’পক্ষের মধ্যে ধাওয়া- পাল্টা ধাওয়া চলে। এসময় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের নির্বিচার গুলিতে একের পর এক শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ হয়। গুলিবিদ্ধ হয়ে অনেকে রাস্তায় পড়ে থাকেন বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। বেলা ১০টা ৫০ মিনিটে ইয়ারপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সুমন ভুঁইয়ার নেতৃত্বে একটি মিছিল এসে ছাত্রদের ধাওয়া দেয়। ওই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় এক ফল বিক্রিতা মানবজমিনকে বলেন, চেয়ারম্যান সুমন ভুঁইয়া ৪ শতাধিক লোক নিয়ে এসে ছাত্রদের ধাওয়া দেন। এসময় সুমন ভুঁইয়ার দুই হাতে দুটি রাইফেল ছিল। তার বোনজামাই রুবেল আহমেদের হাতেও অস্ত্র ছিল। সে গুলি ছুড়তে ছুড়তে ছাত্রদের দিকে দৌড়াতে থাকে। সুমন ভুঁইয়ার সঙ্গে আসা নেতাদের প্রায় সবার হাতেই পিস্তল, শটগান ও বিদেশি নানা প্রকার অস্ত্র ছিল। তারা দুই ঘণ্টা ধরে বাইপাইল এলাকায় তাণ্ডব চালায়। আশুলিয়ায় এত অস্ত্র কীভাবে এলো, এখনো নিজে নিজেকে প্রশ্ন করছি। সেদিন বাইপাইল বাস স্ট্যান্ডের আশপাশে যত বিল্ডিং আছে সব বিল্ডিংয়ের ছাদ থেকে ছাত্রদের ওপর গুলি চালানো হয় বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান চোখের সামনে একের পর এক লাশ পড়তে দেখেছি। গুলি খেয়ে পড়ে যাওয়ার পরেও তারা পা দিয়ে পাড়িয়ে ধরে গুলি করেছে। এমন অমানুষ জীবনে দেখিনি। সেদিন বিকালে ছাত্রদের সঙ্গে আশপাশের গার্মেন্টের হাজার হাজার শ্রমিক যোগ দিলে অবস্থা আরও বেগতিক হয়। পুলিশ থানার গেইট থেকে বেরিয়ে এসে ধাওয়া করলে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও পুলিশের মাঝখানে পড়ে যান আন্দোলনকারীরা। তখন পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের গুলিতে শত শত মানুষ গুলিবিদ্ধ হোন। আশপাশের হাসপাতালে গুলিবিদ্ধ মানুষ আর মানুষে পরিপূর্ণ হয়ে যায়।
স্থানীয়রা জানান, ওইদিন সকাল থেকেই ছাত্রলীগ যুবলীগের নেতারা ছাত্রদের ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করেন। নেতারা সবাই গুলি ছুড়েছে। অস্ত্র ছিল না এমন কাউকে সেদিন দেখা যায়নি। নিজের ব্যবহৃত আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে গুলি চালান স্থানীয় সংসদ সদস্য সাইফুল ইসলামও। সে থানার পাশের ছয়তলা ভবন থেকে ৫ অগষ্ট থেকে শুরু করে ৬ অগষ্ট সকাল পর্যন্ত নিরলসভাবে গুলি করতে থাকে। ৬ তারিখ সকাল ১০ ঘটিকার সময় সেনাবাহিনী তাকে গ্ৰেফতার করে তাদের হেফাজতে নিয়ে যায় বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান। বাড়ির ছাদ থেকে ড্রোন উড়িয়ে ছাত্রদের অবস্থান শনাক্ত করে গুলি চালানো হয়। আশুলিয়ায় সেদিন প্রথম ড্রোন উড়াতে দেখেছি। আশুলিয়া যুবলীগের সভাপতি কবির সরকার, ছাত্রলীগ সভাপতি নাদিম হোসেন, ইউপি চেয়ারম্যান সুমন ভুঁইয়া, মঈনুল হোসেন ভুঁইয়া, গাউস, হাসান মণ্ডল, পান্নু, রিয়াদ, আব্দুল লতিফ মণ্ডল এরা সবাই নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে।

৫ তারিখে যা ঘটেছে:

৫ই আগস্ট সকালে বেপজা স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে একটি মিছিল এসে আশুলিয়া পুরাতন থানার সামনে জড়ো হয়। পরে আশপাশের স্কুল- কলেজের শিক্ষার্থীরাও যোগ দেন। বেলা ১১টার পরে কয়েকদফা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এতে ২১ জন শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ হোন। ১২টার দিকে বাইপাইল মহাসড়কে পুলিশের গুলিতে ৬ জন শিক্ষার্থী ঘটনাস্থলেই মারা যান। তাদের লাশ থানা রোডে মহাসড়কের পাশে পুলিশের পিকআপ ভ্যানে রাখা হয়। এই খবর ছড়িয়ে পড়লে আশপাশের হাজার হাজার গার্মেন্ট শ্রমিকরা রাস্তায় নেমে আসেন। পুলিশকে ধাওয়া করে থানা রোডে ঢুকিয়ে দেন। পুলিশও গুলি চালিয়ে পাল্টা ধাওয়া করে আন্দোলনকারীদের বাইপাইল ফুটওভার ব্রিজের নিচে নিয়ে আসেন। ওই স্থানে পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের প্রায় ঘণ্টা ধরে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলে। এখানে শতাধিক আন্দোলনকারী গুলিবিদ্ধি হয়। বেলা ১টা বেজে ৪৫ মিনিট। ছাত্র-জনতা জানতে পারেন শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন। দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। এই খবর ছড়িয়ে পড়লে আশপাশের এলাকা থেকে হাজার হাজার মানুষ বাইপাইল বাসস্ট্যান্ডে এসে জড়ো হয়। ২০ মিনিটে ওই এলাকা জনসমুদ্রে পরিণত হয়। অবস্থা বেগতিক দেখে আশুলিয়া থানার ওসি এ এফ এম সায়েদ আহমেদ সকল পুলিশ ফোর্স নিয়ে থানায় ঢুকে পড়েন। তখন হাজার হাজার মানুষ বিজয় মিছিল করতে থাকেন। বিজয় মিছিলে কিছু মানুষ আশপাশের দোকানপাট ভাঙচুর করেন। আওয়ামী লীগ নেতাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বাড়ি, গ্যারেজ, মার্কেটে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেন। সন্ধ্যা ৬টা ১০ মিনিটে আশুলিয়া পল্লী বিদ্যুৎ এলাকা থেকে একটি মিছিল বাইপাইল বেপজা স্কুলের গেইট পর্যন্ত যায়। মিছিলটি ফিরে বাইপাইল বাসস্ট্যান্ডে আসার পথে কয়েকশ’ মানুষ থানা রোডে ঢুকে পড়ে। পরে হাজার হাজার মানুষ থানার দিকে রওনা দেন। এতে পুলিশ সদস্যরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। থানার আশপাশে নিরাপত্তায় থাকা পুলিশ সদস্যরা দৌড়ে থানার ভেতর ঢুকে পড়েন। ঢুকেই তারা থানার গেইট বন্ধ করে দেন। তখন ৫ মিনিটের মধ্যে আন্দোলনকারীরা চারদিক থেকে থানা ঘিরে ফেলেন। থানা ভবনে ইটপাটকেল ছুড়তে থাকেন। কেউ কেউ গেইট ভাঙতে এগিয়ে যান। অবস্থা বেগতিক দেখে ওসি সাঈফ আহমেদ পুলিশ সদস্যদের অস্ত্র রেডি করতে বলেন। গুলি লোড করতে বলেন। এই কথা শুনে মানুষ আরও চড়াও হয়। ওই সময় থানা ভবন থেকে বেরিয়ে ৩০ থেকে ৩৫ জন পুলিশ এসে থানার গেইটে অবস্থান নেন। রাত ৭টা বেজে ১০ মিনিট। ওসি সাঈফ আহমেদ গেইটে এসে উত্তেজিত জনতাকে নিবৃত করার চেষ্টা করেন। তখন আন্দোলনকারীরা পুলিশকে উদ্দেশ্য করে ‘ভুয়া ভুয়া’ স্লোগান দিতে থাকেন। এক পর্যায়ে ওসি সবাইকে অস্ত্র হাতে নিয়ে রেডি হতে বলেন। তখন ঘটনাস্থলে থাকা জনগণের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। জনতা পুলিশকে আত্মসমর্পণ করতে বলেন। তখন ওসি সায়েদ আহমেদ আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ্য করে বলেন, আমরা হেরেছি। আপনারা জিতেছেন। আমাদের মাফ করে দেন। এবার সবাই বাড়ি ফিরে যান। এক পর্যায়ে এসআই মালেক, এসআই আরাফাত, এসআই আফজালুল, এসআই জলিল ছাত্র-জনতাকে উদ্দেশ্য করে গুলি ছোড়েন।

থানার পাশের বিল্ডিং থেকে পুরো ঘটনা স্বচক্ষে দেখা রনি আহমেদ নামের এক ব্যক্তি আমাদের প্রতিনিধিকে বলেন, রাত ৮টার দিকে থানা ফটকের সামনে উত্তেজিত জনতার ওপর পুলিশ গুলি ছোড়ে। এতে থানার গেইটের সামনেই ১০ থেকে ১২ জন গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে যান। কয়েক মিনিট ধরে ওখানে গোলাগুলি চলে। পরে জীবিত কয়েকজনকে নিচু হয়ে এসে ছাত্ররা টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যান। তারপরেও ৬ থেকে ৭ জন ওখানে পড়েছিল। তখন আশপাশের সব অলিগলি জনগণ ঘিরে ফেলে। রাস্তা থেকেও লোকজন থানার দিকে রওনা হয়। পরে থানা থেকে সব পুলিশ সশস্ত্র হয়ে একযোগে বেড়িয়ে আসেন। তারা গুলি করতে করতে বেড়িয়ে আসেন। প্রথমে গেইটে এসেই গুলিবিদ্ধ ৭ জনকে থানার পার্কিংয়ে থাকা পুলিশের একটি পিকআপ ভ্যানে তুলে আগুন দেয়া হয়। তাদের আগুনে পুড়িয়ে থানা থেকে সব পুলিশ বেরিয়ে গলি দিয়ে হাঁটতে শুরু করেন। আর গুলি ছুড়তে থাকেন।

আফজাল হোসেন নামের আরেক প্রত্যক্ষদর্শী আমাদেরকে বলেন, পুলিশ থানা থেকে বের হওয়ার সময় কারও কারও হাতে দুটি অস্ত্র ছিল। অনেকে সিভিল ড্রেসে ছিলেন। অনেকের হাতে অচেনা অস্ত্র দেখেছি। তারা গুলি করতে করতে বের হন। কখনো গুলি বন্ধ করেনি। মেইন রোডে এসে একটি পিকআপ ভ্যানে আগুন দেন। ওই পিকআপ ভ্যানেও ৪ থেকে ৫টি গুলিবিদ্ধ মরদেহ ছিল। বিকালে যারা গুলিতে মারা গেছে তাদের ওই ভ্যানেই রাখা হয়েছিল। তারা নির্বিচারে গুলি চালাচ্ছিল। গুলি কখনো বন্ধ করেনি। অলিগলিতে, রাস্তায়, বাসা বাড়িতে যেখানে খুশি সেখানেই গুলি করেছে পুলিশ। তারা দলবদ্ধ ছিল। ৮০ থেকে ৯০ জন হবে।

বাইপাইল বাসস্ট্যান্ডের অটোরিকশা চালক সুমন আমাদেরকে বলেন, পুলিশ থানা থেকে মেইন রোডে এসে ডাম বাম দু’পাশেই গুলি চালায়। রাস্তার দু’পাশে গুলি চালাতে চালাতে তারা নবীনগরের দিকে আগাতে থাকেন। তখন মানুষ জীবন বাঁচাতে যে যার মতো দৌড়ে পালিয়েছে। এক মিনিটের জন্যও পুলিশ গুলি বন্ধ করেনি। যতক্ষণ হেঁটেছে ততক্ষণই তারা গুলি ছুড়েছে। রাস্তার দু’পাশে পথচারী, বাসা বাড়ি ও দোকানপাটের শত শত মানুষ ওইদিন গুলিবিদ্ধ হয়। এমন দিন কখনো দেখেনি বাইপাইলবাসী। কয়েকজন পথচারী বলেন, পুলিশ থানা রোড থেকে গুলি করতে করতে সোহেল হাসপাতাল পর্যন্ত যায়। তখন গুলির শব্দ ছাড়া কিছুই শোনা যায়নি। চারদিকে মানুষের চিৎকার। বাঁচাও বাঁচাও। মনে হয়েছে যুদ্ধ লেগেছে। তখন মানুষ বাসা বাড়ি ছেড়ে পালাতে শুরু করেন। রাত তখন ৯টার বেশি বাজে। পুলিশ সামনের দিকে হেঁটে যাচ্ছিলেন। আর গুলি ছুড়ছিলেন। এভাবে তারা পল্লী বিদ্যুৎ পর্যন্ত চলে যায়। এই সময়ে শত শত মানুষ গুলি খেয়ে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখেছি।
একটি সূত্র মতে জানা যায় , পুলিশের নির্বিচারের গুলির খবর পেয়ে সেনাবাহিনীর একটি টহল টিম বাইপাইলের দিকে রওয়া হলে পল্লী বিদ্যুৎ পার হলে তারাও পুলিশের গুলির মুখে পড়েন। এতে দুই সেনাসদস্য গুলিবিদ্ধ হন। পরে সেনাবাহিনীর একাধিক টিম এসে পুলিশের সকল সদস্যকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। তাদের আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন। পরে কয়েক মিনিটের মধ্যেই পুলিশ সদস্যদের আটক করে নেন সেনাসদস্যরা। সবার অস্ত্র জব্দ করা হয়। এরপর শত শত মানুষ পুলিশকে ঘিরে ফেলেন। পুলিশের কাছে তাদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালানোর কারণ জানতে চান। তাদের জনগণই বিচার করবে বলে ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেন। এরপর সেনাবাহিনী তাদের নিরস্ত্র করে আটক করে সেনানিবাসে নিয়ে যান। রাত ১০টার দিকে নবীনগর সেনানিবাসের গেইটে হাজার হাজার মানুষ জড়ো হন। পরে সেনাসদস্যরা জনতাকে নিবৃত করার চেষ্টা করেন। তখন সেনাবাহিনীকে জনতার সামনে নানা জবাবদিহি করতে দেখা গেছে।

স্থানীয়রা জানান, পুলিশ গুলি করতে করতে থানা থেকে বের হওয়ার সময় আশুলিয়া প্রেস ক্লাবের পেছনে ডিএসবি’র এ এসআই রাজু আহমেদ ও একজন কনস্টেবল আন্দোলনকারীদের হাতে ধরা পড়ে যান। তখন রাত ৮টা বাজে। বিপুল সংখ্যক ছাত্র- জনতার গণপিটুনিতে ঘটনাস্থলেই ওই পুলিশ সদস্যরা মারা যান। প্রায় ঘণ্টা খানেক তাদের মৃতদেহ মহাসড়কে পড়ে থাকে। পরে রাত ১০টার দিকে আন্দোলনকারীরা নিহত দুই পুলিশ সদস্যের লাশ তুলে এনে বাইপাইল ফুটওয়ার ব্রিজের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখেন। পরে পরিবারের লোকজন এসে তাদের লাশ উদ্ধার করে নিয়ে যান।

নিহতের স্বজন ও হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ৫ই আগস্ট সকাল ৯টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত পুলিশ, ছাত্রলীগ, যুবলীগের গুলিতে অন্তত ৩১ জন নিহত হোন। পরদিন গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও ১৫ জন মারা যান। এতে ওই ঘটনায় মোট নিহতের সংখ্যা ৪৬ জন। এ ছাড়া গুলিবিদ্ধ হয়ে ধামরাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, আশুলিয়ার নারী ও শিশু হাসপাতাল, আশুলিয়ার হাবিব ক্লিনিক, গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক হাসপাতাল, এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সাভারের বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে চিকিৎসাধীন আছেন প্রায় দেড় হাজারের বেশি মানুষ।
শনিবার সরজমিন দেখা গেছে, আশুলিয়া এলাকায় সুনসান নীরবতা। রাস্তাঘাটে মানুষজন কম। শোকের ছায়ায় ঢেকে আছে আশুলিয়া। এখনো জনজীবন স্বাভাবিক হয়নি। চারদিকে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের চিহ্ন। রাস্তায় পুলিশের পুড়িয়ে দেয়া পিকআপ ভ্যান দুটি পড়ে আছে। বিভিন্ন জায়গায় ইটপাটকেল আগুনে পোড়া গাছের গুঁড়ি। শিক্ষার্থীরা পোড়া আবর্জনা পরিষ্কার করছেন। ট্রাফিক সিগন্যাল নিয়ন্ত্রণ করছেন। তবে কেউ ওই ঘটনার স্মূতিচারণ করতে চান না। থানায় গিয়ে দেখা গেছে, থানার প্রধান ফটক ভাঙা। থানার প্রতিটি ফ্লোরে শুধুই ধ্বংসস্তূপ। কিছুই নেই সব পুড়ে ছাই গেছে। ফাইলপত্র পুড়ে স্তূপ হয়ে পড়ে আছে। পোড়া বেশকিছু অস্ত্র থানার মধ্যেই পড়ে আছে। ৫ তলা ভবনের পুরোটাই পুড়ে ভস্মীভূত হয়ে গেছে। থানার গেইটে পোড়া পিকআপ ভ্যানটিও পড়ে আছে। আশপাশের দোকানপাট বন্ধ। কেউ এখনো দোকান খুলতে আসেনি। ওই এলাকায় কোনো লোকজনও দেখা যায়নি। পরবর্তীতে সোমবার অবশ্য থানার কার্যক্রম শুরু হয়। অনুসন্ধানে জানা যায়, পুরো ঘটনার নেতৃত্বে ছিলেন স্থানীয় এমপি সাইফুল ইসলাম, স্বনির্ভর ধামসোনা ইউনিয়নের আওয়ামী লীগ সভাপতি আব্দুল লতিফ মন্ডল, ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক আক্কাস আলী মন্ডল সহ আরো অনেকে। ভুক্তভোগীরা বলেন আন্দোলন চলাকালে প্রায় শতাধিক অচেনা মুখকে অস্ত্র হাতে দেখা গেছে তাদেরকে পুর্বে এই এলাকায় দেখা যায় নি। আবার কিছু সরকারী ষ্টিকার যুক্ত গাড়ি দেখা যায় যা থেকে বিভিন্ন অস্ত্র বের করে আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীদের হাতে তুলে দেয়া হয়। যা দিয়ে তারা নির্বাচারে গুলি করে মানুষ হত্যা করা হয়।

এই দুর্বিষহ ঘটনার তদন্তে বাংলাদেশ পরিবেশ পরিক্রমা মানবাধিকার সাংবাদিক সোসাইটির কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান এম এম তোহা নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি চৌকস প্রতিনিধি দল ২০ দিন যাবত তদন্ত করে যাচ্ছেন। তাদের কাছে অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য আছে যা শুনলে গা শিউরে ওঠে। মানুষ মেরে পুড়িয়ে ফেলার লোমহর্ষক ঘটনার সাথে জড়িত সকলকে আসামি করে আদালতে মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে মানবাধিকার সংগঠনটি।

Tag :

আপনার মতামত লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল ও অন্যান্য তথ্য সঞ্চয় করে রাখুন

জনপ্রিয় সংবাদ

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আশুলিয়া ছিল মৃত্যুর মিছিল, নিহত ৯০ ছাত্র জনতা পুলিশ আগুনে পুড়িয়ে ফেলে ৭ ছাত্রের লাশ নেতৃত্ব দেন থানার ওসি ও স্থানীয় এমপি

আপডেট সময় ০৫:২৩:১৩ অপরাহ্ন, রবিবার, ১ সেপ্টেম্বর ২০২৪

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন আশুলিয়া ছিল মৃত্যুর মিছিল, নিহত ৯০ ছাত্র জনতা পুলিশ আগুনে পুড়িয়ে ফেলে ৭ ছাত্রের লাশ
নেতৃত্ব দেন থানার ওসি ও স্থানীয় এমপি সাইফুল ইসলাম। সারাদেশের ন্যায় আশুলিয়া এলাকায় আশপাশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ছাত্ররা আন্দোলনে ঝাঁকে ঝাঁকে মিছিল নিয়ে রাজপথে নেমে পড়ে। তাদেরকে দমন করতে পুলিশ, আওয়ামী লীগের সকল অঙ্গ সংগঠন স্বশস্ত্র অবস্থায় ঝাঁপিয়ে পড়ে বৃষ্টির মতো গুলি করতে থাকে। হায়েনাদের গুলিতে রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে প্রায় শতাধিক লাশ। গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয় কয়েক শতাধিক। হামলায় অংশ নিয়ে আশুলিয়া থানার কয়েক জন এস আই ,ওসি এ এফ এম সায়েদের নির্দেশ ডায়রেক্ট গুলি করে। আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীরা ঘটনাস্থলে ঘট স্থলে বিদেশি অস্ত্র দিয়ে গুলি করে ছত্রভঙ্গ করে দেয় আন্দোলনকারীদের যা অকপটে বর্ণনা করেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।
নারকীয় তান্ডব চলে ৪ ঠা আগস্ট থেকে ৬ অগষ্ট পর্যন্ত। স্থানীয়দের বর্ণনা মতে ঘটনা বিস্তারিত বলেন,
৪ঠা আগস্ট সকাল ১০টা ২০ মিনিট। ছাত্র-জনতার মিছিলে মিছিলে প্রকম্পিত হয় আশুলিয়ার বাইপাইল বাসস্ট্যান্ড। বেপজা স্কুল অ্যান্ড কলেজ, গাজিরচট এএম হাই স্কুল, গাজিরচট আকবর মণ্ডল উচ্চবিদ্যালয় অ্যান্ড কলেজের প্রায় ৮ শতাধিক শিক্ষার্থী বাইপাইল বাসস্ট্যান্ডে অবস্থান নেন। পরে অলিগলি থেকে শত শত লোক এসে ছাত্রদের সঙ্গে যোগ দেন। শিক্ষার্থীরা ২০ মিনিট ধরে রাজপথ দখলে রাখেন। তবে সকাল ১০টা ৪৫ মিনিটের দিকে স্থানীয় এমপি সাইফুল ইসলামের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও শ্রমিক লীগের শত শত নেতাকর্মী বিপুল সংখ্যক আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায়। এতে মুহূর্তেই বাইপাইল বাসস্ট্যান্ড এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। ঘণ্টা ধরে দু’পক্ষের মধ্যে ধাওয়া- পাল্টা ধাওয়া চলে। এসময় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের নির্বিচার গুলিতে একের পর এক শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ হয়। গুলিবিদ্ধ হয়ে অনেকে রাস্তায় পড়ে থাকেন বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। বেলা ১০টা ৫০ মিনিটে ইয়ারপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সুমন ভুঁইয়ার নেতৃত্বে একটি মিছিল এসে ছাত্রদের ধাওয়া দেয়। ওই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় এক ফল বিক্রিতা মানবজমিনকে বলেন, চেয়ারম্যান সুমন ভুঁইয়া ৪ শতাধিক লোক নিয়ে এসে ছাত্রদের ধাওয়া দেন। এসময় সুমন ভুঁইয়ার দুই হাতে দুটি রাইফেল ছিল। তার বোনজামাই রুবেল আহমেদের হাতেও অস্ত্র ছিল। সে গুলি ছুড়তে ছুড়তে ছাত্রদের দিকে দৌড়াতে থাকে। সুমন ভুঁইয়ার সঙ্গে আসা নেতাদের প্রায় সবার হাতেই পিস্তল, শটগান ও বিদেশি নানা প্রকার অস্ত্র ছিল। তারা দুই ঘণ্টা ধরে বাইপাইল এলাকায় তাণ্ডব চালায়। আশুলিয়ায় এত অস্ত্র কীভাবে এলো, এখনো নিজে নিজেকে প্রশ্ন করছি। সেদিন বাইপাইল বাস স্ট্যান্ডের আশপাশে যত বিল্ডিং আছে সব বিল্ডিংয়ের ছাদ থেকে ছাত্রদের ওপর গুলি চালানো হয় বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান চোখের সামনে একের পর এক লাশ পড়তে দেখেছি। গুলি খেয়ে পড়ে যাওয়ার পরেও তারা পা দিয়ে পাড়িয়ে ধরে গুলি করেছে। এমন অমানুষ জীবনে দেখিনি। সেদিন বিকালে ছাত্রদের সঙ্গে আশপাশের গার্মেন্টের হাজার হাজার শ্রমিক যোগ দিলে অবস্থা আরও বেগতিক হয়। পুলিশ থানার গেইট থেকে বেরিয়ে এসে ধাওয়া করলে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও পুলিশের মাঝখানে পড়ে যান আন্দোলনকারীরা। তখন পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের গুলিতে শত শত মানুষ গুলিবিদ্ধ হোন। আশপাশের হাসপাতালে গুলিবিদ্ধ মানুষ আর মানুষে পরিপূর্ণ হয়ে যায়।
স্থানীয়রা জানান, ওইদিন সকাল থেকেই ছাত্রলীগ যুবলীগের নেতারা ছাত্রদের ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করেন। নেতারা সবাই গুলি ছুড়েছে। অস্ত্র ছিল না এমন কাউকে সেদিন দেখা যায়নি। নিজের ব্যবহৃত আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে গুলি চালান স্থানীয় সংসদ সদস্য সাইফুল ইসলামও। সে থানার পাশের ছয়তলা ভবন থেকে ৫ অগষ্ট থেকে শুরু করে ৬ অগষ্ট সকাল পর্যন্ত নিরলসভাবে গুলি করতে থাকে। ৬ তারিখ সকাল ১০ ঘটিকার সময় সেনাবাহিনী তাকে গ্ৰেফতার করে তাদের হেফাজতে নিয়ে যায় বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান। বাড়ির ছাদ থেকে ড্রোন উড়িয়ে ছাত্রদের অবস্থান শনাক্ত করে গুলি চালানো হয়। আশুলিয়ায় সেদিন প্রথম ড্রোন উড়াতে দেখেছি। আশুলিয়া যুবলীগের সভাপতি কবির সরকার, ছাত্রলীগ সভাপতি নাদিম হোসেন, ইউপি চেয়ারম্যান সুমন ভুঁইয়া, মঈনুল হোসেন ভুঁইয়া, গাউস, হাসান মণ্ডল, পান্নু, রিয়াদ, আব্দুল লতিফ মণ্ডল এরা সবাই নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে।

৫ তারিখে যা ঘটেছে:

৫ই আগস্ট সকালে বেপজা স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে একটি মিছিল এসে আশুলিয়া পুরাতন থানার সামনে জড়ো হয়। পরে আশপাশের স্কুল- কলেজের শিক্ষার্থীরাও যোগ দেন। বেলা ১১টার পরে কয়েকদফা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এতে ২১ জন শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ হোন। ১২টার দিকে বাইপাইল মহাসড়কে পুলিশের গুলিতে ৬ জন শিক্ষার্থী ঘটনাস্থলেই মারা যান। তাদের লাশ থানা রোডে মহাসড়কের পাশে পুলিশের পিকআপ ভ্যানে রাখা হয়। এই খবর ছড়িয়ে পড়লে আশপাশের হাজার হাজার গার্মেন্ট শ্রমিকরা রাস্তায় নেমে আসেন। পুলিশকে ধাওয়া করে থানা রোডে ঢুকিয়ে দেন। পুলিশও গুলি চালিয়ে পাল্টা ধাওয়া করে আন্দোলনকারীদের বাইপাইল ফুটওভার ব্রিজের নিচে নিয়ে আসেন। ওই স্থানে পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের প্রায় ঘণ্টা ধরে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলে। এখানে শতাধিক আন্দোলনকারী গুলিবিদ্ধি হয়। বেলা ১টা বেজে ৪৫ মিনিট। ছাত্র-জনতা জানতে পারেন শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন। দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। এই খবর ছড়িয়ে পড়লে আশপাশের এলাকা থেকে হাজার হাজার মানুষ বাইপাইল বাসস্ট্যান্ডে এসে জড়ো হয়। ২০ মিনিটে ওই এলাকা জনসমুদ্রে পরিণত হয়। অবস্থা বেগতিক দেখে আশুলিয়া থানার ওসি এ এফ এম সায়েদ আহমেদ সকল পুলিশ ফোর্স নিয়ে থানায় ঢুকে পড়েন। তখন হাজার হাজার মানুষ বিজয় মিছিল করতে থাকেন। বিজয় মিছিলে কিছু মানুষ আশপাশের দোকানপাট ভাঙচুর করেন। আওয়ামী লীগ নেতাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বাড়ি, গ্যারেজ, মার্কেটে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেন। সন্ধ্যা ৬টা ১০ মিনিটে আশুলিয়া পল্লী বিদ্যুৎ এলাকা থেকে একটি মিছিল বাইপাইল বেপজা স্কুলের গেইট পর্যন্ত যায়। মিছিলটি ফিরে বাইপাইল বাসস্ট্যান্ডে আসার পথে কয়েকশ’ মানুষ থানা রোডে ঢুকে পড়ে। পরে হাজার হাজার মানুষ থানার দিকে রওনা দেন। এতে পুলিশ সদস্যরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। থানার আশপাশে নিরাপত্তায় থাকা পুলিশ সদস্যরা দৌড়ে থানার ভেতর ঢুকে পড়েন। ঢুকেই তারা থানার গেইট বন্ধ করে দেন। তখন ৫ মিনিটের মধ্যে আন্দোলনকারীরা চারদিক থেকে থানা ঘিরে ফেলেন। থানা ভবনে ইটপাটকেল ছুড়তে থাকেন। কেউ কেউ গেইট ভাঙতে এগিয়ে যান। অবস্থা বেগতিক দেখে ওসি সাঈফ আহমেদ পুলিশ সদস্যদের অস্ত্র রেডি করতে বলেন। গুলি লোড করতে বলেন। এই কথা শুনে মানুষ আরও চড়াও হয়। ওই সময় থানা ভবন থেকে বেরিয়ে ৩০ থেকে ৩৫ জন পুলিশ এসে থানার গেইটে অবস্থান নেন। রাত ৭টা বেজে ১০ মিনিট। ওসি সাঈফ আহমেদ গেইটে এসে উত্তেজিত জনতাকে নিবৃত করার চেষ্টা করেন। তখন আন্দোলনকারীরা পুলিশকে উদ্দেশ্য করে ‘ভুয়া ভুয়া’ স্লোগান দিতে থাকেন। এক পর্যায়ে ওসি সবাইকে অস্ত্র হাতে নিয়ে রেডি হতে বলেন। তখন ঘটনাস্থলে থাকা জনগণের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। জনতা পুলিশকে আত্মসমর্পণ করতে বলেন। তখন ওসি সায়েদ আহমেদ আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ্য করে বলেন, আমরা হেরেছি। আপনারা জিতেছেন। আমাদের মাফ করে দেন। এবার সবাই বাড়ি ফিরে যান। এক পর্যায়ে এসআই মালেক, এসআই আরাফাত, এসআই আফজালুল, এসআই জলিল ছাত্র-জনতাকে উদ্দেশ্য করে গুলি ছোড়েন।

থানার পাশের বিল্ডিং থেকে পুরো ঘটনা স্বচক্ষে দেখা রনি আহমেদ নামের এক ব্যক্তি আমাদের প্রতিনিধিকে বলেন, রাত ৮টার দিকে থানা ফটকের সামনে উত্তেজিত জনতার ওপর পুলিশ গুলি ছোড়ে। এতে থানার গেইটের সামনেই ১০ থেকে ১২ জন গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে যান। কয়েক মিনিট ধরে ওখানে গোলাগুলি চলে। পরে জীবিত কয়েকজনকে নিচু হয়ে এসে ছাত্ররা টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যান। তারপরেও ৬ থেকে ৭ জন ওখানে পড়েছিল। তখন আশপাশের সব অলিগলি জনগণ ঘিরে ফেলে। রাস্তা থেকেও লোকজন থানার দিকে রওনা হয়। পরে থানা থেকে সব পুলিশ সশস্ত্র হয়ে একযোগে বেড়িয়ে আসেন। তারা গুলি করতে করতে বেড়িয়ে আসেন। প্রথমে গেইটে এসেই গুলিবিদ্ধ ৭ জনকে থানার পার্কিংয়ে থাকা পুলিশের একটি পিকআপ ভ্যানে তুলে আগুন দেয়া হয়। তাদের আগুনে পুড়িয়ে থানা থেকে সব পুলিশ বেরিয়ে গলি দিয়ে হাঁটতে শুরু করেন। আর গুলি ছুড়তে থাকেন।

আফজাল হোসেন নামের আরেক প্রত্যক্ষদর্শী আমাদেরকে বলেন, পুলিশ থানা থেকে বের হওয়ার সময় কারও কারও হাতে দুটি অস্ত্র ছিল। অনেকে সিভিল ড্রেসে ছিলেন। অনেকের হাতে অচেনা অস্ত্র দেখেছি। তারা গুলি করতে করতে বের হন। কখনো গুলি বন্ধ করেনি। মেইন রোডে এসে একটি পিকআপ ভ্যানে আগুন দেন। ওই পিকআপ ভ্যানেও ৪ থেকে ৫টি গুলিবিদ্ধ মরদেহ ছিল। বিকালে যারা গুলিতে মারা গেছে তাদের ওই ভ্যানেই রাখা হয়েছিল। তারা নির্বিচারে গুলি চালাচ্ছিল। গুলি কখনো বন্ধ করেনি। অলিগলিতে, রাস্তায়, বাসা বাড়িতে যেখানে খুশি সেখানেই গুলি করেছে পুলিশ। তারা দলবদ্ধ ছিল। ৮০ থেকে ৯০ জন হবে।

বাইপাইল বাসস্ট্যান্ডের অটোরিকশা চালক সুমন আমাদেরকে বলেন, পুলিশ থানা থেকে মেইন রোডে এসে ডাম বাম দু’পাশেই গুলি চালায়। রাস্তার দু’পাশে গুলি চালাতে চালাতে তারা নবীনগরের দিকে আগাতে থাকেন। তখন মানুষ জীবন বাঁচাতে যে যার মতো দৌড়ে পালিয়েছে। এক মিনিটের জন্যও পুলিশ গুলি বন্ধ করেনি। যতক্ষণ হেঁটেছে ততক্ষণই তারা গুলি ছুড়েছে। রাস্তার দু’পাশে পথচারী, বাসা বাড়ি ও দোকানপাটের শত শত মানুষ ওইদিন গুলিবিদ্ধ হয়। এমন দিন কখনো দেখেনি বাইপাইলবাসী। কয়েকজন পথচারী বলেন, পুলিশ থানা রোড থেকে গুলি করতে করতে সোহেল হাসপাতাল পর্যন্ত যায়। তখন গুলির শব্দ ছাড়া কিছুই শোনা যায়নি। চারদিকে মানুষের চিৎকার। বাঁচাও বাঁচাও। মনে হয়েছে যুদ্ধ লেগেছে। তখন মানুষ বাসা বাড়ি ছেড়ে পালাতে শুরু করেন। রাত তখন ৯টার বেশি বাজে। পুলিশ সামনের দিকে হেঁটে যাচ্ছিলেন। আর গুলি ছুড়ছিলেন। এভাবে তারা পল্লী বিদ্যুৎ পর্যন্ত চলে যায়। এই সময়ে শত শত মানুষ গুলি খেয়ে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখেছি।
একটি সূত্র মতে জানা যায় , পুলিশের নির্বিচারের গুলির খবর পেয়ে সেনাবাহিনীর একটি টহল টিম বাইপাইলের দিকে রওয়া হলে পল্লী বিদ্যুৎ পার হলে তারাও পুলিশের গুলির মুখে পড়েন। এতে দুই সেনাসদস্য গুলিবিদ্ধ হন। পরে সেনাবাহিনীর একাধিক টিম এসে পুলিশের সকল সদস্যকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। তাদের আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন। পরে কয়েক মিনিটের মধ্যেই পুলিশ সদস্যদের আটক করে নেন সেনাসদস্যরা। সবার অস্ত্র জব্দ করা হয়। এরপর শত শত মানুষ পুলিশকে ঘিরে ফেলেন। পুলিশের কাছে তাদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালানোর কারণ জানতে চান। তাদের জনগণই বিচার করবে বলে ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেন। এরপর সেনাবাহিনী তাদের নিরস্ত্র করে আটক করে সেনানিবাসে নিয়ে যান। রাত ১০টার দিকে নবীনগর সেনানিবাসের গেইটে হাজার হাজার মানুষ জড়ো হন। পরে সেনাসদস্যরা জনতাকে নিবৃত করার চেষ্টা করেন। তখন সেনাবাহিনীকে জনতার সামনে নানা জবাবদিহি করতে দেখা গেছে।

স্থানীয়রা জানান, পুলিশ গুলি করতে করতে থানা থেকে বের হওয়ার সময় আশুলিয়া প্রেস ক্লাবের পেছনে ডিএসবি’র এ এসআই রাজু আহমেদ ও একজন কনস্টেবল আন্দোলনকারীদের হাতে ধরা পড়ে যান। তখন রাত ৮টা বাজে। বিপুল সংখ্যক ছাত্র- জনতার গণপিটুনিতে ঘটনাস্থলেই ওই পুলিশ সদস্যরা মারা যান। প্রায় ঘণ্টা খানেক তাদের মৃতদেহ মহাসড়কে পড়ে থাকে। পরে রাত ১০টার দিকে আন্দোলনকারীরা নিহত দুই পুলিশ সদস্যের লাশ তুলে এনে বাইপাইল ফুটওয়ার ব্রিজের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখেন। পরে পরিবারের লোকজন এসে তাদের লাশ উদ্ধার করে নিয়ে যান।

নিহতের স্বজন ও হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ৫ই আগস্ট সকাল ৯টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত পুলিশ, ছাত্রলীগ, যুবলীগের গুলিতে অন্তত ৩১ জন নিহত হোন। পরদিন গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও ১৫ জন মারা যান। এতে ওই ঘটনায় মোট নিহতের সংখ্যা ৪৬ জন। এ ছাড়া গুলিবিদ্ধ হয়ে ধামরাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, আশুলিয়ার নারী ও শিশু হাসপাতাল, আশুলিয়ার হাবিব ক্লিনিক, গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক হাসপাতাল, এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সাভারের বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে চিকিৎসাধীন আছেন প্রায় দেড় হাজারের বেশি মানুষ।
শনিবার সরজমিন দেখা গেছে, আশুলিয়া এলাকায় সুনসান নীরবতা। রাস্তাঘাটে মানুষজন কম। শোকের ছায়ায় ঢেকে আছে আশুলিয়া। এখনো জনজীবন স্বাভাবিক হয়নি। চারদিকে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের চিহ্ন। রাস্তায় পুলিশের পুড়িয়ে দেয়া পিকআপ ভ্যান দুটি পড়ে আছে। বিভিন্ন জায়গায় ইটপাটকেল আগুনে পোড়া গাছের গুঁড়ি। শিক্ষার্থীরা পোড়া আবর্জনা পরিষ্কার করছেন। ট্রাফিক সিগন্যাল নিয়ন্ত্রণ করছেন। তবে কেউ ওই ঘটনার স্মূতিচারণ করতে চান না। থানায় গিয়ে দেখা গেছে, থানার প্রধান ফটক ভাঙা। থানার প্রতিটি ফ্লোরে শুধুই ধ্বংসস্তূপ। কিছুই নেই সব পুড়ে ছাই গেছে। ফাইলপত্র পুড়ে স্তূপ হয়ে পড়ে আছে। পোড়া বেশকিছু অস্ত্র থানার মধ্যেই পড়ে আছে। ৫ তলা ভবনের পুরোটাই পুড়ে ভস্মীভূত হয়ে গেছে। থানার গেইটে পোড়া পিকআপ ভ্যানটিও পড়ে আছে। আশপাশের দোকানপাট বন্ধ। কেউ এখনো দোকান খুলতে আসেনি। ওই এলাকায় কোনো লোকজনও দেখা যায়নি। পরবর্তীতে সোমবার অবশ্য থানার কার্যক্রম শুরু হয়। অনুসন্ধানে জানা যায়, পুরো ঘটনার নেতৃত্বে ছিলেন স্থানীয় এমপি সাইফুল ইসলাম, স্বনির্ভর ধামসোনা ইউনিয়নের আওয়ামী লীগ সভাপতি আব্দুল লতিফ মন্ডল, ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক আক্কাস আলী মন্ডল সহ আরো অনেকে। ভুক্তভোগীরা বলেন আন্দোলন চলাকালে প্রায় শতাধিক অচেনা মুখকে অস্ত্র হাতে দেখা গেছে তাদেরকে পুর্বে এই এলাকায় দেখা যায় নি। আবার কিছু সরকারী ষ্টিকার যুক্ত গাড়ি দেখা যায় যা থেকে বিভিন্ন অস্ত্র বের করে আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীদের হাতে তুলে দেয়া হয়। যা দিয়ে তারা নির্বাচারে গুলি করে মানুষ হত্যা করা হয়।

এই দুর্বিষহ ঘটনার তদন্তে বাংলাদেশ পরিবেশ পরিক্রমা মানবাধিকার সাংবাদিক সোসাইটির কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান এম এম তোহা নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি চৌকস প্রতিনিধি দল ২০ দিন যাবত তদন্ত করে যাচ্ছেন। তাদের কাছে অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য আছে যা শুনলে গা শিউরে ওঠে। মানুষ মেরে পুড়িয়ে ফেলার লোমহর্ষক ঘটনার সাথে জড়িত সকলকে আসামি করে আদালতে মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে মানবাধিকার সংগঠনটি।