কর রেয়াত সুবিধার পর এবার সরকারি সিকিউরিটিজ বা ট্রেজারি বন্ডের লেনদেনের ওপর সার্কিট ব্রেকার তুলে দেওয়ার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। বর্তমানে বন্ডের লেনদেনের ওপর ২ শতাংশ হারে সার্কিট ব্রেকার রয়েছে। বন্ড মার্কেটকে জনপ্রিয় করতে ব্যাংকারদের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিষয়টি নিয়ে চিন্তাভাবনা করছে।
সূত্র জানায়, দেশের বন্ড মার্কেটের আকার সেকেন্ডারি পুঁজিবাজারের আকারের অর্ধেকের বেশি। পরীক্ষামূলকভাবে এই বন্ড মার্কেটের লেনদেন শুরু হয় গত ১০ অক্টোবর। বন্ড মার্কেট চালুর পরদিন ১১ অক্টোবর দেশের দুই পুঁজিবাজার ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে লেনদেন হয়েছে কয়েকটি বন্ড। কিন্তু বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আগ্রহ কম থাকায় আর লেনদেন হচ্ছে না।
এমন পরিস্থিতি থেকে বের হতে এবং ট্রেজারি বন্ড জনপ্রিয় করতে ব্যাংকারদের নিয়ে বুধবার (১৯ অক্টোবর) বিশেষ বৈঠক করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি। বৈঠকে বন্ড লেনদেন বাড়াতে সার্কিট ব্রেকার তুলে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন ব্যাংকাররা। তারা বলেন, সরকারি ট্রেজারি বন্ডের লেনদেনে ২ শতাংশ সার্কিট ব্রেকার রয়েছে। এই সীমা থাকায় বন্ড বিক্রিতে আগ্রহী নয় ব্যাংক। তাই সার্কিট ব্রেকার বাতিল করতে হবে।
নাম না প্রকাশ শর্তে একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) বৈঠকের বিষয়ে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ট্রেজারি বন্ড লেনদেনে বিনিয়োগকারীদের সচেতনতা বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছি। আমরা টেজারি বন্ড মার্কেট জনপ্রিয় করতে বন্ডের ওপর লেনদেনের কমিশন তুলে দেওয়ার দাবি জানিয়েছি। কারণ বন্ড লেনদেনে এখন প্রতি ১০০ টাকায় শূন্য দশমিক ১০ পয়সা কমিশন দিতে হয়। যা বাংলাদেশ ব্যাংকের এমআই মডিউলে ফ্রি অব কস্টে লেনদেন হয়।
এছাড়া সব ট্রেজারিকে লিস্টেড না করে, ভালো রিটার্ন দেবে এমন সিকিউরিটিজকে তালিকাভুক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছি। এগুলো বাস্তবায়ন হলে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা বন্ড মার্কেটে বিনিয়োগে আগ্রহী হবেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএসইসির কমিশনার ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান অধ্যাপক শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ট্রেজারি বন্ড লেনদেনকে আরও প্রাণবন্ত করতে চাই। সেজন্য কী প্রয়োজন এসব বিষয় নিয়ে ব্যাংকারদের সঙ্গে আলোচনা করেছি। তারা বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেছেন, আমরা তাদেরকে আশ্বস্ত করেছি, বন্ড মার্কেটকে ভাইব্রেন্ট করতে সার্কিট ব্রেকার তুলে দেওয়াসহ যা যা করা দরকার, নিয়ন্ত্রক সংস্থা সবই করবে।
বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ট্রেজারি বন্ডের লেনদেনের সমস্যাসহ পারপিচুয়াল বন্ড তালিকাভুক্ত ও সাবস্ক্রিপশনের সমস্যা নিয়ে আলোচনা হয়েছে সভায়। ব্যাংকের হাতে থাকা বন্ড বিও আইডিতে স্থানান্তর করে পুঁজিবাজারে যোগান নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। ব্যাংকাররা সার্কিট ব্রেকার তুলে দেওয়ার বিষয়ে দাবি জানিয়েছেন।
কমিশন সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে, বন্ড মার্কেট ও পুঁজিবাজার উন্নয়নে ব্যাংকের আরও বিনিয়োগ বাড়ানোর অনুরোধ জানানো হয়েছে বলেও জানান তিনি।
গত ১০ অক্টোবর ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) প্রথমবারের মতো ২৫০টি সরকারি সিকিউরিটিজ বা ট্রেজারি বন্ডের লেনদেন শুরু হয়েছে। যার বাজার মূলধন ৩ লাখ ১৬ হাজার ৮০৮ কোটি টাকা। আর চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) চালু হয়েছে ২৫৩টি বন্ডের লেনদেন।
লেনদেন চালু হওয়ার পর ডিএসইতে দুটি বন্ডের লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে ৭৯ টাকা ৯২ পয়সা দরে একটি ট্রেজারি বন্ডের ১০ হাজার ইউনিট লেনদেন হয়েছে। টাকার অংকে লেনদেন হয়েছে ৭ লাখ ৯৯ হাজার ২০০ টাকা। ১৫ বছর মেয়াদি এই ট্রেজারি বন্ডের মেয়াদ শেষ হবে ২০৩৬ সালের ২৮ জুলাই।
লেনদেন হওয়া অপর বন্ডের মেয়াদ ৫ বছর। বন্ডটির মেয়াদ শেষ হবে ২০২৫ সালের ১৫ জানুয়ারি। ১০৫ টাকা ১৯ পয়সা দরে এই বন্ডটির এক হাজার ইউনিট লেনদেন হয়েছে। টাকার অংকে যার পরিমাণ এক লাখ ৫ হাজার ১৯০ টাকা।
অপরদিকে সিএসইতে ১১ অক্টোবর প্রথম এক হাওলায় ১০০০ বন্ড ১০৫ টাকা ১৯ পয়সা করে মোট ১ লাখ ৫ হাজার ৫৯০ টাকা লেনদেন হয়েছে। TB5Y0125 নামক বন্ডটি ৫ বছর মেয়াদি।
ট্রেজারি বন্ড কী, বিনিয়োগকারীরা কী পাবেন
ট্রেজারি বন্ড হলো সরকারি বিল বা বন্ড, যা একটি দীর্ঘমেয়াদি ঋণ। যার মেয়াদ ন্যূনতম দুই বছর থেকে ২০ বছর। এই বন্ডের মাধ্যমে সরকার পুঁজিবাজার থেকে অর্থ উত্তোলন করে। এখানে বিনিয়োগ করলে টাকা হারানোর কোনো ঝুঁকি থাকবে না। বরং বছরে ৭ থেকে ৯ শতাংশ সুদ বা মুনাফা পাবেন বিনিয়োগকারীরা। পাশাপাশি পাবেন কর রেয়াত।
অর্থাৎ সঞ্চয়পত্র ও ব্যাংকের আমানতের মতোই ফিক্সড ডিপোজিট হিসেবে বন্ডে বিনিয়োগ করলে কোনো ঝুঁকি ছাড়াই মুনাফা পাবেন বিনিয়োগকারীরা।
এতদিন এই বন্ড বিনিয়োগকারীরা কেনা-বেচা করতে পারতেন না পুঁজিবাজারে। শুধু বাংলাদেশ ব্যাংকে কেনা-বেচা হতো। জনপ্রিয়তাও ছিল না। বন্ড মার্কেটে যাতে সব বিনিয়োগকারী অংশগ্রহণ করতে পারেন সেই লক্ষ্যে পুঁজিবাজারে এর লেনদেন শুরু হয়েছে।
কারা কীভাবে বিনিয়োগ করতে পারবেন
‘এ’ ক্যাটাগরিতে থাকা ট্রেজারি বন্ডে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি সাধারণ বিনিয়োগকারীরাও ব্রোকার হাউজের মাধ্যমে লেনদেন করতে পারছেন। সেজন্য নতুন করে কোনো বিও অ্যাকাউন্ট খুলতে হচ্ছে না। তবে বিনিয়োগকারীদের ন্যূনতম ১ লাখ টাকা বিনিয়োগ করতে হবে। কারণ বন্ডের ইউনিটের ফেসভ্যালু হবে ১০০ টাকা। সরকারি টেজারি বন্ডগুলোর মেয়াদ হবে যথাক্রম ২ বছর, ৫ বছর, ১০ বছর, ১৫ বছর এবং ২০ বছর।