ঢাকা ০৪:১৯ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

হাসিনার ‘বিদ্বেষমূলক বক্তব্য’ কীভাবে ও কিসের ভিত্তিতে নির্ধারণ হবে?

বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘বিদ্বেষমূলক বক্তব্য’ প্রচারে নিষেধাজ্ঞা এবং সেগুলো সরানোর জন্য আদালত যে নির্দেশ দিয়েছে তা বাস্তবে কার্যকর করা কঠিন হবে বলে মনে করছেন সিনিয়র আইনজীবীরা। একইসাথে এটি গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপরেও প্রভাব ফেলবে বলে মন্তব্য করছেন তারা।

বৃহস্পতিবার শেখ হাসিনার সব ধরনের ‘বিদ্বেষমূলক বক্তব্য’ গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারে নিষেধাজ্ঞা দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। একইসঙ্গে, শেখ হাসিনা আগে যত বিদ্বেষমূলক বক্তব্য দিয়েছেন তা সব মাধ্যম থেকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সরাতে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনকে (বিটিআরসি) নির্দেশ দিয়েছে আদালত।

প্রসিকিউশনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন বিচারপতির ট্রাইব্যুনাল এ আদেশ দেন।

প্রশ্ন আসছে ‘বিদ্বেষমূলক বক্তব্য’ কিভাবে নির্ধারণ করা হবে? আইনজীবীদের দৃষ্টিতে এটি নির্ধারণ করা ও এই নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়ন করা কঠিন।

কীভাবে নির্ধারিত হবে?

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশনের মতে, গত কয়েকদিন ধরে সামাজিক যোগোযোগ মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকারকে নিয়ে ভারতে অবস্থানরত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নানা কটূক্তিমূলক বক্তব্য ছড়িয়ে পড়ছে।

ওই সমস্ত হেট স্পিচ তথা বিদ্বেষমূলক বক্তব্য বন্ধেই তারা দেশি-বিদেশি তিনটি ‘রেফারেন্সের ভিত্তিতে’ ওই আবেদন করেছে এবং আদালতও সেইসব রেফারেন্সকে আমলে নিয়ে ওই আদেশ দিয়েছে।

সেগুলো হল: সংবিধানের আর্টিকেল ৩৯, ইন্ট্যারন্যাশনাল কভেন্যান্ট অন সিভিল এ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটস (আইসিসিপিআর) এবং রাবাত প্রিন্সিপ্যাল।

আইসিসিপিআর অনুযায়ী, জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া যেতে পারে।

আর রাবাত প্রিন্সিপ্যালে ছয়টি বিষয় আছে, যেগুলোর আওতায় শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক সময়ে দেওয়া বক্তব্য ‘বিদ্বেষমূলক’ হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা যায়, বলছিলেন প্রসিকিউটর আব্দুল্লাহ আল নোমান।

কারও মত প্রকাশের স্বাধীনতা যাতে খর্ব না হয়, তাই কোনো বিবৃতিকে ফৌজদারি অপরাধ হিসাবে বিবেচনা করার জন্য যেগুলোকে বিবেচনায় রাখার কথা বলা হয়েছে রাবাত প্রিন্সিপ্যালে, তা হল– প্রেক্ষাপট, বক্তা, উদ্দেশ্য, বিষয়বস্তু ও ধরন, প্রদত্ত বক্তব্যের বিস্তার এবং সম্ভাব্যতা ও আসন্নতা।

প্রসিকিউশনের ব্যাখ্যা হল, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেহেতু প্রভাবশালী একজন ব্যক্তিত্ব, তাই তার যে কোনো নেতিবাচক বক্তব্যে মানুষ নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত হতে পারে। এবং তিনি যেহেতু অনেকগুলো গণহত্যার মামলার আসামি, তাই তার আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক বক্তব্য মামলার তদন্তে বাধা তৈরি করতে পারে বলেই আবেদন করা হয়েছিলো।

কোন কথা ‘বিদ্বেষমূলক’?

গত ৫ আগস্ট ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর বিভিন্ন সময়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার কিছু ফোনালাপ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল। যদিও সেগুলো সত্যিই তার কথোপকথন কি না, তা স্বাধীনভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি। তবে সেই রেকর্ডগুলোতে তার দলের নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে নানা ধরনের রাজনৈতিক নির্দেশনা দিতে শোনা গেছে তাকে।

সেগুলোতে তাকে বলতে শোনা গিয়েছিল যে তিনি যেকোনো মুহূর্তে ভারত থেকে দেশে চলে আসবেন, কিংবা তিনি তার নেতাকর্মীদেরকে নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ছবি সামনে রেখে মিছিল করতে নির্দেশনা দিচ্ছেন।

সে বিষয়গুলোকে নির্দেশ করে প্রসিকিউটর নোমান ব্যাখ্যা করেন, ‘যেহেতু এখন শেখ হাসিনার বিচার চলছে, সাধারণ মানুষ এসে তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিবে; কিন্তু যখন সে ‘চট করে দেশে ঢুকে যাব’ বা ‘২০০ জনকে মারার লাইসেন্স পেয়ে গেছি, লিস্ট করো’ বলে, তখন তো সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিতে ভয় পেয়ে যাবে।’

‘চট করে দেশে ঢুকে যাওয়া মানে দেশে একটা অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করে, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটিয়ে ঢোকা। বিমানবন্দর দিয়ে ঢুকে যাওয়া নয়,’ বলেন তিনি।

তার মতে, শেখ হাসিনার ওইসব বক্তব্যের উদ্দেশ্য ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করা না’। বরং, ‘উনি খুন করে চলে গেছেন। আরও খুন করতে উনি দেশে আসতে চান…তার আলোচ্যসূচি ছিল ঘৃনাসূচক।’

‘ওনারা নিষিদ্ধ দল না। উনি দল গোছাতে বলতে পারে। তা তো বলে না। বলছে, লিস্ট করো। বাড়িঘর পুড়িয়ে দাও। এখানে এই কথাগুলো কে বলছেন, সেটি গুরুত্বপুর্ণ।’

কথা প্রসঙ্গে প্রসিকিউটর আব্দুল্লাহ আল নোমানকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, শেখ হাসিনা যদি বক্তব্য দিতে গিয়ে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে স্বৈরাচার বলেন, তা কি বিদ্বেষমূলক বক্তব্য হিসাবে গণ্য হবে?

উত্তরে প্রসিকিউটর নোমান বলেন, ‘প্রফেসর ইউনূসকে স্বৈরাচার বলাও একটি বিদ্বেষমূলক বক্তৃতা।’

‘হাসিনাকে স্বৈরাচার বললে তা বিদ্বেষমূলক বক্তৃতা না। শেখ হাসিনা যে একজন ফ্যাসিস্ট এবং তা এ্যাডমিটেড। এরশাদ স্বৈরাচার, এটাও এ্যাডমিটেড। কিন্তু ড. ইউনূস তো স্বৈরাচার হতে পারেন না।’

‘যে জিনিস বলবে, তার পাবলিক অ্যাকসেপ্টিবিলিটি থাকতে হবে। ধরেন, সে ইউনূস সরকারকে বিনা ভোটে আসা সরকার বলতে পারে। তাকে কন্সট্রাক্টিভ শব্দ ব্যবহার করতে হবে। তা রেখে যদি বলে স্বৈরাচার ইউনূসকে হটাতে হবে, তাহলে তা বিদ্বেষমূলক বক্তৃতা,’ বলেন তিনি।

এ প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, ‘আমার তো মনে হতে পারে, সে (মুহাম্মদ ইউনূস) স্বৈরাচার, আপনার মনে হল যে না। এখন, আপনার মনে হয় নি বলে আমি তাকে বলতে পারবো না?।’

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদও বলেন, ‘খালেদা জিয়াকেও শেখ হাসিনা স্বৈরাচার বলেছে। বক্তব্য প্রত্যেকের আলাদা হতেই পারে।’

‘বিদ্বেষমূলক বক্তব্য’ চিহ্নিত করায় জটিলতা

আইন এবং যুক্তি এক অর্থে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গেলেও বাস্তবতার নিরিখে এগুলোকে সংজ্ঞায়িত করে নিষেধাজ্ঞার আওতায় ফেলা শুধু কঠিন না, প্রায় অসম্ভব। সেইসাথে, এই ধরনের সিদ্ধান্ত যে কোনও সময়েই বাকস্বাধীনতার পরিপন্থী, বিবিসি বাংলাকে এমনটাই জানান একাধিক আইন বিশেষজ্ঞ।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, ‘এখানে বিদ্বেষমূলক বক্তব্য বলতে কী বোঝাচ্ছে, সেটির ব্যাখ্যা থাকলে বিটিআরসি’র পক্ষে এই আদেশ তামিল করা সহজতর হতো।’

এখানে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) কথা আসছে, কারণ গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বেলায় এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করার দায়িত্ব তাদের।

প্রসিকউটর নোমান বলেন, আদালতের অর্ডার তিনিটি অথরিটির কাছে যাবে। বিটিআরসি বাদে বাকি দুইটি হল তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়।

কিন্তু বাংলাদেশের গণমাধ্যমে রাষ্ট্রের ভূমিকা থাকলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নিয়ন্ত্রণ স্ব স্ব প্রতিষ্ঠানের অধীনে, সেখানে বাংলাদেশের তেমন কোনো ভূমিকা নেই।

এক্ষেত্রে সেখানে এই নিষেধাজ্ঞা কীভাবে আরোপ করা হবে? জবাবে আবদুল্লাহ আল নোমান বলেন, ‘আমরা আদালতের লিখিত আদেশ পেলে ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটারের পলিসি ডিপার্টমেন্টকে চিঠি লিখে জানাবো যে বাংলাদেশের কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ডের সাথে সাংঘর্ষিক কিছু বক্তব্য দিয়ে দেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেশের আইন শৃঙ্খলার পরিস্থিতি অবনতি করে দিচ্ছে।’

‘এগুলোকে আপনারা ডোমেইন থেকে রিমুভ করে দেন। তাদেরকে (সোশ্যাল মিডিয়া) আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না, অনুরোধ করতে পারি,’ তিনি যোগ করেন।

তবে গণমাধ্যমের বেলায় কী করা হবে? অনুরোধ নাকি নিয়ন্ত্রণ? উত্তরে তিনি বলেন, ‘গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করার অধিকার আমাদের নাই। আদালত তাদেরকে বলবে, অনুরোধ করবে।’

যদিও এ বিষয়ে শাহদীন মালিকের বক্তব্য, ‘আপনি যে ব্যাখ্যাই দেন না কেন…কে কী বলতে পারবে আর কী পারবে না, ওইখানে যাওয়াটাই বাকস্বাধীনতার পরিপন্থী…এগুলো গণমাধ্যমকে কোণঠাসা করার প্রক্রিয়া। কী ছাপানো যাবে, কী যাবে না, বললে তো এর কোনও শেষ নাই।’

যে কারণে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করা মুশকিল

আইনজীবী শাহদীন মালিকের মতে, কোনো আইনের অধীনেই বিদ্বেষমূলক বক্তব্যকে ‘সংজ্ঞায়িত করা সম্ভব না। অত্যন্ত দুস্কর। তাই, এটি কার্যকর হওয়ার কথা না।’

এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদেরও একই বক্তব্য।

তিনি বলেন, ‘রাজনীতিতে বিরুদ্ধ দলের প্রতি বিদ্বেষমূলক বক্তব্য দিতেই হয়। এছাড়া রাজনীতি চলে না। সেখানে সুনির্দিষ্টভাবে বিদ্বেষমূলক বক্তব্য খুঁজে বের করা কঠিন।’

এসময় তারা দু’জনই সর্বশেষ মার্কিন নির্বাচনের প্রচার প্রচারণার কথা উল্লেখ করেছেন। ‘বাইডেনকেও বলেছে, তার মস্তিষ্ক বিকৃত হয়েছে। সে প্রেসিডেন্ট পদে থাকতে পারে না,’ বলেন মনজিল মোরশেদ।

তাই, ‘এই নিষেধাজ্ঞা খুব একটা কার্যকর হবে বলে মনে হয় না। আমাদের যা ক্ষতি হল, কোর্টের ওপর বন্দুক রেখে কাজগুলো করানোর মাধ্যমে কোর্টের ভাবমূর্তি কিছুটা ক্ষুণ্ণ হল।’

এই ধরনের আলোচনায় স্বভাবতই বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ‘সকল ধরনের’ বক্তব্য-বিবৃতি গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে প্রচার ও প্রকাশে হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার বিষয়টি সামনে চলে আসে।

সেই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করা যায়নি উল্লেখ করে মোরশেদ বলেন, ‘সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে তারেক জিয়ার কথার প্রচারের নিষেধাজ্ঞার কার্যকারিতা ছিল না। মানুষ তার বক্তব্য শুনেছে।’

শাহদীন মালিকের মতে, তারেক রহমানের বক্তব্যে নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি কার্যকর করা যায়নি। তবে সেটি চাইলে হয়তো কিছুটা করা যেত। কারণ ওইসময় ‘কোনোকিছুই প্রচার করা সম্ভব না’ বলেছে।

‘সেটি টেকটিক্যালি কার্যকর করা সহজ। কিন্তু বিদ্বেষমূলক বক্তব্য কার্যকর করা প্রায় অসম্ভব।’

তবে বাংলাদেশের মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন, যিনি গুম পরিস্থিতির একজন পর্যবেক্ষকও, বলেন, ‘যে বক্তব্য মানুষের প্রতি বিদ্বেষ ছড়ায়, অপরকে ক্ষতিসাধন করতে পারে বা এক ধরনের অরাজক পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে; শুধু শেখ হাসিনা না, যে কারও এই ধরনের বক্তব্যের ক্ষেত্রে অনেক সতর্ক হওয়া দরকার। কারণ, একটি অস্থির সংকটকাল আমরা অতিক্রম করছি।’

সাম্প্রতিককালে শেখ হাসিনার যে ধরনের বক্তব্য শোনা যাচ্ছে, সেগুলো অস্থিরতা তৈরির জন্য যথেষ্ট এবং সমাজে সম্প্রদায়গতভাবে হানাহানি তৈরি হবে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, সমাজে বিদ্বেষ ছড়ায়, কোনো অবস্থাতেই তেমন কোনো বক্তব্য রাজনীতিকদের দেওয়া ঠিক না।

তবে তিনি এও মনে করিয়ে দেন, শেখ হাসিনার বিদ্বেষপূর্ণ বক্তব্য ঠেকাতে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া যথাযথ হলেও ‘এটার মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার অধিকার যেন লঙ্ঘিত না হয়।’

Tag :

আপনার মতামত লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল ও অন্যান্য তথ্য সঞ্চয় করে রাখুন

জনপ্রিয় সংবাদ

হাসিনার ‘বিদ্বেষমূলক বক্তব্য’ কীভাবে ও কিসের ভিত্তিতে নির্ধারণ হবে?

আপডেট সময় ০১:৩৯:১৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ৭ ডিসেম্বর ২০২৪

বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘বিদ্বেষমূলক বক্তব্য’ প্রচারে নিষেধাজ্ঞা এবং সেগুলো সরানোর জন্য আদালত যে নির্দেশ দিয়েছে তা বাস্তবে কার্যকর করা কঠিন হবে বলে মনে করছেন সিনিয়র আইনজীবীরা। একইসাথে এটি গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপরেও প্রভাব ফেলবে বলে মন্তব্য করছেন তারা।

বৃহস্পতিবার শেখ হাসিনার সব ধরনের ‘বিদ্বেষমূলক বক্তব্য’ গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারে নিষেধাজ্ঞা দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। একইসঙ্গে, শেখ হাসিনা আগে যত বিদ্বেষমূলক বক্তব্য দিয়েছেন তা সব মাধ্যম থেকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সরাতে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনকে (বিটিআরসি) নির্দেশ দিয়েছে আদালত।

প্রসিকিউশনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন বিচারপতির ট্রাইব্যুনাল এ আদেশ দেন।

প্রশ্ন আসছে ‘বিদ্বেষমূলক বক্তব্য’ কিভাবে নির্ধারণ করা হবে? আইনজীবীদের দৃষ্টিতে এটি নির্ধারণ করা ও এই নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়ন করা কঠিন।

কীভাবে নির্ধারিত হবে?

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশনের মতে, গত কয়েকদিন ধরে সামাজিক যোগোযোগ মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকারকে নিয়ে ভারতে অবস্থানরত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নানা কটূক্তিমূলক বক্তব্য ছড়িয়ে পড়ছে।

ওই সমস্ত হেট স্পিচ তথা বিদ্বেষমূলক বক্তব্য বন্ধেই তারা দেশি-বিদেশি তিনটি ‘রেফারেন্সের ভিত্তিতে’ ওই আবেদন করেছে এবং আদালতও সেইসব রেফারেন্সকে আমলে নিয়ে ওই আদেশ দিয়েছে।

সেগুলো হল: সংবিধানের আর্টিকেল ৩৯, ইন্ট্যারন্যাশনাল কভেন্যান্ট অন সিভিল এ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটস (আইসিসিপিআর) এবং রাবাত প্রিন্সিপ্যাল।

আইসিসিপিআর অনুযায়ী, জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া যেতে পারে।

আর রাবাত প্রিন্সিপ্যালে ছয়টি বিষয় আছে, যেগুলোর আওতায় শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক সময়ে দেওয়া বক্তব্য ‘বিদ্বেষমূলক’ হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা যায়, বলছিলেন প্রসিকিউটর আব্দুল্লাহ আল নোমান।

কারও মত প্রকাশের স্বাধীনতা যাতে খর্ব না হয়, তাই কোনো বিবৃতিকে ফৌজদারি অপরাধ হিসাবে বিবেচনা করার জন্য যেগুলোকে বিবেচনায় রাখার কথা বলা হয়েছে রাবাত প্রিন্সিপ্যালে, তা হল– প্রেক্ষাপট, বক্তা, উদ্দেশ্য, বিষয়বস্তু ও ধরন, প্রদত্ত বক্তব্যের বিস্তার এবং সম্ভাব্যতা ও আসন্নতা।

প্রসিকিউশনের ব্যাখ্যা হল, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেহেতু প্রভাবশালী একজন ব্যক্তিত্ব, তাই তার যে কোনো নেতিবাচক বক্তব্যে মানুষ নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত হতে পারে। এবং তিনি যেহেতু অনেকগুলো গণহত্যার মামলার আসামি, তাই তার আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক বক্তব্য মামলার তদন্তে বাধা তৈরি করতে পারে বলেই আবেদন করা হয়েছিলো।

কোন কথা ‘বিদ্বেষমূলক’?

গত ৫ আগস্ট ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর বিভিন্ন সময়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার কিছু ফোনালাপ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল। যদিও সেগুলো সত্যিই তার কথোপকথন কি না, তা স্বাধীনভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি। তবে সেই রেকর্ডগুলোতে তার দলের নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে নানা ধরনের রাজনৈতিক নির্দেশনা দিতে শোনা গেছে তাকে।

সেগুলোতে তাকে বলতে শোনা গিয়েছিল যে তিনি যেকোনো মুহূর্তে ভারত থেকে দেশে চলে আসবেন, কিংবা তিনি তার নেতাকর্মীদেরকে নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ছবি সামনে রেখে মিছিল করতে নির্দেশনা দিচ্ছেন।

সে বিষয়গুলোকে নির্দেশ করে প্রসিকিউটর নোমান ব্যাখ্যা করেন, ‘যেহেতু এখন শেখ হাসিনার বিচার চলছে, সাধারণ মানুষ এসে তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিবে; কিন্তু যখন সে ‘চট করে দেশে ঢুকে যাব’ বা ‘২০০ জনকে মারার লাইসেন্স পেয়ে গেছি, লিস্ট করো’ বলে, তখন তো সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিতে ভয় পেয়ে যাবে।’

‘চট করে দেশে ঢুকে যাওয়া মানে দেশে একটা অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করে, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটিয়ে ঢোকা। বিমানবন্দর দিয়ে ঢুকে যাওয়া নয়,’ বলেন তিনি।

তার মতে, শেখ হাসিনার ওইসব বক্তব্যের উদ্দেশ্য ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করা না’। বরং, ‘উনি খুন করে চলে গেছেন। আরও খুন করতে উনি দেশে আসতে চান…তার আলোচ্যসূচি ছিল ঘৃনাসূচক।’

‘ওনারা নিষিদ্ধ দল না। উনি দল গোছাতে বলতে পারে। তা তো বলে না। বলছে, লিস্ট করো। বাড়িঘর পুড়িয়ে দাও। এখানে এই কথাগুলো কে বলছেন, সেটি গুরুত্বপুর্ণ।’

কথা প্রসঙ্গে প্রসিকিউটর আব্দুল্লাহ আল নোমানকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, শেখ হাসিনা যদি বক্তব্য দিতে গিয়ে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে স্বৈরাচার বলেন, তা কি বিদ্বেষমূলক বক্তব্য হিসাবে গণ্য হবে?

উত্তরে প্রসিকিউটর নোমান বলেন, ‘প্রফেসর ইউনূসকে স্বৈরাচার বলাও একটি বিদ্বেষমূলক বক্তৃতা।’

‘হাসিনাকে স্বৈরাচার বললে তা বিদ্বেষমূলক বক্তৃতা না। শেখ হাসিনা যে একজন ফ্যাসিস্ট এবং তা এ্যাডমিটেড। এরশাদ স্বৈরাচার, এটাও এ্যাডমিটেড। কিন্তু ড. ইউনূস তো স্বৈরাচার হতে পারেন না।’

‘যে জিনিস বলবে, তার পাবলিক অ্যাকসেপ্টিবিলিটি থাকতে হবে। ধরেন, সে ইউনূস সরকারকে বিনা ভোটে আসা সরকার বলতে পারে। তাকে কন্সট্রাক্টিভ শব্দ ব্যবহার করতে হবে। তা রেখে যদি বলে স্বৈরাচার ইউনূসকে হটাতে হবে, তাহলে তা বিদ্বেষমূলক বক্তৃতা,’ বলেন তিনি।

এ প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, ‘আমার তো মনে হতে পারে, সে (মুহাম্মদ ইউনূস) স্বৈরাচার, আপনার মনে হল যে না। এখন, আপনার মনে হয় নি বলে আমি তাকে বলতে পারবো না?।’

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদও বলেন, ‘খালেদা জিয়াকেও শেখ হাসিনা স্বৈরাচার বলেছে। বক্তব্য প্রত্যেকের আলাদা হতেই পারে।’

‘বিদ্বেষমূলক বক্তব্য’ চিহ্নিত করায় জটিলতা

আইন এবং যুক্তি এক অর্থে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গেলেও বাস্তবতার নিরিখে এগুলোকে সংজ্ঞায়িত করে নিষেধাজ্ঞার আওতায় ফেলা শুধু কঠিন না, প্রায় অসম্ভব। সেইসাথে, এই ধরনের সিদ্ধান্ত যে কোনও সময়েই বাকস্বাধীনতার পরিপন্থী, বিবিসি বাংলাকে এমনটাই জানান একাধিক আইন বিশেষজ্ঞ।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, ‘এখানে বিদ্বেষমূলক বক্তব্য বলতে কী বোঝাচ্ছে, সেটির ব্যাখ্যা থাকলে বিটিআরসি’র পক্ষে এই আদেশ তামিল করা সহজতর হতো।’

এখানে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) কথা আসছে, কারণ গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বেলায় এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করার দায়িত্ব তাদের।

প্রসিকউটর নোমান বলেন, আদালতের অর্ডার তিনিটি অথরিটির কাছে যাবে। বিটিআরসি বাদে বাকি দুইটি হল তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়।

কিন্তু বাংলাদেশের গণমাধ্যমে রাষ্ট্রের ভূমিকা থাকলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নিয়ন্ত্রণ স্ব স্ব প্রতিষ্ঠানের অধীনে, সেখানে বাংলাদেশের তেমন কোনো ভূমিকা নেই।

এক্ষেত্রে সেখানে এই নিষেধাজ্ঞা কীভাবে আরোপ করা হবে? জবাবে আবদুল্লাহ আল নোমান বলেন, ‘আমরা আদালতের লিখিত আদেশ পেলে ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটারের পলিসি ডিপার্টমেন্টকে চিঠি লিখে জানাবো যে বাংলাদেশের কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ডের সাথে সাংঘর্ষিক কিছু বক্তব্য দিয়ে দেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেশের আইন শৃঙ্খলার পরিস্থিতি অবনতি করে দিচ্ছে।’

‘এগুলোকে আপনারা ডোমেইন থেকে রিমুভ করে দেন। তাদেরকে (সোশ্যাল মিডিয়া) আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না, অনুরোধ করতে পারি,’ তিনি যোগ করেন।

তবে গণমাধ্যমের বেলায় কী করা হবে? অনুরোধ নাকি নিয়ন্ত্রণ? উত্তরে তিনি বলেন, ‘গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করার অধিকার আমাদের নাই। আদালত তাদেরকে বলবে, অনুরোধ করবে।’

যদিও এ বিষয়ে শাহদীন মালিকের বক্তব্য, ‘আপনি যে ব্যাখ্যাই দেন না কেন…কে কী বলতে পারবে আর কী পারবে না, ওইখানে যাওয়াটাই বাকস্বাধীনতার পরিপন্থী…এগুলো গণমাধ্যমকে কোণঠাসা করার প্রক্রিয়া। কী ছাপানো যাবে, কী যাবে না, বললে তো এর কোনও শেষ নাই।’

যে কারণে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করা মুশকিল

আইনজীবী শাহদীন মালিকের মতে, কোনো আইনের অধীনেই বিদ্বেষমূলক বক্তব্যকে ‘সংজ্ঞায়িত করা সম্ভব না। অত্যন্ত দুস্কর। তাই, এটি কার্যকর হওয়ার কথা না।’

এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদেরও একই বক্তব্য।

তিনি বলেন, ‘রাজনীতিতে বিরুদ্ধ দলের প্রতি বিদ্বেষমূলক বক্তব্য দিতেই হয়। এছাড়া রাজনীতি চলে না। সেখানে সুনির্দিষ্টভাবে বিদ্বেষমূলক বক্তব্য খুঁজে বের করা কঠিন।’

এসময় তারা দু’জনই সর্বশেষ মার্কিন নির্বাচনের প্রচার প্রচারণার কথা উল্লেখ করেছেন। ‘বাইডেনকেও বলেছে, তার মস্তিষ্ক বিকৃত হয়েছে। সে প্রেসিডেন্ট পদে থাকতে পারে না,’ বলেন মনজিল মোরশেদ।

তাই, ‘এই নিষেধাজ্ঞা খুব একটা কার্যকর হবে বলে মনে হয় না। আমাদের যা ক্ষতি হল, কোর্টের ওপর বন্দুক রেখে কাজগুলো করানোর মাধ্যমে কোর্টের ভাবমূর্তি কিছুটা ক্ষুণ্ণ হল।’

এই ধরনের আলোচনায় স্বভাবতই বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ‘সকল ধরনের’ বক্তব্য-বিবৃতি গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে প্রচার ও প্রকাশে হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার বিষয়টি সামনে চলে আসে।

সেই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করা যায়নি উল্লেখ করে মোরশেদ বলেন, ‘সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে তারেক জিয়ার কথার প্রচারের নিষেধাজ্ঞার কার্যকারিতা ছিল না। মানুষ তার বক্তব্য শুনেছে।’

শাহদীন মালিকের মতে, তারেক রহমানের বক্তব্যে নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি কার্যকর করা যায়নি। তবে সেটি চাইলে হয়তো কিছুটা করা যেত। কারণ ওইসময় ‘কোনোকিছুই প্রচার করা সম্ভব না’ বলেছে।

‘সেটি টেকটিক্যালি কার্যকর করা সহজ। কিন্তু বিদ্বেষমূলক বক্তব্য কার্যকর করা প্রায় অসম্ভব।’

তবে বাংলাদেশের মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন, যিনি গুম পরিস্থিতির একজন পর্যবেক্ষকও, বলেন, ‘যে বক্তব্য মানুষের প্রতি বিদ্বেষ ছড়ায়, অপরকে ক্ষতিসাধন করতে পারে বা এক ধরনের অরাজক পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে; শুধু শেখ হাসিনা না, যে কারও এই ধরনের বক্তব্যের ক্ষেত্রে অনেক সতর্ক হওয়া দরকার। কারণ, একটি অস্থির সংকটকাল আমরা অতিক্রম করছি।’

সাম্প্রতিককালে শেখ হাসিনার যে ধরনের বক্তব্য শোনা যাচ্ছে, সেগুলো অস্থিরতা তৈরির জন্য যথেষ্ট এবং সমাজে সম্প্রদায়গতভাবে হানাহানি তৈরি হবে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, সমাজে বিদ্বেষ ছড়ায়, কোনো অবস্থাতেই তেমন কোনো বক্তব্য রাজনীতিকদের দেওয়া ঠিক না।

তবে তিনি এও মনে করিয়ে দেন, শেখ হাসিনার বিদ্বেষপূর্ণ বক্তব্য ঠেকাতে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া যথাযথ হলেও ‘এটার মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার অধিকার যেন লঙ্ঘিত না হয়।’