‘ব্রাজিলের কালোমানিক’ পেলেকে নিয়ে চতুর্থ বা পঞ্চম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকে একটি প্রবন্ধ ছিল। কালো যুবক পেলে ঝকঝকে সাদা দাঁতে হাসছেন আর হাতে তার বিশ্বকাপ—এমন একটি ছবি মলিন নিউজপ্রিন্টের পাঠ্যপুস্তকের পাতা ভেদ করে লাখ লাখ শিশুর অন্তর যে ভেদ করতো সেই বিষয়ে তেমন সন্দেহ নেই।
বোধ করি সেই প্রবন্ধই বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষকে ‘হলুদ-সবুজ’ জার্সিকে ভালোবাসতে শিখিয়েছে। আমিও জেনে গেলাম ‘ব্রাজিল’-এর নাম, আর ব্রাজিলকে ভালোবেসে ফেললাম। কিন্তু তাই বলে ফুটবল কতটুকু বুঝি? তাতে ভৌগোলিকভাবে পৃথিবীর এমন একজন অঞ্চলের নারী হয়ে, যেখানে নারীরা মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হওয়ার কয়েক বছর পর থেকেই খেলাধুলা যাদের জন্য একরকম নিষিদ্ধ হয়ে যায়?
এতকিছুর পরও ‘প্রেম একবারই এসেছিল নীরবে’র মতো ‘ফুটবল জ্বর’ও আমার জীবনে একবার এসেছিল নীরবে। তা আমার ‘বালিকা হৃদয়ে’ ঝড় তোলে। সাপ্তাহিক ‘সচিত্র সন্ধানী’-র কাভার পেজে জাতীয় ফুটবল লীগে ১৯৮২ সালে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব আবাহনী ক্রীড়াচক্র হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় ও সালাম ২৭টি গোল দিয়ে সেরা গোলদাতা হন।
কাজেই পুরো পরিবার আবাহনীর ভক্ত হলেও আমি মোহামেডানের সমর্থক বনে গেলাম, সালামের ভক্ত হলাম আর সেই ১৯৮২ সালেই বিশ্বকাপ ফুটবলে সেবার জিতলো পাওলো রসি (Paolo Rossi)-এর ইতালি।
খেলা বুঝি না তবে ব্রাজিল হেরে যাওয়ায় দুঃখ পাই। সেই ছিল আমার প্রথম বিশ্বকাপ! ব্রাজিলের হেরে যাওয়ায় দুঃখ পেলেও রাজপুত্রের মতো দেখতে পাওলো রসি আর ইতালীয় দলের খেলোয়াড়দের চেহারা সেই বয়সেই মন টেনেছিল।
বরিশালে আমাদের বাসার চতুর্দিকে হলুদ-সবুজ ব্রাজিলের পতাকা বাতাসে পতপত করলেও ম্যারাডোনা নামে এক ছোটখাট যুবকের নাম তখন বাতাসে ভাসছে…
১৯৮৬-র বিশ্বকাপে আমি ব্রাজিল সমর্থক আর আমার চার বছরের বড় বোন শুধুই মিশেল প্লাতিনি (Michel Platini)-এর জন্য ফ্রান্স সমর্থক। বরিশালে আমাদের বাসার চতুর্দিকে হলুদ-সবুজ ব্রাজিলের পতাকা বাতাসে পতপত করলেও ম্যারাডোনা নামে এক ছোটখাট যুবকের নাম তখন বাতাসে ভাসছে।
ইংল্যান্ডের সাথে খেলায় প্রতিপক্ষের সব খেলোয়াড় একাই বলতে গেলে পাস কাটিয়ে বিপক্ষের জালে সেই অসামান্য গোল! আরে থাকুক না হয় ‘ঈশ্বরের হাত’—মাইকেল মধুসূদন দত্তও তো ‘পৃথিবী’কে ‘প্রথিবী’ লিখতেন।
মার্কেজেরও বানান ভুল ছিল। লিখে দেখান না একটা ‘মেঘনাথবধ’ কাব্য বা ‘শতবর্ষের নির্জনতা?’ একটু পারলে দৌড়ান ম্যারাডোনার মতো! তবু তখনো ব্রাজিলের জিকো (Zico) আর সক্রেটিস (Sócrates)-এর জন্য হৃদয়ে কোমলতা বিদ্যমান।
যে রাতে ‘হোয়াইট পেলে’ জিকোর পেনাল্টি মিস হয়ে ফ্রান্স জিতলো, সারা রাত কাঁদতে কাঁদতে টনসিল ফুলে গেল। ফ্রান্সের ওপর রেগে জার্মানির সমর্থক হলাম। তবে শেষমেশ বিশ্বকাপ পেল আর্জেন্টিনা। এমনটাই আমার কপাল!
লেখাটা লিখতে রাজি হওয়াই উচিত হয়নি। কারণ? আমি যে দলই সমর্থন করি, সেই দলই হারে। বিস্তারিত লিখলে পাঠক লজ্জা তো পাবেনই। সমব্যথী পাঠকও কেউ কেউ আমার দুঃখে, কান্নাতে ভেঙে পড়তে পারেন।
এরপর এলো দামামা বাজাতে বাজাতে নব্বইয়ের বিশ্বকাপ। ইতিমধ্যে ১৯৮২ ও ১৯৮৬-এর দুটো বিশ্বকাপেই জার্মানরা রানার্স-আপ হওয়ায় এই সুশৃঙ্খল দলের প্রায় যন্ত্রের মতো নিখুঁত সামর্থ্যে খেলাও চোখ জুড়িয়ে দিচ্ছিল। তা নব্বইয়ের বিশ্বকাপ কঠিন সঙ্কটে ফেলে দিল আমাকে।
একদিকে অধিনায়ক লোথার ম্যাথিউস (Lothar Matthäus) ও কোচ ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার (Franz Beckenbauer)-এর জার্মানি আর অন্যদিকে নব্বইয়ের বিশ্বকাপে সব কিশোরী-তরুণীর ক্রাশ রবার্তো ব্যাজ্জিও (Roberto Baggio)-এর ইতালি।
কর্নার, পেনাল্টি, ফ্রি-কিক, ফাউল, লাল ও হলুদ কার্ড ছাড়া কত যেন আমি ফুটবল বুঝি! ইতালি-জার্মানি-জার্মানি-ইতালি করতে করতে ইতালিকেই সমর্থন দিলাম এবং যথারীতি জার্মানরা জিতলো। ততদিনে আমি ল্যাটিন আমেরিকান ফুটবলের বদলে ইউরোপিয়ান ফুটবলের ভক্ত হয়ে উঠেছি!
‘ছোট ছোট পাসে ল্যাটিন ফুটবলাররা নান্দনিক ফুটবল খেলেন’ শুনতে শুনতে ও পড়তে পড়তে আমি ততদিনে তিতি-বিরক্ত হয়ে উঠছি গোলপোস্টের সামনে ব্রাজিলিয়দের টানা ব্যর্থতায়। দরকার ‘ধর তক্তা, মার পেরেক’ মার্কা ইউরোপিয়ান ফুটবল দল।
দরিদ্র ল্যাটিন আমেরিকার উচ্চতায় তুলনামূলক ছোটখাট খেলোয়াড় নয়, জার্মান দলের মতো দীর্ঘকায় ও অত্যন্ত সবল দৌড়বিদদের ‘পাওয়ার ফুটবল’ই ভালো।
পৃথিবীতে বাঙালিই বোধ করি একমাত্র বিচিত্র জাতি যারা, নিজের দেশ থেকে বহু দূরে ও পৃথিবীর অন্য গোলার্ধের দুই দেশের ফুটবল নিয়ে হাতাহাতি-মারামারি, ঝগড়া-বিবাদ করে…
নবচিন্তায় দীক্ষিত আমি ১৯৯৪-এ বাজি রাখলাম সুরিনামী বংশোদ্ভূত রুড গুলিট (Ruud Gullit)-এর নেদারল্যান্ডসের উপর। রুড গুলিটের লম্বা বেনীগুলো পছন্দ হলো আমার—মানে হ্যাঁ ফুটবল তো আসলে তত বুঝি না! কাজেই খেলোয়াড়দের দেখে আকর্ষক মনে হচ্ছে কি না সেই ভিত্তিতে দল সমর্থন করতাম—হ্যাঁ, ধর্মাবতার—‘যাহা বলিবো সত্য বলিব, সত্য বলিব বই মিথ্যা বলিব না, কোনোকিছু গোপন করিব না।’ কিন্তু আমাকে বিপুল শোকের সাগরে ভাসিয়ে ডাচরা সেবার জিতলো না এবং জিতলো কি না ব্রাজিল! সেই যদি তুই জিতবি, তবে কয়েক বছর আগেই জিততি!
আমার অবস্থা হলো যেন সেই প্রেমিকার মতো যে বহুদিন প্রেমিকের জন্য অপেক্ষা করার পর অস্থির হয়ে যেই না অন্যত্র বিয়ে করেছে, অমনি পুরোনো প্রেমিক কোথা থেকে সিনেমার শেষ মুহূর্তে এসে হাজির!
নেড়া বেলতলায় ক’বার যায়? কতবারই বা ভগ্ন হৃদয়ের যাতনা সহ্য করা যায়? ১৯৯৮-এ হাসি হাসি মুখে ব্রাজিল সমর্থন করতে গিয়ে দেখি কাপ নিলো ফ্রান্স। তারপর আমার অবস্থা হলো সুকুমার রায়ের ‘নন্দলালের মন্দ কপাল’-এর মতোই। যাকেই সমর্থন করি, সেই হারে।
এই বিষাদের শোকগাঁথা আর দীর্ঘতর করা অর্থহীন। এছাড়া ২৩/২৪ থেকেই জীবনের সুর বদলে যেতে শুরু করলো। পেশাগত জীবনে যোগ দেওয়ার পর আগের মতো প্রচুর অবসর সময় আর হাতে থাকলো না। কাজে ব্যস্ত হওয়া শুরু করলাম। বহুদিন ফুটবল অতটা দেখাও হয় না। জীবনে সফল-ব্যর্থ যাই হই না কেন, ফুটবলের আফিমে এখন তত মগ্ন হওয়া হয় না।
যাই হোক, শেষ কথা হচ্ছে পৃথিবীতে বাঙালিই বোধ করি একমাত্র বিচিত্র জাতি যারা, নিজের দেশ থেকে বহু দূরে ও পৃথিবীর অন্য গোলার্ধের দুই দেশের ফুটবল নিয়ে হাতাহাতি-মারামারি, ঝগড়া-বিবাদ করে। আর কোনো দেশে এই ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হয় বলে মনে হয় না।
খোদ আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলে নিজ দেশের খেলা বাদ দিয়ে এতটা মত্ততা হয় কি না জানা নেই। তবে ফুটবলের প্রতি বাঙালির প্রেম সবসময় ফুটবল জ্বরে রূপ নেবে তা নিশ্চিত।