গণপূর্ত অধিদপ্তরের আরবরিকালচার (বৃক্ষবিদ্যা) বিভাগের প্রধান শেখ মোঃ কুদরত-ই খুদা’র বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। যিনি গত ১২ বছর ধরে পদটি আকড়ে ধরে আছেন। জানা যায়, গণপূর্তের যে সকল কর্মকর্তা সরাসরি দুর্নীতির সাথে জড়িত রয়েছেন কুদরত-ই খুদা তাদের মধ্যে অন্যতম প্রধান। বিগত সরকারের আমলে মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে সচিব পর্যায়ের সকল সভা সেমিনারে কুদরত-ই খুদার উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, প্রায় আট বছর আগেই তিনি সরকারি বরাদ্ধের ভূয়া বিলে অর্থ আত্মসাৎ, আউট সোর্সিং এর ভূয়া তালিকা তৈরি করে অর্থ উত্তোলনের মাষ্টারমাইন্ড হিসাবে সুপরিচিতি লাভ করে গণপূর্তে। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, অনিয়ম, দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে গণপূর্ত অধিদপ্তরের আরবরিকালচার বিভাগে রাম-রাজত্ব করেছেন কুদরত-ই খুদা এবং অধিদপ্তরের প্রতিনিধি হয়ে নিয়োগ পরীক্ষায় হস্তক্ষেপ ও কেন্দ্র মনিটরিং কর্মকর্তার দায়িত্বে থেকে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার মতো অভিযোগও আছে তাঁর বিরুদ্ধে।
নথি বলছে, জানুয়ারী ২০০৪ সালে গণপূর্তের চট্রগ্রাম উপ-বিভাগীয় অফিসার (আরবরিকালচার) পদে যোগদান করেন কুদরত-ই-খুদা। নিয়োগের পরপরই বাংলাদেশ সরকারী কর্মকমিশনের সকল শর্তাবলীকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ১০ বছর যাবত বেতন তুলেছেন ৫ম গ্রেডে। সেই সাথে এক যুগ ধরে মোটা অংঙ্কের ঘুষ লেনদেনের মাধ্যমে গণপূর্ত বিভাগ ঢাকার (২ এপ্রিল ২০১২ সাল) প্রধান বৃক্ষপালনবিদের চেয়ার দখলে রেখেছেন কুদরত-ই-খুদা। অথচ জেষ্ঠ্যতার ভিত্তিতে এই দায়িত্ব পালনের কথা ছিল উপ-বিভাগীয় অফিসার মোঃ মোয়াজ্জেম হোসেন-এর।
৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরপরই আরবরিকালচার বিভাগের প্রধান কর্মকর্তা কার্যালয়ে অনুপস্থিত আছেন বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। অফিসে অনুপস্থিত থেকেও অফিস সহকারী আব্দুল মান্নান, চালক বাচ্চু, অফিস সহকারী-কাম-কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক (বড় বাবু) জাহাঙ্গীরের সহায়তায় বাসায় থেকেই অফিস করছেন এবং ফাইল পত্রে স্বাক্ষর আনতে মোহাম্মদপুরের বাসায় প্রতিদিন যাচ্ছে সরকারি গাড়ি।
অভিযোগ আছে, গণপূর্ত অধিদপ্তরের-অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী শামীম আহমেদ, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (সংস্থাপন) নন্দিতা রানী সাহার সমন্বয়ে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেট বছরের পর বছর অর্থ লেনদেনের মাধ্যমে শেখ মো. কুদরত-ই খুদার মতো দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করে আসছেন। এবিষয়ে নন্দিতা রানী সাহা তিনি সব অস্বীকার করে বলেন আমি কেন কারো অপরাধের দায় নেবো, যে অপরাধ করবে তার জন্য শাস্তি পাবে।
এই বিষয়ে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী শামীম আহমেদের মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে জানান, “আমি যতটুকু শুনেছি শেখ মোঃ কুদরত-ই খুদা’র বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রামানিত হয় নাই তবে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (সংস্থাপন) নন্দিতা রানী সাহা এই বিষয়ে ভালো বলতে পারবেন।” তিনি বলেন, ২০১২ সালে শেখ মোঃ কুদরত-ই খুদা ও মোঃ মোয়াজ্জেম হোসেন দুজনের ফাইলই মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয় এবং কুদরত-ই-খুদা উক্ত পদে নিয়োগ পেয়েছেন। তিনি যোগ করেন, প্রয়োজনে পূনরায় শেখ মো. কুদরত-ই খুদা’র বিরুদ্ধে উঠা অভিযোগ গুলো তদন্ত করা হবে।
কুদরত-ই-খুদা’র কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকার বিষয়ে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী জানান, তাঁর কর্ম এলাকা অনেক বড় তাই হয়তো অন্য কোথাও বসে অফিস করছেন।
এ বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (সংস্থাপন) নন্দিতা রানী সাহা পাল্টা অভিযোগ করে বলেন, উপ-বিভাগীয় অফিসার (আরবরিকালচার) মোঃ মোয়াজ্জেম হোসেন ‘প্রধান বৃক্ষপালনবিদ’র রুম দখল করার পায়তারা করছেন তাই হয়তো কুদরত-ই খুদা অফিস করছেন না। তবে তিনি প্রধান প্রকৌশলীর অনুমতি ছাড়া তার বিরুদ্ধে উঠা অভিযোগ এবং কুদরত-ই খুদা’র অনিয়মের বিষয়ে কোন মন্তব্য করবেন না বলে জানিয়ে দেন।
প্রধান বৃক্ষপালনবিদ’র রুম দখলের বিষয়ে জানতে চাইলে আরবরিকালচার-এর উপ-বিভাগীয় অফিসার মোঃ মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন কর্তৃক প্রকাশিত নিয়োগের তালিকায় আমি জৈষ্ঠ্যতম হয়ে ২০০৪ সালে চাকরিতে যোগদান করি। জন্মস্থান বগুড়া হওয়াতে আমাকে বিভিন্ন ভাবে হয়রানী করে ১৬ বছর পদোন্নতি বঞ্চিত করে চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিভাগে রিজার্ভে পদায়ন করে রাখা হয়েছে। গত ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তারিখে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান-এর দপ্তরে প্রধান বৃক্ষপালনবিদ পদে পদোন্নতি/ চলতি/ অতিরিক্ত দায়িত্ব পালনের জন্য লিখিত আবেদন করেছি। উপদেষ্টার দপ্তর থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ প্রদান করা হলেও সংশ্লিষ্ট দপ্তর তা মানছেন না বলে তিনি অভিযোগ করেন।
সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, গণপূর্ত অধিদপ্তরের আরবরিকালচার গনপূর্ত বিভাগের আউট সোর্সিং পদে প্রত্যেকটি নিয়োগে শেখ মোঃ কুদরত-ই খুদা সর্বনিম্ন ৩ লক্ষ টাকা ঘুষ নিয়ে থাকেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সেই সাথে আউট সোর্সিং ও বাউচার (মাস্টার রোল) পদের ভূয়া তালিকা তৈরি করে বিগত বছরগুলোতে প্রায় ২২ কোটি টাকা অর্থ বিভাগ থেকে হাতিয়েছেন।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ২০১৬ সালের ২৮ জানুয়ারি তাঁকে প্রয়োজনীয় নথিপত্র জমা দিতে বলেছিল, কিন্তু তিনি তখন কোন নথি-পত্র জমা না দিয়ে অসহযোগিতা করেন বলে জানা যায়। এতে ২০১৩-১৪ ও ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ভুয়া পোশাক ভাতা বিলের মাধ্যমে ৫ লাখ টাকা উত্তোলন, পরিচ্ছন্নতা খাতে ৩ লাখ ৯৯ হাজার ৩৯৯ টাকা আত্মসাৎ এবং বিভিন্ন খাতে ১৩ লাখ ৭৭ হাজার ৭২ টাকার বিল উত্তোলনের অভিযোগ অন্তর্ভুক্ত ছিল।
সেই সাথে ২০২০ সালের আরও একটি তদন্ত প্রতিবেদন ঘুষ প্রধানের মাধ্যমে ধামাচাপা দিয়েছেন বলে গণর্পূতের একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছেন।
২০১৬ সালে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এ জমা হওয়া অভিযোগে বলা হয়, ২০১৩-১৪ ও ২০১৪-২০১৫ অর্থ বছরের বিভিন্ন খাতের ১৭ লক্ষ ৭৭ হাজার ৩৭২ টাকা ভুয়া বিলের মাধ্যমে আত্মসাৎ করেছেন কুদরত-ই-খুদা এবং ২০২০ সালের আরেকটি অভিযোগে বলা হয়েছে কুদরত-ই-খুদার সিন্ডিকেট অবৈধভাবে ওভারশিয়ার পদে পদোন্নতি ও ৪ টি পদ পদবি ব্যবহার করে অর্ধ-কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন।
অভিযোগ পত্রে বলা হয়েছে, সরকারি পার্ক ও উদ্যানসমূহ রক্ষণাবেক্ষণের কাজ, ফুলের টব সরবরাহ, গেট সাজানো, উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মঞ্চসজ্জা, স্মৃতি মিলনায়তনের পুষ্প বিন্যাস, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ উপহার আত্মসাৎসহ কাজ না করেই ভুয়া বিল দেখিয়ে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন গণপূর্তের প্রধান বৃক্ষপালনবিদ কুদরত-ই খোদা। এছাড়াও ভুয়া বিলে কর্মীদের পোশাকের টাকা আত্মসাৎ, বাগান পরিষ্কারের টাকা তুলে পকেট ভরা, ভুয়া কর্মচারী সাজিয়ে টাকা উত্তোলন, ঠিকাদারের সঙ্গে আঁতাত করে চারা রোপণ, সীমানা প্রাচীর তৈরি, হেজবেড ও ফুলের বেড প্রস্তুতের জন্য বরাদ্দকৃত টাকা তসরুপ করারও অভিযোগ রয়েছে।
সে সময় তাঁর দুর্নীতির বিষয়ে দুদক-এর কাছে মুখ খোলেন গণপূর্ত-এর একজন কর্মকর্তা ও কয়েকজন কর্মচারী। তারা হলেন উপ বিভাগীয় বৃক্ষপালনবিদ মোঃ মোয়াজ্জেম হোসেন, মেকানিক মোঃ সোলেমান, পাওয়ার লেন মেশিন অপারেটর মোঃ মিজানুর রহমান, মালি মোঃ নয়ন মোল্লাহ, সামছু বিশ্বাস, জালাল আহমেদ ও শহিদ মিয়া এবং ফরাশম্যান মোঃ ইব্রাহিম। অভিযোগ আছে, ঐ সময় দুদকের তদন্ত কর্মকর্তা সাক্ষীদের সাক্ষাৎকার পাল্টে ফেলে প্রধান বৃক্ষপালনবিদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের ঘুষ নিয়ে সাদামাটা প্রতিবেদন জমা দিয়েছিলেন।
এ ঘটনার পর প্রধান বৃক্ষ পালনবিদ প্রশাসনকে ম্যানেজ করে দুর্নীতির প্রতিবাদকারীদের একজনকে চাকরীচ্যুত করেন। আর বাকিদের শাস্তিমূলক বদলি করেন। প্রায় ৮ বছর ধরে চেপে রেখেছেন দুর্নীতির তদন্ত; আর এটা করতে বিপুল অর্থও খরচ করতে হয়েছে তাকে। বার্ষিক বরাদ্দের রক্ষণাবেক্ষণের টাকা নয় ছয় করে সেসব করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ঘটনায় প্রতিবাদকারীরা শাস্তি পেলেও বীরদর্পে গণপূর্ত দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন কুদরত।
২০২০ সালে আরও একটি অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আরবরিকালচার বিভাগের প্রধান শেখ মোঃ কুদরত-ই-খুদা’র সরকারি অর্থ আত্মসাৎ, অনিয়ম, দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার সংক্রান্ত বিষয়গুলো তদন্ত পূর্বক প্রতিবেদন প্রেরণের জন্য তত্বাবধায় প্রকৌশলী কায়কোবাদ, নির্বাহী প্রকৌশলী হাসনাত সাবরিনা ও উপ বিভাগীয় প্রকৌশলী নাহিদ আফরোজ-এর সমন্বয়ে তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে গণপূর্ত অধিদপ্তর। অফিস আদেশে ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে উল্লেখিত অভিযোগের বিষয়গুলো সরেজমিন তদন্ত করে সুস্পষ্ট মতামত দাখিল করার জন্য বলা হয়েছিল।
তদন্ত কমিটির কর্মকর্তাদের সাথে এই বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে সদস্য সচিব হাসনাত সাবরিনা বাংলাদেশ পোস্ট-কে জানান, “নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছিল এবং আমাদের তদন্তের পরে আরও একটি তদন্ত কমিটি হয়েছে শেখ মোঃ কুদরত-ই-খুদা’র বিরুদ্ধে। তদন্ত প্রতিবেদন জমা হওয়ার পর এই বিষয়ে প্রশাসন, সংস্থাপন ও তদন্ত কোষ শাখা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করবেন।
তদন্ত প্রতিবেদন এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়ে নির্বাহী প্রকৌশলী তৌফিক আলম সিদ্দিকী (তদন্ত কোষ) জানান, অফিসিয়াল ফাইল পত্র না দেখে বিস্তারিত বলতে পারছিনা। বর্তমানে বিষয়টি নিয়ে অনেক বড় ইস্যু চলছে। গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ শামীম আখতার এসব অভিযোগের বিষয়ে বাংলাদেশ প্রস্ট-এর কাছে কোন মন্তব্য করতে রাজি হন নি। গণপূর্ত অধিদপ্তরের আরবরিকালচার বিভাগের (ঢাকা) প্রধান শেখ মোঃ কুদরত-ই- খুদা এই বিষয়ে যানতে বার বার ফোন দিলে তিনি কেটে দেন ।
সংবাদ শিরোনাম ::
গণপূর্ত অধিদপ্তরের বৃক্ষবিদ্যা প্রধানের বিরুদ্ধে কুদরত-ই খুদা’র অন্তহীন অভিযোগ ।
- নিজস্ব প্রতিবেদক ।
- আপডেট সময় ০১:৩৪:৩৭ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১০ নভেম্বর ২০২৪
- ৫৪৪ বার পড়া হয়েছে
Tag :
জনপ্রিয় সংবাদ