রাজধানীর প্রায় সর্বত্রই ভয়াবগ আকার ধারণ করেছে ছিনতাই। নগরীর প্রধান সড়ক থেকে অলিগলি, বস্তি এলাকা থেকে অভিজাত পাড়া-সব জায়গায় ছিনতাইয়ের শিকার হওয়ায় আতঙ্কে নগরবাসী। পথচারীদের রাস্তা আটকে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে যেমন ছিনতাই হচ্ছে, তেমনি প্রাইভেটকার ও মোটরসাইকেলেও ছিনতাইকারীরা হামলে পড়ছে নিরীহ মানুষের ওপর। গত কয়েক মাসে ছিনতাইকারীদের হামলায় বেশ কয়েকটি হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে। মোহাম্মপুরে সম্প্রতি একাধিক ছিনতাইয়ের ঘটনায় সারা দেশে আলোড়ন তৈরি হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ৫ আগস্টের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এখনো পুরোপুরি সক্রিয় না হওয়ার সুযোগ নিচ্ছে অপরাধীরা। পাশাপাশি কারাগারে থাকা অপরাধীরা জামিনে এসে ছিনতাইয়ে জড়িয়ে পড়েছে। তবে ছিনতাইয়ের প্রকৃত ঘটনার তুলনায় থানায় মামলার সংখ্যা কয়েকগুণ কম। মামলা নিতে অনীহা, আবার কখনো ঝামেলা এড়াতে পুলিশের দ্বারস্থ না হওয়াই এর বড় কারণ। ছিনতাই বন্ধে মোহাম্মদপুরে রাস্তায় নেমে এলাকাবাসী প্রতিবাদ জানিয়েছেন। এক্ষেত্রে পুলিশি টহল জোরদার ও চেকপোস্ট বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন অপরাধ বিশেজ্ঞরা। এদিকে আগের চেয়ে রাজধানীতে ছিনতাই বাড়েনি বলে মনে করছেন পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারা। সাম্প্রতিক যে ঘটনাগুলো ঘটেছে, তাতে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ছিনতাইসহ সব ধরনের অপরাধ দমনে ভবিষ্যতেও পুলিশ আরও শক্ত ভূমিকা নেবে এমনটাই আশা করছেন নগরবাসী, পুলিশ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞরা।
ছিনতাইয়ের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সম্প্রতি মোহাম্মদপুরে এক ছাত্রীকে ধারালো অস্ত্র নিয়ে ধাওয়া দিয়ে তার ব্যাগ ছিনিয়ে নেওয়া হয়। ২৪ অক্টোবর মোহাম্মদপুর বসিলা ৪০ ফিট এলাকার একটি মুদি দোকানে ঢুকে ধারালো অস্ত্রের মুখে দোকানিকে জিম্মি করে দুষ্কৃতকারীরা ক্যাশের সব টাকা নিয়ে যায়। ২০ অক্টোবর সকালে মোহাম্মদী হাউজিং লিমিটেডে দিনদুপুরে ফিল্মিস্টাইলে নেসলে কোম্পানির গাড়ি আটকে অস্ত্রের মুখে ১১ লাখ ৮৫ হাজার টাকা ছিনতাই করে ৬ দুর্বৃত্ত। ১৮ অক্টোবর রাত ২টার দিকে কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে বাসায় ফেরার পথে মগবাজার রেলক্রসিংয়ের কাছে ডাকাতির শিকার হন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শিবলু হক। ১১ অক্টোবর রাতে মোহাম্মদপুরে সেনাবাহিনী ও র্যাবের পোশাক পরে সংঘবদ্ধ ডাকাতদল এক ব্যবসায়ীর বাসায় ঢুকে সাড়ে ৭৫ লাখ টাকা ও ৬০ ভরি স্বর্ণালংকার লুট করে।
শতাধিক স্পটে সক্রিয় কয়েক হাজার ছিনতাইকারী : ডিএমপির সাসপেক্ট আইডেন্টিফিকেশন অ্যান্ড ভেরিফিকেশন সিস্টেমের (এসআইভিএস) তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীতে ছয় হাজার ১৯৮ জন ছিনতাই ও ডাকাতিতে জড়িত। ছিনতাইয়ের হটস্পটের তালিকায় রয়েছে শাহবাগ, রমনা, মতিঝিল, খিলগাঁও, বাড্ডা, যাত্রাবাড়ী, ডেমরা, ভাটারা, শেরেবাংলা নগর, কলাবাগান, রামপুরা, হাজারীবাগ, মোহাম্মদপুর, বিমানবন্দর, খিলক্ষেত, উত্তরা পশ্চিম ও পল্লবী এলাকা। এছাড়া পান্থপথ, টিএসসি, কাওরান বাজার, হাতিরঝিল ও তেজগাঁও রেলস্টেশন ছিনতাইয়ের অন্যতম হটস্পট। বাসস্ট্যান্ড, লঞ্চ টার্মিনাল ও রেলস্টেশনগুলোও ছিনতাইয়ের হটস্পট।
ছিনতাই বাড়লেও মামলা কম : ডিএমপির অপরাধ পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে ছিনতাইয়ের ঘটনায় ১ হাজার ৪৬৪টি মামলা হয়েছে। অর্থাৎ প্রতিবছর গড়ে ২৯২টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ছিনতাই করে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা ৮২০টি। আর ছিনতাইয়ের সময় হাতেনাতে আটকের ঘটনা ৬৪৪টি। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২২ সালে ১৬৫টি, ২০২১ সালে ৩৪৩টি ও ২০২০ সালে ১৭৬টি ছিনতাইয়ের মামলা হয়েছে।
অন্যদিকে চলতি বছর জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৮ মাসে রাজধানীর বিভিন্ন থানায় ছিনতাইয়ের মামলা হয়েছে মাত্র ১৬২টি। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ২৫, ফেব্রুয়ারিতে ২৬, মার্চে ২৮, এপ্রিলে ১৫, মে মাসে ১৯, জুনে ১৬, জুলাইতে ১৫, আগস্টে ৪ এবং সেপ্টেম্বরে ১৪টি মামলা হয়েছে। তবে বাস্তবে এ সংখ্যা কয়েকগুণ বেশি বলে মনে করছেন সাধারণ মানুষ। ৫ আগস্টের পর মোহাম্মদপুরে ভয়াবহ বেশ কয়েকটি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। এ সময়ে শুধু মোহাম্মদপুরেই খুন হয়েছে অন্তত ১০ জন। যেখানে ছিনতাই, ডাকাতি, আধিপত্য বিস্তার, মাদক কারবার নিয়ন্ত্রণ ও বাজারদখলসহ নানা কারণ উঠে এসেছে।
ছিনতাইয়ের শিকার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শিবলু হক বলেন, তিনি হাতিরঝিল থানায় মামলা করতে গেলে পুলিশ তা নিতে চায়নি। তারা তাকে জিডি করার পরামর্শ দিয়েছেন।
গ্রেফতারের পর ছাড়া পেয়েই ফের ছিনতাইয়ে : ডিএমপির ছিনতাই প্রতিরোধে গঠিত টাস্কফোর্সের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ৯ অক্টোবর থেকে এ বছর অক্টোবরের শুরু পর্যন্ত ২৭৭টি ছিনতাইয়ের মামলায় দুই শতাধিকের বেশি অপরাধী গ্রেফতার হয়েছে। ছিনতাইয়ের সময় হাতেনাতে গ্রেফতার হয়েছে ১ হাজার ৮৪১ জনের বেশি। এ সময়ে জামিন পেয়েছে প্রায় ১ হাজার ৭৮৬ জন। এই এক বছরে গ্রেফতারদের বিরুদ্ধে ১১২টি দ্রুত বিচার আইনে মামলা হয়েছে। তথ্যে দেখা গেছে, গ্রেফতার আসামিদের বেশির ভাগই জামিনের পরপরই ফের ছিনতাইয়ে জড়িয়েছেন। এমনকি জামিনের তিন দিন পরই ছিনতাই করতে গিয়ে গ্রেফতার হওয়ারও নজির রয়েছে।
পুর্লিশের নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ রাজধানীবাসীর : মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা ব্যাংক কর্মকর্তা রফিকুল হক যুগান্তরকে জানান, আগে সন্ধ্যার পর থেকে ভোররাত পর্যন্ত অলিগলিতে ছিনতাই বেশি হতো। পুলিশ আগের মতো সক্রিয় না থাকায় এখন প্রকাশ্যে দিনের বেলায়ও অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে সর্বস্ব লুটে নিচ্ছে। ভুক্তভোগীরা হয়রানি এড়াতে থানা পুলিশের দ্বারস্থ হন না, আবার কখনো কখনো পুলিশই ছিনতাইয়ের ঘটনায় মামলা নিতে চায় না।
যাত্রাবাড়ীর বাসিন্দা আলী আকবর বলেন, ছাত্র-জনতার বিপ্লবে পুলিশ আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে কাজ করায় ক্ষোভের মুখে পড়ে বাহিনীর সদস্যরা। এর প্রভাব মাঠ পর্যায়ের পুলিশিংয়েও পড়েছে। পুলিশের মধ্যে এখন আতঙ্ক বিরাজ করছে। তারা এখনো পুরোপুরিভাবে স্বাভাবিকভাবে কাজ শুরু করতে না পারার সুযোগ নিচ্ছে ছিনতাইকারীসহ অন্য অপরাধীরা।
পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার প্রতিবাদে শনিবার সকালে মোহাম্মদপুরে বিক্ষোভ করেন স্থানীয়রা। বিক্ষোভ থেকে তারা ৭২ ঘণ্টার আলটিমেটাম দেন। এরপরই শনিবার গভীর রাতে সেনাসদস্য ও পুলিশ যৌথ অভিযান চালিয়ে ডাকাতদলের হোতাসহ ৪৫ জনকে আটক করে। ঢাকা উদ্যানে অস্থায়ী সেনাক্যাম্প বসানো হয়েছে। শনিবার সকাল থেকে রোববার পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ৩৪ জনকে গ্রেফতার করেছে যৌথ বাহিনী।
রাজধানীতে ছিনতাইয়ের আরও যত ঘটনা : ১০ অক্টোবর রাত সাড়ে ৯টার দিকে মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যানে রবিউল ইসলাম নামে এক নিরাপত্তাকর্মীর বুকে, পিঠে ও হাতে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে ছিনতাইকারীরা। ৩০ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে ৮টার দিকে যাত্রাবাড়ীর কুতুবখালীতে রাসেল শিকদার নামে এক যুবককে কুপিয়ে হত্যা করে ছিনতাইকারীরা। ১৬ সেপ্টেম্বর সকালে মিটফোর্ড এলাকায় বেড়িবাঁধে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে নিহত হন দিনমজুর আলমগীর ব্যাপারী। ৪ সেপ্টেম্বর দারুসসালাম এলাকায় রইচ ব্যাপারী নামে এক ব্যবসায়ীকে গুলি করে ৩ লাখ ৩১ হাজার টাকা নিয়ে যায় ছিনতাইকারীরা। ৩ সেপ্টেম্বর কদমতলীর মেরাজনগরে ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে নিহত হন কাঁচামাল বিক্রেতা হাশেম। একইদিন ভোরে হাজারীবাগের সিকদার মেডিকেলের পাশে যাত্রীবেশী ছিনতাইকারীরা ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা (মিসুক) চালক সাদেকিনকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে।
৩১ আগস্ট ভোরে বাসাবো ফ্লাইওভারের নিচে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে খুন হন ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাচালক ইউসুফ সাধু।
ছিনতাই রোধে যা বলছেন আইনসংশ্লিষ্টরা : সারা দেশে ছিনতাই রোধে রেঞ্জ পুলিশ, পুলিশ কমিশনার, র্যাবসহ সব ইউনিটকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে ছিনতাই প্রবণতা ঢাকায় বেশি হওয়ায় ঢাকার ৫০ থানা, ডিবিকে এ নিয়ে কাজ করার নির্দেশনা দিয়েছে সদর দপ্তর।
ঢাকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন এলাকায় টহল বাড়ানোসহ প্রতিটি থানার ওসিদের সতর্ক করা হয়েছে।
এ বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর যুগান্তরকে বলেন, ছিনতাইসহ সব ধরনের অপরাধ প্রতিরোধে বিশেষ অভিযান চলছে। নতুন করে মাঠপর্যায়ের অভিযান আরও জোরদার করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি টহল ও চেকপোস্ট বাড়ানো হয়েছে। তিনি বলেন, ডিএমপিতে আড়াইশর মতো টহল টিম, পাশাপাশি স্থায়ী-অস্থায়ী দেড়শর বেশি চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। এর বাইরে গাড়িতে ও মোটরসাইকেলে দিনে ও রাতে প্যাট্রলিং করা হচ্ছে। জামিনে মুক্ত পাওয়া আসামিদের ওপরও আলাদা নজরদারি রয়েছে।
ডিএমপি কমিশনার মো. মাইনুল হাসান যুগান্তরকে বলেন, রাজধানীতে সংখ্যাগত দিকে ছিনতাই খুব বেশি বাড়েনি। তবে গত কয়েক মাসে যে কটি ঘটনা ঘটেছে পুলিশ তাৎক্ষণিকভাবে অপরাধীদের গ্রেফতার করেছে। তিনি বলেন, বর্তমানে থানাগুলোর পাশাপাশি মাঠেও পুলিশ পুরোপুরি কাজ করছে। ভবিষ্যতেও যে কোনো ঘটনায় আরও জোরালো ভূমিকা নেওয়া হবে।