‘আপনার কি বিদেশি পাসপোর্ট?’ বিমানবালা ভদ্রমহিলার কথায় কোনো অস্পষ্টতা ছিল না। তবুও কেন বুঝতে অসুবিধা হলো? তখন এতকিছু ভাবার উপায় পাইনি।
পেছনে লম্বা লাইন, মানুষ অপেক্ষায়। তবে পরে ভেবে পেলাম নিজেকে ‘বিদেশি’ পরিচয় দিতে হবে, এই ব্যাপারটা মাথায় গাঁথেনি। প্রায় ৩৮ হাজার ফুট উঁচুতে উঠে ততক্ষণে যে পাড়ি দিয়েছি ১৮২০ কিলোমিটার, সেটিও।
বড় হয়েছি রীতিমতো ছিমছাম একটা গ্রামে। ওখানে ধান হয়, বর্ষায় মাছ ধরা যায়; কিন্তু আকাশ দেখার স্বপ্ন বুনতে জায়গাটা তেমন প্রসিদ্ধ না। সারাজীবন বিমান দেখতে হয়েছে দূর আকাশে ‘হাঁ’ হয়ে তাকিয়ে থেকে। বন্ধুদের সঙ্গে গল্পতেও নানা ‘বোকা, বোকা’ প্রশ্নই মাথায় এসেছে আকাশে উড়ে বেড়ানো যানটাকে নিয়ে। বিমানবন্দর অবধি যে দুয়েকবার এসেছি, তখনও উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখে কেবল কৌতূহলই বেড়েছে; মেটানোর উপায় পাইনি।
ভদ্রমহিলার প্রশ্নে ফিরে আসি, কারণ এ নিয়ে কাঁটাতারের ওপারেও একটা গল্প আছে। ‘বিদেশি পাসপোর্ট কি না’ প্রশ্নের উত্তরে শুরুতে ‘না’-ই বলেছিলাম। পরে ‘আমার বাংলাদেশি পাসপোর্ট’ বলার পর ছোট্ট একটি ফর্ম ধরিয়ে দিলেন তিনি।
ইন্ধিরা গান্ধী এয়ারপোর্টের টার্মিনালে লাগেজ নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মনকে বোঝালাম, এখন আর দেশে নেই; অবধারিতভাবেই তাই বিদেশি হয়ে গেছি। পরে দিল্লি শহরে ঢুকে অনেকক্ষণ ভেবেও ভাঙা ভাঙা হিন্দি বলতে বাধ্য হওয়ার পর বিশ্বাসটা পোক্ত হয়েছে। ভারতের ইমিগ্রেশন অফিসারের কাছে আসার পর মুচকি হেসে তিনি বললেন, ‘প্রথমবার ভারতে এলেন?’ উত্তরে ‘হ্যাঁ’ বলার পর তিনি শুভকামনা জানালেন।
অথচ একই প্রশ্নের অভিন্ন উত্তর দিয়ে বাংলাদেশে ভীষণ বিপদেই পড়ে গিয়েছিলাম। প্রথম বিশ্বকাপ যাত্রার রোমাঞ্চ প্রায় মাটি হয়ে যেতে বসেছিল। এর আগে কখনো বিদেশ তো দূর, বিমানেই উঠা হয়নি। নিয়ম-কানুন কিছুই জানা নেই। কোথায় ইমিগ্রেশন, কোথায় বোর্ডিং পাস এসবও অজানা।
১১টার ফ্লাইটের জন্য ঘুম ভেঙেছে সোয়া পাঁচটায়। রাতেও এক-দুবার ঘুম ভেঙে ঘড়ি দেখতে হয়েছে। সময় যেন ফুরাচ্ছিল না। এতসব রোমাঞ্চ তো আর ইমিগ্রেশন অফিসারের জানার কথা নয়। তার দায়িত্ব তার কাছে রোজকার ব্যাপার। আমাকে প্রশ্ন করলেন, কেন যাচ্ছি, কবে ফিরবো। এরপর বললেন, ‘প্রথমবার যাচ্ছেন ভারতে?’ উত্তরটা হ্যাঁ হওয়ার পরও কিছুক্ষণ তিনি চুপ থেকে কাজই করছিলেন।
কিন্তু হুট করে তার ‘স্যার’ সামনে চলে এলেন। তাকে কাজটাজ করেন এমন বোঝাতেই হয়তো পাসপোর্ট আটকে দিলেন। শুরুতে তেমন একটা চিন্তা হয়নি। পাসপোর্টে স্টিকারে স্পষ্ট করে লেখা আছে-বিশ্বকাপ কাভার করতে ভারতে যাচ্ছি। এত দৌড়ঝাঁপ করে ভিসা নেওয়ার পরও আমাকে কেন আটকাবে?
কিন্তু এই বুঝ মনকে বেশিক্ষণ দেওয়া গেলো না। কারণটাও ওই ইমিগ্রেশন অফিসারই। এমন খোশগল্পে মেতে উঠলেন, আমি বা আমরা আছি কি না যেন তার খেয়ালই নেই। দুয়েকবার এগিয়ে গিয়ে কথা বলতে গেলেও খুব একটা পাত্তা-টাত্তা তারা দিচ্ছেন না; মাথায় ভীষণ চাপ অনুভব করলাম। এরপর মাথায় এলো, ভারতে যাওয়া আটকে দিতে না পারলেও ফ্লাইটটা ঠিকই মিস করাতে পারবেন এমন খোশগল্প মেতে থাকলে।
একটু করে সময় যায়, চিন্তাও বাড়ে। মুখোমুখি সময় এসে পোশাকে থাকা ভদ্রলোকরা সদয় হন, বাড়ে তাদের তোড়জোড়ও। এ ডেস্ক, ও ডেস্ক করে পাসপোর্ট যখন হাতে এলো, ততক্ষণে অনেক বেলা বয়ে গেছে। পাসপোর্ট নিয়ে দৌড়ে দৌড়ে আর সামনে কী আছে এই ভয় ভয়ে নিয়ে চেকিং পার করলাম।
স্বপ্নপূরণের রোমাঞ্চের কথা একটা ছবি দিয়ে ফেসবুকে পোস্ট করার শখ এ যুগের ছেলেদের না হওয়ার কোনো কারণ নেই। এই ইচ্ছে পূরণ করতে গিয়ে হারাতে হয় শখের হেডফোনটিকে। তবুও এত এত দিনের ঝক্কি, টেনশন, অনিশ্চয়তা; সব যেন নিমিষেই উড়ে গেল মেঘের ভেতর থেকে ঢাকাকে দেখে।
শহরটাতে আছি প্রায় ৮ বছর। ইদানিং একটু-আধটু মায়া জন্মালেও, এখনও ঠিকঠাক নিজের করতে পারিনি। মেঘের ভেতর থেকে ঢাকাকে দেখে ভীষণ ভালোই লাগছিল। স্বপ্নের সঙ্গে আকাশে উড়া হলো ছিমছাম গ্রামের রেডিও নিয়ে ঘুরে ঘুরে খেলা দেখা ছেলেটারও।
প্রিয় পাঠক, নিশ্চিত করেই বলতে পারি আপনারা অনেকেই বিমানে চড়েছেন বহুবার। লেখাটা এতটুকু অবধি পড়ে ফেলে যদি বিরক্ত বোধ করেন; একজনের স্বপ্নপূরণের আবেগের কথা চিন্তা করে ক্ষমা করবেন বলে প্রত্যাশা করি।
লেখা পড়ে এতক্ষণে পুরো ধারণাই পেয়ে যাওয়ার কথা। তবুও যদি না পেয়ে থাকেন, তবে আপনাকে বলছি- কাল থেকে শুরু হতে যাওয়া বিশ্বকাপে ভারতের মাঠগুলোতে থাকবেন বাংলানিউজের প্রতিনিধি। খবর, ছবি, ভিডিও এসব পাওয়ার প্রতিশ্রুতি আপনাদেরকে দেওয়া হচ্ছে। মাঝেমধ্যে হয়তো এমন ‘বিরক্ত’ হওয়ার মতো দুয়েকটা গল্পও সামনে চলে আসতে পারে। সেসবের জন্য আগেভাগেই আপনাদের কাছে করজোড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।