আকাশ চিরে বের হওয়া ১৬৫ তলার বুর্জ খলিফা বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু ভবন। দুবাইয়ের এই ভবন সম্পর্কে জানেন না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। মেঘের ওপরেও থাকবে ভবনের অংশ, এমন ১১১ তলার আইকনিক টাওয়ার নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ। প্রাথমিক পর্যায়ে এর অগ্রগতিও বেশ।
এটি শুনে বিশ্বের উন্নত অনেক দেশ অবাক হয়েছে বটেই, তবে রাজধানীর উপকণ্ঠে পূর্বাচলে প্রস্তাবিত ১১১ তলার আইকনিক টাওয়ার নির্মাণ নিয়ে শুরু হয়েছে নতুন জটিলতা।
পূর্বাচলে টাওয়ারটি নির্মাণের উদ্যোগ নেয়রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। কিন্তু টাওয়ারটির কারণে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে উড়োজাহাজ ওঠা-নামায় সমস্যার সৃষ্টি হবে— এমন যুক্তি সামনে এনে এটি নির্মাণে আপত্তি জানিয়েছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা যায়, গত ১৩ অক্টোবর (বৃহস্পতিবার) প্রস্তাবিত আইকনিক টাওয়ার নির্মাণ নিয়ে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয় সচিবালয়ে। মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামের সভাপতিত্বে রাজউক ও বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের সংশ্লিষ্ট শীর্ষ কর্মকর্তারা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সভায় আইকনিক টাওয়ারের উচ্চতা নিয়ে আপত্তির কথা স্পষ্ট করে জানায় বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ। তারা যুক্তি তুলে ধরে বলেছে, সুউচ্চ ১১১ তলাবিশিষ্ট আইকনিক টাওয়ার পূর্বাচলে নির্মাণ হলে উড়োজাহাজ চলাচলে বিঘ্ন ঘটতে পারে।
‘ঢাকায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে উড়োজাহাজগুলোর ওঠা-নামা করতে প্রচলিত পথ বদলাতে হবে। এতে নিরাপত্তা ঝুঁকিসহ জ্বালানির ব্যয় বাড়বে। এছাড়া ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশনের (আইসিএও) নিয়ম অনুসারে বিমানবন্দরের ১৫ কিলোমিটারের মধ্যে ৫০০ ফুটের বেশি উঁচু ভবন থাকা যাবে না। স্থানীয় নিয়ম অনুসারে পূর্বাচলে সর্বোচ্চ ১৫০ ফুট বা ১৫ তলার বেশি উঁচু ভবন নির্মাণ করা যাবে না’— যুক্তি দেখান তারা।
প্রায় ৪৭ মিলিয়ন বর্গফুট এলাকা নিয়ে গড়ে ওঠা প্রকল্পটির ৫৫ শতাংশ জায়গা উন্মুক্ত থাকবে। প্রকল্পটি ঘিরে আধুনিক শপিং কমপ্লেক্স, আন্তর্জাতিক পাঁচ তারকা হোটেল, কৃত্রিম লেক নির্মাণ করা হবে। পরিবেশবান্ধব এই ভবনের দেয়ালে থাকবে বিশ্বের সর্বাধুনিক সোলার গ্লাস ও আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা
অন্যদিকে, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে সভায় বলা হয়েছে, পৃথিবীর অনেক দেশ এমন টাওয়ার নির্মাণ করেছে যা অহংকার করার মতো স্থাপনা। আমাদের দেশেও যদি এমন ১১১ তলাবিশিষ্ট আইকনিক টাওয়ার নির্মাণ করা যায়, সেটি হবে আমাদের গর্বের। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে কেবল আমরাই এমন সক্ষমতা দেখাতে পারব। সবদিক বিবেচনা করে জমি বরাদ্দ দেওয়াসহ আমরা অনেক দূর এগিয়েছি। বিষয়টি নিয়ে আমরা বারবার বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি দিয়েছি। কিন্তু তারা কোনো সাড়া দেয়নি— এমন যুক্তি তুলে ধরে রাজউক।
দুই পক্ষের প্রস্তাব, যুক্তি ও সিদ্ধান্তের কথা শুনে মন্ত্রিপরিষদ সচিব সভায় অংশগ্রহণকারীদের জানান, সরকারের উচ্চপর্যায়ে আলোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। জানা গেছে, এ সংক্রান্ত আরও একটি সভা শেষে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) সূত্রে জানা গেছে, পূর্বাচলের ১৯ নম্বর সেক্টরে আইকনিক টাওয়ার নির্মাণের জন্য ১১৪ একর জমি বেসরকারি কোম্পানি শিকদার গ্রুপকে বরাদ্দ দিয়েছে রাজউক। প্রতি একরের মূল্য ৩০ কোটি হিসাবে তিন হাজার ৬০০ কোটি টাকা পাবে রাজউক। ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠানটি ৪০০ কোটি টাকা রাজউককে দিয়েছে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী পূর্বাচলের আইকনিক টাওয়ারটি তিনটি ভবন নিয়ে গঠিত হবে। যার মধ্যে ১৫৫২ ফুট উচ্চতার ১১১ তলা হবে আইকনিক লিগ্যাসি টাওয়ার। এছাড়া ৭১ তলাবিশিষ্ট হবে স্বাধীনতা টাওয়ার এবং ৫২ তলার হবে ভাষা টাওয়ার।
সার্বিক বিষয় নিয়ে কথা হয় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) নগর পরিকল্পনাবিদ ও ডিটেল এরিয়া প্ল্যানের পরিচালক আশরাফুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, সচিবালয়ে এ নিয়ে বৈঠক হয়েছে। আমাদের পক্ষ থেকে আইকনিক টাওয়ার নির্মাণের পক্ষে মত দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ তাদের নিরাপত্তার যুক্তি তুলে ধরে আইকনিক টাওয়ার নির্মাণের বিপক্ষে বলেছে। এর আগেও কয়েকবার বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষর কাছে আইকনিক টাওয়ারের উচ্চতার ছাড়পত্রের জন্য চিঠি দেওয়া হয়। কিন্তু তারা কোনো সাড়া দেয়নি। যে কারণে টাওয়ারের মূল নকশার অনুমোদন এখনও হয়নি। তবে, আমরা মনে করি ১১১ তলাবিশিষ্ট এই আইকনিক টাওয়ার বিশ্বের বুকে আমাদের সম্মান ও মর্যাদা বাড়াবে।
ভাষা আন্দোলনের স্মৃতির নিদর্শন হিসেবে ৫২ তলা ভবন, মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি হিসেবে ৭১ তলা ভবন এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অগ্রযাত্রা সম্পর্কিত ৯৬ তলায় একটি জাদুঘরসহ গড়ে উঠবে দেশের সর্ব বৃহৎ ১১১ তলা ভবন। তিনটি আইকনিক ভবনের একত্রে নাম হবে বঙ্গবন্ধু ট্রাই টাওয়ার
‘পৃথিবীর বহু দেশ এমন টাওয়ার নির্মাণ করেছে। আমরাও যদি নির্মাণ করতে পারি তাহলে আমাদের দেশের অবস্থানও অনেক উপরে থাকবে। যে প্রতিষ্ঠানকে টাওয়ার নির্মাণের জন্য জায়গা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে তাদের কাছে টাওয়ারের উদ্যোগের (নির্মাণ) বিষয়ে অনেক দেশের বিনিয়োগকারীরা আগ্রহ দেখাচ্ছেন। আমরা আমাদের যুক্তিগুলো তুলে ধরেছি। আগামীতে আরও একটি সভা হবে এ বিষয়ে। তখনই মূল সিদ্ধান্ত জানা যাবে। সরকারের পক্ষ থেকে যে সিদ্ধান্ত জানানো হবে আমরা সেই নির্দেশনা মেনে পরবর্তী পদক্ষেপ নেব।’
পূর্বাচলে ১১১ তলাবিশিষ্ট আইকনিক টাওয়ার নির্মাণের বিষয়ে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট- আইপিডি’র নির্বাহী পরিচালক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক পরিকল্পনাবিদ আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, যেখানে বলা হচ্ছে এই টাওয়ার নির্মাণ করলে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে উড়োজাহাজ ওঠা-নামায় সমস্যা হবে, তাহলে কেন এই আইকনিক টাওয়ার রাজউককে নির্মাণ করতে হবে? তারা বলছে, এই টাওয়ার নির্মাণ হলে বিশ্বের কাছে বাংলাদেশ উপস্থাপিত হবে, নিজস্ব আইডেনটিটি তৈরি হবে। দেশের আইডেনটিটি তৈরির জন্য আরও অনেক মাধ্যম আছে। আমরা সেগুলো করতে পারি।
‘বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ যেখানে যুক্তিসহকারে দেখিয়ে দিচ্ছে এই টাওয়ার নির্মাণের ফলে উড়োজাহাজ ওঠা-নামায় সমস্যা হবে, তাহলে কেন আবার এই টাওয়ার নির্মাণ করতে চায় রাজউক?’
‘আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী বিমানবন্দরের ১৫ কিলোমিটারের মধ্যে ৫০০ ফুটের বেশি উঁচু ভবন থাকতে পারবে না। যদি এই টাওয়ার নির্মাণ হয় তাহলে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে উড়োজাহাজের ওঠা-নামার পথ পরিবর্তন করতে হবে। এতে জ্বালানির ব্যয়সহ অন্যান্য খরচও বাড়বে। নিরাপত্তার ঝুঁকি তো আছেই। সবকিছু বিবেচনা করে রাজউকের এই আইকনিক টাওয়ার নির্মাণের বিষয়ে আর বাড়াবাড়ি করা উচিত নয়। দেশকে রিপ্রেজেন্ট করার মতো অন্য যেসব উদ্যোগ রয়েছে সেগুলো নিয়ে কাজ করা উচিত।’
এ বিষয়ে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম. মফিদুর রহমান বলেন, এখানে যে ধরনের প্রতিবন্ধকতা রয়েছে তা আমাদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। তবে, সরকার যদি এটি করতে চায় তাহলে করতে পারবে। সেক্ষেত্রে উড়োজাহাজ চলাচলের সময় একটু বাড়বে।
‘কারণ, উচ্চতা কিছুটা বেড়ে যাবে। আস্তে আস্তে, দূরত্ব রেখে উড়োজাহাজগুলোকে নামতে হবে। সুউচ্চ ওই টাওয়ার যদি করা হয় তাহলে উড়োজাহাজ চলাচলে ট্রাফিক সিস্টেমে বেশকিছু পরিবর্তন আনতে হবে। সবকিছু আমরা ক্যাবিনেট মিটিংয়ে (মন্ত্রিসভার বৈঠক) জানিয়েছি। এখন সরকার যে সিদ্ধান্ত নেয় তা-ই হবে। আমরা আমাদের পক্ষ থেকে বিষয়গুলো জানিয়েছি।’
জানা গেছে, ভাষা আন্দোলনের স্মৃতির নিদর্শন হিসেবে ৫২ তলা ভবন, মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি হিসেবে ৭১ তলা ভবন এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অগ্রযাত্রা সম্পর্কিত ৯৬ তলায় একটি জাদুঘরসহ গড়ে উঠবে দেশের সর্ব বৃহৎ ১১১ তলা ভবন। তিনটি আইকনিক ভবনের একত্রে নাম হবে বঙ্গবন্ধু ট্রাই টাওয়ার। মোট ভূমির ৫৫ শতাংশ উন্মুক্ত রেখে করা হয়েছে মাস্টার প্ল্যান।
পূর্বাচলে সেন্ট্রাল বিজনেস ডিস্ট্রিক্ট বা সিবিডি নামে রাজউকের আইকনিক টাওয়ার নির্মাণকাজটি দরপত্রের মাধ্যমে পেয়েছে শিকদার গ্রুপ ও জাপানের কাজিমা কর্পোরেশন। প্রায় ৪৭ মিলিয়ন বর্গফুট এলাকা নিয়ে গড়ে ওঠা প্রকল্পটির ৫৫ শতাংশ জায়গা উন্মুক্ত থাকবে। প্রকল্পটি ঘিরে আধুনিক শপিং কমপ্লেক্স, আন্তর্জাতিক পাঁচ তারকা হোটেল, কৃত্রিম লেক নির্মাণ করা হবে। পরিবেশবান্ধব এই ভবনের দেয়ালে থাকবে বিশ্বের সর্বাধুনিক সোলার গ্লাস ও আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। এছাড়া অভ্যন্তরীণ যাতায়াতে থাকবে পরিবেশবান্ধব ইলেকট্রনিক বাস এবং অ্যান্ডারগ্রাউন্ড ওয়াক ওয়ে।