ঢাকা ০৩:০৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৮ অক্টোবর ২০২৪, ১৩ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

নির্বাচনে কারচুপি ও তার পরিণতি

গত এক দশকে আমরা বাংলাদেশিরা নির্বাচনে নানা ধরনের কারচুপির সঙ্গে পরিচিত হয়েছি। ২০১৪ সালে ছিল এক ধরনের একতরফা কারচুপির নির্বাচন। পরবর্তীতে অনুষ্ঠিত স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে ছিল আরেক ধরনের কারচুপির মহড়া। বস্তুত এসব স্থানীয় নির্বাচন ছিল পরবর্তী বড় ধরনের কারচুপির নির্বাচনের ‘কার্টেন ওপেনার’ বা পর্দার উন্মোচন। ওই নির্বাচনগুলো আমাদেরকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে, আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে অকার্যকর করে তুলেছে এবং একটি স্বৈরাচারী সরকার প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করেছে, যার ফলে ক্ষমতাসীনদের প্রতি ব্যাপক জনরোষ সৃষ্টি হয়েছে। এরই পরিণতিতে ৫ই আগস্ট ২০২৪ তারিখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটেছে এবং কর্তৃত্ববাদী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিবেশী দেশ ভারতে পালাতে বাধ্য হয়েছেন।

সাপ্তাহিত রাজনৈতিক ম্যাগাজিন জনতার চোখে ড. বদিউল আলম মজুমদারের লেখা বিশেষ রচনায় বিষয়টি উঠে আসে।

২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে অনুষ্ঠিত সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলো ছিল পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনের কারচুপির মহড়া ও ক্ষমতাসীনদের অসদুপায়ে ক্ষমতায় টিকে থাকার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। স্বভাবতই খুলনা সিটি নির্বাচনের মধ্যদিয়ে পাঁচটি সিটি করপোরেশনে ‘ম্যানেজড’ বা নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, যাকে বর্তমান লেখক ‘খুলনা মডেল’ বলে আখ্যায়িত করেন। সেই নির্বাচনের বৈশিষ্ট্যগুলো ছিল:

১. নির্বাচনের আগে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা করার জন্য পুলিশকে ব্যবহার করা হয়। এসব মামলার মাধ্যমে তাদের ঘরছাড়া করা হয়, যাতে তারা তাদের দলীয় প্রার্থীদের পক্ষে প্রচার চালাতে না পারেন। ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মধ্যে গাজীপুরে বিরোধী নেতাকর্মীদের ব্যাপারে তৎকালীন এসপি (পরবর্তীতে ‘ভাতের হোটেল’ খ্যাত ডিবি) হারুনের নেতৃত্বে পুলিশ সবচেয়ে বেশি আগ্রাসী ছিল।

২. বিএনপি’র প্রার্থীদের নির্বাচনী এজেন্টদের হুমকি দিয়ে নির্বাচনের দিন ভোটকেন্দ্র থেকে দূরে রাখা বা জোরপূর্বক তাড়িয়ে দেয়া হয়। তাদের কাউকে কাউকে নির্বাচনের দিনে কারাগারেও আটকে রাখা হয়।

৩. ভোটের দিন ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা ভোটকেন্দ্রের সামনে জড়ো হয়ে বিরোধী রাজনৈতিক দলের সমর্থকদের ভোট দিতে আসতে বাধা সৃষ্টির লক্ষ্যে ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করে।

৪. দুর্বৃত্তরা আকস্মিকভাবে এসে নির্ধারিত ভোটকেন্দ্র দখল করে এবং স্ট্যাম্প করা ব্যালট দিয়ে ব্যালট বাক্স ভর্তি করে দ্রুত পালিয়ে যায়। তবে বরিশালের সিটি করপোরেশন নির্বাচন ছিল ব্যতিক্রম, যেখানে ভোট গ্রহণের শুরু থেকেই ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকরা সব ভোটকেন্দ্র দখলে নেয়। এমনকি প্রয়াত নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের উদ্যোগে নির্বাচন কমিশনও সেখানে ভোটগ্রহণ বন্ধের ব্যাপারে ফাইল চালাচালি করেছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার সহকর্মীদের বিরোধিতার কারণে তা সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি।

৫. পক্ষপাতদুষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে ২০১৭ সালে কৌশল করে গঠিত নূরুল হুদা কমিশন জেল-জরিমানা হওয়ার মতো নির্বাচনী অপরাধের বিষয়ে সম্পূর্ণ উদাসীনতা প্রদর্শন করে।

৬. বিরোধী দল থেকে নির্বাচিত কয়েকজন মেয়রকে মামলা দিয়ে হয়রানি করা হয় এবং এদের মধ্যে কয়েকজনকে কারাগারেও পাঠানো হয়। তারা সরকারি বরাদ্দ প্রাপ্তি থেকেও বঞ্চিত হন, ফলে তারা তাদের নগরে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন করতে পারেননি। এমনি প্রেক্ষাপটে প্রচারণা চালানো হয় যে, এলাকার উন্নয়ন চাইলে আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে ভোট দিতে হবে।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত এই পাঁচটি সিটি করপোরেশনের সব নির্বাচনই অংশগ্রহণমূলক ছিল। বিএনপিসহ অন্যান্য দল এগুলোতে অংশগ্রহণ করেছিল। কিন্তু কারচুপির কারণে সেগুলো প্রতিযোগিতামূলক হয়নি। ফলে সিলেট ছাড়া সব সিটিতেই বিএনপি’র মেয়র প্রার্থীরা হেরে যান। উল্লেখ্য, সিলেটের নির্বাচনে কারচুপি করেও বিএনপি’র বিদায়ী মেয়রকে হারানো যায়নি।

এসব সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তিক্ত অভিজ্ঞতা এবং কয়েক বছর ধরে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যাপক দলীয়করণের কারণে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি। মূলত ২০১১ সালের ৩০শে জুন একতরফা ও অসাংবিধানিকভাবে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাসের মাধ্যমে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিধান ফিরিয়ে আনার কারণে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠেয় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার বিষয়ে দলটি অনড় অবস্থান নেয়।

বিএনপি এবং অন্যান্য দলের ২০১৮ সালের নির্বাচনকে বর্জন করার হুমকির প্রেক্ষাপটে ক্ষমতাসীন দল তাদের পূর্ব-পরীক্ষিত নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনের খুলনা মডেলে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনে। সে পরিবর্তনগুলো ছিল:

১. নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ করেন। সংলাপে তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা হিসেবে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হওয়ার নিশ্চয়তা দেন।

২. নির্বাচনী প্রক্রিয়ার শুরুতে ক্ষমতাসীন দলের কর্মীরা অনেক ক্ষেত্রে পুলিশের মদতে বিএনপি’র উদ্যোগে এবং ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে গঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতাকর্মীদের ওপর সহিংস হামলা চালায়। তাদের প্রচার-প্রচারণা চালাতে বাধা দেয়। চরম ভীতিকর পরিস্থিতির কারণে ঐক্যফ্রন্টের কিছু প্রার্থী নিজ এলাকায় নির্বাচনী প্রচারেও যেতে পারেননি।

৩. মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া চলাকালে নির্বাচন কমিশন ৭৮৬ জনের মনোনয়নপত্র বাতিল করে, যাদের প্রায় সবাই ছিলেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী।

৪. আদালত বেগম খালেদা জিয়াসহ জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অনেক প্রার্থীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য অযোগ্য ঘোষণা করেন, যদিও শুধু সেসব ক্ষেত্রেই আদালতের হস্তক্ষেপ করার সুযোগ রয়েছে, যেখানে মামলার বিষয়টি ‘কোরাম নন-জুডিস’ (এখতিয়ার বহির্ভূত) এবং ‘ম্যালিস ইন ল’ (অবৈধ)-সম্পর্কিত। আদালতের এমন হস্তক্ষেপের কারণে ৩০০ সংসদীয় আসনের মধ্যে ২০১৮ সালের নির্বাচনে ১৮টিতে ঐক্যফ্রন্টের কোনো প্রার্থী ছিল না।

৫. নির্বাচনের দিনে দায়িত্ব পরিচালনার জন্য যাদের নিয়োগ দেয়া হয়েছিল পুলিশ নির্বাচনের আগেই তাদের বাড়িতে গিয়ে ক্ষমতাসীন দলের প্রতি তাদের আনুগত্য আছে কিনা, তা নিশ্চিত করেছিল।

৬. বিএনপি ও তার সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে পুলিশ অসংখ্য মিথ্যা মামলা দায়ের করে, যাতে নির্বাচনের দিনে তারা হয় জেলে, না হয় নিজ নির্বাচনী এলাকার বাইরে থাকতে বাধ্য হয়। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকায় দায়ের করা এ রকম ৫০টি মামলার বিষয়ে ‘ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর’ শিরোনামে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে প্রথম আলো এগুলোকে গায়েবি মামলা বলে দাবি করে।

৭. ক্ষমতাসীন দলের কর্মী-সমর্থকরা, সরকারি কর্মকর্তাদের একটি অংশ এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা নির্বাচন কমিশনের যোগসাজশে নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালট পেপারে স্টাম্প মেরে সেগুলো দিয়ে ব্যালট বাক্স ভর্তি করে রাখে। ভোটের দিন সকালে ‘বিবিসি বাংলা’ ব্যালট পেপার ভর্তি করা বাক্সের একটি ছবি প্রদর্শন করে।

৮. নির্বাচনের দিন ক্ষমতাসীন দলের কর্মীরা বিভিন্ন কেন্দ্র দখল করে নৌকার পক্ষে ব্যালট পেপারে স্ট্যাম্প মেরে ব্যালট বাক্স ভর্তি করে। ‘ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)’ ৫০টি নির্বাচনী এলাকায় পরিচালিত সমীক্ষায় ভোটের আগের রাতে ৩৩টি আসনে ব্যালট বাক্স ভর্তি এবং ভোটের দিন ৩০টি আসনে ভোটকেন্দ্র দখল করে প্রকাশ্যে সিল মেরে জাল ভোট দেয়ার প্রমাণ তুলে ধরে।

৯. নির্বাচন কমিশন নির্বাচনী দায়িত্ব পালনের সময় সাবেক সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ সাংবাদিকদেরকে ‘মূর্তির’ মতো দাঁড়িয়ে থাকার নির্দেশ দেয়ার মাধ্যমে গণমাধ্যমের নির্বাচনী প্রতিবেদন তৈরির কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।

১০. ভোটগ্রহণ শেষে ব্যালট গণনা ছাড়াই ফলাফল ঘোষণার আলামত পাওয়া যায়। দু’টি নির্বাচনী এলাকায় প্রাথমিকভাবে ঘোষিত ফলাফল শতভাগের বেশি ভোটার উপস্থিতির হার দেখানো হয়, যা পরে সংশোধন করা হয়। প্রাথমিকভাবে ঘোষিত ফলাফলের ভিত্তিতে প্রতিবেদন প্রকাশ করায় সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করা হয়।

১১. ২০১৮ সালের ৩০শে ডিসেম্বরের বিতর্কিত নির্বাচনের পর ঘোষিত ফলাফল বানোয়াট বলে অভিযোগ ওঠে। ‘সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক’-এর তথ্য অধিকার আইনের আওতায় আবেদন করে বহু কাঠখড় পুড়িয়ে নির্বাচন কমিশন থেকে প্রাপ্ত কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফলের বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায় যে, ২১৩টি কেন্দ্রে প্রদত্ত ভোটের হার শতভাগ এবং ৫৮৬টি কেন্দ্রে সবক’টি ভোট পড়েছে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকে। এ ছাড়া ১ হাজার ১৭৭টি কেন্দ্রে বিএনপি, এমনকি দু’টি কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন দলও শূন্য ভোট পায়। ভোটে কারচুপি এবং ব্যালট গণনা ছাড়াই ফলাফল ঘোষণার কারণেই এসব অসঙ্গতি ঘটেছে।

১২. একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে বাংলাদেশে আসার জন্য কোনো নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষককে সরকার ভিসা প্রদানে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে। তবে ‘সার্ক হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন’ নামে একটি পক্ষপাতদুষ্ট সংস্থা কানাডা, ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কাসহ কয়েকজন বিদেশিকে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে নিয়ে আসে। ওই দলের সদস্য কানাডার তানিয়া ফস্টার ভোটের দিন গণমাধ্যমের কাছে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে বলে দাবি করেন, যা পরে তিনি প্রত্যাহার করে নেন।

উপরিউক্ত কারসাজির কারণে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হলেও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হয়নি। প্রকৃতপক্ষে এটি স্পষ্টভাবেই ভয়াবহ কারচুপির নির্বাচন ছিল, যার ফলে ক্ষমতাসীন দলের জন্য একতরফা বিজয় অর্জন সম্ভব হয়। ৩০০টি নির্বাচনী এলাকার মধ্যে ক্ষমতাসীন জোট ২৮৯টিতে জয়ী হয়, বিএনপি পায় মাত্র ছয়টি আসন।

২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচন এবং তার আগে সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে বিএনপি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে ভবিষ্যতের সব নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নেয়। দলটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনরুদ্ধারের দাবিতেও অনড় থাকে, যা সরকারের জন্য অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সর্বোপরি দুর্নীতি, অর্থ পাচার, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং জনগণের নাগরিক অধিকার হরণের মাধ্যমে নাগরিকদের ব্যাপক অসন্তোষের কারণেও সরকার চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। এই চ্যালেঞ্জগুলোর মুখোমুখি হয়ে সরকার এবং ক্ষমতাসীন দল আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বহু পরীক্ষিত নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনের খুলনা মডেল, কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সাপেক্ষে, অনুসরণের সিদ্ধান্ত নেয়। পরিবর্তিত খুলনা মডেল অনুসরণে পরবর্তী নির্বাচনে গৃহীত পদক্ষেপগুলো হলো:

১. সরকার ‘নির্বাচন কমিশনার এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন-২০২২’ লঙ্ঘন করে অনুগত ব্যক্তিদের নিয়ে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে আউয়াল কমিশন গঠন করে। ওই আইনের ৪ (১) ধারায় শুধু রাজনৈতিক দল ও পেশাজীবী সংগঠনকে নির্বাচন কমিশনের নিয়োগের জন্য নাম প্রস্তাবের এখতিয়ার দেয়া হয়। কিন্তু ৫ই ফেব্রুয়ারি ২০২২-এ গঠিত অনুসন্ধান কমিটি যেকোনো ব্যক্তিকে অন্যের, এমনকি নিজের নামও নির্বাচন কমিশনে নিয়োগের জন্য প্রস্তাবের সুযোগ করে দেয়, যা ছিল আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। ফলে আইনগতভাবে অযোগ্য অনেক ব্যক্তিই নির্বাচন কমিশনে নিয়োগের জন্য নাম প্রস্তাব করে। উদাহরণস্বরূপ, প্রয়াত ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী সিইসি পদের জন্য হাবিবুল আউয়ালের নাম প্রস্তাব করেন, যদিও তিনি আইনগতভাবে তা করতে যোগ্য ছিলেন না। তাই এটি সুস্পষ্ট যে, আউয়াল কমিশন গঠিত হয়েছে আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে। প্রশ্নবিদ্ধ বৈধতা নিয়ে গঠিত নির্বাচন কমিশনের নির্বাচনী তফসিল ঘোষণাসহ সব কার্যক্রমের আইনি বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ হতে বাধ্য। প্রসঙ্গত, অনুসন্ধান কমিটির অন্তত একজন সদস্য, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ছহুল হোসেনের- যিনি গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রার্থী ছিলেন- নিরপেক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।

২. নির্বাচন কমিশন অন্যান্য সক্রিয় রাজনৈতিক দলকে উপেক্ষা করে কয়েকটি ‘কিংস পার্টি’কে নিবন্ধন দেয়। কমিশনের এই উদ্যোগ মূলত ছিল বিএনপিকে ভাঙার একটি অশুভ কৌশলের অংশ, যার মাধ্যমে দলটির নেতাদের এসব নামসর্বস্ব দলে যোগ দিতে প্রলুব্ধ করা হয়।

৩. সরকার পক্ষপাতদুষ্ট ব্যক্তিদের নিয়োগ দিয়ে সব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান দখল করে নেয় এবং এগুলোতে অযোগ্য এবং অনেক ক্ষেত্রে দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিদেরকে নিয়োগ দেয়।

৪. ২৮শে অক্টোবরের সহিংসতাকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে পুলিশ কয়েক ডজন মামলা দায়ের করে কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতাসহ বিএনপি’র প্রায় ২৫ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার এবং অনেককে ঘরছাড়া করে। বিএনপিকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে দূরে রাখার জন্যই এসব মামলা এবং গ্রেপ্তার করা হয়। তাই তারা চাইলেও ৩০শে নভেম্বরের মধ্যে মনোনয়নপত্র দাখিল করা বিএনপি’র পক্ষে সম্ভব হতো না।

৫. নির্বাচন কমিশন ঘোষণা দেয় যে, তারা রাজনৈতিক হয়রানির দায় নেবে না, যা বিএনপিকে আরও দমন ও হয়রানি করতে পুলিশকে উৎসাহিত করে।

৬. নির্বাচন কমিশন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে ৭ই জানুয়ারির তথাকথিত নির্বাচনের বিরোধিতাকারীদের সব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে অনুরোধ করে, যা ছিল নাগরিকদের মৌলিক অধিকার তথা ভিন্নমত পোষণের অধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

৭. নির্বাচনকালীন সময়ে নিরাপত্তা সংস্থার হুমকি ও ভয়ভীতি ভয়াবহ আকার ধারণ করে, সাইবার নিরাপত্তা আইনের মতো নিবর্তনমূলক আইনের ব্যবহার বৃদ্ধি পায় এবং সরকার গণমাধ্যমকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে।

৮. সরকার বিভিন্ন বিধিনিষেধ, দমনমূলক আইন এবং ভয়ের সংস্কৃতি তৈরির মাধ্যমে নাগরিক সমাজের ভূমিকাকে মারাত্মকভাবে সংকুচিত করে। প্রকৃতপক্ষে সরকারি নিয়ন্ত্রণের কারণে নাগরিক সমাজ বহুলাংশে অকার্যকর এবং নির্বাচনকালীন সময়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে অপারগ হয়ে পড়ে।

৯. সরকার দ্রুততার সঙ্গে অনেক মামলার বিচার করে, যার অধিকাংশই ছিল ভুয়া মামলা। অনেক আগে দায়ের করা এসব মামলায় বিএনপি’র নেতাকর্মীদের শাস্তি প্রদান করা হয়। গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এসময়ে ঢাকার বিভিন্ন আদালতে দেড় হাজারের বেশি ব্যক্তিকে- যাদের অধিকাংশই ছিলেন বিএনপি নেতাকর্মী। তাদের দোষী সাব্যস্ত করে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়। ফলে তাদের অধিকাংশই সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার অযোগ্য হয়ে পড়েন।

১০. গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের কিছু এলাকায় স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের কাছে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচির সুবিধাভোগীদেরকে তাদের কার্ড জমা দিতে এবং ভোট দেয়ার পরে সেগুলো সংগ্রহ করতে বলা হয়। এ ছাড়া ভোট না দিলে তাদের ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেয়ার হুমকিও দেয়া হয়। এসবের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের ভোট দেয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করা এবং ভোটদানের হার বৃদ্ধি করার প্রচেষ্টা চালানো হয়।

বিএনপিকে প্রতিদ্বন্দ্বিতার বাইরে রাখতে এবং আসন্ন নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের বিজয় নিশ্চিত করার জন্য উপরিউক্ত নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনী কৌশল ব্যবহার করা হয়। এটি ছিল এমন একটি কৌশল যেখানে নিয়মিত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, কিন্তু কোনো প্রতিযোগিতা থাকবে না। ফলে নির্বাচনে ক্ষমতাসীনদের জয় সুনিশ্চিত হবে।

তবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ৭ই জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনকে ‘প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক’ করার জন্য একটি বিশেষ কৌশল অবলম্বন করে। তারা নিজ দলের ডামি ও ‘স্বতন্ত্র’ প্রার্থীদের দিয়ে এবং জোটের শরিকদের নৌকা প্রতীক দিয়ে নির্বাচনী খেলা জমিয়ে তোলার চেষ্টা চালায়। জাতীয় পার্টিসহ অন্য দলগুলোর সঙ্গে কিছু আসন ভাগাভাগি করে নির্বাচনকে প্রতিযোগিতামূলক করে তোলার চেষ্টাও চালানো হয়। এ কৌশলের কারণে যারাই নির্বাচনে জিতবে তারাই হয় আওয়ামী লীগ দলভুক্ত অথবা তাদের প্রতি অনুগত হবে। অর্থাৎ ২০২৪ সালের ৭ই জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছিল পুরোপুরি পাতানো। প্রসঙ্গত, এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের তার নিজ দলের মনোনীত প্রার্থীদের সঙ্গে নিজ দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অনুমতি প্রদান ছিল দলীয় গঠনতন্ত্রের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

নির্বাচন কমিশনের তথ্যানুযায়ী, ৫৩টি অদ্যাবধি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের মধ্যে ২৮টি দলের মোট ১ হাজার ৯৭০ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে, যার মধ্যে ৪৩৬ জন ছিল স্বতন্ত্র প্রার্থী। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২২৪টি ও নিজ দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ৬২টি আসনে জয়লাভ করে। এ ছাড়াও আওয়ামী লীগের জোটসঙ্গী হিসেবে জাতীয় পার্টি ১১টি, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি ১টি, ওয়ার্কার্স পার্টি ১টি এবং জাসদ ১টি করে আসনে জয়লাভ করে। সরকারের পক্ষ থেকে প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, আদালত ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করে বিরোধী দলসমূহের ওপর ধারাবাহিকভাবে দমন-পীড়নের স্টিমরোলার চালানোর ফলেই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এমন ফলাফল সৃষ্টি হয়েছে।

পাতানো দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আমরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলাম যে, আরেকটি বিতর্কিত নির্বাচন আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থাকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেবে, যা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের, এমনকি জাতির জন্যও চরম বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। নির্বাচনের পরে নতুন সরকার তার বৈধতার সংকট কাটিয়ে উঠতে বিদেশি মিত্রদের ওপর আরও বেশি নির্ভরশীল হয়ে ওঠতে পারে, যা আমাদের সার্বভৌমত্বকে ঝুঁকিতে ফেলতে পারে। এ ছাড়া তৃতীয়বারের মতো নাগরিকদের ভোটাধিকার বঞ্চিত করা হলে তা ভবিষ্যতে সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক জনরোষে পরিণত হতে পারে। নিঃসন্দেহে এমন আশঙ্কা ক্ষমতাসীনদের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে না। কারণ জনগণের বৈষম্যের শিকার ও ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ার বোধ থেকেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয়েছিল। সৌভাগ্যবশত আমাদের এমন আশঙ্কা অক্ষরে অক্ষরে সত্যে পরিণত হয়েছে গত ৫ই আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারতে পলায়নের মাধ্যমে।

Tag :

আপনার মতামত লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল ও অন্যান্য তথ্য সঞ্চয় করে রাখুন

জনপ্রিয় সংবাদ

নির্বাচনে কারচুপি ও তার পরিণতি

আপডেট সময় ০১:৫৮:০১ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৮ অক্টোবর ২০২৪

গত এক দশকে আমরা বাংলাদেশিরা নির্বাচনে নানা ধরনের কারচুপির সঙ্গে পরিচিত হয়েছি। ২০১৪ সালে ছিল এক ধরনের একতরফা কারচুপির নির্বাচন। পরবর্তীতে অনুষ্ঠিত স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে ছিল আরেক ধরনের কারচুপির মহড়া। বস্তুত এসব স্থানীয় নির্বাচন ছিল পরবর্তী বড় ধরনের কারচুপির নির্বাচনের ‘কার্টেন ওপেনার’ বা পর্দার উন্মোচন। ওই নির্বাচনগুলো আমাদেরকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে, আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে অকার্যকর করে তুলেছে এবং একটি স্বৈরাচারী সরকার প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করেছে, যার ফলে ক্ষমতাসীনদের প্রতি ব্যাপক জনরোষ সৃষ্টি হয়েছে। এরই পরিণতিতে ৫ই আগস্ট ২০২৪ তারিখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটেছে এবং কর্তৃত্ববাদী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিবেশী দেশ ভারতে পালাতে বাধ্য হয়েছেন।

সাপ্তাহিত রাজনৈতিক ম্যাগাজিন জনতার চোখে ড. বদিউল আলম মজুমদারের লেখা বিশেষ রচনায় বিষয়টি উঠে আসে।

২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে অনুষ্ঠিত সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলো ছিল পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনের কারচুপির মহড়া ও ক্ষমতাসীনদের অসদুপায়ে ক্ষমতায় টিকে থাকার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। স্বভাবতই খুলনা সিটি নির্বাচনের মধ্যদিয়ে পাঁচটি সিটি করপোরেশনে ‘ম্যানেজড’ বা নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, যাকে বর্তমান লেখক ‘খুলনা মডেল’ বলে আখ্যায়িত করেন। সেই নির্বাচনের বৈশিষ্ট্যগুলো ছিল:

১. নির্বাচনের আগে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা করার জন্য পুলিশকে ব্যবহার করা হয়। এসব মামলার মাধ্যমে তাদের ঘরছাড়া করা হয়, যাতে তারা তাদের দলীয় প্রার্থীদের পক্ষে প্রচার চালাতে না পারেন। ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মধ্যে গাজীপুরে বিরোধী নেতাকর্মীদের ব্যাপারে তৎকালীন এসপি (পরবর্তীতে ‘ভাতের হোটেল’ খ্যাত ডিবি) হারুনের নেতৃত্বে পুলিশ সবচেয়ে বেশি আগ্রাসী ছিল।

২. বিএনপি’র প্রার্থীদের নির্বাচনী এজেন্টদের হুমকি দিয়ে নির্বাচনের দিন ভোটকেন্দ্র থেকে দূরে রাখা বা জোরপূর্বক তাড়িয়ে দেয়া হয়। তাদের কাউকে কাউকে নির্বাচনের দিনে কারাগারেও আটকে রাখা হয়।

৩. ভোটের দিন ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা ভোটকেন্দ্রের সামনে জড়ো হয়ে বিরোধী রাজনৈতিক দলের সমর্থকদের ভোট দিতে আসতে বাধা সৃষ্টির লক্ষ্যে ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করে।

৪. দুর্বৃত্তরা আকস্মিকভাবে এসে নির্ধারিত ভোটকেন্দ্র দখল করে এবং স্ট্যাম্প করা ব্যালট দিয়ে ব্যালট বাক্স ভর্তি করে দ্রুত পালিয়ে যায়। তবে বরিশালের সিটি করপোরেশন নির্বাচন ছিল ব্যতিক্রম, যেখানে ভোট গ্রহণের শুরু থেকেই ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকরা সব ভোটকেন্দ্র দখলে নেয়। এমনকি প্রয়াত নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের উদ্যোগে নির্বাচন কমিশনও সেখানে ভোটগ্রহণ বন্ধের ব্যাপারে ফাইল চালাচালি করেছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার সহকর্মীদের বিরোধিতার কারণে তা সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি।

৫. পক্ষপাতদুষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে ২০১৭ সালে কৌশল করে গঠিত নূরুল হুদা কমিশন জেল-জরিমানা হওয়ার মতো নির্বাচনী অপরাধের বিষয়ে সম্পূর্ণ উদাসীনতা প্রদর্শন করে।

৬. বিরোধী দল থেকে নির্বাচিত কয়েকজন মেয়রকে মামলা দিয়ে হয়রানি করা হয় এবং এদের মধ্যে কয়েকজনকে কারাগারেও পাঠানো হয়। তারা সরকারি বরাদ্দ প্রাপ্তি থেকেও বঞ্চিত হন, ফলে তারা তাদের নগরে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন করতে পারেননি। এমনি প্রেক্ষাপটে প্রচারণা চালানো হয় যে, এলাকার উন্নয়ন চাইলে আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে ভোট দিতে হবে।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত এই পাঁচটি সিটি করপোরেশনের সব নির্বাচনই অংশগ্রহণমূলক ছিল। বিএনপিসহ অন্যান্য দল এগুলোতে অংশগ্রহণ করেছিল। কিন্তু কারচুপির কারণে সেগুলো প্রতিযোগিতামূলক হয়নি। ফলে সিলেট ছাড়া সব সিটিতেই বিএনপি’র মেয়র প্রার্থীরা হেরে যান। উল্লেখ্য, সিলেটের নির্বাচনে কারচুপি করেও বিএনপি’র বিদায়ী মেয়রকে হারানো যায়নি।

এসব সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তিক্ত অভিজ্ঞতা এবং কয়েক বছর ধরে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যাপক দলীয়করণের কারণে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি। মূলত ২০১১ সালের ৩০শে জুন একতরফা ও অসাংবিধানিকভাবে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাসের মাধ্যমে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিধান ফিরিয়ে আনার কারণে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠেয় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার বিষয়ে দলটি অনড় অবস্থান নেয়।

বিএনপি এবং অন্যান্য দলের ২০১৮ সালের নির্বাচনকে বর্জন করার হুমকির প্রেক্ষাপটে ক্ষমতাসীন দল তাদের পূর্ব-পরীক্ষিত নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনের খুলনা মডেলে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনে। সে পরিবর্তনগুলো ছিল:

১. নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ করেন। সংলাপে তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা হিসেবে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হওয়ার নিশ্চয়তা দেন।

২. নির্বাচনী প্রক্রিয়ার শুরুতে ক্ষমতাসীন দলের কর্মীরা অনেক ক্ষেত্রে পুলিশের মদতে বিএনপি’র উদ্যোগে এবং ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে গঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতাকর্মীদের ওপর সহিংস হামলা চালায়। তাদের প্রচার-প্রচারণা চালাতে বাধা দেয়। চরম ভীতিকর পরিস্থিতির কারণে ঐক্যফ্রন্টের কিছু প্রার্থী নিজ এলাকায় নির্বাচনী প্রচারেও যেতে পারেননি।

৩. মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া চলাকালে নির্বাচন কমিশন ৭৮৬ জনের মনোনয়নপত্র বাতিল করে, যাদের প্রায় সবাই ছিলেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী।

৪. আদালত বেগম খালেদা জিয়াসহ জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অনেক প্রার্থীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য অযোগ্য ঘোষণা করেন, যদিও শুধু সেসব ক্ষেত্রেই আদালতের হস্তক্ষেপ করার সুযোগ রয়েছে, যেখানে মামলার বিষয়টি ‘কোরাম নন-জুডিস’ (এখতিয়ার বহির্ভূত) এবং ‘ম্যালিস ইন ল’ (অবৈধ)-সম্পর্কিত। আদালতের এমন হস্তক্ষেপের কারণে ৩০০ সংসদীয় আসনের মধ্যে ২০১৮ সালের নির্বাচনে ১৮টিতে ঐক্যফ্রন্টের কোনো প্রার্থী ছিল না।

৫. নির্বাচনের দিনে দায়িত্ব পরিচালনার জন্য যাদের নিয়োগ দেয়া হয়েছিল পুলিশ নির্বাচনের আগেই তাদের বাড়িতে গিয়ে ক্ষমতাসীন দলের প্রতি তাদের আনুগত্য আছে কিনা, তা নিশ্চিত করেছিল।

৬. বিএনপি ও তার সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে পুলিশ অসংখ্য মিথ্যা মামলা দায়ের করে, যাতে নির্বাচনের দিনে তারা হয় জেলে, না হয় নিজ নির্বাচনী এলাকার বাইরে থাকতে বাধ্য হয়। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকায় দায়ের করা এ রকম ৫০টি মামলার বিষয়ে ‘ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর’ শিরোনামে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে প্রথম আলো এগুলোকে গায়েবি মামলা বলে দাবি করে।

৭. ক্ষমতাসীন দলের কর্মী-সমর্থকরা, সরকারি কর্মকর্তাদের একটি অংশ এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা নির্বাচন কমিশনের যোগসাজশে নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালট পেপারে স্টাম্প মেরে সেগুলো দিয়ে ব্যালট বাক্স ভর্তি করে রাখে। ভোটের দিন সকালে ‘বিবিসি বাংলা’ ব্যালট পেপার ভর্তি করা বাক্সের একটি ছবি প্রদর্শন করে।

৮. নির্বাচনের দিন ক্ষমতাসীন দলের কর্মীরা বিভিন্ন কেন্দ্র দখল করে নৌকার পক্ষে ব্যালট পেপারে স্ট্যাম্প মেরে ব্যালট বাক্স ভর্তি করে। ‘ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)’ ৫০টি নির্বাচনী এলাকায় পরিচালিত সমীক্ষায় ভোটের আগের রাতে ৩৩টি আসনে ব্যালট বাক্স ভর্তি এবং ভোটের দিন ৩০টি আসনে ভোটকেন্দ্র দখল করে প্রকাশ্যে সিল মেরে জাল ভোট দেয়ার প্রমাণ তুলে ধরে।

৯. নির্বাচন কমিশন নির্বাচনী দায়িত্ব পালনের সময় সাবেক সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ সাংবাদিকদেরকে ‘মূর্তির’ মতো দাঁড়িয়ে থাকার নির্দেশ দেয়ার মাধ্যমে গণমাধ্যমের নির্বাচনী প্রতিবেদন তৈরির কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।

১০. ভোটগ্রহণ শেষে ব্যালট গণনা ছাড়াই ফলাফল ঘোষণার আলামত পাওয়া যায়। দু’টি নির্বাচনী এলাকায় প্রাথমিকভাবে ঘোষিত ফলাফল শতভাগের বেশি ভোটার উপস্থিতির হার দেখানো হয়, যা পরে সংশোধন করা হয়। প্রাথমিকভাবে ঘোষিত ফলাফলের ভিত্তিতে প্রতিবেদন প্রকাশ করায় সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করা হয়।

১১. ২০১৮ সালের ৩০শে ডিসেম্বরের বিতর্কিত নির্বাচনের পর ঘোষিত ফলাফল বানোয়াট বলে অভিযোগ ওঠে। ‘সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক’-এর তথ্য অধিকার আইনের আওতায় আবেদন করে বহু কাঠখড় পুড়িয়ে নির্বাচন কমিশন থেকে প্রাপ্ত কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফলের বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায় যে, ২১৩টি কেন্দ্রে প্রদত্ত ভোটের হার শতভাগ এবং ৫৮৬টি কেন্দ্রে সবক’টি ভোট পড়েছে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকে। এ ছাড়া ১ হাজার ১৭৭টি কেন্দ্রে বিএনপি, এমনকি দু’টি কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন দলও শূন্য ভোট পায়। ভোটে কারচুপি এবং ব্যালট গণনা ছাড়াই ফলাফল ঘোষণার কারণেই এসব অসঙ্গতি ঘটেছে।

১২. একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে বাংলাদেশে আসার জন্য কোনো নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষককে সরকার ভিসা প্রদানে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে। তবে ‘সার্ক হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন’ নামে একটি পক্ষপাতদুষ্ট সংস্থা কানাডা, ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কাসহ কয়েকজন বিদেশিকে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে নিয়ে আসে। ওই দলের সদস্য কানাডার তানিয়া ফস্টার ভোটের দিন গণমাধ্যমের কাছে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে বলে দাবি করেন, যা পরে তিনি প্রত্যাহার করে নেন।

উপরিউক্ত কারসাজির কারণে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হলেও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হয়নি। প্রকৃতপক্ষে এটি স্পষ্টভাবেই ভয়াবহ কারচুপির নির্বাচন ছিল, যার ফলে ক্ষমতাসীন দলের জন্য একতরফা বিজয় অর্জন সম্ভব হয়। ৩০০টি নির্বাচনী এলাকার মধ্যে ক্ষমতাসীন জোট ২৮৯টিতে জয়ী হয়, বিএনপি পায় মাত্র ছয়টি আসন।

২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচন এবং তার আগে সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে বিএনপি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে ভবিষ্যতের সব নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নেয়। দলটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনরুদ্ধারের দাবিতেও অনড় থাকে, যা সরকারের জন্য অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সর্বোপরি দুর্নীতি, অর্থ পাচার, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং জনগণের নাগরিক অধিকার হরণের মাধ্যমে নাগরিকদের ব্যাপক অসন্তোষের কারণেও সরকার চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। এই চ্যালেঞ্জগুলোর মুখোমুখি হয়ে সরকার এবং ক্ষমতাসীন দল আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বহু পরীক্ষিত নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনের খুলনা মডেল, কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সাপেক্ষে, অনুসরণের সিদ্ধান্ত নেয়। পরিবর্তিত খুলনা মডেল অনুসরণে পরবর্তী নির্বাচনে গৃহীত পদক্ষেপগুলো হলো:

১. সরকার ‘নির্বাচন কমিশনার এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন-২০২২’ লঙ্ঘন করে অনুগত ব্যক্তিদের নিয়ে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে আউয়াল কমিশন গঠন করে। ওই আইনের ৪ (১) ধারায় শুধু রাজনৈতিক দল ও পেশাজীবী সংগঠনকে নির্বাচন কমিশনের নিয়োগের জন্য নাম প্রস্তাবের এখতিয়ার দেয়া হয়। কিন্তু ৫ই ফেব্রুয়ারি ২০২২-এ গঠিত অনুসন্ধান কমিটি যেকোনো ব্যক্তিকে অন্যের, এমনকি নিজের নামও নির্বাচন কমিশনে নিয়োগের জন্য প্রস্তাবের সুযোগ করে দেয়, যা ছিল আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। ফলে আইনগতভাবে অযোগ্য অনেক ব্যক্তিই নির্বাচন কমিশনে নিয়োগের জন্য নাম প্রস্তাব করে। উদাহরণস্বরূপ, প্রয়াত ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী সিইসি পদের জন্য হাবিবুল আউয়ালের নাম প্রস্তাব করেন, যদিও তিনি আইনগতভাবে তা করতে যোগ্য ছিলেন না। তাই এটি সুস্পষ্ট যে, আউয়াল কমিশন গঠিত হয়েছে আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে। প্রশ্নবিদ্ধ বৈধতা নিয়ে গঠিত নির্বাচন কমিশনের নির্বাচনী তফসিল ঘোষণাসহ সব কার্যক্রমের আইনি বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ হতে বাধ্য। প্রসঙ্গত, অনুসন্ধান কমিটির অন্তত একজন সদস্য, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ছহুল হোসেনের- যিনি গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রার্থী ছিলেন- নিরপেক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।

২. নির্বাচন কমিশন অন্যান্য সক্রিয় রাজনৈতিক দলকে উপেক্ষা করে কয়েকটি ‘কিংস পার্টি’কে নিবন্ধন দেয়। কমিশনের এই উদ্যোগ মূলত ছিল বিএনপিকে ভাঙার একটি অশুভ কৌশলের অংশ, যার মাধ্যমে দলটির নেতাদের এসব নামসর্বস্ব দলে যোগ দিতে প্রলুব্ধ করা হয়।

৩. সরকার পক্ষপাতদুষ্ট ব্যক্তিদের নিয়োগ দিয়ে সব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান দখল করে নেয় এবং এগুলোতে অযোগ্য এবং অনেক ক্ষেত্রে দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিদেরকে নিয়োগ দেয়।

৪. ২৮শে অক্টোবরের সহিংসতাকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে পুলিশ কয়েক ডজন মামলা দায়ের করে কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতাসহ বিএনপি’র প্রায় ২৫ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার এবং অনেককে ঘরছাড়া করে। বিএনপিকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে দূরে রাখার জন্যই এসব মামলা এবং গ্রেপ্তার করা হয়। তাই তারা চাইলেও ৩০শে নভেম্বরের মধ্যে মনোনয়নপত্র দাখিল করা বিএনপি’র পক্ষে সম্ভব হতো না।

৫. নির্বাচন কমিশন ঘোষণা দেয় যে, তারা রাজনৈতিক হয়রানির দায় নেবে না, যা বিএনপিকে আরও দমন ও হয়রানি করতে পুলিশকে উৎসাহিত করে।

৬. নির্বাচন কমিশন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে ৭ই জানুয়ারির তথাকথিত নির্বাচনের বিরোধিতাকারীদের সব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে অনুরোধ করে, যা ছিল নাগরিকদের মৌলিক অধিকার তথা ভিন্নমত পোষণের অধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

৭. নির্বাচনকালীন সময়ে নিরাপত্তা সংস্থার হুমকি ও ভয়ভীতি ভয়াবহ আকার ধারণ করে, সাইবার নিরাপত্তা আইনের মতো নিবর্তনমূলক আইনের ব্যবহার বৃদ্ধি পায় এবং সরকার গণমাধ্যমকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে।

৮. সরকার বিভিন্ন বিধিনিষেধ, দমনমূলক আইন এবং ভয়ের সংস্কৃতি তৈরির মাধ্যমে নাগরিক সমাজের ভূমিকাকে মারাত্মকভাবে সংকুচিত করে। প্রকৃতপক্ষে সরকারি নিয়ন্ত্রণের কারণে নাগরিক সমাজ বহুলাংশে অকার্যকর এবং নির্বাচনকালীন সময়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে অপারগ হয়ে পড়ে।

৯. সরকার দ্রুততার সঙ্গে অনেক মামলার বিচার করে, যার অধিকাংশই ছিল ভুয়া মামলা। অনেক আগে দায়ের করা এসব মামলায় বিএনপি’র নেতাকর্মীদের শাস্তি প্রদান করা হয়। গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এসময়ে ঢাকার বিভিন্ন আদালতে দেড় হাজারের বেশি ব্যক্তিকে- যাদের অধিকাংশই ছিলেন বিএনপি নেতাকর্মী। তাদের দোষী সাব্যস্ত করে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়। ফলে তাদের অধিকাংশই সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার অযোগ্য হয়ে পড়েন।

১০. গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের কিছু এলাকায় স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের কাছে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচির সুবিধাভোগীদেরকে তাদের কার্ড জমা দিতে এবং ভোট দেয়ার পরে সেগুলো সংগ্রহ করতে বলা হয়। এ ছাড়া ভোট না দিলে তাদের ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেয়ার হুমকিও দেয়া হয়। এসবের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের ভোট দেয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করা এবং ভোটদানের হার বৃদ্ধি করার প্রচেষ্টা চালানো হয়।

বিএনপিকে প্রতিদ্বন্দ্বিতার বাইরে রাখতে এবং আসন্ন নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের বিজয় নিশ্চিত করার জন্য উপরিউক্ত নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনী কৌশল ব্যবহার করা হয়। এটি ছিল এমন একটি কৌশল যেখানে নিয়মিত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, কিন্তু কোনো প্রতিযোগিতা থাকবে না। ফলে নির্বাচনে ক্ষমতাসীনদের জয় সুনিশ্চিত হবে।

তবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ৭ই জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনকে ‘প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক’ করার জন্য একটি বিশেষ কৌশল অবলম্বন করে। তারা নিজ দলের ডামি ও ‘স্বতন্ত্র’ প্রার্থীদের দিয়ে এবং জোটের শরিকদের নৌকা প্রতীক দিয়ে নির্বাচনী খেলা জমিয়ে তোলার চেষ্টা চালায়। জাতীয় পার্টিসহ অন্য দলগুলোর সঙ্গে কিছু আসন ভাগাভাগি করে নির্বাচনকে প্রতিযোগিতামূলক করে তোলার চেষ্টাও চালানো হয়। এ কৌশলের কারণে যারাই নির্বাচনে জিতবে তারাই হয় আওয়ামী লীগ দলভুক্ত অথবা তাদের প্রতি অনুগত হবে। অর্থাৎ ২০২৪ সালের ৭ই জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছিল পুরোপুরি পাতানো। প্রসঙ্গত, এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের তার নিজ দলের মনোনীত প্রার্থীদের সঙ্গে নিজ দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অনুমতি প্রদান ছিল দলীয় গঠনতন্ত্রের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

নির্বাচন কমিশনের তথ্যানুযায়ী, ৫৩টি অদ্যাবধি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের মধ্যে ২৮টি দলের মোট ১ হাজার ৯৭০ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে, যার মধ্যে ৪৩৬ জন ছিল স্বতন্ত্র প্রার্থী। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২২৪টি ও নিজ দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ৬২টি আসনে জয়লাভ করে। এ ছাড়াও আওয়ামী লীগের জোটসঙ্গী হিসেবে জাতীয় পার্টি ১১টি, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি ১টি, ওয়ার্কার্স পার্টি ১টি এবং জাসদ ১টি করে আসনে জয়লাভ করে। সরকারের পক্ষ থেকে প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, আদালত ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করে বিরোধী দলসমূহের ওপর ধারাবাহিকভাবে দমন-পীড়নের স্টিমরোলার চালানোর ফলেই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এমন ফলাফল সৃষ্টি হয়েছে।

পাতানো দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আমরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলাম যে, আরেকটি বিতর্কিত নির্বাচন আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থাকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেবে, যা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের, এমনকি জাতির জন্যও চরম বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। নির্বাচনের পরে নতুন সরকার তার বৈধতার সংকট কাটিয়ে উঠতে বিদেশি মিত্রদের ওপর আরও বেশি নির্ভরশীল হয়ে ওঠতে পারে, যা আমাদের সার্বভৌমত্বকে ঝুঁকিতে ফেলতে পারে। এ ছাড়া তৃতীয়বারের মতো নাগরিকদের ভোটাধিকার বঞ্চিত করা হলে তা ভবিষ্যতে সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক জনরোষে পরিণত হতে পারে। নিঃসন্দেহে এমন আশঙ্কা ক্ষমতাসীনদের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে না। কারণ জনগণের বৈষম্যের শিকার ও ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ার বোধ থেকেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয়েছিল। সৌভাগ্যবশত আমাদের এমন আশঙ্কা অক্ষরে অক্ষরে সত্যে পরিণত হয়েছে গত ৫ই আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারতে পলায়নের মাধ্যমে।