ইলন মাস্কের ‘টুইটারযাত্রা’টা শুরু হয় এ বছরের এপ্রিলে। তখন ৯.২ শতাংশ শেয়ার কিনে যোগাযোগমাধ্যমটির সবচেয়ে বড় বিনিয়োগকারীতে পরিণত হন এই প্রযুক্তি ব্যবসায়ী। সাত কোটি ৩৫ লাখ শেয়ার কিনতে তিনি খরচ করেছিলেন ৩০০ কোটি ডলার। ওই কেনাকাটা সারার পরপরই শুরু হয় তাঁর টুইটারের বিষয়ে ‘নাক গলানো’।
ঘটনা এগোতে থাকে দ্রুতগতিতে। পরিচালনা পর্ষদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কে টানাপড়েন শুরু হয়। একসময় প্রযুক্তি দুনিয়ায় ইলন মাস্কের গোটা টুইটারই কিনে নেওয়ার রব ওঠে। শেষ পর্যন্ত এপ্রিলের মাঝামাঝি টুইটারের পুরো মালিকানা চার হাজার ৩৪০ কোটি ডলারের বিশাল অঙ্কে কিনে নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েই দেন ইলন মাস্ক। অচিরেই আবার বেঁকে বসে বলেন, কিনবেন না। কারণ নাকি টুইটার যা বলছে, তার চেয়ে সাইটটিতে স্পাম ও ভুয়া অ্যাকাউন্টের সংখ্যা বহুগুণে বেশি। যা-ই হোক, এ রকম নানা উত্থান-পতন আর মামলার মতো নাটকীয়তার পর গত অক্টোবরে টুইটার কিনতেই হয় মাস্ককে। আর বলা যায়, এর পর থেকে শুরু হয় টুইটারপালার দ্বিতীয় পর্ব।
টুইটারের মালিক হওয়ার পরই খরচ বাঁচাতে কয়েক দফা গণছাঁটাইয়ে যান মাস্ক। প্রধান নির্বাহী ভারতীয় বংশোদ্ভূত পরাগ আগারওয়াল ছিলেন তাঁর প্রথম শিকারগুলোর একজন। এই পর্যন্ত চাকরি হারিয়েছেন কয়েক হাজার কর্মী। ইলন মাস্ক সম্প্রতি খোলাখুলিই বলেছেন, তাঁর ধারণা, ৪৪ বিলিয়ন ডলারে টুইটার কিনে খুব বেশি দাম দিয়ে ফেলেছেন তিনি। চাপে পড়ে আয় বাড়ানোর নানা মওকা খুঁজছেন তিনি। পরীক্ষামূলকভাবে ‘টুইটার ব্লু’ চালু করা এর মধ্যে একটি কৌশল। পয়সার বিনিময়ে পাওয়া সেবা টুইটার ব্লুর জন্য প্রতি মাসে আট ডলার করে গুনতে হবে ব্যবহারকারীদের। বিনিময়ে তারা পাবে ব্লু টিক, টুইট এডিট এবং লম্বা ভিডিও পোস্ট করার সুবিধা। টুইটার ফিডে বিজ্ঞাপনের সংখ্যাও কমে হবে অর্ধেক। ব্যবহারকারী আগ্রহী হবে শুধু এমন বিজ্ঞাপনই দেখানো হবে তখন।
টুইটার দেউলিয়া হয়ে যেতে পারে এমন আশঙ্কার কথা বলে সব দিকেই খরচ কমাতে চাচ্ছেন নতুন মালিক ইলন মাস্ক। এমনকি দুপুরে বরাদ্দ ফ্রি লাঞ্চ বন্ধ করেছেন। তাঁর দাবি, দুপুরের খাবারের জন্য বছরে খরচ হতো এক কোটি ৩০ লাখ ডলার। কর্মীদের উদ্দেশে পাঠানো এক ই-মেইলে মাস্ক বলেন, ‘সামনে কঠিন সময় আসছে। প্রত্যেক কর্মী যেন সপ্তাহে ৪০ ঘণ্টা অফিসে থাকেন, টুইটারের অর্ধেক আয় যেন সাবস্ক্রিপশন ফির মাধ্যমে আসে এবং বিজ্ঞাপনের ওপর কম নির্ভর করতে হয়। ’ কিছুদিন আগেই নিজের নামে বাজারে বিলাসবহুল সুগন্ধি এনেছেন মাস্ক। বিষয়টিকে আয় বাড়ানোর কৌশল হিসেবে দেখা যেতেই পারে হয়তো।
এসবের মধ্যে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে বিজ্ঞাপন হারাতে শুরু করেছে টুইটার। এ মাইক্রোব্লগিং সাইটে বিজ্ঞাপন প্রচারকে ‘খুবই ঝুঁকিপূর্ণ’ আখ্যা দিয়ে গ্রাহকদের সতর্ক করে দিয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মিডিয়া ইনভেস্টমেন্ট কম্পানি ‘গ্রুপএম’। ইলন মাস্ক মালিকানা কেনার আগ পর্যন্ত তাদের মাধ্যমেই টুইটারে সবচেয়ে বেশি বিজ্ঞাপন প্রচারিত হতো। এর আগে আইপিজি ও অমনিকম মিডিয়া গ্রুপও তাদের গ্রাহকদের টুইটারে বিজ্ঞাপন দেওয়া থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেয়। গ্রুপএমের গ্রাহক তালিকায় আছে গুগল, লরিয়েল, নেসলে, ইউনিলিভার, কোক, মার্সসহ অনেক বড় প্রতিষ্ঠান। ইলন মাস্ক মালিকানা গ্রহণের পর তাঁর নেওয়া কিছু সিদ্ধান্ত তাদের উদ্বিগ্ন করে তোলে। ফলস্বরূপ ক্রমাগত বিজ্ঞাপন হারাতে থাকে টুইটার।
‘টুইটার টুইটার’ করতে করতে নিজের পুরনো, মূল ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বৈদ্যুতিক গাড়ি কম্পানি টেসলারের ক্ষতি করেছেন মাস্ক। সম্প্রতি টেসলারের আরো প্রায় দুই কোটি শেয়ার বিক্রি করেন বিশ্বের শীর্ষ এই ধনকুবের। চলতি বছরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত টেসলারের শেয়ারের দর কমেছে প্রায় ৫০ শতাংশ। তার ওপর পাওয়ার স্টিয়ারিংয়ে সমস্যার আশঙ্কায় সম্প্রতি ৪০ হাজারের বেশি গাড়ি বাজার থেকে তুলে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। সম্প্রতি ইলন মাস্ক দাবি করেছেন, আগের চেয়ে টুইটার ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ছে। প্রমাণ হিসেবে গত জুলাই মাস থেকে ব্যবহারকারী বৃদ্ধির গ্রাফ তুলে ধরেছেন তিনি। যদিও অনবরত শেয়ারের দাম কমার জেরে ডিসেম্বরের শুরুতে বিশ্বের শীর্ষ ধনীর অবস্থানও হারান মাস্ক।
টুইটার কাহিনির সর্বশেষ ঘটনায় এক জনমত জরিপের ঘোষণা দিয়েছেন ইলন মাস্ক। তিনি টুইটারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করা অব্যাহত রাখবেন কি না, এটাই জরিপের বিষয়। গতকাল সোমবার শুরু হওয়া এই জরিপে অংশ নেওয়া ব্যবহারকারীদের ৫৭.৫ শতাংশ জানিয়েছে, প্রধান নির্বাহী হিসেবে মাস্কের পদত্যাগ করা উচিত। ১২ কোটি ২০ লাখ ফলোয়ারের মধ্যে জরিপে অংশ নেয় এক কোটি তিন লাখ। এখন দেখার বিষয় ইলন মাস্ক কী সিদ্ধান্ত নেন। অনেকেই বলছে, এর মধ্য দিয়ে হয়তো নিজের অন্যান্য ব্যবসায় মন দিতে চাচ্ছেন তিনি।
One thought on “টুইটার নিয়ে গ্যাঁড়াকলে ইলন মাস্ক”