ঢাকা ০৩:৩৩ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৪ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::
বঙ্গভ্যাক্স ভ্যাকসিনে অনীহা নজর ছিল আমদানিতে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী চট্টগ্রাম সদরঘাট থানা’র উদ্যোগে সিরাতুন্নবী (সঃ) মাহফিল অনুষ্ঠিত এমন গরম আর কতদিন ? কোরআন পড়ে বাড়ি ফেরা হলো না চার শিশুর দুই ছাত্রীকে যৌন হয়রানি, বড় হুজুর গ্রেফতার রাজনৈতিক বিবেচনায় নেওয়া গণপূর্তের সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকার ছয় প্রকল্প বাতিল দাউদকান্দিতে অবৈধভাবে এলপিজি গ্যাস বোতলজাতকরণের দায়ে ৩ জনকে সাজা প্রদান চাঁপাইনবাবগঞ্জে আন্তর্জাতিক তথ্য অধিকার দিবসে আলোচনা সভা বোরহানউদ্দিনে উত্তর-টবগী রাস্তার মাথা জামে মসজিদের সভাপতি বাচ্চু পন্ডিত- সম্পাদক- আলম ফরাজি তিস্তার পানি বিপৎসীমা ছুঁই ছুঁই

বিজয় নিশ্চিত, কোণঠাসা করে আত্মসমর্পণের আলাপ

বাংলাদেশে পশ্চিম পাকিস্তানের দখলদার বাহিনীর কমান্ডার-ইন-চিফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজি ১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর  যুদ্ধবিরতির জন্য অনুরোধ করেন। অপরদিকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল মানকেশ দখলদার পাক সেনাবাহিনীকে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানান। পাশাপাশি লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজিকে ১৬ ডিসেম্বর সকাল ৯টা পর্যন্ত সময় বেঁধে দেন তিনি। এদিকে ভারতীয় পদাতিক বাহিনী ঢাকার দুই কিলোমিটারের মধ্যে এসে পড়েছে, শহরের মহল্লায়-মহল্লায় তারা কামান দাগাছে। মিত্রবাহিনী চট্টগ্রাম থেকে আসছে, তখন তারা ঢাকার কাছাকাছি মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূরে ছিল।

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সাল। হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে ১৫ তারিখে ঘটে যাওয়া একটার পর একটা ঘটনার বিবরণে বলছে— জেনারেল মানকেশ লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজিকে জানান যে, ভারত বিকাল ৫টা থেকে তার (নিয়াজি) বাহিনীর বিরুদ্ধে বিমান অভিযান স্থগিত করেছে। ১৬ তারিখ সকাল ৯টা পর্যন্ত সেটা বহাল থাকবে। তবে ভারতীয় স্থলবাহিনী এবং মুক্তিবাহিনীর অভিযান  স্থগিত করা হবে না।

নয়া দিল্লির এক মুখপাত্র বলেন, ঢাকায় দখলদার বাহিনী আত্মরক্ষার এক অভিনব কৌশল অবলম্বন করছিল। পাক সেনাদের ঢাকার নিরপেক্ষ অঞ্চলে জড়ো করা হচ্ছিল। খান সেনাদের সদর দফতর হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বিমান বাহিনীর সদর দফতর করা হয় যক্ষ্মা হাসপাতালে, আর সামরিক পর্যবেক্ষণের জন্য বেছে নেওয়া হয় ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল। এসব স্থান রেডক্রসের নিরাপদ এলাকা বলে ঘোষিত হয় আগে থেকেই। খান সেনারা ঢাকার উত্তরাঞ্চলে পাঁচটি বাংকারের ওপর অসামরিক লোকদের আটক করে রেখেছিল বলে ভারতীয় বিমান বাহিনীর দেওয়া তথ্য প্রকাশ করে আনন্দবাজার পত্রিকা। এর উদ্দেশ্য ভারতীয় আক্রমণের হাত থেকে আত্মরক্ষা নিজেদের করা।

লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজি বাংলাদেশে যুদ্ধবিরতির অনুরোধ করে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে নয়া দিল্লিতে মার্কিন দূতাবাসের মাধ্যমে জেনারেল মানকেশকে একটি বার্তায় জানায়। সামরিক শাসনের অধীনে গভর্নরের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল ফরমান আলী এই বার্তাটি দেখেন। জেনারেল মানকেশের পক্ষ থেকে উত্তরও মার্কিন দূতাবাসের মাধ্যমে পাঠানো হয়েছিল। তবে সে সময় ওই বার্তায় কী ছিল, তার বিস্তারিত জানানো হয়নি।

পরবর্তীকালে ভারতীয় মুখপাত্র সন্ধ্যায় তার কিছু অংশ প্রকাশ করেন। জেনারেল মানকেশ জেনারেল নিয়াজিকে বলেন, ‘আমি আপনার বার্তা পেয়েছি। আমি পূর্বে জেনারেল ফরমান আলীকে দুটি বার্তায় জানিয়েছি যে,  বাংলাদেশে আমার কাছে আত্মসমর্পণকারী আপনার সব সামরিক ও আধাসামরিক বাহিনীর নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেবো। বিদেশি নাগরিক, জাতিগত সংখ্যালঘু এবং পশ্চিম পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত কর্মীদের সম্পূর্ণ সুরক্ষা দেওয়া হবে। যেহেতু আপনি যুদ্ধ বন্ধ করতে অনুরোধের ইঙ্গিত দিয়েছেন, আমি আশা করি— আপনি বাংলাদেশে আপনার কমান্ডের অধীনে থাকা বাহিনীকে অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধ করতে এবং আমার অগ্রসর বাহিনী যে যেখানেই অবস্থান করুন, তাদের কাছে আত্মসমর্পণের আদেশ জারি করবেন। নিরাপত্তার জন্য কারও কোনও ভয়ের দরকার নেই। বা আমার কমান্ডের অধীনে পরিচালিত বাহিনী দিয়ে কোনও প্রতিশোধ নেওয়া হবে না।’

১৫ তারিখ ৫টা থেকে ঢাকায় কোনও বিমান অভিযান হবে না বলে জানিয়ে বার্তায় বলা হয়, ‘আমি আপনাকে আশ্বাস দিচ্ছি যে, আমি আপনার সৈন্যদের অপ্রয়োজনীয় ক্ষয়ক্ষতি ঘটাতে চাই না। কারণ, আমি মানুষের প্রাণহানি ঘৃণা করি। আমি যা বলেছি তা মেনে না চললে ১৬ ডিসেম্বর সকাল ৯টার পর থেকে সর্বোচ্চ শক্তি নিয়ে পুনরায় আক্রমণ শুরু করা ছাড়া আমাদের উপায় থাকবে না।’

ভয়েস অব আমেরিকা সেদিন রাতে ঢাকা থেকে একটি প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে জানায়, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জেনারেল নিয়াজির কাছে একটি বার্তায় তাকে ‘প্রয়োজনে যুদ্ধ বন্ধ করার’ পরামর্শ দিয়েছেন। রাওয়ালপিন্ডিতে একজন সরকারি মুখপাত্র অবশ্য অস্বীকার করেন যে, ঢাকায় পাকিস্তানি সামরিক কমান্ড এবং ভারতীয় কর্তৃপক্ষের মধ্যে কোনও আলোচনা চলছে না।

তবে জেনারেল মানকেশ আত্মসমর্পণের সময়সীমা বেঁধে দিলেও ১৬ ডিসেম্বর সকাল ৯টা পর্যন্ত জেনারেল নিয়াজি কোনও উচ্চবাচ্য করেননি। ফলে ভারতীয় ফৌজ সকাল ৯টার পর গোলাগুলি বর্ষণ শুরু করে। সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় বিমান থেকে বোমা বর্ষণও চলে। পাক সেনাপতির তখন চৈতন্যোদয় হয় এবং আত্মসমর্পণে তিনি রাজি হন। মানকেশের কাছে তিনি বার্তা পাঠান এবং আত্মসমর্পণের শর্ত নিয়ে আলোচনার জন্য জেনারেল জেকবকে ঢাকায় আমন্ত্রণ জানান।

Tag :

আপনার মতামত লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল ও অন্যান্য তথ্য সঞ্চয় করে রাখুন

আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

বঙ্গভ্যাক্স ভ্যাকসিনে অনীহা নজর ছিল আমদানিতে

বিজয় নিশ্চিত, কোণঠাসা করে আত্মসমর্পণের আলাপ

আপডেট সময় ০৯:৪৭:২৬ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২২

বাংলাদেশে পশ্চিম পাকিস্তানের দখলদার বাহিনীর কমান্ডার-ইন-চিফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজি ১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর  যুদ্ধবিরতির জন্য অনুরোধ করেন। অপরদিকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল মানকেশ দখলদার পাক সেনাবাহিনীকে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানান। পাশাপাশি লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজিকে ১৬ ডিসেম্বর সকাল ৯টা পর্যন্ত সময় বেঁধে দেন তিনি। এদিকে ভারতীয় পদাতিক বাহিনী ঢাকার দুই কিলোমিটারের মধ্যে এসে পড়েছে, শহরের মহল্লায়-মহল্লায় তারা কামান দাগাছে। মিত্রবাহিনী চট্টগ্রাম থেকে আসছে, তখন তারা ঢাকার কাছাকাছি মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূরে ছিল।

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সাল। হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে ১৫ তারিখে ঘটে যাওয়া একটার পর একটা ঘটনার বিবরণে বলছে— জেনারেল মানকেশ লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজিকে জানান যে, ভারত বিকাল ৫টা থেকে তার (নিয়াজি) বাহিনীর বিরুদ্ধে বিমান অভিযান স্থগিত করেছে। ১৬ তারিখ সকাল ৯টা পর্যন্ত সেটা বহাল থাকবে। তবে ভারতীয় স্থলবাহিনী এবং মুক্তিবাহিনীর অভিযান  স্থগিত করা হবে না।

নয়া দিল্লির এক মুখপাত্র বলেন, ঢাকায় দখলদার বাহিনী আত্মরক্ষার এক অভিনব কৌশল অবলম্বন করছিল। পাক সেনাদের ঢাকার নিরপেক্ষ অঞ্চলে জড়ো করা হচ্ছিল। খান সেনাদের সদর দফতর হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বিমান বাহিনীর সদর দফতর করা হয় যক্ষ্মা হাসপাতালে, আর সামরিক পর্যবেক্ষণের জন্য বেছে নেওয়া হয় ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল। এসব স্থান রেডক্রসের নিরাপদ এলাকা বলে ঘোষিত হয় আগে থেকেই। খান সেনারা ঢাকার উত্তরাঞ্চলে পাঁচটি বাংকারের ওপর অসামরিক লোকদের আটক করে রেখেছিল বলে ভারতীয় বিমান বাহিনীর দেওয়া তথ্য প্রকাশ করে আনন্দবাজার পত্রিকা। এর উদ্দেশ্য ভারতীয় আক্রমণের হাত থেকে আত্মরক্ষা নিজেদের করা।

লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজি বাংলাদেশে যুদ্ধবিরতির অনুরোধ করে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে নয়া দিল্লিতে মার্কিন দূতাবাসের মাধ্যমে জেনারেল মানকেশকে একটি বার্তায় জানায়। সামরিক শাসনের অধীনে গভর্নরের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল ফরমান আলী এই বার্তাটি দেখেন। জেনারেল মানকেশের পক্ষ থেকে উত্তরও মার্কিন দূতাবাসের মাধ্যমে পাঠানো হয়েছিল। তবে সে সময় ওই বার্তায় কী ছিল, তার বিস্তারিত জানানো হয়নি।

পরবর্তীকালে ভারতীয় মুখপাত্র সন্ধ্যায় তার কিছু অংশ প্রকাশ করেন। জেনারেল মানকেশ জেনারেল নিয়াজিকে বলেন, ‘আমি আপনার বার্তা পেয়েছি। আমি পূর্বে জেনারেল ফরমান আলীকে দুটি বার্তায় জানিয়েছি যে,  বাংলাদেশে আমার কাছে আত্মসমর্পণকারী আপনার সব সামরিক ও আধাসামরিক বাহিনীর নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেবো। বিদেশি নাগরিক, জাতিগত সংখ্যালঘু এবং পশ্চিম পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত কর্মীদের সম্পূর্ণ সুরক্ষা দেওয়া হবে। যেহেতু আপনি যুদ্ধ বন্ধ করতে অনুরোধের ইঙ্গিত দিয়েছেন, আমি আশা করি— আপনি বাংলাদেশে আপনার কমান্ডের অধীনে থাকা বাহিনীকে অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধ করতে এবং আমার অগ্রসর বাহিনী যে যেখানেই অবস্থান করুন, তাদের কাছে আত্মসমর্পণের আদেশ জারি করবেন। নিরাপত্তার জন্য কারও কোনও ভয়ের দরকার নেই। বা আমার কমান্ডের অধীনে পরিচালিত বাহিনী দিয়ে কোনও প্রতিশোধ নেওয়া হবে না।’

১৫ তারিখ ৫টা থেকে ঢাকায় কোনও বিমান অভিযান হবে না বলে জানিয়ে বার্তায় বলা হয়, ‘আমি আপনাকে আশ্বাস দিচ্ছি যে, আমি আপনার সৈন্যদের অপ্রয়োজনীয় ক্ষয়ক্ষতি ঘটাতে চাই না। কারণ, আমি মানুষের প্রাণহানি ঘৃণা করি। আমি যা বলেছি তা মেনে না চললে ১৬ ডিসেম্বর সকাল ৯টার পর থেকে সর্বোচ্চ শক্তি নিয়ে পুনরায় আক্রমণ শুরু করা ছাড়া আমাদের উপায় থাকবে না।’

ভয়েস অব আমেরিকা সেদিন রাতে ঢাকা থেকে একটি প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে জানায়, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জেনারেল নিয়াজির কাছে একটি বার্তায় তাকে ‘প্রয়োজনে যুদ্ধ বন্ধ করার’ পরামর্শ দিয়েছেন। রাওয়ালপিন্ডিতে একজন সরকারি মুখপাত্র অবশ্য অস্বীকার করেন যে, ঢাকায় পাকিস্তানি সামরিক কমান্ড এবং ভারতীয় কর্তৃপক্ষের মধ্যে কোনও আলোচনা চলছে না।

তবে জেনারেল মানকেশ আত্মসমর্পণের সময়সীমা বেঁধে দিলেও ১৬ ডিসেম্বর সকাল ৯টা পর্যন্ত জেনারেল নিয়াজি কোনও উচ্চবাচ্য করেননি। ফলে ভারতীয় ফৌজ সকাল ৯টার পর গোলাগুলি বর্ষণ শুরু করে। সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় বিমান থেকে বোমা বর্ষণও চলে। পাক সেনাপতির তখন চৈতন্যোদয় হয় এবং আত্মসমর্পণে তিনি রাজি হন। মানকেশের কাছে তিনি বার্তা পাঠান এবং আত্মসমর্পণের শর্ত নিয়ে আলোচনার জন্য জেনারেল জেকবকে ঢাকায় আমন্ত্রণ জানান।