রাজধানীর উত্তরা। কয়েক সপ্তাহ আগে একটি কাঁচাবাজারের সবজি বিক্রেতার সাথে আলাপ। সবজির দামবৃদ্ধির জন্য ডলারের মূল্যবৃদ্ধি দায়ী করলেন। বললেন, ব্যাংকের মালিকেরা ডলারের কারসাজির সাথে জড়িত। বিষয়টি অবাক হওয়ার মতো ঘটনা নয়। এক ডাব বিক্রেতার সাথে আলাপ করলাম, ৪০-৫০ টাকার কচি ডাব এখন ১৪০-১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তার কাছেও একই সুর জ্বালানির দাম বৃদ্ধি ও ডলারের সংকট।
সবজি ও কচি ডাব দেশে উৎপাদিত হলেও তারাও বড় ব্যবসায়ীদের সুরে কথা বলা শুরু করেছেন। দাম বাড়লেই একগুচ্ছ অজুহাত নিয়ে হাজির হন। তবে সবগুলো অজুহাত এখানে প্রযোজ্য কি না তা না ভেবেই কথাগুলো বলে যান। ভোক্তা হিসেবে অসহায়ের মতো আমাদের শুনে হজম করা ছাড়া বিকল্প কিছুই নেই। কারণ তারা ব্যবসায়ী এবং বাজারে তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাদের কথার ওপর কারো কোনো কথা চলে না। সরকার, প্রশাসন ও রাজনৈতিক দলসহ ক্ষমতার সবগুলো কাঠামো তাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।
আকাশছোঁয়া নিত্যপণ্যের দামে দিশেহারা সাধারণ মানুষ। ‘অপরিবর্তিত আয়’ দিয়ে নিত্যপণ্যের চড়া দামের সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে না পেরে ব্যয় কমাতে বাধ্য হচ্ছে। যদিও সরকারের পরিসংখ্যান বলেছিল, মানুষের আয় বাড়ছে। চলতি বছরের মধ্যে দেশের মানুষের মাথাপিছু বার্ষিক আয় তিন হাজার ডলার ছাড়িয়ে যাবে—এমন আশ্বাসও শোনা গিয়েছিল সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিদের কাছ থেকে। অর্থনীতিবিদের মতে, মাথাপিছু আয়ের বিষয়টি গড় হিসাব। সবার সম্মিলিত আয় যোগ করে মোট সংখ্যা দিয়ে ভাগ দিয়ে মাথাপিছু আয় ধরা হয়।
অর্থনীতিবিদের মতে, মাথাপিছু আয়ের বিষয়টি গড় হিসাব। সবার সম্মিলিত আয় যোগ করে মোট সংখ্যা দিয়ে ভাগ দিয়ে মাথাপিছু আয় ধরা হয়।
তারা বলছেন, হাতেগোনা কিছু মানুষ টাকার ভারে আঙুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছে। তাদের আয় বাদ দিলে বাস্তব চিত্র পাওয়া যাবে। অথচ বাস্তবতা হলো এখন মধ্যবিত্তরাও নিজে, না হয় বাসার কাজের লোককে টিসিবির লাইনে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য আকাশচুম্বী। অথচ সরকারি খাতায় খাদ্য মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রিত। খাদ্য বহির্ভূত মুদ্রাস্ফীতিও বেশ বেড়েছে।
বৈশ্বিক মহামারি করোনা ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের অজুহাতে দেশে অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে সবকিছুর খরচ। বাড়তি মূল্যের এই যন্ত্রণা, বিশেষ করে সীমিত আয়ের লোকেরা এমন মাত্রায় অনুভব করছে, যা আগে কখনো করেনি। প্রায় সব ধরনের নিত্যপণ্য তাদের নাগালের বাইরে চলে গেছে। ফলে তারা বাধ্য হচ্ছে, স্বাভাবিক কেনাকাটা কমাতে এবং সেগুলোর সস্তা বিকল্প সন্ধানে নামছেন তারা।
সংসার পরিচালনায় টিকে থাকতে নানা উপায়ে খরচ কমানোর চেষ্টা করছেন নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা। বাধ্য হয়ে সন্তানের লেখাপড়ার পেছনে খরচ কমাচ্ছেন। প্রতিবছর সন্তানের দর্জি দোকান থেকে দুই সেট ‘স্কুল ড্রেস’ বানাতেন। কিন্তু এবার বছর কম দামে সন্তানের স্কুল পোশাক কিনেছেন। ডিম-দুধের দাম বেড়ে যাওয়ায় পরিমাণে কম খাওয়াচ্ছেন। সংসারের খরচে কৃচ্ছ্রসাধনে অনেকেই অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমানোর পাশাপাশি খাবার ব্যয় কমিয়েছে।
বেসরকারি অনেক চাকরিজীবী দুপুরে খাবার ছোট করে এনেছেন। আগে দুপুরে হোটেলে খেতেন। এখন বেশিরভাগ দিন কলা-রুটি দিয়েই সেরে ফেলছেন। এখন সাধারণ রেস্তোরাঁয় এক বেলা সবজি, ডাল ও ভাত খেতেও একশ টাকায় হয় না। ঠিক একইভাবে সন্তানের স্কুলে যাওয়া-আসার জন্য দিনে রিকশাভাড়া বেড়েছে। অফিসে যাওয়া-আসার খরচও বেশি দিতে হচ্ছে। সংসার চালাতে এখন প্রতি মাসেই ধারকর্জ করে চলতে হচ্ছে। পর্যাপ্ত আয় না বাড়ায় খাদ্যপণ্যের অতিরিক্ত খরচ মেটাতে গিয়ে দামি পোশাক, আসবাবপত্র, ইলেকট্রনিক্স এবং অন্যান্য বিলাসবহুল পণ্য মানুষ আর আগের মতো কিনছে না।
তবে জ্বালানি তেলের হঠাৎ দাম বৃদ্ধি, ডলারের সংকট, করোনার পরে জাহাজ ভাড়া বৃদ্ধি, কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি এরকম হাজারও অজুহাতে অস্থির হতে থাকে নিত্যপণ্যের বাজার। আর আগুন কিন্তু থামতে চায় না। প্রতিযোগিতা করে সবগুলো পণ্যের গায়ে রং ছাড়াচ্ছে। ডিজিটাল যুগে এই প্রবাহ রাজধানী ঢাকা থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত সর্বত্র ছাড়াচ্ছে। এর মাঝেই হঠাৎ করে জ্বালানি তেলের দাম অস্বাভাবিক বাড়িয়ে দেওয়ায় দেশের মানুষ দারুণভাবে ধাক্কা খেয়েছে। কবে কোন নিত্যপণ্যের দাম কত বাড়বে তা কারোই আগে থেকে জানা থাকে না।
মানুষ পরিকল্পনা করে বাজারে গেলেই ঘটে বিপত্তি। বাজেট অনুযায়ী আর বাজার করা হয় না। দেশে সিংহভাগ মানুষের আয় সীমিত, কিন্তু ব্যয় বাড়ছে হু হু করে। তবে এটাও ঠিক দেশে আবার একশ্রেণির অঢেল টাকার মানুষের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়, তাদের পকেট এতটাই গরম যে বাজারের উত্তাপ তাদের কাছে কোনো বিষয় নয়। কিন্তু সমস্যায় আছে সাধারণ মানুষ, তাদের অবস্থা তো ত্রাহি ত্রাহি। এই মানুষগুলোর দিন কাটছে অর্ধাহারে, হয়তো বা স্বল্পাহার অথবা খরচের তালিকা কমানোর মধ্য দিয়ে।
মানুষ পরিকল্পনা করে বাজারে গেলেই ঘটে বিপত্তি। বাজেট অনুযায়ী আর বাজার করা হয় না। দেশে সিংহভাগ মানুষের আয় সীমিত, কিন্তু ব্যয় বাড়ছে হু হু করে।
প্রান্তিক আয়ের মানুষ বিশেষ করে স্বল্প আয়ের মানুষগুলোর অধিকাংশের আয় এখন শূন্যের কৌটায় গিয়ে ঠেকেছে। কারণ তারা যাদের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন সেই মানুষগুলো নিজেরাই সমস্যায়। বিষয়গুলো অনেকটাই কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবিরে দিনে দিনে রোহিঙ্গাদের জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তা কমে যাওয়ার মতো। কারণ রোহিঙ্গাদের জন্য সিংহভাগ সহায়তা আসতো যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপ থেকে।
এখন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে তারাই এখন সংকটে। ফলে এই রোহিঙ্গারা যেমন প্রবল খাদ্য সংকটে পড়তে যাচ্ছে, তেমনি আমাদের স্বল্প আয়ের মানুষগুলো যাদের ওপর নির্ভর করতো সেই মানুষগুলোও আয় রোজগার কমে গিয়ে বাড়তি খরচের চাপে নিজেরাই দিনে দিনে জীবন জীবিকার কঠিন সংগ্রামে জর্জরিত।
মানুষের খরচের চাপ এখন শুধু নিত্যপণ্য নয়, সরকারের অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আহরণে তোড়জোড়ের কারণে যেমন প্রত্যক্ষ কর বাড়ছে, তেমনি পরোক্ষ করের হারও বাড়ছে। ফলে মানুষ ঘরে বাইরে বাড়তি খরচের তালিকা নিয়ে প্রতিনিয়তই সংগ্রামে লিপ্ত। সেই কারণে তার পক্ষে পরিবার পরিজন নিয়ে বেঁচে থাকাই যেখানে দায় সেখানে তাদের পক্ষে আত্মীয়স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী ও এলাকার নিম্ন আয়ের মানুষের দিকে তাকানোর সুযোগও কমে যাচ্ছে।
নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতি ঠেকাতে হলে প্রয়োজন সরকারের সদিচ্ছা ও ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা। সেই সাথে প্রয়োজন কার্যকরী মূল্য নির্ধারণ বা স্থিতিশীল রাখার নীতিমালা প্রণয়ন ও কার্যকর করা। দেশে উৎপাদিত পণ্যের পরিমাণ, আমদানির পরিমাণ, চাহিদা, ক্রয় ক্ষমতা ইত্যাদির সাথে সঙ্গতি রেখে এই নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে।
উৎপাদন বা আমদানি খরচের উপর ভিত্তি করে পণ্যের মূল্য নির্ধারিত হবে। কোনো অজুহাতে এই মূল্যের বৃদ্ধি হবে না, হলে কঠিন ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিধান ও প্রয়োগের পথ খোলা রাখতে হবে। তা না হলে নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতি কেউ ঠেকাতে পারবে না।