গণপূর্ত অধিদপ্তরের দু’জন নির্বাহী প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে বেনামী ঠিকাদারী ব্যবসা টেন্ডার জালিয়াতিসহ বহুবিধ অনিয়ম দুর্নীতি আর লুটপাটের গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। অভিযুক্ত কর্মকর্তাদ্বয় হলেন- নোয়াখালী ও যশোর ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী যথাক্রমে কামরুল হাসান ও জাহিদুল ইসলাম। চাকরিজীবনে এভাবে অনৈতিক পথে উপার্জিত অর্থে কামরুল হাসান ঢাকার মিরপুরে ৬তলা বাড়ী, ধানমন্ডিতে বিলাশবগুল এপার্টমেন্ট ও জাহিদুল ইসলাম খুলনার জোড়াকলে পাঁচতলা বাড়ি, মার্কেট, ঢাকায় বিলাশবহুল এপার্টমেন্টসহ তারা উভয়েই নামে-বেনামে অর্ধ শতাধিক কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। তথ্য সংশ্লিস্ট নির্ভরযোগ্য সূত্রের।
প্রকৌশলী কামরুল (বৈষম্যের শিকার ঠিকাদারদের ভাষায় কামরুপ) হাসান ইতোপূর্বে নির্বাহী হিসেবে এপ্রিল ২০১৭ থেকে শুরু করে এপ্রিল ২০২২ পর্যন্ত একটানা ৫ বছর নোয়াখালী গণপূর্ত বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন। সে সময়ে তৎকালীন লীগ সরকারের যোগাযোগ মন্ত্রীর লোকদের সাথে আতাঁত করে ওটিএম পদ্ধতিতে যেমনি একচেটিয়া কাজ দিয়েছেন তেমনি এলটিএমেও জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে ১/২টি সিডিউল ফেলিয়ে নিজের পছন্দের ঠিকাদারদের কাজ দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। উন্নয়নমূলক কাজ নিয়ে বৈষম্য তৈরীর নেপথ্য খলনায়ক এই গণপূর্ত কর্মকর্তা কোটি টাকা ঘুষ নিয়ে গণপূর্তের জায়গা জমি বেহাতে সহায়তা করার পাশাপাশি সে সময়ে নোয়াখালী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের বিভিন্ন উন্নয়নমুলক কাজে বেনামী ঠিকাদারী ব্যবসাসহ বিবিধ জাল-জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে প্রায় ২০ কোটি টাকা লোপাট করেছেন বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দু’জন ঠিকাদার জানিয়েছেন। পরবর্তীতে স্বৈরাচার সচিব শহিদুল্লাহ খন্দকারের ছেলেকে বরিশালে বড় বাজেটের কাজ দিতে সাবেক যোগাযোগ মন্ত্রীর আস্থাভাজন এই কামরুপকে বরিশালে পোষ্টিং এর ব্যবস্থা করেন অধিদপ্তরের সওস অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী রোহিঙ্গা শহিদুল আলম। প্রকৌশলী কামরুল হাসান ২০২২-২৩ অর্থবছরে ওই সওস প্রকৌশলীকে ২ কোটি টাকা ঘুষ দিয়ে প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও বরিশালের জন্য এপিপি’তে ২৫% বরাদ্দ বাড়িয়ে নিয়ে লুটপাটে নতুন ধরণের ক্যামিও দেখান। নোয়াখালীর ন্যায় বরিশালেও ২০২২-২৩ অর্থবছরে এলটিএম টেন্ডার নিয়ে ক্যারিশম্যাটিক ইনিংস খেলে ব্যাপক জালিয়াতি করেন প্রকৌশলী কামরুপ। কিন্তু তার ক্যারিশম্যাটিক ক্যামিওতে বাঁধ সাধেন স্থানীয় কতিপয় ঠিকাদার। মেডিকেল সাবডিভিশনের ব্যাপক অনিয়ম দুর্নীতি নিয়ে সে সময়ে দেশ টিভিতে তথ্যবহুল সংবাদ প্রচারিত হয়। কিন্তু অধিদপ্তরের সওস প্রকৌশলী শহিদুলকে মোটা অংকের ঘুষ দিয়ে বরিশাল মেডিকেলের লুটপাটকেও ডিপফ্রিজে ঢুকিয়ে রাখেন ধূর্ত এই পূর্ত কর্মকর্তা। বরিশালে স্বার্থ সিদ্ধির পরে ওই শহিদুলের বদান্যতায় প্রকৌশলী কামরুল পুরনো কায়দায় টেন্ডার জালিয়াতির উদ্দেশে আবার ফিরে এসেছেন নোয়াখালী ডিভিশনে। প্রবৌশলী কামরুপ কামরুলের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরণের অসামাজিক ও সরকার বিরোধী কাজে জড়িত বেনামে ঠিকাদারী ব্যবসাসহ অনিয়ম দুর্নীতি ও লুটপাটের বিষয়ে অত্র সাপ্তাহিকের পরবর্তী সংখ্যাগুলোতে থাকছে কয়েকটি বিস্তারিত প্রতিবেদন।
অপরদিকে প্রকৌশলী জাহিদুল ইসলাম ইতোপূর্বে কুষ্টিয়া ডিভিশনে থাকতে আ’লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফের প্রভাব খাটিয়ে ওই দপ্তরটিতে লুটপাটের হোলিখেলায় মেতেছিলেন। শুধুমাত্র কুষ্টিয়া ডিভিশন থেকেই তিনি গত তিনবছরে অর্ধশতাধিক কোটি টাকা লোপাট করেছেন বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিভিশনটির এক প্রকৌশলী ও কতিপয় ঠিকাদার জানিয়েছেন। এই অনৈতিক কাজে তিনি ব্যবহার করেছেন সদর উপজেলা চেয়ারম্যান আতাউর রহমান আতা ও গ্যালাক্সি এসোসিয়েটস নামক একটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে। এছাড়া শারমিন এন্টারপ্রাইজ নামক একটি প্রতিষ্ঠানকে অযোগ্য হওয়া সত্ত্বেও কোটি কোটি টাকার কাজ দিয়েছেন নির্বাহী প্রকৌশলী নিজের একক প্রচেষ্টায়। পাশাপাশি ঢাকার বাঃ এসোসিয়েটস ও এস এ এন্টারপ্রাইজকেও অনেক কাজ দিয়েছেন ডেকে এনে। অতীতের ধারা বজায় রেখে নিজের অন্যতম ব্যবসায়িক পার্টনার গ্যালাক্সি এসোসিয়েটসকে যশোর ডিভিশনেও কাজ দেওয়া শূরু করেছেন এ্ই দুর্নীতিবাজ প্রকৌশলী।
অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল স্থাপন প্রকল্পের লিফটের দরপত্র নিয়ে তিনি ব্যাপক জালিয়াতি করেছেন। লিফট স্থাপনে সুপার স্টার ইঞ্জিনিয়ারিং ও ক্রিয়েটিভ ইনঞ্জিনিয়ারিংকে সম্পূর্ণ নিজস্ব প্রচেস্টায় কাজ দিয়ে প্রায় অধুকোটি টাকবা হাতিয়ে নেন প্রকৌশলী জাহিদুল। এছাড়াও কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল স্থাপন প্রকল্পের অভ্যন্তরীণ সড়ক, ড্রেন, পুকুর সহ আনুষাঙ্গিক কাজে দুইজন দরপত্র দাখিল করে প্রথম সর্বনিন্ন দরদাতা মেসার্স শামীম এন্টারপ্রাইজ, ২য় সর্বনিম্ন দরদাতা গ্যালাক্সি এ্যাসোসিয়েটস। এখানে মেসার্স শামীম এন্টারপ্রাইজ কে বাদ দিয়ে গ্যালাক্সি এ্যাসোসিয়েটস্ কে কার্যাদেশ প্রদান করা হয়। অথচ কুষ্টিয়া গণপূর্ত বিভাগে ওই সময়ে এই প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৫০ কোটি টাকার কাজ চলমান রয়েছে। কুষ্টিয়া নতুন সার্কিট হাউস ও মডেল মসজিদ নির্মানসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের কাজ মের্সাস শামীম এন্টারপ্রাইজ বাস্তবায়ন করেছে। ওই সময়ে প্রকৌশলী জাহিদুল ইসলামের নামে মেসার্স শামীম এন্টারপ্রাইজ লিখিত অভিযোগ দায়ের করেও কোন সুরাহা পায়নি। কুষ্টিয়া গণপূর্ত বিভাগীয় ক্যাম্পাসের মধ্যে উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী ৪০ বছরের বাসভবনের কাঠামোগত নকশা পরিবর্তন করে মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের ২০.০০ লক্ষ টাকার দরপত্র আহবান করে নিয়ম বহির্ভূত ভাবে কাঠামোগত নকশা পরিবর্তন করছে যা সরেজমিন পরিদর্শন করলে প্রমাণ পাওয়া যাবে। জুন মাসে একই জায়গায় আরেকটি দরপত্র আহবান করে কিছু কাজ করা হয়। জুন মাসে এই রকম একাধিক জায়গায় বার বার দরপত্র আহবান অর্থ লোপাট করেছে। যেমন প্রমাণ সরূপ ডিসি অফিসে অর্থ বছরের শুরুতে ঘাসকাটা ও স্যানিটারি মালামাল ও বৈদ্যুতিক মালামাল সাপ্লাইয়ের জন্য তিনটি দরপত্র আহবান করা হয়। আবার ডিসি অফিসের বাউন্ডারী ওয়াল নির্মাণ করার দরপত্র আহবান করা হয় নভেম্বর-২০২১ আবার একই অর্থবছরে মে-২০২২ রেনোভেশনসহ বাউন্ডারী ওয়াল নির্মাণ করার জন্য ৯৫.০০ লক্ষ টাকার দরপত্র আহবান করা হয়। এভাবে জজ কোর্ট, সদর হাসপাতালসহ বিভিন্ন জায়গায় ওভার লেপিং করে কোটি কোটি লুটপাট করেছেন এই নির্বহী প্রকৌশলী জাহিদুল ইসলাম।
প্রকৌশলী জাহিদুল ইসলাম চাকুরী জীবনের প্রথমে ২০১১ সালে সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে কক্সবাজারে ১ এক বছর চাকুরীতে ছিলেন। পরবর্তীতে ২০১২ সালে এসডিই পদে যোগদান করেন ওখানেই। শুরু হয় তার ঘুষ-দুর্নীতির পালা। যা ক্রমেই অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠে। ওই সময় মেরিন টেকনোলজি ভবন নির্মাণ কাজে অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে তাকে তৎকালীন জেলা প্রশাসকের সুপারিশে ২০১৪ সালে তাকে বদলি করেন প্রধান কার্যালয়ে। অল্প কয়েকদিন পরেই পোস্টিং বাগিয়ে নেন শের-ই-বাংলা নগর গণপূর্ত বিভাগ-২ তে। কক্সবাজারে থাকাবস্থায় প্ল্যান পাস করা থেকে শুরু করে সর্বক্ষেত্রে দুর্নীতির অভয়ারণ্যে পরিণত করেছিল এই বর্তমান নির্বাহী প্রকৌশলী জাহিদুল। যে কারণে মেরিন টেকনোলজি ভবনটি উদ্বোধন হতে দীর্ঘ সাত বছর লেগে যায়।
ঢাকায় বদলী হলেও থেমে থাকেনি তার দুর্নীতি। যোগ দেন বহুল আলোচিত জি কে শামীমের জিটিসিএল ভবন নির্মাণ কাজের তদারকিতে। এর পর থেকে তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। জিটিসিএল ভবন নির্মাণে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি করাসহ বিভিন্ন অনিয়ম করে মাত্র ০১ এক বছরে আলাউদ্দিনের প্রদীপ পাওয়ার মত কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যান। তার সীমাহীন দুর্নীতি ধরা পড়লে তাকে বরিশাল গণপূর্তে বদলি করেন তৎকালীন প্রধান প্রকৌশলী। ওখানে এক বছর চাকরি করার পর তিনি নাটোরে বদলি হন। এর পরে তিনি কুষ্টিয়া গণপূর্ত বিভাগে দায়িত্ব নিয়ে আলাদ্দিনের চেরাগে ফুয়েল ভরে মেডিকেল কলেজসহ বিভিন্ন স্থাপনায় ঘষে প্রায় অর্ধশত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে লুটপাটের আগুনে ভস্মিভূত করেছেন গোটা ডিভিশনকে। লুটপাটের ম্যান্ডেট নিয়ে যশোর ডিভিশনের দায়িত্ব নিয়েছেন চলতি বছরের জানুয়ারী থেকে।
এ বিষয়ে প্রকৌশলী জাহদুল ইসলামকে মুঠোফোনে ফোন করে জানতে চাইলে তিনি এ প্রতিবেদককে যা পেয়েছে তা লিখে দিতে বলেন।