কয়েক মাস ধরে চলা মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ গোলযোগের প্রভাব পড়ছে সীমান্তের এপাশেও। তারপর বেশ কিছুদিন শান্ত ছিল পরিস্থিতি। মিয়ানমার সীমান্তের কথা বলছি। এর মধ্যে কক্সবাজারের টেকনাফে অনুষ্ঠিত হলো বিজিবি-বিজিপি-এর বৈঠক।
সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেছেন দুই দেশের সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর কর্মকর্তারা। সেই বৈঠকে সীমান্তে গোলাগুলি ও সংঘর্ষ নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছে মিয়ানমারের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশ-বিজিপি।
বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার বাংলাদেশ মিয়ানমার সীমান্ত আলোচনা চলছে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর থেকে। ওপাশে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের তুমব্রু। এপাশের এলাকার নামও তুমব্রু।
মিয়ানমারের তুমব্রু অঞ্চলে এক সময় লোকবসতি ছিল। রোহিঙ্গাদের সেই বসতি এপাশ থেকেই দেখা যেত। দুই দেশের মানুষদের মধ্যে যোগাযোগ ছিল। ২০০১ সালের পর অসংখ্যবার সেই অঞ্চলে গিয়েছি। ওপাশে নাসাকা’র (নাসাকা মিয়ানমারের তখনকার সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর নাম ছিল) কার্যক্রম দেখেছি দূর থেকে।
বিজিবি-নাসাকা’র পতাকা বৈঠকও দেখেছি সামনে থেকে। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর সীমান্তের ওপাশের লোকালয়গুলো হারিয়ে গেছে। রোহিঙ্গাদের ফেলে আসা ঘরগুলো এখন পরিণত হয়েছে ঝোপ-জঙ্গলে।
মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ নানা বিষয়ে খোঁজ খবর রাখার চেষ্টাও করছি। তবে সেই অর্থে মিয়ানমারের ভেতরের যথেষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। দুই দেশের মানুষের মধ্যে দূরত্ব, সরকারের মধ্যকার টানাপোড়েনের সম্পর্ক ও ভাষার কারণে সেই খবর আমরা ভালোভাবে নিতে পারি না।
মিয়ানমারের ভেতরের যথেষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। দুই দেশের মানুষের মধ্যে দূরত্ব, সরকারের মধ্যকার টানাপোড়েনের সম্পর্ক ও ভাষার কারণে সেই খবর আমরা ভালোভাবে নিতে পারি না।
অন্যদিকে মিয়ানমারের সামরিক গোয়েন্দাদের তৎপরতার খবরগুলো গোপন থাকে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক তথ্য হারিয়ে যায়। তাই অনেক কিছুই ঘটে যাচ্ছে যা আমাদের ধারণারও বাইরে। তবুও মিয়ানমারের রাখাইন ও চিন রাজ্যের ভেতরের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি জানার চেষ্টা করেছি, চেষ্টা করেই যাচ্ছি।
রোহিঙ্গাদের তথাকথিত মিয়ানমারে বিদ্রোহী গ্রুপ আরসা’র তৎপরতার ফলাফল হিসেবে আসে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের ইনফ্ল্যাক্স (বিশাল সংখ্যার অনুপ্রবেশ)। মানবিকতার খাতিরে সীমান্ত খুলে দেওয়া হয়।
মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত নাগরিকেরা আশ্রয় নেয় বাংলাদেশের মাটিতে। এই বিশাল সমস্যা নিয়ে বিপর্যস্ত বাংলাদেশ। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে আপ্রাণ চেষ্টা চলছে। এই বিষয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোর সহযোগিতা না থাকায় বেশ বেগ পেতে হচ্ছে আমাদের।
জাতিসংঘও এই বিষয়ে এখনো কার্যকর কিছুই করেনি। বাংলাদেশ গলা ফাটিয়ে যাচ্ছে, বিশ্বনেতারা শুধু আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছেন। এদিকে ১২ লাখ মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত নাগরিকদের চাপ নিচ্ছে বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক সংস্থা ও এনজিওগুলোর সরব উপস্থিতি মেনে নিতে হচ্ছে নিরুপায় হয়ে।
বিশাল সংখ্যার রোহিঙ্গাদের ব্যবস্থাপনা ও প্রত্যাবাসন নিয়ে ব্যস্ত যখন বাংলাদেশ তখন মিয়ানমারের ভেতরে কী হচ্ছে? আজ সেই বিষয়েই লিখছি। যতটুকু জেনেছি তা জানানোর চেষ্টা করছি।
কয়েক বছর ধরে আরাকানের বিভিন্ন অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করছে দেশটির বিদ্রোহী গ্রুপ আরাকান আর্মি। ধীরে ধীরে তারা প্রস্তুত হয়েছে। পাহাড়ের দুর্গম অঞ্চলে প্রশিক্ষণ নিয়েছে তারা। ধাপে ধাপে অস্ত্র সংগ্রহ করেছে। এরপর উত্তর থেকে একটি একটি করে দেশের সেনা ও বিজিপি ক্যাম্প দখল করেছে তারা।
মংডুসহ কৌশলগত কারণে গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন অঞ্চলের বেশকিছু স্থাপনাও দখলে নিয়েছে তারা। সর্বশেষ রাখাইনের মাইয়ু নদীর পাশের বাউলাই সেনা ক্যাম্প দখলে নেয় বিদ্রোহী আরাকান আর্মি। সেখান থেকে বেশ ভালো সংখ্যার যুদ্ধাস্ত্র ও গোলা-বারুদ নিজেদের আয়ত্তে নেয় তারা।
বাউলাই কৌশলগত কারণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি সেনা ক্যাম্প। মাইয়ু নদীর উপর সেখানে ফেরিঘাট আছে। রাখাইনের পশ্চিমের দুর্গম অঞ্চলগুলোয় সড়ক পথে আসা যাওয়ার জন্য এই ফেরিঘাট অতি গুরুত্বপূর্ণ। এমন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো দখলে নিতে গিয়েই সংঘর্ষ ঘটছে।
সীমান্তের কাছাকাছি সংগঠিত সংঘর্ষগুলোর আঁচ এসে পড়ছে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোয়। দখল ঠেকাতে কিংবা পাল্টা দখল নিতে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী আর্টিলারি শেল বর্ষণ করছে। কখনো কখনো করছে আকাশ পথে আক্রমণ বা এয়ার স্ট্রাইক।
যার শুরু ১ সেপ্টেম্বর ২০২২ তারিখ সকাল থেকে। সেদিন সকাল ৮টায় মিয়ানমারের ম্যাগওয়ে এয়ার বেইজ থেকে দুটি মিগ ২৯ আকাশে উড়ল। লক্ষ্য আরাকানের উত্তর মংডুর ওয়ালিংটন পাহাড়। নির্দেশ মতো তারা ফাইটার চালিয়ে স্ট্রাইক করে আবার ফিরে যায়। তবে যাওয়ার আগে ঢুকে পড়ে বাংলাদেশের সীমান্তের ভেতরে।
এই বাংলাদেশে ঢুকে পড়াটা কি ইচ্ছাকৃত? নাকি ভুলবশত? সেই বিষয়ে আলোচনা চলতে পারে। তবে মিয়ানমারের যুদ্ধ বিমানের আকাশ সীমা লঙ্ঘনের এই ঘটনা নিয়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। তখন থেকেই বাংলাদেশের নাগরিকদের মাঝে সংশয় তৈরি হয়। মিয়ানমার সামরিক আক্রমণ করবে কি না তা নিয়েও চলে জল্পনা-কল্পনা। বাংলাদেশ পাল্টা আঘাত করবে কি না সেই বিষয়েও আলোচনা শুরু হয় বিভিন্ন মহলে।
এবার জানা যাক, কী কারণে মিয়ানমারের এই বিমান আক্রমণ? আগের দিন ৩১ আগস্ট আরাকান আর্মির সম্মুখ যোদ্ধারা ওয়ালিংটন এলাকার বর্ডার গার্ড পুলিশের একটি ক্যাম্প দখল করে। সংঘর্ষে ১৯ জন সীমান্তরক্ষী নিহত হন।
বাংলাদেশের সীমান্তের কাছাকাছি এই বিজিপি ক্যাম্প পুনর্দখল করতে রওনা দেয় মিয়ানমার সেনাবাহিনী। পথে তারাও অ্যামবুশের শিকার হয়। এভাবেই দখল আর পাল্টা দখলে ব্যস্ত মিয়ানমারের সেনাবাহিনী আর বিদ্রোহী আরাকান আর্মি। সীমান্তে এর প্রভাব পড়ছে। আতঙ্কিত করছে বাংলাদেশের সীমান্তের মানুষদের।
নাইক্ষ্যংছড়ির চাকডালা, আশারতলী, লেম্বুছড়ি, পাইনছড়ি, বাইশফাঁড়ী, তুমব্রু হয়ে ঘুমধুম পর্যন্ত সীমান্তের মানুষদের দিন কাটছে শঙ্কার মধ্য দিয়ে। কক্সবাজারের উখিয়ার কিছু অংশও একই আতঙ্কে আছে। নাফ নদীর সীমান্ত অর্থাৎ হোয়াইক্যং থেকে সেন্টমার্টিন দ্বীপ পর্যন্ত মানুষ একই রকমের দুশ্চিন্তায় আছে।
বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যথাসাধ্য চেষ্টা চলছে তবে আস্থা ফেরাতে সেই উদ্যোগ যথেষ্ট বলে মনে করি না। অন্যদিকে প্রথম ডিফেন্স লাইনের বাহিনী বিজিবি অর্থাৎ বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী আছে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে।
এবার আমার এই লেখার মূল বিষয়ে আসছি। মিয়ানমারের ভেতরের আর্টিলারি শেলিং ও ফাইটার বিমানের বেড়ানো, বোমা বর্ষণ ও থেমে থেমে গোলাগুলি সন্ত্রস্ত করেছে আমাদের। বিশেষ করে সীমান্ত সংলগ্ন অঞ্চলে মর্টার শেলিং, সীমান্ত লাগোয়া অঞ্চলে সেই দেশের অভ্যন্তরে মাইন বিস্ফোরণ আতঙ্ক ছড়িয়েছে।
জাতিসংঘও এই বিষয়ে এখনো কার্যকর কিছুই করেনি। বাংলাদেশ গলা ফাটিয়ে যাচ্ছে, বিশ্বনেতারা শুধু আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছেন। এদিকে ১২ লাখ মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত নাগরিকদের চাপ নিচ্ছে বাংলাদেশ।
সংঘর্ষ শুরু হওয়ার পর দুটি মর্টার শেল বাংলাদেশের ভেতরে পড়েছে। কিন্তু বিস্ফোরণ না হওয়ায় প্রাণে বেঁচে গেছে মানুষ। আর শূন্য রেখার কোণারপাড়া রোহিঙ্গা বসতিতে মর্টার বিস্ফোরণে একজন রোহিঙ্গা অর্থাৎ বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে। সেই ঘটনায় আহত হয়েছেন কয়েকজন।
অন্যদিকে মিয়ানমারের ভেতরে গরু আনতে গিয়ে মাইন বিস্ফোরণে একজন বাংলাদেশি নাগরিক আহত হয়েছেন। প্রায় পুরো অক্টোবর মাস জুড়ে আরাকান আর্মি ও মিয়ানমার আর্মির মধ্যকার সংঘর্ষ সীমান্ত থেকে কিছুটা পূর্ব দিকে সরে যায়। ফলে সীমান্তবর্তী এলাকায় এর প্রভাব ছিল না।
এই সময়ে লেম্বুছড়ি ও বাইশফাঁড়ি সীমান্তের মিয়ানমার অংশের ভেতরে কিছু ঘটনা ঘটেছে। সেই ঘটনার সঙ্গে অবশ্য আরাকান আর্মির সম্পৃক্ততা ছিল না। যতটুকু জানতে পেরেছি বিজিপি’র কয়েকটি দখল হয়ে যাওয়া সীমান্ত পোস্ট পুনর্দখল করেছে মিয়ানমার আর্মি। গোলাগুলিতে রোহিঙ্গাদের বিদ্রোহী সংগঠন আরএসও’র দুই জনের মৃত্যু হয়েছে।
৩ নভেম্বর রাতে আবারও মর্টার শেল ও যুদ্ধ বিমান থেকে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটছে। নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রুসহ আশেপাশের এলাকার মানুষের মাঝে তাই নতুন করে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে।
সর্বশেষ পতাকা বৈঠকে দুঃখ প্রকাশ করেছে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপি। তারপর আবারও সীমান্তবর্তী অঞ্চলে সংঘর্ষের ঘটনাগুলো চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিভিন্ন সূত্রে জানতে পেরেছি এই সীমান্তে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী-বিজিপি’র বেদখল হওয়া সীমান্ত ফাঁড়ি দখলে নেওয়ার চেষ্টা করছে সেই দেশের সেনা বাহিনী ও সীমান্তরক্ষী বাহিনী। ঘটনা সত্য হলে আরও কিছুদিন সংঘর্ষ চলবে এই সীমান্তে।