কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি উপজেলার কৃতি সন্তান, উজ্জ্বল নক্ষত্র, আন্তর্জাতিক পরমাণু বিজ্ঞানী, ভাষা সৈনিক, একুশে পদক প্রাপ্ত, জাতিসংঘের আণবিক শক্তি কমিশনের কর্মকর্তা ড. জসিম উদ্দিন আহমেদ মারা গেছেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। বুধবার বিকেল ৫:৩০ মিনিটে ব্যাংকক কে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। তার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন জাতীয় মানবাধিকার সমিতির চেয়ারম্যান মো. মঞ্জুর হোসেন ঈসা, মহাসচিব এড. সাইফুল ইসলাম সেকুল ও সাংগঠনিক সম্পাদক লায়ন আল-আমিন।
নেতৃবৃন্দ শোক বিবৃতিতে বলেন, একজন কিংবদন্তি ভাষা সৈনিক হিসেবে ড. জসিম উদ্দিন আহমেদ আজীবন দেশপ্রেমের প্রেরণা হয়ে থাকবেন। নেতৃবৃন্দ তার বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন এবং শোকাহত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করেন। ড. জসিম উদ্দিন আহমেদ ১৯৩১ সালের ১০ ডিসেম্বর কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি উপজেলা উপজেলার গলিয়ারচর গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন।
তার পিতা মরহুম ওয়াজ উদ্দিন আহমেদ এবং মাতা রাহাতুন্নেছা। ড.জসিম উদ্দিন আহমেদ ১৯৪৮ সালে গৌরীপুর সুবল-আফতাব উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মেট্টিকুলেশন,১৯৫০ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে আই.এস.সি, ১৯৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এস.সি এবং ১৯৫৫ সালে পর্দাথ বিদ্যায় এম.এস.সি ডিগ্রী লাভ করেন। তিনি ১৯৫৬ সালে ঢাকা সরকারি কলেজে প্রভাষক পদে যোগদান করেন, ১৯৫৭ সালে ডিসেম্বর মাসে পাকিস্তান আণবিক শক্তি কমিশনে যোগদান করেন; সাথে সাথেই আমেরিকা গমন করেন। ১৯৫৯ সালে নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের রচেস্টার ইউনিভার্সিটি থেকে আণবিক বিকিরণ নিরাপত্তা বিষয়ে এম, এস, তারপর পাকিস্তানে ফেরত, করাচী পাকিস্তান আণবিক শক্তি কমিশন ল্যাবরেটরিতে যোগ দেন। ১৯৬১ সালে ঢাকায় বদলি হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পূর্ব পাকিস্তানে প্রথম নিউক্লিয়ার মেডিসিন কেন্দ্র স্থাপন করার দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি ১৯৬৩ সালের জানুয়ারি মাসে পি. এইচ.ডি ডিগ্রী জন্য আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অব মিসিগানে চলে যান এবং ১৯৬৬ সালের এপ্রিল মাসে পাকিস্তানে ফেরত এসে ঢাকা আণবিক শক্তি কেন্দ্রে আণবিক বিকিরণ বিভাগের প্রধান হিসাবে যোগ দেন। ১৯৬৮ সালে করাচী আণবিক শক্তি কমিশন হেড অফিসে বদলি হন এবং ডাইরেক্টর পদে থাকাকালীন সময়ে ১৯৭০ সালে পাকিস্তান সরকার স্পনসরশিপে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি এজেন্সি ভিয়েনাতে যোগ দেন। দীর্ঘ ২৪ বছর চাকরি করেন এবং আণবিক বিকিরণ নিরাপত্তা বিভাগের ডাইরেক্টর এবং প্রধান থাকাকালীন ১৯৯৪ সালে অবসর গ্রহণ করেন। তারপরও ২০০০ সাল পর্যন্ত আন্তর্জাতিক কনসালটেন্ট হিসেবে কাজ করেন। তিনি প্রায় ৪০ টি দেশের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ উপদেষ্টা ছিলেন। তিনি আণবিক বিকিরণ নিরাপত্তা বিষয়ে স্ট্যান্ডার্ডস,কোডস,গাইডস, এবং টেকনিক্যাল রিপোর্ট নিয়মাবলি, নীতি, উপদেশবলী বিষয়ক ১৭ টি বই প্রস্তুত করেন, যা বিশ্বের প্রায় সব দেশে ব্যবহৃত হয়।
ভিয়েনায় মসজিদ নির্মাণে সহায়তাসহ জাতিসংঘ বিল্ডিং-এ জুম্মার নামাজের ব্যবস্থা করেন এবং প্রায় ১২ বছর সেখানে জুম্মার খুতবা দেন। এছাড়াও তিনি একজন ভাষা সৈনিক। ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারী ফ্রন্ট লাইন সংগ্রামে বাংলা ভাষার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে পুলিশের সাথে মুখোমুখি যুদ্ধ করেন। অনুমান বেলা ৩:১৫ টায় সময় ডিস্ট্ক্টি ম্যাজিস্ট্রেট কোরায়শির সিদ্ধান্ত ৩ জন পুলিশ হাঁটু গেড়ে বন্দুক নিয়ে বসে এবং গুলি ছুড়তে থাকে। এসময় তিনি এবং তার বাম পাশে শাহজাহান এবং ডানপাশে গায়ে গায়ে লাগানো আবুল বরকত ১২ নং ব্যারাকের সম্মুখে দাঁড়ানো ছিল।
আবুল বরকত গুলিবিদ্ধ হয়ে বারান্দায় পড়ে যায়। তখন ড. জসিম উদ্দিন ত্বরিত গতিতে বরকতের রক্তাক্ত দেহ কোলে নেন এবং রক্তে তার কাপড় চোপড় ভিজে যায়। তিনি পবিত্র কোরআনের বিজ্ঞান বিষয়ে এবং ধর্মের উপর তুলনামূলক গবেষণা করেন এবং বহু বৈজ্ঞানিক তথ্য সম্বন্ধে দেশে বিদেশে ৪৬ টি বিষয়ের উপর বক্তৃতা করেন। রবীন্দ্র সঙ্গীতের উপর তার দুটি সিডি প্রকাশিত হয়েছে। তিনি সম্নানজনক কর্মকান্ডের স্বীকৃতিস্বরূপ দেশ বিদেশের বিভিন্ন সংস্থা থেকে এ পর্ষন্ত স্বর্ণপদকসহ ২০০টি সম্মাননা পদক পেয়েছেন। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে একুশে পদক প্রদান করেন।