বিভিন্ন সময়ে প্রশ্নপত্রে যেকোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটলেই কিছু লোক সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি বা সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। আসুন আমাদের দেশের সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতি সম্পর্কে কিছু জানার চেষ্টা করি।
প্রায় পৌনে একশ বছর আগের ব্রিটিশদের চালু করা কেরানি তৈরি করার (উচ্চ) শিক্ষা পদ্ধতি এখনো দেশে চালু আছে। নিম্ন বা মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা পদ্ধতি কখনো আংশিক, কখনো ভাইটাল পরিবর্তন করা হয়ে থাকলেও তার সবগুলোই ছিল ‘টেস্ট কেস’। কোনো এক বা একাধিক ব্যক্তি ইচ্ছে পোষণ করেছেন, আর সেটা চালু করা হয়েছে। প্রয়োগ করার পরে যখন আবার কর্তৃপক্ষ পরিবর্তিত হয়েছে, সাথে সাথে শিক্ষা পদ্ধতিও পরিবর্তিত হয়েছে।
একমাত্র ‘সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতি’ চালু হয়েছে পরীক্ষালব্ধভাবে। এই শিক্ষা পদ্ধতি নিয়ে হয়েছে প্রচুর গবেষণা। ইংরেজি নাম (creative) শুনলেই অনুমান করা যায় সিস্টেম কেমন হতে পারে। শিক্ষা পদ্ধতির আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক জ্যাক হলব্রুকের পরীক্ষালব্ধ এই শিক্ষা পদ্ধতি পৃথিবীর অনেক দেশেই (সব দেশে নয়) চালু হয়েছে।
সৃজনশীল নামে পৃথিবীর আর কোথাও চালু না থাকলেও মূল থিম ঠিক রেখে চলছে সর্বত্র। ‘এ’ লেভেল / ‘ও’ লেভেল বা জিআরই (GRE)-এর প্রশ্ন পদ্ধতি দেখলেও কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়।
দেশে এর পূর্বে যত ধরনের পরীক্ষা পদ্ধতি চালু ছিল বা উচ্চশিক্ষায় এখনো আছে—তার কোনোটিতেই শিক্ষার্থীকে নম্বর দেওয়ার কোনো মানদণ্ড তৈরি হয়নি আজও। সেজন্য ১০০ নম্বরের একটা উত্তরপত্র ১০ জন শিক্ষককে দিয়ে মূল্যায়ন করার পরে ৪৬ নম্বর পর্যন্ত ভেরিয়েশন পাওয়া গেছে। যেখানে সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতিতে উত্তরপত্র মূল্যায়নের ক্ষেত্রে পার্থক্য হয় এক ডিজিটে।
দুনিয়াব্যাপী প্রশ্ন পদ্ধতি নিয়ে ব্যাপক গবেষণা হয়ে থাকে। কারণ প্রশ্ন পদ্ধতির মধ্যেই থাকে প্রোডাক্ট কোয়ালিটি বিশ্লেষণ করার টেকনিক। সেজন্য উন্নত দেশগুলোয় সারাবছর প্রশ্ন (items) তৈরির জন্য লোকবল নিয়োগ থাকে, যারা হাইলি পেইড।
আইইএলটিএস (IELTS) পরীক্ষার প্রশ্ন তৈরি হয় সারাবছর এবং প্রশ্ন ব্যাংকে তা রিজার্ভ করা হয়ে থাকে। পৃথিবীব্যাপী প্রশ্ন প্রণেতারা হাই ডিমান্ডেড হলেও বাংলাদেশে ইহা সাধারণ। এদেশে সবাই প্রশ্ন প্রণেতা, অথচ প্রশ্নমাণ (question validity) সম্পর্কে ধারণা/প্রশিক্ষণ খুব কম শিক্ষকেরই আছে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একজন শিক্ষককে গণিত বিষয়ের প্রশ্ন করতে দিলে তিনিও একটা বই দেখে দুই-তিন বছরের প্রশ্নের আলোকে প্রশ্ন করতে পারেন। তেমনিভাবে গণিত বিষয়ের শিক্ষকেরও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রশ্ন করতে ন্যূনতম চিন্তা করতে হয় না।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার আরেকটি দুর্বল দিক হচ্ছে—মুখস্থ নির্ভর। যা পৃথিবীতে এখন বিরল। কলা বিভাগের শিক্ষার্থী পরীক্ষার খাতায় my aim in life রচনায় লিখে—I want to be a doctor. মুখস্থ নির্ভর জ্ঞান নিয়ে দুনিয়ায় চলতে গেলে, জীবনের বাঁকে বাঁকে যে সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়—সেই উপলব্ধি হতে যেকোনো উদ্ভূত সমস্যায় নিজের অর্জিত মেধাকে কাজে লাগিয়ে সমাধান করার জন্যই উদ্ভাবিত হয়েছে এই সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতি।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে—শিক্ষার্থী দূরে থাক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীল অধিকাংশ ব্যক্তিই জানেন না—শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। গন্তব্যহীন শিক্ষা থেকে সরিয়ে অভিষ্ঠ লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতির প্রত্যেকটি প্রশ্নে রয়েছে শিখনফল। প্রত্যেকটা বিষয়ের উচ্চতর দক্ষতা অর্জনের জন্য এই পদ্ধতিতে রয়েছে জ্ঞানমূলক বিশ্লেষণ। এছাড়া নকলবাজী পরীক্ষা সিস্টেমের নকল প্রায় তাড়িয়ে দিয়েছে এই পদ্ধতি।
তবে এই শিক্ষা পদ্ধতিই যে পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো পদ্ধতি—তা বলছি না। তবে পূর্বে যত শিক্ষা পদ্ধতি এদেশে চালু ছিল, তা অপেক্ষা যে কয়েকগুণ ভালো তা নিঃসন্দেহে অনুমেয়।
তাহলে সমস্যা কোথায়? একটু গোড়ার কথা বলি। ২০০৬-২০০৭ সালে দেশে চালু হতে যাচ্ছিলো ‘এক মুখী শিক্ষা নীতি’। এডিবির অর্থায়নে শিক্ষার মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে সেই শিক্ষা পদ্ধতির বই প্রণয়নে যারা নিয়োজিত ছিলেন আমি তাদের মধ্যে একজন নগণ্য সদস্য ছিলাম। সেই শিক্ষা পদ্ধতিতে প্রশ্নের ধারণা ছিল কাঠামোবদ্ধ/গুচ্ছ প্রশ্ন।
নিম্ন জ্ঞান থেকে উচ্চতর জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীকে অধিক যোগ্যতায় নিয়ে যাওয়াই ছিল সেই পদ্ধতির লক্ষ্য। নতুন এই পদ্ধতি চালু হওয়ার পূর্বেই কর্তৃপক্ষ পরিবর্তন হয়, হোঁচট খায় ‘এক মুখী শিক্ষা নীতি’।
এরপরে নতুন কর্তৃপক্ষ দুয়েকটা বিষয়ের সামান্য পরিবর্তন করে এবং কাঠামোবদ্ধ/গুচ্ছ প্রশ্নের গায়ে কিছুটা রংয়ের প্রলেপ দিয়ে আর নীতিনির্ধারণী মহল পরিবর্তনের মাধ্যমে নতুন যে শিক্ষা পদ্ধতি চালু করেন ২০১০ সালে তার নাম ‘সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতি’।
উল্লেখ্য, একমুখী শিক্ষা পদ্ধতিতে যারা বই লিখবেন তাদের নিয়ে একটা সেমিনারের আয়োজন করা হয়েছিলো, যেখানে আমি উপস্থিত ছিলাম। ২১ দিনের মধ্যে বইয়ের পাণ্ডুলিপি জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হলো। সব লেখক প্রচণ্ড প্রতিবাদ করলেও, অনুষ্ঠানের প্রধান ব্যক্তি ঢাবির প্রয়াত অধ্যাপক আ ফ ম খোদাদাদ খান তার অসহায়ত্ব প্রকাশ করে বলেছিলেন—”আমি কর্তৃপক্ষ কে বুঝিয়ে বলব, তবে শুনবেন বলে মনে করিনা”।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত যেকোনো সদস্যের অর্ধেক বয়স তখন আমার। দাঁড়িয়ে কী বলবো, কীভাবে বলবো বুঝতে পারছিলাম না। নির্ভয়ে যতটুকু বলেছিলাম তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য দুয়েকটা লাইন নিম্নরূপ—”আমি দেখতে পাচ্ছি, এখানে যারা আছেন-সবাই বৃদ্ধ মানুষ। সবাই নিশ্চয়ই অভিজ্ঞ লেখক। কিন্তু নতুন এই সিস্টেমের সাথে কারোর কোনো সম্পর্ক নেই। তাই আমি নিশ্চিত যে, বইয়ে এই নতুন পদ্ধতি প্রতিফলিত হবে না। কারিকুলাম সম্পর্কে শিক্ষকের ধারণা একটু কম হলেও চলে, শিখে নিবেন; কিন্তু লেখকের পূর্ণ ধারণা থাকতেই হবে, অন্যথায় কখনোই সফলতা আসবে না। কলাপ্স করবে এই শিক্ষা পদ্ধতি। তাই আমার প্রস্তাব-আগে লেখকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। যদি তা সম্ভব না হয়-তবে ৭ দিন, ন্যূনতম ৩ দিনের একটা ওয়ার্কশপের আয়োজন করে হলেও লেখকদের পূর্ণাঙ্গ ধারণা দিতে হবে।”
সবাই হইচই করে একমত পোষণ করলেন। খোদাদাদ খান বললেন—”আমি কর্তৃপক্ষকে অবগত করব এবং সবিনয় অনুরোধ করব”।
কিছুই হলো না। নির্ধারিত সময়েই বই প্রকাশিত হলো। একটা বইও কারিকুলামের ধারে কাছেও গেল না। ক, খ, গ, ঘ উল্লেখপূর্বক চারটি প্রশ্ন এক সাথে লিখে দিয়ে তৈরি করে ফেলেছেন সবাই ‘কাঠামোবদ্ধ’ প্রশ্ন! আগেই বলেছি—সেই কাঠামোবদ্ধ প্রশ্ন পদ্ধতির গায়ে রঙ লাগিয়ে বার্নিশ করে নতুন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে প্রস্তুত করা হয়েছে ‘সৃজনশীল’ শিক্ষা পদ্ধতি।
এটা গেল বই প্রসঙ্গ। সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতি শিক্ষকেরা কীভাবে পড়াবেন! কীভাবে প্রশ্ন প্রণয়ন করবেন! কীভাবে উত্তরপত্র মূল্যায়ন করবেন! তারজন্য ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা হলো। প্রথমে কয়েক’শ শিক্ষকদের ট্রেনিং দিয়ে মাস্টার ট্রেইনার করা হলো। তাদের দিয়ে সারাদেশের শিক্ষকদের ট্রেনিং দেওয়া হবে।
আমিও সেই মাস্টার ট্রেইনার হলাম ২০১২ সালে, আজ পর্যন্ত কোনো শিক্ষকদের ট্রেনিং দিতে হয়নি আমার! তাহলে সারাদেশের শিক্ষকদের কী ট্রেনিং হয়েছে? নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানলাম, প্রায় এক পঞ্চমাংশ শিক্ষকের (৩ দিন করে) ট্রেনিং হয়েছে নতুন এই শিক্ষা পদ্ধতি নিয়ে। তাহলে সিংহভাগ শিক্ষকের কাছেই সৃজনশীল পদ্ধতি রয়েছে অধরা।
কোনো প্রকার ট্রেনিং ছাড়াই অনেকেই হয়েছেন লেখক। পাশাপাশি কয়েকটা প্রশ্ন জোড়া লাগিয়ে তৈরি করে ফেলেছেন ‘সৃজনশীল’ প্রশ্ন! আর সেই প্রশ্নের ওপরে অর্থহীন, ভাবহীন ২/৩ লাইন লিখে চালিয়ে দিচ্ছেন ‘উদ্দীপক’ হিসেবে।
প্রশ্ন প্রণেতারা গাইড ফলো করে প্রশ্ন প্রণয়ন করতে গিয়ে ‘আলালের’ পরিবর্তে ‘হালাল’ লিখে সমাজে বিতর্ক সৃষ্টি করে চলেছেন। কথা উঠছে সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতি নিয়ে, শিক্ষকদের দক্ষতা নিয়ে। ট্রেন চালক দিয়ে বিমান চালাতে গিয়ে দুর্ঘটনার দায় চাপানো হচ্ছে বিমান নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের।
সারকথা হলো, আজ পর্যন্ত দেশে যত ধরনের শিক্ষা পদ্ধতি চালু হয়েছে—সৃজনশীল তার মধ্যে সেরা। যদি এর চেয়েও ভালো কোনো পদ্ধতি কেউ কখনো প্রবর্তন করতে পারেন—তখন সেটাকে গ্রহণ করা যেতেই পারে। কিন্তু অবশ্যই সেটা হতে হবে পরীক্ষিত। ‘টেস্ট কেস’ বা গণভোটের মাধ্যমে কোনো দেশের শিক্ষা পদ্ধতি পরিবর্তন হতে পারে না—এটা অবশ্যই গবেষণাধর্মী বিষয়।
ড. মুহম্মদ মফিজুর রহমান ।। বিসিএস, সাধারণ শিক্ষা; পিএইচডি, হুয়াজং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, চীন
One thought on “সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতি ও পেছনের কথা”