লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর প্রধান সাইয়েদ হাসান নাসরুল্লাহ ছিলেন ইসরাইলের বিরুদ্ধে ৩২ বছরের দীর্ঘ প্রতিরোধ সংগ্রামের মূল চালিকাশক্তি। শুক্রবার রাতে লেবাননের বৈরুতে ইসরাইলের বাঙ্কার বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় তিনি নিহত হন।
এ ঘটনার মাত্র এক সপ্তাহের কিছু বেশি আগে বৈরুতে ইসরাইলের আরেক হামলায় নিহত হন হিজবুল্লাহর জ্যেষ্ঠ কমান্ডার ইব্রাহিম আকিল। ইরানের রাজধানী তেহরানে ইসরাইলের হাতে ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের প্রধান ইসমাইল হানিয়া নিহত হওয়ার দুই মাস পর ঘটল এসব ঘটনা।
লেবাননে নজিরবিহীন এসব হামলায় হাসান নাসরুল্লাহ ও অন্য কয়েকজন নেতা নিহত হওয়া এবং এ মাসেরই শুরুর দিকে দেশটিজুড়ে হাজারো পেজার ও ওয়াকিটকি বিস্ফোরণে হতাহত হওয়ার ঘটনায় এখন সম্ভাব্য ক্ষমতাশূন্যতার সম্মুখীন হিজবুল্লাহ।
তাই হাসান নাসরুল্লাহর উত্তরসূরির নাম এখনই ঘোষণা করবে না লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ। কেননা যার নাম ঘোষণা করা হবে তিনিই ইসরাইলের টার্গেটে পরিণত হতে পারেন। নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক আলী রিজক এ ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, শীর্ষ ও জ্যেষ্ঠ নেতাদের হারানোর এসব ঘটনা হিজবুল্লাহর জন্য স্বল্প মেয়াদে বড় আঘাত হলেও দীর্ঘ মেয়াদে সংগঠনটির ওপর খুব খারাপ প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা নেই। কেননা, এক নেতার জায়গায় অন্য নেতাকে বসিয়ে ক্ষমতার শূন্যতা পূরণ করবে হিজবুল্লাহ। তা ছাড়া সংগঠনটির রয়েছে অস্ত্রশস্ত্রের বিশাল সম্ভার, সঙ্গে যথেষ্ট শক্তিমত্তা।
বিশ্লেষকদের মতে, হিজবুল্লাহ এখন টিকে থাকার জন্য পূর্ণশক্তিতে আঘাত করার চেয়ে অস্থায়ী নেতৃত্বশূন্যতার কৌশলগত বিকল্পকে বেছে নেওয়ার মুখোমুখি অবস্থায় রয়েছে।
ইউনিভার্সিটি অব তেহরানের অধ্যাপক মোহাম্মদ মারান্ডি বলেন, বৈরুতকে হিজবুল্লাহর ‘দুর্বলতম পয়েন্ট’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সেখানে পশ্চিমা বিভিন্ন দেশের দূতাবাস ও পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাও থাকেন। তবে সার্বিকভাবে হিজবুল্লাহকে সামরিক দিক থেকে হারানোর সক্ষমতা নেই ইসরাইলের।
বিশেষজ্ঞদের ধারণা, হিজবুল্লাহ ভিন্ন একটি ভুল করেছে, যা তাকে ইসরাইলের কাছে দুর্বল করে তুলেছে।
এ প্রসঙ্গে হামাদ বিন খলিফা ইউনিভার্সিটির জননীতিবিষয়ক জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক সুলতান বারাকাত বলেন, হিজবুল্লাহর বড় ভুল, তারা নিজেদের ইরানিদের প্রক্সি হিসেবে অনেক বেশি ব্যবহার করার সুযোগ দিয়েছে। অথচ এর আগে নিজেদের জনগণের স্বার্থে লেবাননের ভূখণ্ড রক্ষায় ইসরাইলের সঙ্গে হওয়া লড়াইয়ে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে হিজবুল্লাহ।
কার্নেগি মিডল ইস্ট প্রোগ্রামের জ্যেষ্ঠ ফেলো ইয়েজিদ সেইগ বলেন, ‘হিজবুল্লাহ নিঃশেষ হচ্ছে না। এমনকি এখন ইরান যদি তাকে (হিজবুল্লাহ) রক্ষায় এগিয়ে না আসে, তবু কৌশলগত ধৈর্য ধরাকেই বেছে নেবে তারা।’
১৯৯২ সালে হিজবুল্লাহর তৎকালীন নেতা আব্বাস আল-মুসাভি ইসরাইলি হামলায় নিহত হলে নাসরুল্লাহ মাত্র ৩৫ বছর বয়সে সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তার নেতৃত্বে হিজবুল্লাহ ইসরাইলের বিরুদ্ধে একাধিক সফল প্রতিরোধ অভিযান পরিচালনা করে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ২০০০ সালে ইসরাইলি সেনাবাহিনীর দক্ষিণ লেবানন থেকে প্রত্যাহার। এটি ছিল হিজবুল্লাহর বড় বিজয়, যা নাসরুল্লাহকে লেবাননসহ আরব বিশ্বের মধ্যে একজন প্রতিরোধ নেতায় পরিণত করে।
নাসরুল্লাহর নেতৃত্বে হিজবুল্লাহ ইরান থেকে মিসাইল ও রকেট সংগ্রহ করে, যা ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালাতে কাজে লাগানো হয়। ২০০৬ সালে ইসরাইলের সঙ্গে ৩৪ দিনের যুদ্ধে হিজবুল্লাহর প্রতিরোধ ও প্রতিশোধ স্পষ্টভাবে প্রকাশ পায়। যাকে তিনি ‘স্পস্ট বিজয়’ বলে আখ্যা দেন। এ যুদ্ধের পর তিনি আরব বিশ্বের মধ্যে একজন শ্রদ্ধেয় নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন।
তার নেতৃত্বেই হিজবুল্লাহ দূরপাল্লার রকেট অর্জন করে। যা তাদেরকে উত্তর ইসরাইলের লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালানোর সক্ষমতা দেয়। যদিও ইসরাইল দক্ষিণ লেবাননে তার দখলদারিত্ব বজায় রেখেছিল।