যোগ্যতার মাপকাঠিতে কর্মীদের পদোন্নতি দেওয়ার নিয়ম হঠাৎ করে যেন পাল্টে গেছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই)। এখন যোগ্যতার পাশাপাশি লাগছে কর্তাদের সুপারিশও! যে কারণে যোগ্যতার পরও সুপারিশের অভাবে পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন অনেক কর্মকর্তা। ফলে তাদের মধ্যে দেখা দিয়েছে অসন্তোষ।
সম্প্রতি এ বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কাছে অভিযোগ করেছেন ডিএসইর কর্মকর্তারা। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সুনির্দিষ্ট কারণ জানতে চেয়ে গত মঙ্গলবার ডিএসইকে চিঠি দিয়েছে বিএসইসি।
অন্যদিকে, ডিএসইর নিরীক্ষক প্রতিষ্ঠান একনাবিনও পদোন্নতির বিষয়ে গত মঙ্গলবার প্রতিষ্ঠানটির ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইফুর রহমান মজুমদারের কাছে জানতে চেয়েছে। কিন্তু এ বিষয়ে একনাবিনকে কোনো উত্তর দেননি ডিএসইর ভারপ্রাপ্ত এমডি।
পদোন্নতি থেকে নাম বাতিল ও ডাবল প্রমোশন দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএসইর ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও মুখপাত্র সাইফুর রহমান মজুমদার কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি
গত ২৭ অক্টোবর ডিএসইর সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তারিক আমিন ভূঁইয়ার দেওয়া পদোন্নতির তালিকা থেকে ১৮ কর্মকর্তার নাম বাতিল করেছে পরিচালনা পর্ষদ। একইসঙ্গে আট কর্মকর্তাকে দুবার পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। গত ২৩ আগস্ট ৯৫ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেন সাবেক এমডি তারিক আমিন। ওই দিনই তিনি পদত্যাগ করেন।
এদিকে, পদোন্নতিবঞ্চিতরা বিএসইসির কাছে নিয়ম ভাঙার প্রসঙ্গ তুলে বেশ কয়েকটি অভিযোগ করেছেন। সেখানে তারা বলেছেন, ডিএসই (বোর্ড অ্যান্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেশন) রেগুলেশন, ২০১৩-এর ৬.৬ ধারা অনুযায়ী, পরিচালনা পর্ষদ এমডির সব সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। যদি হস্তক্ষেপ করে তাহলে তা নীতিমালা পরিপন্থী বলে বিবেচিত হবে। কিন্তু ডিএসইর ১০৪৪তম সভায় প্রতিষ্ঠানটির সাবেক এমডির দেওয়া পদোন্নতিতে হস্তক্ষেপ করা হয়েছে। গত ২৭ অক্টোবর অনুষ্ঠিত সভায় গত ২৩ আগস্টের দেওয়া পদোন্নতি বাতিল করা হয়েছে।
৮.৯ ধারায় বলা আছে, পরিচালকরা কোনোভাবেই এক্সচেঞ্জের ম্যানেজমেন্টের কার্যক্রমের বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারবেন না। এমডির কোনো সিদ্ধান্তে কিছু ভুল বা ডিএসইর ক্ষতি হতে পারে— এমন মনে হলে পরিচালনা পর্ষদ তা বিএসইসিকে তদন্ত করার জন্য অনুরোধ করতে পারে। অথবা অভ্যন্তরীণ অডিট দল দিয়ে তদন্ত করার সুযোগ রয়েছে। ডিএসইর পর্ষদ এ আইন লঙ্ঘন করেছে।
দ্বিতীয় অভিযোগ হলো- ডিএসইর পদোন্নতি আইনের ৯.১ ধারায় বলা হয়েছে, ডিএসইর কর্মকর্তাদের পদোন্নতি, ইনক্রিমেন্ট, পুরস্কার দেওয়া হবে কর্মকর্তাদের পারফরম্যান্স অ্যাপ্রাইজাল (পিএ) বা মানদণ্ড মূল্যায়নের ওপর। কিন্তু এ পদোন্নতিতে সেই আইন ভঙ্গ করা হয়েছে।
তৃতীয়ত- ডিএসইর পিএ গাইডলাইন ৭.৩ অনুসারে, যাদের বার্ষিক মানদণ্ড মূল্যায়নের (এপিএ) রেটিং-৫, তাকে অবশ্যই পদোন্নতি দিতে হবে। এ পদোন্নতিতে সেই নিয়ম পালন করা হয়নি। বরং ২০২১-২২ অর্থবছরে পিএ রেটিং-৫ পাওয়া সাতজনের পদোন্নতি বাতিল করা হয়েছে।
চতুর্থত- ডিএসইর পদোন্নতি আইনের ৯.১.১ এ বলা হয়েছে, যখন দুই ব্যক্তির পারফরম্যান্স সমান হয়, তখন ডিএসই দেখবে তাদের মধ্যে কে জ্যেষ্ঠ, তাকে পদোন্নতি দেবে। কিন্তু জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি না দিয়ে সবচেয়ে ছোট কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে।
পঞ্চম অভিযোগ হলো- আট কর্মকর্তাকে ডাবল পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। যাকে অতিরঞ্জিত পদোন্নতি বলা হয়। কিন্তু ডিএসইর সার্ভিস রুলস, কিংবা অন্য কোনো রুলসে ডাবল প্রমোশনের কোনো বিধান নেই।
সর্বশেষ অভিযোগে বলা হয়, ডিএসই কোনোভাবেই পদোন্নতি দেওয়া কর্মকর্তাদের পদোন্নতি বাতিল করতে পারে না। এতে সমাজে কর্মকর্তাদের মানসম্মান ক্ষুণ্ন হয়। কর্মকর্তারা ডিমোটিভেট হন।
নাম না প্রকাশের শর্তে পদোন্নতিবঞ্চিত এক কর্মকর্তা বলেন, নিয়ম অনুসারে পিএ রেট-৫ হলেই পদোন্নতি হবে। পিএ-৫ পেতে হলে প্রত্যেক কর্মকর্তাকে দিন-রাত পরিশ্রম করতে হয়। আমি দিন-রাত পরিশ্রম করে পরপর তিন বছর পিএ-৫ পাই। কিন্তু ম্যানেজমেন্টের কর্তাব্যক্তিদের অপছন্দের কারণে পদোন্নতি হওয়ার পরও তা বাতিল করা হয়।
‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করেছি। কিন্তু আমাদের পদোন্নতি দেওয়া হয়নি। অথচ সরকারনিষিদ্ধ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় দারুল ইহসান থেকে ডিগ্রিধারী পিএ রেট-৩ থাকা ব্যক্তিকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। এটা শুধু ম্যানেজমেন্ট টিমের বিশেষ ব্যক্তিদের ইচ্ছার কারণে হয়েছে।’
ডিএসইর আরেক কর্মকর্তা বলেন, তিন মাস আগে আমাকে প্রমোশন দেওয়া হয়েছে। এখন কোন অপরাধে আমার পদোন্নতি বাতিল করা হলো? আমি আমার পদোন্নতির খবর পারিবার ও বন্ধুবান্ধব, এমনকি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জানিয়েছিলাম। এখন পদোন্নতি বাতিল করে দিয়ে আমাকে ছোট করা হয়েছে।
‘সিনিয়র ম্যানেজার থেকে এজিএম হয়েছি। গত দুই-আড়াই মাস খাতায় এটি লিখে এসেছি। এজিএম হিসেবে নথিপত্রে সই করেছি। এটা কি এমনি এমনি?’
পদোন্নতি থেকে নাম বাতিল ও ডাবল প্রমোশন দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএসইর ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও মুখপাত্র সাইফুর রহমান মজুমদার কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে, সাবেক এমডি তারিক আমিন ভূঁইয়া বলেন, আমি নিয়ম ও যোগ্যতা অনুসারে ৯৫ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দিয়েছি। এখন শুনছি ১৮ জনকে পদোন্নতি থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। এটা বেআইনি। যারা এ জঘন্য কাজ করেছেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
তবে, নাম না প্রকাশের শর্তে ডিএসইর স্বতন্ত্র এক পরিচালক বলেন, সাবেক এমডির দেওয়া পদোন্নতি নিয়ে অনেক প্রশ্ন ওঠে। তাই ডিএসইর বর্তমান ম্যানেজমেন্ট টিম যাচাই-বাছাই করে পদোন্নতির নতুন তালিকা তৈরি করেছে। বোর্ডে এসেছে, সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখানে বোর্ডের পক্ষ থেকে ম্যানেজমেন্টের ওপর কোনো হস্তক্ষেপ করা হয়নি।
উল্লেখ্য, গত ২৩ আগস্ট ডিএসইর কর্মকর্তাদের মধ্যে কাজের উদ্দীপনা ফেরাতে একযোগে ৯৫ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়। এটি দেন সাবেক এমডি তারিক আমিন। কিন্তু এতে ক্ষিপ্ত হন পরিচালনা পর্ষদের অনেকে। অভিযোগ আছে, ডিএসইর সংক্ষুব্ধ পরিচালকরা তার সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন। বিষয়টি মানতে না পেরে পদত্যাগ করেন সাবেক এমডি।
পদত্যাগের পর তারিক আমিন ভূঁইয়া বিএসইসিতে পাঠানো এক চিঠিতে দাবি করেন, ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশন নীতিমালা মেনে তিনি কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দিয়েছিলেন। নীতিমালা মেনে কাজের সুযোগ পেলে তিনি আবার ফিরতে চান। কিন্তু তাকে সেই সুযোগ না দিয়ে অনেকটা তড়িঘড়ি করে তার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা হয়।
ডিএসইর কর্মকর্তাদের অভিযোগ, তারিক আমিন ভূঁইয়ার প্রতি আক্রোশ থেকেই এ পদোন্নতি বাতিল করা হয়েছে। তিনি দায়িত্বে থাকাকালে যাদের কাজে আস্থা রাখতেন বেছে বেছে তাদের পদোন্নতি বাতিল করা হয়েছে।
এ সংক্রান্ত একটি অভিযোগও তারিক আমিন বিএসইসির কমিশনার অধ্যাপক শেখ সামসুদ্দিন আহমেদ ও বিএসইসির চেয়ারম্যানকে পাঠান। অভিযোগপত্রে তিনি উল্লেখ করেন, সব নিয়ম অনুসরণ করে আমি ৯৫ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দিয়েছে। আমার দেওয়া পদোন্নতি বাতিল করে ডিএসইর বর্তমান ম্যানেজমেন্ট যে পদোন্নতি দিয়েছে তা নিয়মবহির্ভূত ও আইনের লঙ্ঘন। তিনি বিএসইসির কাছে তার দেওয়া পদোন্নতি বহাল রাখার অনুরোধ জানান।
সেখানে আরও বলা হয়, বর্তমান কমিটি মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেনি এমন সব ব্যক্তিকে প্রমোশন দিয়েছে। নিয়মের বাইরে গিয়ে ডাবল প্রমোশনও দিয়েছে। যোগ্যতা অনুসরণ করা ১৮ ব্যক্তির প্রমোশন বাতিল করা অত্যন্ত দুঃখজনক।
এ বিষয়ে বিএসইসির কমিশনার অধ্যাপক শেখ সামসুদ্দিন আহমেদ বলেন, ডিএসইর কর্মকর্তাদের পদোন্নতিতে অনিয়ম হয়েছে বলে আমাদের কাছে অভিযোগ এসেছে। আমরা সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তাদের ডেকেছি। দেখি তারা কী জবাব দেন। তারপর দেখা যাবে কোথায় গলদ হয়েছে।
নাম না প্রকাশের শর্তে বিএসইসির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ডিএসইর কর্মকর্তা ও পরিচালনা পর্ষদের কাজে হতাশ আমরা। ডিএসইর বোর্ড অথর্ব। তারা কিছু কর্মকর্তার পরামর্শে চলেন। তা না হলে এমন একটি কাণ্ড হলো, এটা কীভাবে অনুমোদন পেল? আমরা বিষয়টি দেখছি।
পদোন্নতি হারানো কর্মকর্তারা হলেন- সৈয়দ আল-আমিন রহমান, সাইদ মাহমুদ যোবায়ের, মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম ভূঁইয়া, মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন রেজা, মো. বজলুর রহমান, কামরুন নাহার, মোহাম্মদ হারুন-অর-রশিদ পাঠান, মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান, সৈয়দ ফয়সাল আব্দুল্লাহ, মোহাম্মদ আহসান হাবিব, ফারহানা শরিফা, সাদাত মারুফ হাসনায়েন, শরিফ গিয়াস উদ্দিন আলম, মশিউর রহমান চৌধুরী, মামুন-উর-রশিদ, আব্দুল লতিফ মিয়া, সফিকুল আলম ও দেলোয়ার হোসেন।
অপরদিকে, ডাবল প্রমোশন পাওয়া কর্মকর্তা হলেন- ডেপুটি ম্যানেজার এ এইচ এম রাহাত আহমেদ ও সাহাদাত হোসেন, সিনিয়র এক্সিকিউটিভ অফিসার নাজমুস সাকিব, এক্সিকিউটিভ অফিসার সাবিনা ইয়াসমিন, উৎপল চন্দ্র দেবনাথ, বদরুল আলম শাওন, রাজিব সরকার এবং ইমরান হোসেন।