হায়দরাবাদ (তেলেঙ্গানা, ভারত) থেকে ফিরে: মাসে খরচ বাবদ মেলে ৬০ হাজার রুপি, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৭৫ হাজার টাকা। আর বছরে গবেষণার জন্য মেলে এক লাখ রুপি।
এছাড়া আবাসন সুবিধা তো থাকছেই।
বাংলাদেশসহ বিদেশের শিক্ষার্থীরা এমনই স্কলারশিপে উচ্চশিক্ষার সুযোগ পাচ্ছেন ভারতের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি হায়দরাবাদে (আইআইটি হায়দরাবাদ)।
প্রতিষ্ঠানটির অবস্থান ভারতের দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ রাজ্য তেলেঙ্গানার সাঙ্গারেডি জেলার কান্দি গ্রামে।
সবুজ চাদরে আবৃত প্রায় ৬০০ একর জমির ওপর গড়ে ওঠা সরকারি এ প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় বিদেশি শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার অন্যতম পছন্দের হয়ে উঠেছে।
এখানে প্রকৌশল, প্রযুক্তি, স্থাপত্য, কলা, মনোবিজ্ঞান, সাইবার নিরাপত্তা, আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই), শিল্প-বিজ্ঞানসহ বিভিন্ন আধুনিক বিষয়ে শিক্ষা ও গবেষণার সুযোগ রয়েছে।
নয়াদিল্লি ও হায়দরাবাদ সফরকারী বাংলাদেশের সাংবাদিক প্রতিনিধি দল পরিদর্শন করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
ব্যস্ত নগর ছেড়ে নিভৃত গ্রামের ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতেই স্বাগত জানান আইআইটি হায়দরাবাদের জনসংযোগ কর্মকর্তা মিতালী আগারওয়াল। পরিচ্ছন্ন সড়ক ধরে বাস বিশ্ববিদ্যালয়ের কনফারেন্স রুমে পৌঁছানোর আগে তিনি বিভিন্ন ভবন ও স্থাপনা এবং এসবের বিশেষত্ব তুলে ধরেন প্রতিনিধি দলের কাছে।
এসময় তিনি জানান, এটি একটি পরিবেশবান্ধব গ্রিন ক্যাম্পাস। এখানে প্রতি মাসের প্রথম শনিবার বৃক্ষরোপণ দিবস পালিত হয়। ফলে এই ক্যাম্পাস এখন শত প্রকারের হাজার হাজার গাছের বাগানে পরিণত হয়েছে।
পরে কনফারেন্স রুমে পৌঁছালে সেখানে এক মতবিনিময় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এতে ভিডিও প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে আইআইটি হায়দরাবাদের উচ্চশিক্ষা কার্যক্রম সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরেন প্রতিষ্ঠানের পরিচালক অধ্যাপক বি এস মূর্তি।
তিনি জানান, বর্তমানে গোটা ভারতে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে আইআইটি হায়দরাবাদ। এ প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করছেন চার হাজার ২০০ শিক্ষার্থী। এর মধ্যে স্নাতক পর্যায়ে এক হাজার ৭৬০, স্নাতকোত্তর পর্যায়ে এক হাজার ২৮০ এবং ডক্টরাল শিক্ষার্থী আছেন এক হাজার ১৬০ জন।
আইআইটি হায়দরাবাদে পড়তে আগ্রহী শিক্ষার্থীদের আবেদন করতে সিজিপিএ ১০-এর মধ্যে ন্যূনতম ৮ লাগে জানিয়ে তিনি বলেন, ফার্স্ট স্কিমের মাধ্যমে আমরা বিদেশি শিক্ষার্থীদের পূর্ণ অর্থনৈতিক সহযোগিতাসহ পিএইচডি করার সুযোগ দিচ্ছি। ফেলোশিপ হিসেবে প্রতিমাসে শিক্ষার্থী ৬০ হাজার রুপি করে পাবেন এবং বছরে গবেষণা সহায়তা হিসেবে এক লাখ রুপি করে পাবেন। এই ফেলোশিপের মেয়াদ থাকবে চার বছর।
ইঞ্জিনিয়ারিং অথবা টেকনোলজি সম্পর্কিত যে কোনো বিষয়ে ভালো ফলাফলসহ স্নাতকোত্তর ডিগ্রি থাকলে যে কেউ এই ফেলোশিপের জন্য আবেদন করতে পারবেন বলে জানান পরিচালক।
বি এস মূর্তি বলেন, আইআইটি হায়দরাবাদের সঙ্গে বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের সমঝোতা চুক্তির মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা এখানে পড়ার সুযোগ পাচ্ছেন। বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় আগ্রহী হলে তাদেরও সে ব্যাপারে সার্বিক সহায়তা করব আমরা।
তিনি আরও জানান, অস্ট্রেলিয়ার সুইনবার্ন ইউনিভার্সিটি ও ডিকিন ইউনিভার্সিটির সঙ্গে যৌথ ডক্টরাল ডিগ্রি প্রোগ্রাম আছে আইআইটি হায়দরাবাদের। নানা সুযোগ-সুবিধার কারণে প্রতিষ্ঠানটিতে পিএইচডি শিক্ষার্থীর হার বাড়ছে। ২০২০ সালে এই প্রতিষ্ঠানে পিএইচডি করতে আসেন ২৩০ জন, পরের বছর সে সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৭০ জনে।
গবেষণা ও উদ্ভাবনে শিক্ষার্থীরা উৎসাহ পায় এমনভাবে পাঠ্যক্রম সাজানোর কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, কোনো শিক্ষার্থী কোনো সমস্যা সমাধানের আইডিয়া নিয়ে এলে সেটা অনুমোদন বোর্ডে যায়। বোর্ড অনুমোদন দিলে শুরুতেই ওই শিক্ষার্থীকে আইডিয়ার কাজ এগিয়ে নিতে এক লাখ রুপি বৃত্তি দেওয়া হয়। সেই আইডিয়া স্টার্টআপ পর্যায়ে চলে গেলে প্রতিষ্ঠানই তাকে কোম্পানি পর্যায়ে যুক্ত করে দেয়।
মতবিনিময় অনুষ্ঠানে প্রতিষ্ঠানের ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন্সের ডিন প্রফেসর তরুণ কান্তি পান্ডা বলেন, আমরা বাংলাদেশের বেশি বেশি শিক্ষার্থীকে এখানে দেখতে চাই। কিন্তু বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বা ইনস্টিটিউটের সঙ্গে আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক যোগাযোগ নেই। কোনো প্রতিষ্ঠান যোগাযোগ করলে আমরা অবশ্যই সহযোগিতার হাত বাড়াব এবং সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর বিষয়ে চিন্তা করতে পারবো।
কনফারেন্স রুমে বাংলাদেশ সাংবাদিক প্রতিনিধি দলের জন্য চমক হয়ে হাজির ছিলেন দুজন তরুণ। তারা হলেন আবুল হাসনাত ও উৎপল কুমার ঘোষ। আইআইটি হায়দরাবাদে পড়ছেন তারা। এর মধ্যে হাসনাতের বাড়ি চাঁদপুরে আর উৎপলের বাড়ি সাতক্ষীরায়।
স্বদেশি সাংবাদিকদের কাছে পেয়ে তারা উচ্ছ্বসিত হন এবং আইআইটি হায়দরাবাদে পড়ার সুযোগ-সুবিধা তুলে ধরেন।
হাসনাত এখানকার প্রথম বাংলাদেশি শিক্ষার্থী। তিনি ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (ডুয়েট) থেকে বিএসসি সম্পন্ন করে দেশের বাইরে উচ্চশিক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এ সময় আইআইটি হায়দরাবাদের স্কলারশিপের বিজ্ঞপ্তি তার নজরে আসে।
হাসানাত বলছিলেন, ‘আমি সুইজারল্যান্ড ও ভারতে স্কলারশিপের জন্য চেষ্টা করছিলাম। ভারতের দুটো প্রতিষ্ঠানে সুযোগ পাই। আইএলটিএস বা এজাতীয় কিছু ছাড়াই কেবল অনলাইনে সাক্ষাৎকার দিয়ে স্কলারশিপ পেয়ে যাই এখানে। ’
তিনি জানান, পাশের দেশ হওয়ায় এই প্রতিষ্ঠানে তার খাপ খাইয়ে নিতে সুবিধা হয়েছে। এছাড়া এখানকার গবেষণার সুযোগ-সুবিধাও ভালো। এখন সপরিবারে থাকছেন প্রতিষ্ঠানেরই দেওয়া দুই কক্ষের আবাসনে।
যশোরের এম এম কলেজ থেকে অনার্স-মাস্টার্স করা উৎপল কুমারের আইআইটি হায়দরাবাদে আসার গল্পটা আরও চমকপ্রদ। তিনি ভ্রমণ ভিসার জন্য ভারতের ভিসা সেন্টারে গিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। সেখানে স্কলারশিপের বিজ্ঞপ্তি দেখে ওয়েবসাইটে ঘাঁটাঘাঁটি করে আবেদন করে ফেলেন। এরপর অনলাইনে দেন সাক্ষাৎকার। পরবর্তী প্রক্রিয়াগুলো অনুসরণ করে পেয়ে যান ফেলোশিপ।
তিনি জানান, এখানে বিশ্বমানের ল্যাবরেটরিতে গবেষণা করা যায়। আর বাংলাদেশের খুব কাছাকাছি হওয়ায় এখানে যাতায়াতসহ সব রকমের সুবিধা আছে।