ঢাকা ০২:৩০ অপরাহ্ন, বুধবার, ০২ অক্টোবর ২০২৪, ১৭ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বঙ্গোপসাগরের ছোবলে আড়াই শত কোটি টাকার বন

বরগুনাঃ বঙ্গোপসাগরের ছোবলে স্থানীয়ভাবে বনটি ফাতরার বন হিসেবে অধিক পরিচিত। ১৩ তালতলীর টেংরাগিরি বন সাগরে ভেসে যাওয়ার কারণে বনের আকার ছোট হয়ে বঙ্গোপসাগরের উত্তাল ঢেউয়ে উপকূলীয় টেংরাগিরি বন এখন বিলীনের পথে।
ইতোমধ্যে প্রায় ২৫০ কোটি টাকা মূল্যের ২ হাজার একর জমিসহ কয়েক লাখ গাছ সাগর গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। সাগরের ভাঙন রোধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ না নেয়ায় বনটি টিকে থাকবে কিনা সে প্রশ্ন এখন সামনে চলে এসেছে।
পটুয়াখালী বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, পাকিস্তান সরকার ১৯৬০ সালে টেংরাগিরি বনটিকে সংরক্ষিত বন হিসেবে ঘোষণা করে। কাগজে কলমে টেংরাগিরি বন হলেও হাজার ৬শ’ ৪৭ দশমিক ৩ একর আয়তনের বনটির পূর্বদিকে রয়েছে কুয়াকাটা, মহিপুর ও আন্দার মানিক নদী। পশ্চিমে লালদিয়া, কুমির মারা, পায়রা ও বিষখালী নদীর মোহনা। উত্তরে সোনাকাটা, নিশান বাড়িয়া ও সখিনা খাল। দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। বনটির চতুর দিকে সাগর নদী বেষ্টিত পর্যকটদের কাছে এর আকর্ষণ বেশি। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, নির্বিচারে মানুষের গাছ নিধন ও সাগরের ঢেউয়ের ছোবলে বনের বিপর্যয়ের কারণে জৌলুশ হারিয়ে ফেলায় এখন আর আগের মত পর্যটকরা টেংরাগিরি বনে আসে না। ১১ কিলোমিটার প্রস্থ আর ১৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যর বনের পুরোটাই রয়েছে সাগরের তীর ঘেঁষে। ১৯৬০ সালে প্রতিষ্ঠিত বনটি ৬১ বছরের ব্যবধানে বনের আকার কমে গেছে অনেক। ভেসে গেছে কোটি কোটি টাকা মূল্যের বনের গেওয়া, কেওরা ধুন্দল, হেতাল রেস্ট্রিসহ বহু প্রজাতির গাছ। প্রতি বছর বর্ষা মৌসুম আসলে সাগরের হিংস্রতা বেড়ে যায়। এ সময় পাহাড় সমান ঢেউ এসে বনের উপর আছড়ে পড়ে। এভাবে অনবরত ঢেউয়ের ছোবলে ধীরে ধীরে ক্ষয় হয়ে গাছের গোড়ার মাটি সড়ে গাছগুলো মাটিতে পড়ে সাগরে ভেসে যায়। বছরে অন্তত কোটি টাকা মূল্যের গাছ ভেসে যায় সাগরে। অন্যদিকে সাগরের ঢেউয়ে বনের ভিতরে বালু জমে শ্বাস মূল নষ্ট হওয়ায় অনেক গাছ মরে যাচ্ছে।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, সাগরের তীর ঘেঁষে অবস্থিত ১৭ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বনের হাজার হাজার কেওড়া, গেওয়া, করমচা, হেতাল, রেন্ট্রি গাছ সাগরের ঢেউয়ের তোরে উপরে মাটিতে পড়ে আছে। ভাটার সময় গাছ গুলো দেখা গেলেও জোয়ারের পরে এসে দেখা যাবে গাছ গুলো আর নেই সাগরে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। এভাবেই দিনের পর দিন বছরের পর বছর ধরে গাছ যাচ্ছে সাগরের পেটে। সাগরের তীরের বালু পেরিয়ে বনের ভিতরে ঢুকলেই দেখা যাবে ঢেউয়ের তোড়ে বনের ভিতরের প্রায় ৫শ মিটার পর্যন্ত গাছের গোড়ার মাটি সরে গেছে।
ফকির হাটের স্থানীয় বাসিন্দা আবজাল হোসেন বলেন, ঘূর্ণিঝড় বন্যাসহ নানা কারণে বনের কাহিল দশা। প্রতি বছর বর্ষাকালে সাগরের উত্তাল ঢেউয়ের ছোবলে মাটি ক্ষয়ে গাছ উপরে পরে আসছে। এভাবে চলতে থাকলে এক সময় বনটি বিলীন হয়ে যাবে। এছাড়াও রয়েছে বনদস্যুদের ছোবল। রাতে অন্ধকারে একশ্রেণির প্রভাবশালীদের ছত্রছায় বনের গাছ কেটে চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে বনদস্যুরা।
২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বরের সুপার সাইক্লোন সিডরের আঘাতে বনটি প্রায় লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। কয়েক লাখ গাছ দুমড়ে মুচড়ে যায়। এ রেশ কাটতে না কাটাতেই ২০০৯ সালে আবার আঘাত হানে আইলা। এতেও বনের অনেক ক্ষতি হয়। এর পর রয়েছে বনদস্যুদের উৎপাত। স্থানীয় বন কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে একদল বনদস্য দিনে রাতে সমানভাবে বনের গাছ কেটে নদী পথে পাচার করছে উপকূলীয় এলাকার বিভিন্ন ইট ভাটাসহ সমিলে। স্থানীয় একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট এই গাছ চুরির সাথে জড়িত। তারা দীর্ঘদিন ধরে ফাতরা, সুন্দরবন ও নলবুনিয়ার চর থেকে বিভিন্ন সময় গাছ চুরি করে থাকে।
পটুয়াখালী বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. শফিকুর রহমান জানান, সাগরের ভাঙনের হাত থেকে বনকে রক্ষার জন্য নতুন করে গাছ লাগানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে। এছাড়া সাগরের ভাঙনের হাত থেকে বনকে রক্ষার জন্য কি ধরনের পদক্ষেপ নেয়া যায় এ বিষয়ে জুনের প্রথম সপ্তাহে জাইকার ২ সদস্য বিশিষ্ট একটি শক্তিশালী টিম বন্য এলাকা পরিদর্শন করেছে। তাছাড়া এ বছর আমরা ঝাউ এবং অন্যান প্রজাতির গাছ ঘন করে লাগাব। যাতে সাগরের ঢেউ আছরে পরে মাটির ক্ষয় করতে না পারে।
Tag :

আপনার মতামত লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল ও অন্যান্য তথ্য সঞ্চয় করে রাখুন

আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

বঙ্গোপসাগরের ছোবলে আড়াই শত কোটি টাকার বন

আপডেট সময় ১২:৩৬:১০ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৬ জুলাই ২০২৩
বরগুনাঃ বঙ্গোপসাগরের ছোবলে স্থানীয়ভাবে বনটি ফাতরার বন হিসেবে অধিক পরিচিত। ১৩ তালতলীর টেংরাগিরি বন সাগরে ভেসে যাওয়ার কারণে বনের আকার ছোট হয়ে বঙ্গোপসাগরের উত্তাল ঢেউয়ে উপকূলীয় টেংরাগিরি বন এখন বিলীনের পথে।
ইতোমধ্যে প্রায় ২৫০ কোটি টাকা মূল্যের ২ হাজার একর জমিসহ কয়েক লাখ গাছ সাগর গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। সাগরের ভাঙন রোধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ না নেয়ায় বনটি টিকে থাকবে কিনা সে প্রশ্ন এখন সামনে চলে এসেছে।
পটুয়াখালী বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, পাকিস্তান সরকার ১৯৬০ সালে টেংরাগিরি বনটিকে সংরক্ষিত বন হিসেবে ঘোষণা করে। কাগজে কলমে টেংরাগিরি বন হলেও হাজার ৬শ’ ৪৭ দশমিক ৩ একর আয়তনের বনটির পূর্বদিকে রয়েছে কুয়াকাটা, মহিপুর ও আন্দার মানিক নদী। পশ্চিমে লালদিয়া, কুমির মারা, পায়রা ও বিষখালী নদীর মোহনা। উত্তরে সোনাকাটা, নিশান বাড়িয়া ও সখিনা খাল। দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। বনটির চতুর দিকে সাগর নদী বেষ্টিত পর্যকটদের কাছে এর আকর্ষণ বেশি। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, নির্বিচারে মানুষের গাছ নিধন ও সাগরের ঢেউয়ের ছোবলে বনের বিপর্যয়ের কারণে জৌলুশ হারিয়ে ফেলায় এখন আর আগের মত পর্যটকরা টেংরাগিরি বনে আসে না। ১১ কিলোমিটার প্রস্থ আর ১৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যর বনের পুরোটাই রয়েছে সাগরের তীর ঘেঁষে। ১৯৬০ সালে প্রতিষ্ঠিত বনটি ৬১ বছরের ব্যবধানে বনের আকার কমে গেছে অনেক। ভেসে গেছে কোটি কোটি টাকা মূল্যের বনের গেওয়া, কেওরা ধুন্দল, হেতাল রেস্ট্রিসহ বহু প্রজাতির গাছ। প্রতি বছর বর্ষা মৌসুম আসলে সাগরের হিংস্রতা বেড়ে যায়। এ সময় পাহাড় সমান ঢেউ এসে বনের উপর আছড়ে পড়ে। এভাবে অনবরত ঢেউয়ের ছোবলে ধীরে ধীরে ক্ষয় হয়ে গাছের গোড়ার মাটি সড়ে গাছগুলো মাটিতে পড়ে সাগরে ভেসে যায়। বছরে অন্তত কোটি টাকা মূল্যের গাছ ভেসে যায় সাগরে। অন্যদিকে সাগরের ঢেউয়ে বনের ভিতরে বালু জমে শ্বাস মূল নষ্ট হওয়ায় অনেক গাছ মরে যাচ্ছে।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, সাগরের তীর ঘেঁষে অবস্থিত ১৭ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বনের হাজার হাজার কেওড়া, গেওয়া, করমচা, হেতাল, রেন্ট্রি গাছ সাগরের ঢেউয়ের তোরে উপরে মাটিতে পড়ে আছে। ভাটার সময় গাছ গুলো দেখা গেলেও জোয়ারের পরে এসে দেখা যাবে গাছ গুলো আর নেই সাগরে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। এভাবেই দিনের পর দিন বছরের পর বছর ধরে গাছ যাচ্ছে সাগরের পেটে। সাগরের তীরের বালু পেরিয়ে বনের ভিতরে ঢুকলেই দেখা যাবে ঢেউয়ের তোড়ে বনের ভিতরের প্রায় ৫শ মিটার পর্যন্ত গাছের গোড়ার মাটি সরে গেছে।
ফকির হাটের স্থানীয় বাসিন্দা আবজাল হোসেন বলেন, ঘূর্ণিঝড় বন্যাসহ নানা কারণে বনের কাহিল দশা। প্রতি বছর বর্ষাকালে সাগরের উত্তাল ঢেউয়ের ছোবলে মাটি ক্ষয়ে গাছ উপরে পরে আসছে। এভাবে চলতে থাকলে এক সময় বনটি বিলীন হয়ে যাবে। এছাড়াও রয়েছে বনদস্যুদের ছোবল। রাতে অন্ধকারে একশ্রেণির প্রভাবশালীদের ছত্রছায় বনের গাছ কেটে চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে বনদস্যুরা।
২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বরের সুপার সাইক্লোন সিডরের আঘাতে বনটি প্রায় লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। কয়েক লাখ গাছ দুমড়ে মুচড়ে যায়। এ রেশ কাটতে না কাটাতেই ২০০৯ সালে আবার আঘাত হানে আইলা। এতেও বনের অনেক ক্ষতি হয়। এর পর রয়েছে বনদস্যুদের উৎপাত। স্থানীয় বন কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে একদল বনদস্য দিনে রাতে সমানভাবে বনের গাছ কেটে নদী পথে পাচার করছে উপকূলীয় এলাকার বিভিন্ন ইট ভাটাসহ সমিলে। স্থানীয় একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট এই গাছ চুরির সাথে জড়িত। তারা দীর্ঘদিন ধরে ফাতরা, সুন্দরবন ও নলবুনিয়ার চর থেকে বিভিন্ন সময় গাছ চুরি করে থাকে।
পটুয়াখালী বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. শফিকুর রহমান জানান, সাগরের ভাঙনের হাত থেকে বনকে রক্ষার জন্য নতুন করে গাছ লাগানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে। এছাড়া সাগরের ভাঙনের হাত থেকে বনকে রক্ষার জন্য কি ধরনের পদক্ষেপ নেয়া যায় এ বিষয়ে জুনের প্রথম সপ্তাহে জাইকার ২ সদস্য বিশিষ্ট একটি শক্তিশালী টিম বন্য এলাকা পরিদর্শন করেছে। তাছাড়া এ বছর আমরা ঝাউ এবং অন্যান প্রজাতির গাছ ঘন করে লাগাব। যাতে সাগরের ঢেউ আছরে পরে মাটির ক্ষয় করতে না পারে।